leadT1ad

আফগানিস্তানে কেন ইন্টারনেট বন্ধ করল তালেবান

স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা
আফগানিস্তানে বন্ধ ইন্টারনেট। ছবি: সংগৃহীত।

আফগানিস্তানে সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) থেকে প্রায় পুরো দেশজুড়ে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ২০২১ সালে তালেবানরা ক্ষমতায় ফেরার পর এটিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট। সংযোগ নেমে আসে স্বাভাবিক অবস্থার ১ শতাংশেরও নিচে। মোবাইল ফোন, স্যাটেলাইট টিভি ও ল্যান্ডলাইন যোগাযোগও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

তালেবান সরকার জানিয়েছে, এই পদক্ষেপ ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত’ চলবে। তবে বিস্তারিত কোনো সরকারি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। প্রাদেশিক মুখপাত্ররা বলেছেন, ‘অসৎ কাজ’ ও ‘অশ্লীলতা’ বন্ধ করার জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন প্রদেশে আংশিক নিষেধাজ্ঞার পর এবার তা পুরো দেশে কার্যকর করা হলো। এতে লাখ লাখ মানুষ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং আন্তর্জাতিক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

ঘটনার সময়রেখা: স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে

সেপ্টেম্বরের শুরুতে উত্তরাঞ্চলের বালখ, বাদাখশান ও তাকহার প্রদেশে ফাইবার অপটিক কেবল কেটে দেওয়া হয়। দক্ষিণাঞ্চলের কান্দাহার, হেলমান্দ, নানগারহার ও উরুজগানেও একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এসব অঞ্চলের মানুষ ধীরগতির ইন্টারনেট কিংবা সম্পূর্ণ সংযোগ বিচ্ছিন্নতার কথা জানান। অনেক ক্ষেত্রে সেবা ফোর-জি থেকে টু-জিতে নামিয়ে আনা হয়।

২৯ সেপ্টেম্বর সকালে ধাপে ধাপে সংযোগ বন্ধ হতে থাকে। দুপুরের মধ্যে পুরো দেশ অন্ধকারে ডুবে যায়। লন্ডনভিত্তিক সংস্থা নেটব্লকস একে ‘পূর্ণ ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট’ বলে আখ্যা দেয়। ক্লাউডফেয়ার রাডার জানায়, প্রধান সেবাদাতাদের ট্রাফিক প্রায় শূন্যে নেমে আসে।

স্থানীয় সময় বিকেল ৫টার দিকে ব্ল্যাকআউট শুরু হয়। এতে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ফোনকলও বন্ধ হয়ে পড়ে। ৩০ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দিনেও সংযোগ ফেরেনি। কাবুলে বিদেশি কূটনীতিকদের তালেবান কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই পদক্ষেপ অনির্দিষ্টকালের জন্য চালু থাকবে।

শাটডাউনের কারণ: ‘অসৎ কাজ’ দমন ও তথ্য নিয়ন্ত্রণ

তালেবান কর্তৃপক্ষ বলছে, এই পদক্ষেপ সমাজ থেকে ‘অশ্লীলতা’ ও ‘অসৎ কাজ’ দূর করার জন্য প্রয়োজন। তাদের মতে, এটি শরিয়াহর কঠোর ব্যাখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বালখ প্রদেশের গভর্নরের মুখপাত্র সেপ্টেম্বরের শুরুতে বলেছিলেন, ‘অসৎ কার্যকলাপ’ নির্মূলই মূল উদ্দেশ্য। বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা খোঁজার কথাও তখন উল্লেখ করা হয়।

সূত্রগুলো জানায়, কাবুলে একটি বিশেষ কমিটি ইন্টারনেট কনটেন্ট কীভাবে ফিল্টার করা যায় তা খতিয়ে দেখছে। এতে অনুমোদনহীন সাইটে প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ হতে পারে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর পেছনে আরও বড় উদ্দেশ্য আছে। তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ, গণমাধ্যম ও শিক্ষায় সীমাবদ্ধতা আরোপই এর মূল লক্ষ্য। অনেকে মনে করেন, নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিষয়ও যুক্ত থাকতে পারে। যেমন— বাইরের হুমকি, ভেতরের বিরোধিতা বা বিদ্রোহের আশঙ্কা। সম্প্রতি লেবানন ও ইরানে যোগাযোগ অবরোধের ঘটনাও এতে প্রভাব ফেলতে পারে।

তালেবান এসব সরাসরি স্বীকার করেনি। তবে একই সময়ে নারীদের লেখা বই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরানো ও মানবাধিকার শিক্ষা নিষিদ্ধ করার মতো পদক্ষেপ এই নীতিরই ধারাবাহিকতা দেখায়।

তাৎক্ষণিক প্রভাব: দৈনন্দিন জীবন থেকে অর্থনীতি ও বিমান চলাচল

ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট আফগানিস্তানের নানা ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। প্রথম প্রভাব পড়ে যোগাযোগ ও গণমাধ্যমের ওপর। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপি ও অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস কাবুল অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ হারায়। স্থানীয় টিভি ও রেডিও, যেমন টোলো নিউজ, সম্প্রচার ব্যাহত হওয়ার সতর্কতা দেয়। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের আহ্বান জানালেও সেটিও এখন অনেকের নাগালে নেই। ব্যবহারকারীরা বলছেন, আফগান কণ্ঠহীন ‘নীরবতা’ নেমে এসেছে অনলাইনে।

অর্থনীতি ও সেবা খাতেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ব্যাংকিং, ই-কমার্স ও কাস্টমস সিস্টেম পুরোপুরি অচল হয়ে গেছে। অনলাইন লেনদেন নির্ভর ব্যবসায়ীরা, যেমন মানি এক্সচেঞ্জ, বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে।

বিমান চলাচল ও ভ্রমণও বাধাগ্রস্ত হয়। কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ৩০ সেপ্টেম্বর অন্তত আটটি ফ্লাইট বাতিল হয়। দুবাইসহ বিভিন্ন জায়গায় যাত্রী আটকা পড়েন।

শিক্ষা ও নারীদের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। অনলাইন শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নারী শিক্ষার সুযোগ আরও খর্ব হয়। এটি ছিল সেই নারীদের জন্য শেষ আশ্রয়, যাদের ১২ বছর বয়সের পর থেকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইংরেজি ক্লাস ও মিডওয়াইফারি কোর্স বন্ধ হয়ে গেছে। এক নারী বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের শেষ আশা শেষ হয়ে গেল।’ সাবেক সংসদ সদস্য মরিয়ম সোলাইমানখিল একে ‘নির্মম স্বৈরতন্ত্র’ আখ্যা দেন এবং গণগ্রেফতারের আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

সামগ্রিকভাবে, ফোন ও ইন্টারনেটহীন আফগানিস্তান এখন অন্ধকারে ডুবে গেছে। দেশটি আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, যেখানে আগে থেকেই তীব্র মানবিক সংকট চলছে।

প্রতিক্রিয়া: দেশীয় ক্ষোভ ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ

এই ঘটনায় দেশের ভেতরে তীব্র সমালোচনা তৈরি হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান রহমাতুল্লাহ নাবিল অভিযোগ করেছেন, তালেবান শুধু ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য জনগণকে নীরব করছে। অনেকে আফগানিস্তানকে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কেউ লিখেছেন, ‘একাকীত্ব পুরো দেশকে গ্রাস করেছে।’ মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এটি একটি মানবিক সংকট, যা লাখ লাখ মানুষকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।

আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন অধিকার সংগঠন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। তবে ঘটনাটি তালেবানের ‘লিঙ্গবৈষম্যমূলক’ নীতির ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। নেটব্লকস ও ক্লাউডফ্লেয়ার একে ‘সম্পূর্ণ ব্ল্যাকআউট’ আখ্যা দিয়েছে। প্রতিবেশী পাকিস্তান সীমান্ত ইস্যুতে উত্তেজনার মধ্যে সামরিক প্রতিক্রিয়ার হুমকি দিয়েছে, যদিও সরাসরি এই শাটডাউন নিয়ে মন্তব্য করেনি।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল-জাজিরা, সিএনএন

Ad 300x250

সম্পর্কিত