leadT1ad

সোনম ওয়াংচুককে গ্রেপ্তারে যা যা ঘটল

ইনস্ক্রিপ্ট প্রতিবেদকস্ট্রিম প্রতিবেদক
সোনম ওয়াংচুককে গ্রেপ্তারের ঘটনায় ভারতজুড়ে নিন্দা। স্ট্রিম গ্রাফিক

সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত করার অভিযোগে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে সমাজকর্মী সোনম ওয়াংচুককে গ্রেপ্তারের পর ৪৮ ঘণ্টা পার হলেও ভারতজুড়ে আলোচনায় লাদাখ। একাংশ দেখছে ডিপস্টেটের ‘জুজু’, আবার একটা বড় অংশই বলছে সোনমের কর্মকাণ্ড সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার জন্যই। জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারের পর নিরাপত্তা ও তদন্তের স্বার্থে সোনমকে রাজস্থানের যোধপুরের কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে।

পুলিশ স্পষ্টতই দাবি করছে, লাদাখে অশান্তির কারণ সোনম নিজেই। সামাজিক ও রাজনৈতিক অশান্তিতে ইন্ধন, স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসা, অনলাইনে এবং স্থানীয় সমাবেশে বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগ আনা হচ্ছে সোনমের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর যোগসাজশও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তাঁর পাকিস্তান সফরের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া চলছে।

পুলিশের দাবি, ওয়াংচুকের বিভিন্ন বিক্ষোভ কর্মসূচির ভিডিও পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। এমনকি পাকিস্তানি গুপ্তচরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল বলেও মন্তব্য করেছেন লাদাখের ডিজিপি এসডি সিংহ জামওয়াল। ওয়াংচুক ছাড়াও লাদাখ বিক্ষোভের ঘটনায় ৫০ জনকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

বলা বাহুল্য, ভারতের কঠোরতম আইনগুলোর একটি হলো জাতীয় নিরাপত্তা আইন। আইনটি আনা হয়েছিল দেশের অভ্যন্তরীণ অশান্তি ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করতে। সোনমের ক্ষেত্রে এই আইন প্রয়োগ কি অপরিহার্য ছিল, এ প্রশ্ন তুলছে নাগরিক সমাজ।

প্রশ্ন উঠছে, সোনমকে দেশদ্রোহী তকমা দেওয়া বুমেরাং হবে না তো।

এদিন লাদাখে পুলিশের গুলিতে মৃত চারজনের একজনে অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন হওয়ার সময় গোটা এলাকার নিরাপত্তায় জড়াকড়ি আরোপ করে।

সাংবাদিকদের সেখানে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। লে প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সেওয়াং রিগজিন বলছেন, লাদাখের অনুভূতি নিয়ে খেলছে দেশের মূলধারার সমাজমাধ্যম। এই দেশকে প্রথম থেকে রক্ষা করেছে লাদাখ, সেনার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অখণ্ডতা রক্ষা করেছে। আজ তাদেরই সন্দেহযোগ্য করে তোলা হচ্ছে। তিনি আরও বলছেন, বিক্ষোভ দমনে অন্য উপায় অবলম্বন করা উচিত ছিল। বিজেপি অফিস ভাঙচুর ঠিক কাজ হয়নি মনে করে তিনি প্রশ্ন করেন, বিক্ষোভ দমন করতে কি বিক্ষোভকারীর বুকে মাথায় গুলি করতে হবে?

গ্রেপ্তার হওয়ার আগে সোনম ওয়াংচুক বারবার সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, তাঁর কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এবং আইনসম্মত আন্দোলনের অংশ।

সোনম বলেন, 'আমরা কখনো হিংসা বা সহিংস কর্মসূচি চাইনি। আমাদের লক্ষ্য শুধুই লাদাখবাসীর সাংস্কৃতিক মর্যাদা, ভাষা ও ঐতিহ্য রক্ষা করা, যাতে স্থানীয় সম্প্রদায়ের জীবন ও পরিচয় সুরক্ষিত থাকে। আমাদের আন্দোলন সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও সংবিধানসম্মত।'

সোনমের বক্তব্য ছিল, তাঁকে গ্রেপ্তার করলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। সোনম ওয়াংচুকের গ্রেপ্তারের পর দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল সরব হয়েছে।

আম আদমি পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়, 'দেশের প্রখ্যাত সমাজকর্মী ও বিজ্ঞানী সোনম ওয়াংচুককে ভুয়া অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে মোদির একনায়কতন্ত্র। তাঁর গ্রেপ্তার নিয়ে কেন বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী মুখ খুলছেন না, সেই নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল আম আদমি পার্টি।

প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে কিছু না বললেও এক্স হ্যান্ডেলে রাহুল এই ঘটনাকে 'গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ' হিসেবে অভিহিত করেছেন। রাহুল দাবি করেছেন, সরকার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এবং জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে।

রাহুল আরও বলেন, 'গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করা হলে দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। লাদাখের মানুষদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বিজেপি ও আরএসএসের আক্রমণে ঝুঁকির মুখে। লাদাখের মানুষ প্রতিবাদ করেছিলেন। বিজেপি জবাবে চার জনকে হত্যা করেছে, সোনম ওয়াংচুককে জেলে ভরেছে। লাদাখের দাবি শোনা হোক। লাদাখকে ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।'

কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে অভিযোগ করেছেন, ২০২০-এ লেহ-র স্বায়ত্তশাসিত পার্বত্য পরিষদের নির্বাচনের সময় বিজেপি লাদখকে ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তার আগের বছর জাতীয় তফসিলি জনজাতি কমিশন এই সুপারিশ করে। কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র, আইন ও জনজাতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কোনো আপত্তি তোলেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা মোদি সরকার এই পথে হাঁটেনি। তৃণমূলের রাজ্য সংসদ সদস্য সাগরিকা ঘোষ কটাক্ষ করে বলেছেন, 'শ্রীশাহ, আপনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কর্তব্য পালন করুন। নির্বাচন মন্ত্রী হিসেবে কাজ করা বন্ধ করুন।'

কংগ্রেস, তৃণমূল মন্ব করাচ্ছে, শাহের জামানাতেই মণিপুরে হিংসা, দিল্লিতে হিংসা, পহেলগাঁও-এ সন্ত্রাসবাদীদের হামলা হয়েছে। এখন লাদাখে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

বিজেপির অভ্যন্তরেও এই গ্রেপ্তার নিয়ে নানা মত রয়েছে। স্থানীয় বিজেপি এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করছে। সংসদ সদস্য হানিফা মুহম্মদ প্রকাশ্যে বলছেন, 'সোনম ওয়াংচুকের বিরুদ্ধে দোষারোপ করা অনুচিত। অভিযোগের প্রমাণ পর্যাপ্ত নয়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নামে কোনো ব্যক্তিকে হিংসার দায়ে দোষারোপ করা উচিত নয়।'

এই গ্রেপ্তার নিয়ে সরব আইনজীবী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক অনির্বাণ ব্যানার্জি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, 'সত্যি কথা বলতে, সম্পূর্ণ অসাংবিধানিকভাবে ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির পর সেই অবলুপ্তির পক্ষে দাঁড়ানো সোনমের প্রতি খানিক অবজ্ঞামিশ্রিত অশ্রদ্ধা তৈরি হয়েছিল...তারপর ক্রমে ক্রমে দেখলাম, বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে সোনম তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করছেন। এরপর দেখলাম, বিজেপির পোষ্যরা তাঁকে দেশদ্রোহী ঠাউরাচ্ছে। নিশ্চিত হয়ে গেলাম, সোনম দেরিতে হলেও সঠিক পথে চলে এসেছেন। এবার সোনমের পাশে যেভাবে যেটুকু সম্ভব, দাঁড়াতে হবে।'

লেখক বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারী বলছেন, 'একদিন সোনোম যে ফসল বুনেছিলেন, আজ সেই ফসল কাটছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ধ্বংসকারী যে বিজেপির তিনি অন্ধভক্ত হয়েছিলেন, সেই বিজেপি আজ তাঁর হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দিয়েছে, তো আমি আর ভেবে কী করব?'

Ad 300x250

সম্পর্কিত