প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদকালে যুক্তরাষ্ট্রের অনুষ্ঠিত প্রথম বড় তিনটি নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা বিশাল জয় পেয়েছেন। জানুয়ারি মাসে ট্রাম্পের অভিষেকের পর এই প্রথম বড় আকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব উপকূল ও ক্যালিফোর্নিয়ায় অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে জয় পায়।
নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জোহরান মামদানি। সিএনএনের আভাস অনুযায়ী, ডেমোক্র্যাটরা ভার্জিনিয়ার গভর্নর নির্বাচন, নিউ জার্সির গভর্নর পদ এবং ক্যালিফোর্নিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ গণভোটেও বিজয়ী হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা এই ফলাফলকে ডেমোক্র্যাটদের জন্য ‘আত্মবিশ্বাসের বার্তা’ হিসেবে দেখছেন। এটি রিপাবলিকানদের দুর্বলতার ইঙ্গিত দিচ্ছে এবং অভিবাসন, অর্থনীতি ও সামাজিক নীতিতে ট্রাম্পের নীতির প্রতি ভোটারদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছে।
এই নির্বাচনে নগর ও শহরতলির এলাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। এই ধরনের নির্বাচন প্রায়ই জাতীয় মনোভাবের সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়। বেশ কিছু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্র্যাটরা তাদের অবস্থান শক্ত করেছে।
সিএনএন এই বিজয়কে ডেমোক্র্যাটদের ‘প্রভাবশালী আধিপত্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। এতে দলটি আগামী মধ্যবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসে রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অবস্থান অর্জন করেছে।
জোহরান মামদানি। ছবি: সংগৃহীত।
নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচন: জোহরান মামদানির ঐতিহাসিক উত্থান
দেশের বৃহত্তম শহর ও বৈশ্বিক অর্থনীতির কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত নিউইয়র্কে ৩৪ বছর বয়সী ডেমোক্র্যাটিক সমাজতন্ত্রী জোহরান মামদানি এক ঐতিহাসিক জয় পেয়েছেন। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো এবং রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াকে পরাজিত করেন। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের আইনপ্রণেতা এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ারের পুত্র মামদানি শহরের প্রথম মুসলিম ও প্রথম দক্ষিণ এশীয় মেয়র হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, প্রগতিশীল ভোটার, তরুণ প্রজন্ম এবং অশেতাঙ্গদের ব্যাপক সমর্থনে মামদানি এগিয়ে ছিলেন। নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেল লেটিশিয়া জেমস বলেন, মামদানি ‘রেকর্ড পরিমাণ ভোটার উপস্থিতি’ নিশ্চিত করেছেন। তিনি মন্তব্য করেন, ‘নিউইয়র্ক সিটি আবার জেগে উঠেছে।’ কুইন্সের এক দক্ষিণ এশীয় ভোটার সামেহা জামাল বলেন, ‘মামদানি আমাকে মনে করিয়ে দেন, নিউইয়র্ক আসলে কী নিয়ে গঠিত।’
ব্রুকলিনে বিজয়োৎসবে মামদানি এক জোরালো বক্তৃতা দেন। তিনি ট্রাম্পকে সরাসরি সমালোচনা করে বলেন, ‘আমরা পরিবর্তনের এক নতুন যুগ শুরু করতে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন,
‘আশা এখনো জীবিত। নিউইয়র্ক আজ স্পষ্টভাবে বলেছে—আশা জয়ী হয়েছে অত্যাচারের ওপর, টাকার রাজনীতির ওপর, হতাশার ওপর।’
তিনি এই বিজয় উৎসর্গ করেন সাধারণ নিউইয়র্কবাসীর প্রতি—ট্যাক্সিচালক, রাঁধুনি, দোকানমালিক ও নার্সদের। তিনি নিজের বক্তব্যে এক ট্যাক্সিচালক রিচার্ডের সঙ্গে ১৫ দিনের অনশন কর্মসূচির অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেন। সিনেটের সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমার, যিনি প্রাথমিক নির্বাচনে মামদানিকে সমর্থন দেননি, পরে এই জয়কে ‘যোগ্য ও ঐতিহাসিক’ বলে অভিনন্দন জানান।
অন্যদিকে, কুওমো পরাজয় মেনে নেন এবং বলেন, তার প্রচারণা ছিল ‘প্রচলিত দলীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে সঠিক লড়াই।’ তিনি উল্লেখ করেন, পরাজয়ের পরও ৪০ শতাংশ ভোট তিনি পেয়েছেন।
মেয়র হিসেবে মামদানির সামনে রয়েছে একটি বিশাল দায়িত্ব। শহরের ১১০ বিলিয়ন ডলারের বাজেট আবাসন সংকট ও গণপরিবহন সমস্যায় চাপে রয়েছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—সাশ্রয়ী আবাসন, জননিরাপত্তা ও জলবায়ু সহনশীলতা নিয়ে তিনি সাহসী পদক্ষেপ নেবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেও শহরের স্বার্থ রক্ষা করবেন।
অ্যাবিগেইল স্প্যানবার্গার। ছবি: সংগৃহীত।
ভার্জিনিয়ায় ঐতিহাসিক জয়: প্রথম নারী গভর্নর অ্যাবিগেইল স্প্যানবার্গার
দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ভার্জিনিয়ায় ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি অ্যাবিগেইল স্প্যানবার্গার গভর্নর পদে জয়ী হয়ে ইতিহাস গড়েছেন। তিনি রিপাবলিকান লেফটেন্যান্ট গভর্নর উইনসাম আর্ল-সিয়ার্সকে পরাজিত করে গভর্নরশিপ আবার ডেমোক্র্যাটদের হাতে ফিরিয়ে আনেন। সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা ও ফেডারেল প্রসিকিউটর স্প্যানবার্গার রাজ্যের প্রথম নারী গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। তিনি রিপাবলিকান গভর্নর গ্লেন ইয়াংকিনের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন, যিনি এক মেয়াদ শেষে অবসর নিচ্ছেন।
ভোট গণনা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সিএনএন তার বিজয় ঘোষণা করে। বিশ্লেষকেরা বলেন, এই জয় শহরতলির ভোটারদের অগ্রাধিকারের প্রতিফলন—বিশেষ করে গর্ভপাতের অধিকার, শিক্ষা ও অবকাঠামো ইস্যুতে। এসব ইস্যুতে ডেমোক্র্যাটরা স্পষ্টভাবে রিপাবলিকানদের থেকে এগিয়ে ছিল।
সিএনএনের বিশ্লেষক জেফ জেলেনি এই জয়কে ডেমোক্র্যাটদের জন্য ‘আত্মবিশ্বাসের নতুন ঢেউ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ফোনে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, এই ফল জাতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এর মাধ্যমে ভার্জিনিয়ার নির্বাহী শাখা ২০২১ সালের পর প্রথমবারের মতো ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণে আসে, যা ফেডারেল নীতির প্রতিক্রিয়ায় রাজ্যের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।
নিউ জার্সিতে মিকি শেরিলের জয়: ডেমোক্র্যাটদের শক্ত ঘাঁটি অটুট
ডেমোক্র্যাট অধ্যুষিত নিউ জার্সিতে প্রতিনিধি মিকি শেরিল গভর্নর পদে বিজয়ী হয়েছেন। তিনি ট্রাম্প-সমর্থিত প্রার্থী জ্যাক সিয়াটারেলিকে পরাজিত করে ডেমোক্র্যাটিক শাসনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। সাবেক নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার পাইলট ও ফেডারেল প্রসিকিউটর শেরিল রাজ্যের প্রথম নারী ডেমোক্র্যাট গভর্নর হচ্ছেন। তার রানিং মেট ছিলেন রাজ্য সিনেটর ডেল ক্যাল্ডওয়েল।
বিজয়ের পর তার সমর্থন সমাবেশে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন আবারও ফোনে অভিনন্দন জানান এবং এই ফলকে ট্রাম্পবিরোধী জনমতের প্রতিফলন হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনবার গভর্নর পদে প্রার্থী হওয়া সিয়াটারেলি পরাজয় মেনে নেন, তবে কোনও মন্তব্য করেননি। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং প্রজনন অধিকারের পক্ষে শেরিলের অবস্থান ভোটারদের সমর্থন পেয়েছে। ফলে নিউ জার্সি আবারও ডেমোক্র্যাটদের দৃঢ় দুর্গ হিসেবে প্রমাণিত হলো।
মিকি শেরিল। ছবি: সংগৃহীত।
ক্যালিফোর্নিয়ায় গণভোটে প্রস্তাব ৫০ গৃহীত: ডেমোক্র্যাটদের সুবিধা
পশ্চিম উপকূলে ভোটাররা প্রস্তাব ৫০-এর পক্ষে ভোট দিয়ে ডেমোক্র্যাটদের বিজয়ধারা সম্পূর্ণ করেন। গভর্নর গ্যাভিন নিউজমের উদ্যোগে আনা এই প্রস্তাবে কংগ্রেসীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হবে, যা ভবিষ্যতে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে পাঁচটি পর্যন্ত আসন বাড়াতে পারে। রাত ৮টায় ভোট শেষ হলেও অরেঞ্জ কাউন্টিতে দীর্ঘ সারি ছিল। কর্মকর্তারা আশ্বাস দেন, সময়মতো লাইনে থাকা সব ভোটই গণনা করা হবে।
ট্রাম্প ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ প্রস্তাবটিকে ‘কারচুপি’ ও ‘অসংবিধানিক’বলে অভিযোগ করেন, তবে সিএনএন সেই দাবি খণ্ডন করে জানায়—ক্যালিফোর্নিয়ায় ভোট জালিয়াতির হার অত্যন্ত কম। গভর্নর নিউজমের জন্য এই সাফল্য তার জাতীয় রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে এবং ২০২৮ সালের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে তার পরিচিতি বাড়িয়েছে।
এ ছাড়া ডেমোক্র্যাট গজালা হাশমি রাজ্য সিনেটে জয়ী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে কোনো রাজ্যব্যাপী পদে নির্বাচিত হয়েছেন। এতে ক্যালিফোর্নিয়ার নেতৃত্ব আরও বৈচিত্র্যময় হয়েছে।
মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে রিপাবলিকানদের জন্য সতর্কবার্তা
এই ধারাবাহিক জয় ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ডেমোক্র্যাটদের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ বড় সাফল্য। এই জয় রিপাবলিকান শিবিরে মনোবলহীনতার ইঙ্গিত। ট্রাম্প সমর্থিত প্রার্থীরা একের পর এক পরাজিত হওয়ায় তিনি এর দায় সরকারি অচলাবস্থা ও নিজের অনুপস্থিতির ওপর চাপিয়েছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়ার পুনঃনির্ধারণ প্রক্রিয়া ভবিষ্যতে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের আসন বিন্যাসকে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ঝুঁকিয়ে দিতে পারে।
সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া চললেও ডেমোক্র্যাটরা এখন ২০২৬ সালের নির্বাচনের দিকে আশাবাদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ট্রাম্পের দল পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে, কিন্তু আপাতত স্পষ্ট বার্তা একটাই—ট্রাম্পের আমেরিকায়ও নীল দুর্গগুলো টিকে আছে দৃঢ়ভাবে।
সূত্র: সিএনএন