leadT1ad

কাবুল বিস্ফোরণ কি ‘পাকিস্তানের বার্তা’

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
আফগান চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স সরদার আহমদ শাকিবের সঙ্গে আলোচনায় পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক এক চরম সংকটময় মুহূর্ত পার করছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের ‘চিরশত্রু’ ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক ক্রমশ উন্নতির দিকে মোড় নিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) ভারত সফরে যান আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। আবার একই দিনে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে কয়েক দফা বিস্ফোরণ ও গুলি বর্ষণের শব্দ শোনা গেছে। অভিযোগ উঠেছে, এ হামলার পেছনে রয়েছে পাকিস্তান।

তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ কাবুলে বিস্ফোরণের কথা স্বীকার করে জানিয়েছেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

কাবুলে বিস্ফোরণের পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, এই হামলার পেছনে সরাসরি পাকিস্তান জড়িত। বিভিন্ন সূত্রের বরাতে দাবি করা হয়, এই হামলার মূল লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানে আশ্রয় নেওয়া তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) প্রধান নূর ওয়ালি মেহসুদসহ সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা।

এদিকে, বৃহস্পতিবার দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতে পৌঁছান। ২০২১ সালে তালেবান দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর দেশটির কোনো শীর্ষ নেতার এটি প্রথম ভারত সফর।

এই সফরকে ভারতের আফগান নীতির এক নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। আজ শুক্রবার (১০ অক্টোবর) আমির খান মুত্তাকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে দেখা করার পর দিল্লি ঘোষণা করেছে, চার বছর আগে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর বন্ধ করে দেওয়া কাবুল দূতাবাস পুনরায় খুলবে ভারত।

অন্যদিকে, তালেবানের প্রথম শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) এবং তাদের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও, এখন সেই সম্পর্ক অনেকটাই খারাপ হয়ে গেছে।

পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে যে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা প্রকাশ্যে আফগানিস্তানকে ‘শত্রু দেশ’ বলে অভিহিত করেছেন। পাকিস্তান অভিযোগ করছে, তালেবান সরকার পাকিস্তানি তালেবানকে (টিটিপি) আফগান মাটি ব্যবহার করে পাকিস্তানে হামলা চালাতে সাহায্য করছে। এমনকি টিটিপির আস্তানা আখ্যা দিয়ে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলাও চালিয়েছে পাকিস্তান। তালেবান বারবার এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, পাকিস্তানের ভেতরের কিছু মহল আফগানিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে চায়।

যদিও তালেবান সরকার বৃহস্পতিবারের কয়েক দফা বিস্ফোরণ বা হামলার জন্য এখনো কাউকে দায়ী করেনি। অনদিকে পাকিস্তান এই হামলার দায় স্বীকার বা অস্বীকার—কোনটিই করেনি। আজ শুক্রবার (১০ অক্টোবর) বিকেলে খাইবার পাখতুনখোয়ার পেশোয়ারে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটির আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক (ডিজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী বলেছেন, জনগণকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।

আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আশ্রয়ের অভিযোগ করছে পাকিস্তান। ছবি: সংগৃহীত
আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আশ্রয়ের অভিযোগ করছে পাকিস্তান। ছবি: সংগৃহীত

টিটিপি নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদকে লক্ষ্য করে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালিয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী বলেন, আমি আপনাকে স্পষ্ট করে দিয়েছি যে আফগানিস্তানের নিরাপদ আশ্রয়স্থলগুলি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এর প্রমাণ রয়েছে। পাকিস্তানের জনগণের জানমালের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

তালেবান বা টিটিপি—কোনো পক্ষই মেহসুদের নিরাপত্তা বা অবস্থান নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে জাবিহুল্লাহ মুজাহিদের বক্তব্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এই বিস্ফোরণে কেউ নিহত হয়নি।

একসময় মনে করা হতো যে আফগান তালেবান সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানের মদদপুষ্ট একটি শক্তি। কিন্তু বর্তমানে তারা তাদের বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে এবং ভারতের মতো প্রাক্তন প্রতিপক্ষের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপন করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের পথে হাঁটছে।

ভেঙে পড়া আস্থা, জোড়াতালির ভঙ্গুর চেষ্টা

২০২৪ সাল ছিল পাকিস্তানের জন্য গত এক দশকের মধ্যে অন্যতম রক্তক্ষয়ী বছর। ২০২৪ সালে পাকিস্তান জুড়ে বিভিন্ন সহিংসতায় আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। পাকিস্তান বারবার দাবি করেছে, তাদের দেশে এসব সহিংসতার জন্য প্রধানত দায়ী টিটিপি, যারা আফগানিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এই রক্তাক্ত অধ্যায়ের পর দুই দেশ তাদের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের একটি ভঙ্গুর প্রচেষ্টা শুরু করেছিল।

পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার চলতি বছরের এপ্রিলে কাবুল সফর করেন। এছাড়াও চীনের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রক্রিয়ার ফলে কূটনৈতিক সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি ঘটে এবং গ্রীষ্মকালে সাময়িকভাবে সহিংসতাও কমে আসে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা যে ফলপ্রসূ হয়নি, তার প্রমাণ মেলে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে।

ইসলামাবাদ-ভিত্তিক থিংক ট্যাংক পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (পিআইসিএসএস) তথ্যমতে, ২০২৫ প্রথম চার মাসে সহিংসতার মাত্রা প্রায় পুরো ২০২৪ সালের মোট সহিংসতার সমান।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটার (এসিএলইডি) মতে, ২০২১ সাল থেকে পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান হামলার পেছনে টিটিপিই একমাত্র এবং প্রধান কারণ।

এসিএলইডি-র সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আমাদের তথ্য অনুযায়ী, টিটিপি শুধু গত এক বছরেই পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর অন্তত ৬০০ হামলা করেছে। ২০২৫ সালে তাদের কার্যকলাপের মাত্রা ইতিমধ্যেই পুরো ২০২৪ সালকে ছাড়িয়ে গেছে।’

সাম্প্রতিক দিনগুলোতে পাকিস্তানে সহিংসতার মাত্রা আরও বেড়েছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ ও অচিহ্নিত সীমান্ত থাকা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে ধারাবাহিক হামলায় কয়েক ডজন সৈন্য নিহত হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরেই কমপক্ষে ১৩৫ জন নিহত এবং ১৭৩ জন আহত হয়েছে।

গত সেপ্টেম্বরেই এক হামলায় ১৯ জন সেনাসদস্য নিহত হওয়ার পর আহতদের দেখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ আফগানিস্তানকে কঠোর সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, ‘তাদের দুটি পথের একটি বেছে নিতে হবে। যদি তারা প্রকৃত সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়, আমরা তার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু যদি তারা সন্ত্রাসীদের পক্ষ নেয় এবং তাদের সমর্থন করে, তাহলে আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’

গভীর হচ্ছে অবিশ্বাস, বাড়ছে সংঘাতের ঝুঁকি

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান ও তালেবানের মধ্যে উত্তেজনা কেবল কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, রূপ নিয়েছে সরাসরি সামরিক সংঘাতেও। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের হামলাসহ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এর আগে একাধিকবার আফগান ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালিয়েছে।

দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে ভারত সফরে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। ছবি: সংগৃহীত
দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে ভারত সফরে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্লেষকরা বলছেন, কাবুলের সাম্প্রতিক বিস্ফোরণের পেছনে যদি সত্যিই পাকিস্তান জড়িত থাকে, তবে এর পরিণতি অত্যন্ত গুরুতর হতে পারে। কাবুল-ভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক তামিম বাহিস বলেন, তালেবান বরাবরই তাদের মাটিতে টিটিপি যোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার কথা অস্বীকার করে আসছে। রাজধানীর অভ্যন্তরে এ ধরনের হামলার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

তামিম বাহিস আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা অতীতে দেখেছি যে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের বিমান হামলা কোনো সুনির্দিষ্ট ফল আনতে পারেনি। বরং কেবল অবিশ্বাসকে গভীর করেছে এবং টিটিপি-কে মোকাবিলায় সহযোগিতার পথকে আরও কঠিন করে তুলেছে। এই সর্বশেষ ঘটনাটি সম্ভবত উভয় পক্ষের অবস্থানকে আরও কঠোর করবে এবং সংলাপ ও সমন্বয়কে আরও জটিল করে তুলবে।’

ইসলামাবাদ-ভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইহসানুল্লাহ টিপু মেহসুদ বলেন, যদি এই হামলায় পাকিস্তান জড়িত থাকে, তবে এটি তাদের মাটিতে সাম্প্রতিক ভয়াবহ হামলার প্রতিক্রিয়ায় একটি জোরালো সতর্কবার্তা হতে পারে।

টিপু মেহসুদ সতর্ক করে বলেন, ‘পাকিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি যদি গুরুতর থাকে এবং আফগান তালেবান যদি টিটিপিকে নিয়ন্ত্রণ না করে, তবে পাকিস্তান কাবুলের মতো রাজনৈতিক রাজধানী এবং কান্দাহারের মতো তালেবানের আধ্যাত্মিক রাজধানীতে থাকা শীর্ষ লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করতে পারে।’

তবে বাহিস পাল্টা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, যেকোনো ধরনের আন্তঃসীমান্ত হামলা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের জন্যই উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। তার মতে, ‘পাকিস্তান যদি আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে তাদের হামলা অব্যাহত রাখে, তবে আরও বেশি সংখ্যক আফগান টিটিপির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে পারে। এই সহানুভূতি সংগঠনটির জন্য নতুন সদস্য বৃদ্ধি, তহবিল সংগ্রহ এবং এমনকি আফগান তালেবানের কিছু অংশের নীরব সমর্থনে রূপান্তরিত হতে পারে।’

বাহিস আরও বলেন, যদি সত্যিই কাবুলে টিটিপির নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়, তবে টিটিপি পাকিস্তানে আরও ভয়াবহ ও আগ্রাসী হামলার মাধ্যমে এর প্রতিশোধ নিতে পারে।

পাকিস্তানের নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং তালেবানের সার্বভৌমত্বের সংঘাত এই অঞ্চলকে কোন দিকে ঠেলে দেবে? ইসলামাবাদ কি সত্যিই কাবুলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থ আদায় করতে পারবে, নাকি এই ধরনের পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত উভয় দেশের জন্য আরও বড় এবং দীর্ঘস্থায়ী সংকট ডেকে আনবে? এই জটিল প্রশ্নগুলো এখন দক্ষিণ এশিয়ার উত্তপ্ত ভূ-রাজনৈতিক মঞ্চে ঘুরপাক খাচ্ছে।

আল-জাজিরার প্রতিবেদন। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত