leadT1ad

মামদানির বিজয়ে উচ্ছ্বসিত নিউইয়র্কের মুসলিমরা: ‘এবার আমাদের সময়’

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

কুইন্সের অ্যাস্টোরিয়ায় মুসলিম-কেন্দ্রিক একটি ওয়াচ পার্টিতে মঙ্গলবারের নির্বাচনের ফলাফলে ভোটারদের আনন্দ। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস।

মঙ্গলবার রাতে কুইন্সের অ্যাস্টোরিয়ার ‘মোকা অ্যান্ড কো’ নামের এক ক্যাফেতে বসার জায়গা ছিল না। হালাল রেস্টুরেন্ট ও ইয়েমেনি ক্যাফেতে ঘেরা ওই এলাকায় শত শত মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। মুসলিম ডেমোক্র্যাটিক ক্লাব অব নিউইয়র্ক ও আরও কয়েকটি মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় সংগঠন সেখানে নির্বাচনী ফলাফল দেখার আয়োজন করেছিল।

ভোটগণনা শুরু হতেই উপস্থিত জনতা ইংরেজি, বাংলা ও আরবি ভাষায় উত্তেজিতভাবে আলাপ করছিল। কিছুক্ষণ পর প্রায় নিশ্চিত হয়ে ওঠে যে, নিউইয়র্কের লাখো মুসলিম এবার তাদের প্রথম মুসলিম মেয়রকে দেখতে যাচ্ছে।

রাত ৯টা ৩০ মিনিটের কিছু পর যখন আনুষ্ঠানিকভাবে জোহরান মামদানিকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়, তখন ক্যাফেতে ‘মামদানি! মামদানি!’ ধ্বনি ওঠে। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটে আলোকিত হয়ে ওঠে গোটা পরিবেশ। মুহূর্তটি ছিল ঐতিহাসিক ও উচ্ছ্বাসে ভরা।

এক তরুণ বন্ধুকে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’

৩২ বছর বয়সী ফাতিমা খান বললেন, ‘এটা অবিশ্বাস্য লাগছে। একই স্থানে এত মুসলিম নেতাকে দেখা সত্যিই অনন্য অভিজ্ঞতা।’ তিনি আনন্দে চিৎকার করে বললেন, ‘তিনি জিতেছেন!’

আগামী ১ জানুয়ারি মেয়র হিসেবে শপথ নিলে মামদানি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম নির্বাচিত প্রতিনিধি হবেন। তাঁর এই জয় নিউইয়র্কের মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এতদিন তারা শহরের জনজীবনের অনেক অংশ থেকেই নিজেদের বঞ্চিত মনে করতেন।

মামদানির নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিমরা শুধু রাজনৈতিকভাবে দৃশ্যমানই হয়নি, বরং তারা এখন নেতৃত্বের শীর্ষে নিজেদের একজনকে দেখতে পাচ্ছেন।

৪১ বছর বয়সী ফার্মাসিস্ট সুমাইয়া চৌধুরী বলেন, ‘আমি আগেভাগে ভোট দিয়েছিলাম, আর কেঁদে ফেলেছিলাম। আগে ভাবতেই পারিনি, নিউইয়র্কে কোনো মুসলিম মেয়র হতে পারেন।’

প্রায় ২০ লাখ ভোটের মধ্যে মামদানি পেয়েছেন প্রায় ১০ লাখ ভোট— যা গত পঞ্চাশ বছরে কোনো নিউইয়র্ক মেয়র প্রার্থীর পাওয়া সর্বোচ্চ ভোট।

তাঁর প্রচারণার মূল বিষয় ছিল জীবনযাত্রার ব্যয় কমানো—এক কথায় ‘সস্তায় জীবন-যাপন’। এই বার্তা ছুঁয়ে যায় বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী ভোটারকে, যাদের অনেকেই প্রথমবার ভোট দেন। মুসলিম শ্রমজীবীরাও এতে অনুপ্রাণিত হন।

প্রচারণার শুরু থেকেই মামদানি মুসলিমদের কাছে পৌঁছান। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস।
প্রচারণার শুরু থেকেই মামদানি মুসলিমদের কাছে পৌঁছান। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস।

ব্রঙ্কসের ভোটার তারেক মোনাওয়ার বলেন, ‘ভালো লাগছে যে তিনি মুসলিম, কিন্তু আসল বিষয় হলো তিনি সমাজের জন্য কী করবেন। নিউইয়র্ক ব্যয়বহুল শহর, কিন্তু যদি তা সাশ্রয়ী করা যায়, সেটা সবার জন্য ভালো।’

সামাজিক মাধ্যমে দক্ষ প্রচারণার পাশাপাশি মামদানি মাঠের প্রচারেও বাজিমাত করেন। হাজারো স্বেচ্ছাসেবক মুসলিম অধ্যুষিত কুইন্স, ব্রুকলিন ও ব্রঙ্কস এলাকায় দরজায় দরজায় গিয়ে প্রচারণা চালান। ভোটারদের কাছে পৌঁছানো হয় আরবি, বাংলা ও উর্দু ভাষায়। মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় ভোটাররাই প্রথম থেকে তাঁর সবচেয়ে দৃঢ় সমর্থক ছিলেন।

ধর্মীয় পরিচয়কে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে মামদানি ৫০টিরও বেশি মসজিদে গিয়ে মুসল্লিদের সঙ্গে নামাজ পড়েন। রমজানে কিউ ট্রেনে বসে ইফতার করার একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যা কিছু বিতর্কও সৃষ্টি করে। তবে তিনি দক্ষতার সঙ্গে বিষয়টি সামাল দেন। মুসলিমরা এতে দেখেছেন এমন এক প্রার্থী, যিনি তাঁদের ধর্মীয় সংস্কৃতি নিয়ে স্বচ্ছন্দে কথা বলেন।

কুইন্সের সংগঠন ‘ড্রিম এমপাওয়ারমেন্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা রানা আবদেলহামিদ বলেন, ‘মুসলিমরা এই শহরের সর্বত্র রয়েছেন—শিক্ষক, ব্যবসায়ী, দোকানদার। হালাল খাবার পাওয়া যায় প্রতিটি মোড়ে। এতদিন আমরা শহরের মূল চালিকাশক্তি হয়েও প্রান্তে ছিলাম। এখন সময় আমাদের।’

৯/১১ হামলার পর থেকে মুসলিমরা নিউইয়র্কে বারবার ইসলামবিদ্বেষের মুখে পড়েছেন। মামদানির উত্থান সেই মনোভাবকে আবারও আলোচনায় আনে। শেষ সপ্তাহগুলোতে ধর্ম নিয়ে আক্রমণের মুখে তিনি নিজ বিশ্বাস ও পরিচয় নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেন।

অক্টোবরের শেষ দিকে ব্রঙ্কসের ইসলামিক কালচারাল সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, মুসলিমরা অনেক সময় শহরের ‘ছায়ায়’ বসবাস করেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, আর লুকিয়ে থাকবেন না।

ইতিহাসবিদ আসাদ দানদিয়া বলেন, ‘নিউইয়র্ককে আমরা বলি সব সংস্কৃতির মিলনস্থল, কিন্তু মুসলিমদের ক্ষেত্রে তা দীর্ঘদিন ছিল কেবল কথার কথা। আমি ভাবিনি, শহরটি একজন মুসলিম মেয়রের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু এখন আমাদের একজন আছে।’

মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতারা মনে করছেন, মামদানির এই সাফল্য শহরজুড়ে মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয়দের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ আরও বাড়াবে। ইতিমধ্যে কুইন্সের দুজন বাংলাদেশি প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছেন, তাদের একজন মেরি জোবাইদা মামদানির পুরোনো রাজ্য অ্যাসেম্বলির আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান।

মালি থেকে ব্রঙ্কসে আসা ২৮ বছর বয়সী ছাত্রী আমিনাতা দিয়ালো বলেন, ‘মামদানির গল্প আমাদেরই গল্প। তিনি দেখাচ্ছেন আমরা এই শহরের প্রতিটি জায়গায় থাকার যোগ্য—আমাদের কণ্ঠ ও মূল্যবোধ শহরের ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ।’

সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস

Ad 300x250

সম্পর্কিত