leadT1ad

কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টের সাহসী অবস্থান

আন্তর্জাতিক সেনাবাহিনী পাঠিয়ে ফিলিস্তিনকে ‘স্বাধীন’ করার আহ্বান

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১: ০৭
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের বাইরে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছেন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো। ছবি: বিবিসি

কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও বিতর্কিত অবস্থান নিয়েছেন। ফিলিস্তিনকে ‘স্বাধীন’ করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সেনাবাহিনী গঠনের আহ্বান জানিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। শুধু তাই নয়, পেত্রো মার্কিন সৈন্যদের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আদেশ অমান্য করারও আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের পর গত শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে একটি ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভে যোগ দিয়ে এই মন্তব্য করেন কলম্বিয়ার বামপন্থী এই নেতা। তাঁর এমন পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কূটনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করেছে।

জাতিসংঘে তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড়
গত মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণেও পেত্রো যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বিরুদ্ধে ‘স্বৈরাচার ও সর্বগ্রাসী’ শাসনব্যবস্থা চাপানোর অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর বক্তব্যের সময় মার্কিন প্রতিনিধিদল অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করে। পেত্রো গাজায় চলমান পরিস্থিতিকে ‘গণহত্যা’ বলে উল্লেখ করে বলেন, জাতিসংঘ এই গণহত্যার ‘নীরব সাক্ষী’ হয়ে আছে। তিনি বলেন, ‘যেসব দেশ গণহত্যা সমর্থন করে না, তাদের নিয়ে আমাদের একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলা দরকার। আমাদের অবশ্যই ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করতে হবে।’

তিনি এশিয়া, হিটলারকে পরাজিত করা 'মহান স্লাভিক জাতি' মানে রাশিয়া, লাতিন আমেরিকার বলিভারের সেনাবাহিনীসহ বিশ্বের সব দেশের সেনাবাহিনীকে এই উদ্যোগে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। পেত্রো আরও বলেন, ‘অনেক কথা হয়েছে, এখন সময় এসেছে বলিভারের তরবারির—হয় স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু।’

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ‘গণহত্যার সহযোগী’ আখ্যা দিয়ে পেত্রো ক্যারিবীয় অঞ্চলে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জন্য মার্কিন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি করেন।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে বক্তব্য দিচ্ছেন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো। এক্স থেকে নেওয়া ছবি
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে বক্তব্য দিচ্ছেন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো। এক্স থেকে নেওয়া ছবি

বিক্ষোভে মার্কিন সেনাদের প্রতি আহ্বান
জাতিসংঘ সদর দপ্তরের বাইরে শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) হাজার হাজার ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীর সঙ্গে যোগ দেন পেত্রো। ব্রিটিশ সংগীতশিল্পী রজার ওয়াটার্সকে পাশে নিয়ে তিনি ঘোষণা করেন, কলম্বিয়া জাতিসংঘের কাছে একটি ‘বিশ্ব ত্রাণ সেনাবাহিনী’ গঠনের প্রস্তাব পেশ করবে, যার প্রথম কাজ হবে ‘ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করা’।

মার্কিন সেনাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে পেত্রো বলেন, ‘নিউইয়র্কের মাটি থেকে আমি মার্কিন সৈন্যদের অনুরোধ করছি, মানবতার দিকে বন্দুক তাক করবেন না। ট্রাম্পের আদেশ অমান্য করুন! মানবতার আদেশ মেনে চলুন।’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ও পেত্রোর পাল্টা জবাব
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টের মন্তব্যের পর যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত ও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখায়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ভিসা বাতিল করে পেত্রোর মন্তব্যকে ‘বেপরোয়া ও উসকানিমূলক’ বলে অভিহিত করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা জানায়, পেত্রো ‘মার্কিন সৈন্যদের আদেশ অমান্য করতে এবং সহিংসতায় উসকানি দিয়েছেন’।

এর প্রতিক্রিয়ায় পেত্রো বলেন, ‘আমার এখন আর যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ভিসা নেই। আমি চিন্তিত নই। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। গণহত্যার নিন্দা করার জন্য ভিসা বাতিল করা প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্র আর আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান করে না।’ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন।

যদিও পেত্রোর ‘আন্তর্জাতিক সেনাবাহিনী’ গঠনের আহ্বানের বিষয়ে ইসরায়েলি সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এর নিন্দা জানান। তিনি সম্প্রতি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর কর্মকাণ্ডকে ‘ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসের কাছে লজ্জাজনক আত্মসমর্পণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

বিশ্বমঞ্চে এক ব্যতিক্রমী অবস্থান
পেত্রোর এই সাহসী অবস্থান বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কলম্বিয়ার প্রথম বামপন্থী প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান পূর্ববর্তী নেতাদের নীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি প্রতিষ্ঠিত কূটনৈতিক শিষ্টাচারকে অস্বীকার করে সরাসরি বক্তব্য দেন। বিশ্বের অনেক নেতা যুদ্ধবিরতির আহ্বান বা দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও পেত্রো কার্যত একাই আন্তর্জাতিক সেনাবাহিনী গঠনের ডাক দিয়েছেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই অবস্থান পেত্রোকে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর দেশগুলোর কাছে আপসহীন কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত করবে। তবে পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে কলম্বিয়ার সম্পর্ক আরও টানাপোড়েনে পড়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।

পুতুল নয়, বাস্তব কূটনীতির পরীক্ষা
পেত্রোর বক্তব্য শুধু সাহসী নয়, এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও আইনের বাস্তব পরীক্ষাও। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে মুখোমুখি হলে ছোট রাষ্ট্রগুলো কখনো কখনো বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। পেত্রো যদিও দাবি করেন ইউরোপীয় নাগরিকত্ব থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে তিনি ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করতে পারবেন, তবুও এটি ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করবে।

পেত্রোর পদক্ষেপ শুধু কলম্বিয়ার জন্য নয়, গোটা আন্তর্জাতিক মঞ্চের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি ‘গ্লোবাল সাউথ’ এবং পশ্চিমা শক্তির দ্বন্দ্বের প্রতীক। পেত্রোর সরাসরি আহ্বান ও কঠোর অবস্থান, বিশেষ করে ফিলিস্তিন ইস্যুতে, আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও সমর্থন—উভয়ই তৈরি করেছে। তবে এটি তার দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।

গুস্তাভো পেত্রোর সাহসী উদ্যোগ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই পদক্ষেপ ‘কূটনৈতিক ভাষা’ ও ‘সরাসরি পদক্ষেপের মধ্যে’ সীমারেখা টেনে দিয়েছে। এটি বিশ্বমঞ্চে কলম্বিয়ার অবস্থান এবং লাতিন আমেরিকার বামপন্থী রাজনীতির প্রভাবকে নতুন আলোকে প্রকাশ করেছে। তবে পশ্চিমা শক্তির বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং সম্ভাব্য বিচ্ছিন্নতা কলম্বিয়াকে সতর্ক ও কৌশলী করতে বাধ্য করবে।

তথ্যসূত্র: কলম্বিয়া রিপোর্টস, প্যালেস্টাইন ক্রনিকল, বিবিসি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত