২৭তম সাংবিধানিক সংশোধনীতে স্বাক্ষর করেছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি। এর মাধ্যমে সংশোধনীটি আইনে পরিণত হয়েছে। এর আগে বুধবার পাকিস্তানের পার্লামেন্ট সংশোধনীটি পাস করে। দেশটির জাতীয় পরিষদে ২৩৪-৪ ভোটে সংশোধনীটি পাস হয়। এই সংশোধনীতে সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল সৈয়দ আসিম মুনিরকে নতুন পদ—চিফ অফ ডিফেন্স ফোর্সেস (সিডিএফ) দেওয়া হয়। এর ফলে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর ওপর তার একক সাংবিধানিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
সংশোধনীতে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য আজীবন আইনি দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, সাংবিধানিক বিষয়ে বিচার করার জন্য নতুন ফেডারেল কনস্টিটিউশনাল কোর্ট (এফসিসি) গঠিত হবে। এতে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা কমে যাবে।
সরকারি জোট—পিএমএল-এন, পিপিপি এবং মিত্র দলগুলো—এ সংশোধনীকে ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু বিরোধী দল পিটিআই একে ‘সাংবিধানিক অভ্যুত্থান’ এবং ‘গণতন্ত্রের মৃত্যু’ বলে নিন্দা করেছে। বিক্ষোভ ও বয়কটের মধ্যেই বিলটি পাস হয়। এখন এটি সিনেটে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়।
সমালোচকেরা বলছেন, এই সংশোধনী পাকিস্তানে সামরিক প্রভাবকে চূড়ান্তভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে এবং বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নষ্ট করবে। এতে ২০২৪-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে। ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত বিলটি প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরের অপেক্ষায় আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিবাদ চলছে।
পাকিস্তানে সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই প্রভাবশালী। দেশটিতে তিনবার সরাসরি সামরিক শাসন হয়েছে—১৯৫৮, ১৯৭৭ ও ১৯৯৯ সালে। প্রায়শই সংবিধান সংশোধন ব্যবহার করা হয়েছে সামরিক প্রভাব টিকিয়ে রাখতে। ২০১০ সালের ১৮তম সংশোধনী প্রাদেশিক ক্ষমতা বাড়ালেও সেনাবাহিনীর নির্বাহী স্বাধীনতা বজায় ছিল।
২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন, পিটিআই নেতা ইমরান খানের কারাবরণ, এবং ২৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির সংকট—এসবের প্রেক্ষাপটে এই সংশোধনী আসে। সেনাপ্রধান আসিম মুনির ২০২২ সালে নিয়োগের পর রাজনৈতিক দমন এবং মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেন। সমালোচকেরা সংশোধনীটিকে ‘বাকু সংশোধনী’ বলছেন—শরীফের আজারবাইজান সফরের পেছনের গোপন সমঝোতার ইঙ্গিত হিসেবে।
বিরোধীরা হয় কারাবন্দি, নয় নির্বাসিত। ফলে পিএমএল-এন ও পিপিপির দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংশোধনী পাসকে সহজ করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এ ঘটনাকে গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরন হিসেবে দেখছে।
৩২৮ পাতার এই বিল সংবিধানের বেশ কয়েকটি ধারা পরিবর্তন করে।
সামরিক পরিবর্তন:
সিডিএফকে তিন বাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার করা হয়েছে। বর্তমান সেনাপ্রধানই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ পদে বসবেন। সামরিক প্রধানদের আজীবন সম্মানসূচক পাঁচ-তারকা পদমর্যাদা দেওয়া হবে। প্রতিরক্ষা খাতকে সাংবিধানিক সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ২৪৩ অনুচ্ছেদ শক্তিশালী করা হয়েছে।
বিচার বিভাগের পুনর্গঠন:
এফসিসি সাংবিধানিক ও ফেডারেল বিরোধ নিষ্পত্তির একমাত্র আদালত হবে। বিচারকরা রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নিযুক্ত হবেন, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে। সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা কমে শুধু দেওয়ানি ও ফৌজদারি আপিল সীমিত থাকবে। বিচারকদের জন্য ৬৫ বছর বয়সসীমা ও বাধ্যতামূলক বদলি/পদত্যাগের বিধান যোগ হয়েছে।
দায়মুক্তি:
সিডিএফ ও রাষ্ট্রপতিকে আজীবন আইনি দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে শীর্ষ সামরিক নেতৃত্ব ভবিষ্যতেও আইনি জবাবদিহি থেকে মুক্ত থাকতে পারে। আইনমন্ত্রী আজম নাজির তারার সংশোধনীকে ‘সামরিক ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে সাংবিধানিক তদারকি নিশ্চিত করা’বলে উল্লেখ করেছেন।
সংশোধনীটি পাকিস্তানে তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় আনা হয়েছে। ক্ষমতাসীন জোট প্রতিরক্ষা ও বিচারব্যবস্থার মূল প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করতে চাইছে। এর আগে সিনেট বিলটি অনুমোদন করে। সেখানে ৬৪ জন সমর্থন দেন। বিরোধীরা বয়কট করায় কোনো বিরোধিতা ওঠেনি।
প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ সংশোধনীর পাস হওয়াকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সংসদ সংহতি প্রদর্শন করেছে। ওয়ানার সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলাকে তিনি এপিএস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করেন এবং শিক্ষার্থী ও ক্যাডেটদের নিরাপদ রাখার জন্য আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশংসা করেন।
পিএমএল-এন, পিপিপি, এমকিউএম-পি এবং অন্যান্য মিত্র দল সংশোধনীকে সমর্থন করে। বিরোধীরা একে অসাংবিধানিক বলে নিন্দা জানায়। পিটিআই চেয়ারম্যান গৌর আলী খান একে ‘বাকু সংশোধনী’ বলে অভিহিত করেন এবং সরকারের ওপর গণতন্ত্র দুর্বল করার অভিযোগ তোলেন। পিকেএমএপি নেতা মাহমুদ খান আছকজাই সংসদে বিলের কপি ছিঁড়ে প্রতিবাদ জানান।
বিশ্লেষকদের মতে, ২৭তম সংশোধনী আসিম মুনিরের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে এবং বিচারিক তদারকির কাঠামো বদলে দেবে। এতে পাকিস্তানের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে।