শিমা আক্তার (২৪) ফুটবল অনুশীলনের মাঝেই খবরটি পান। তার এক সহপাঠী অনুশীলন থামিয়ে জানায়—বাংলাদেশের পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসির রায় হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর কাছে এটি যেন এক ধরনের প্রতিশোধের মুহূর্ত মনে হয়।
শিমা আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী হাসিনা ভেবেছিলেন তাকে হারানো যাবে না, তিনি চিরদিন ক্ষমতায় থাকবেন। তার ফাঁসির রায় আমাদের শহীদদের প্রতি ন্যায়ের পথে একটি পদক্ষেপ।’
তবে তিনি এটিও যোগ করেন যে রায় যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই তাকে ঢাকাতেই ফাঁসি দেওয়া হোক!’
কিন্তু তা সহজে সম্ভব নয়। কারণ হাসিনা এখনো ভারতে। বাংলাদেশের বারবার প্রত্যর্পণ অনুরোধ সত্ত্বেও ভারত তাকে ফেরত দেয়নি। হাসিনার ভারতে অবস্থান গত ১৫ মাস ধরে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বড় বিরোধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন মানবতাবিরোধী অপরাধে আনুষ্ঠানিকভাবে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পর উত্তেজনা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অবশ্য ভারত পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী। তবু বহু ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন—নয়াদিল্লি কখনোই হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশে ফেরত দেবে না।
ঢাকায় দায়িত্ব পালন করা ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘নয়াদিল্লি তাকে কীভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে?’
‘অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ পদক্ষেপ’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হাসিনাকে ফেরত দিতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তারা ভারত–বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির উল্লেখ করে জানায় যে হাসিনাকে ফেরত পাঠানো ভারতের ‘অবশ্য কর্তব্য’। মন্ত্রণালয় আরও জানায়, ভারতের তাকে ফের না পাঠানো হবে ‘অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ পদক্ষে ‘, যা ন্যায়বিচারের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করবে।
অন্যদিকে ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করিয়ে দেন যে প্রত্যর্পণ চুক্তিতে ‘রাজনৈতিক চরিত্রের’ অপরাধের জন্য বিশেষ ব্যতিক্রম রাখা আছে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলেন, ভারত এই মামলাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবেই দেখছে। তার মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে এমন শক্তি ক্ষমতায় আছে যারা ভারত-বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। ইউনুসও নিয়মিতভাবে ভারতকে সমালোচনা করছেন। এছাড়া হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের একাধিক নেতা ভারতের অতীত সমর্থনকে দায়ী করেছেন।
এই পরিস্থিতিতে হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো মানে ভারতের বিরোধীদের অবস্থানকে বৈধতা দেওয়া—এমন মন্তব্যও করেন ভরদ্বাজ।
‘ভারতের সমীকরণে পরিবর্তন প্রয়োজন’
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায় যে তারা হাসিনার বিরুদ্ধে ঘোষিত রায় ‘নজরে নিয়েছে’ এবং নয়াদিল্লি ‘সকল অংশীজনের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করবে’। ভারত আরও জানায়, তারা বাংলাদেশের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ—বিশেষ করে শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে।
তবুও বর্তমানে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক শীতল ও অনিশ্চিত। হাসিনার সময় যে অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সহযোগিতা দৃঢ়ভাবে গড়ে উঠেছিল, তা এখন অবিশ্বাস ও সন্দেহে ভরা সম্পর্ক হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, এই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন তিনি আশা করছেন না। তার মতে, বাংলাদেশে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলে সম্পর্ক টানাপোড়েনের মধ্যেই থাকবে। কারণ তারা বারবার বলবে যে ভারত হাসিনাকে ফেরত দিচ্ছে না।
তবে তিনি মনে করেন, আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন একটি নতুন সম্ভাবনার পথ খুলে দিতে পারে। যদিও হাসিনার আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ এবং অন্যান্য বড় রাজনৈতিক দল—যেমন বিএনপিসহ—নয়াদিল্লির সমালোচক, তবুও একটি নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে ভারতের কাজ করা তুলনামূলক সহজ হবে।
চক্রবর্তী বলেন, ‘এভাবে চলতে পারে না। ভারতের ঢাকায় একটি নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন।’ তার মতে, ভারতকে এখন অপেক্ষা করতে হবে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে, তবে বাণিজ্যের মতো বিদ্যমান ব্যবস্থা অযথা নষ্ট করা যাবে না।
ভারতের জিনদাল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, হাসিনাকে কেন্দ্র করে ভারত এখন জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছে। তবে বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষ আছে—এ বিষয়টি নয়াদিল্লি উপেক্ষা করছে না। তার মতে, আদর্শ অবস্থায় ভারত ভবিষ্যতে আবারও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চাইবে। তিনি বলেন, ‘ভারতের জন্য হাসিনা সবসময়ই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিকল্প ছিলেন।’
কিন্তু বাস্তবতা হলো—বাংলাদেশ আর তাকে ক্ষমতায় ফেরানোর সম্ভাবনা দেখছে না। তাই নয়াদিল্লিকে ঢাকায় অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে হবে। দত্ত বলেন, ‘ভারত আগে কখনোই ওখানকার অন্যান্য রাজনৈতিক অংশীজনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়েনি। কিন্তু এখন সেই সমীকরণ বদলাতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। তাই হাসিনাকে প্রত্যর্পণ ইস্যুতে আটকে না থেকে উভয় পক্ষকে এগিয়ে যেতে হবে।
দত্তের ভাষায়, ভারত ও বাংলাদেশ আর আগের মতো ঘনিষ্ঠ না থাকলেও, ‘তাদের পরস্পরের প্রতি অন্তত সৌজন্য বজায় রাখতে হবে।’
হাসিনার সাথে আঁকড়ে থাকার সুফল
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের সীমান্ত প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ। ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার, চীনের পরেই। সাম্প্রতিক উত্তেজনা সত্ত্বেও দুই দেশের বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারত সবসময় বলে এসেছে যে তাদের সম্পর্ক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে, কোনো নির্দিষ্ট দল বা নেতার সঙ্গে নয়। তবুও, বাস্তবে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গেই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিল। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ হয় এবং তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় আসেন। ভারতের জন্য এটি ছিল একটি বড় কৌশলগত স্বস্তি, কারণ তাদের পূর্ব সীমান্তে শত্রুভাবাপন্ন পাকিস্তানের পরিবর্তে তখন একটি বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র গড়ে ওঠে।
হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পর্কও ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের। ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হন। হাসিনা ও তার ছোট বোন রেহানা জার্মানিতে থাকায় বেঁচে যান। পরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাদের আশ্রয় দেন। হাসিনা তার স্বামী এম এ ওয়াজেদ, সন্তান এবং রেহানাকে নিয়ে নয়াদিল্লির বিভিন্ন বাসভবনে থাকতেন। এমনকি তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওর বাংলা বিভাগেও কাজ করেছিলেন।
ছয় বছর নির্বাসনে থাকার পর তিনি দেশে ফিরে বাবার দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে টানা ১৫ বছর দেশ পরিচালনা করেন। তার সময়ে ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়, যদিও দেশে অনেকেই ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক চুক্তিগুলোকে ঢাকার জন্য ক্ষতিকর বলে সমালোচনা করতেন।
২০২৪ সালে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়তে চাইলে, তিনি কোথায় আশ্রয় নেবেন তা নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন ছিল না। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল তাকে নয়াদিল্লির উপকণ্ঠে অবতরণের সময় গ্রহণ করেন। ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘এবার ভারত তাকে ডাকেনি। তবে তিনি তখনও বসমান প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাই একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছেন। ভারত তাকে থাকতে দিয়েছে কারণ তেমন বিকল্প কোনো পথ ছিল না।’
তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘এখন যখন তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, তিনি কি বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন?’ চক্রবর্তী মনে করেন, হাসিনা ভারতের প্রতি সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন, তাই ভারতকে এখন নৈতিক অবস্থান নিতে হচ্ছে।
ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, হাসিনার ভারতে অবস্থান দুই দেশের সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদি ‘কাঁটা’ হয়ে থাকবে। তবে একই সঙ্গে এটি প্রমাণ করে যে ভারত তার মিত্রদের প্রতি অঙ্গীকারে অটল থাকতে চায়।
কুগেলম্যানের মতে, রাজনৈতিক দিক থেকে দীর্ঘমেয়াদে নয়াদিল্লির জন্য এর লাভও থাকতে পারে। তিনি অন্যান্য বিশ্লেষকদের মতো মনে করেন না যে হাসিনার রাজনৈতিক ঐতিহ্য বা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। হাসিনা একটি পুরোনো ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক দলের নেতৃত্ব দেন। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, এমন দলে সংকট এলেও তারা সহজে বিলীন হয় না। অনেক সময় পর আবার ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
তার ভাষায়, দক্ষিণ এশিয়ায় ‘বংশগত দলগুলো টিকে থাকে’ এবং যথেষ্ট সময় ধরে রাজনীতির পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করলে ‘ফিরে আসার নতুন পথও তৈরি হতে পারে।’
সূত্র: আল-জাজিরা