leadT1ad

দুই দিনের বৈরাগী ভাতেরে কয় অন্ন: ফোকের ভদ্দরলোক হয়ে ওঠা

দাদী যে পিঠা শীতে ফ্রিতে খাওয়ায়, বা পাড়ার মোড়ের দোকানে ৫ টাকা পিস রেটে পাওয়া যায়, ভদ্দরলোকের এলাকা বনানীতে তার দাম আড়াইশো হয় কেন? গ্রাফিতির গালি-ক্রোধ-শিল্প সব মুছে তাকে কেন ‘ম্যুরাল' বানানো হয়? এই ভদ্দরলোকিপনার শেষ কোথায়?

রাতুল আল আহমেদ
প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ১৯: ০৯
দুই দিনের বৈরাগী ভাতেরে কয় অন্ন: ফোকের ভদ্দরলোক হয়ে ওঠা। স্ট্রিম গ্রাফিক

থাকি আমি ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে। ভদ্দরলোকের চৌহদ্দীর বাইরে। তবুও তো, কত কিছুর সাধ হয়। ভাবলাম, ভদ্দরলোকেরা তো শুনি কত কীই খায়, একদিন চেখে দেখা যাক তাদের খাবার। তো, গেলাম একদিন ভদ্দরলোকেদের শহর, বনানীতে। কিন্তু, কিছুই তো চিনি না। কই খাইতে যাওয়া যায়?

এরকম সময়ে একটা রেস্টুরেন্ট দেখলাম। বেশ ভদ্দরলোকি ম্যাড়মেড়ে রঙের দেয়াল। ভেতরে ঢুকে দেখি প্রায় অন্ধকার অন্ধকার সিঁড়ি, ঠিক সিনেমায় যেমন দেখি। কিছুটা এগোতেই, দেখি আলপনাও করা। তবে, রংপুরে আমাদের দেশের বাড়িতে নবান্নের সময়, বা পরেশ কাকাদের বাড়ির লক্ষ্মীপূজায় যেমন আলপনা হয়, ঠিক তেমন না। একদম ওপরে উঠে দেখি আমাদের বাড়ির মতো গোলপাতার ঘরও আছে। ভদ্দরলোকেরা তাহলে আমাদের মতই নরমাল? আশ্বস্ত হই আমি।

গাছপালা ঘেরা, ধুনোর গন্ধ মাখা, এমনকি আমাদের বাড়ির বেড়ালের মতন বেড়ালও ঘুরঘুর করছে। সত্যি বলতে, বেশ ভালোই লাগছিল। চারপাশটা কেমন এস্থেটিক এস্থেটিক।

এবার আসল কাজে নামা যাক। খাবারের অর্ডার দিতে হবে। মেন্যু দেখে ফাইনাল করলাম স্টিমড রাইস ফ্লাওয়ার কেক সার্ভড উইথ মাস্টার্ড অ্যান্ড কোরিয়েন্ডার ডিপ। আড়াইশো টাকারও বেশি ধাক্কা। ভয়ে ভয়েই অর্ডার করলাম।

খাবার দেখে তো আমার আক্কেল গুড়ুম! এ কী! এ তো সর্ষে আর ধনেপাতা ভর্তা দিয়ে চিতই পিঠা। তায় আড়াইশো টাকার ধাক্কা! কোনোমতে খানাখাদ্য গিলে বিল মিটিয়ে বুঝলাম, ভদ্দরনোক হয়ে আর কাজ নেই।

খাবার দেখে তো আমার আক্কেল গুড়ুম! এ কী! এ তো সর্ষে আর ধনেপাতা ভর্তা দিয়ে চিতই পিঠা। তায় আড়াইশো টাকার ধাক্কা! কোনোমতে খানাখাদ্য গিলে বিল মিটিয়ে বুঝলাম, ভদ্দরনোক হয়ে আর কাজ নেই।

এখন কথা হচ্ছে, দাদী যে পিঠা প্রত্যেক শীতে ফ্রিতে খাওয়ায়, বা পাড়ার মোড়ের খালা পাঁচ টাকা দরে পিঠা, আর ফ্রি ভর্তা খাওয়ায়, ভদ্দরলোকের জাতে উঠতে গেলে তার দাম আড়াইশো হয়ে ওঠে ক্যামনে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বইপত্তর ঘেঁটে এক নতুন টার্মের সন্ধান পেলাম, যার গালভরা নাম হচ্ছে গিয়ে ‘জেনট্রিফিকেশন’। বাংলা করলে হয় যাকে বলে গিয়ে ‘ভদ্দরলোকিকরণ’। এই প্রক্রিয়ায় কোনো একটি এলাকার জনমানুষের সংস্কৃতিকে ছেঁকে নিখুঁতভাবে প্যাকেজিং করে বিশাল দামে আবার তাদের কাছেই বিক্রি করা হয়।

শুধু যে ফ্যান্সি মাসালা চায়ের দামই বেড়ে যায় এক্ষেত্রে তা নয়; বলা চলে আমাদের কালচারের আত্মা, যাকে অনেকে বলে কি না ফোক, তাকে সুন্দর মোড়কে পুরে দোকানের শেলফে সাজিয়ে রাখা হয়। সবচেয়ে বেশি দাম যে হাঁকবে, জিনিসটা তার হয়ে যাবে। এভাবেই আমার দাদীর হাতের আচার হয়ে ওঠে ‘গুরমে, স্মল-ব্যাচ লাক্সারি আইটেম’ আর আমাদের মাটির সুরের বাউল গান কোনো দামি গাড়ির বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলে বেজে ওঠে।

এই ভদ্দরলোকিকরণের একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য আছে যাকে বলা হয় ‘জেনট্রিফায়েড এস্থেটিক’। এটা হলো ভদ্দরলোকের চোখে ফোকের যেসব “খুঁত”, যেমন সর্ষে বাটার ঝাঁজ, সেসব কমিয়ে, খুঁতগুলোকে যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে দেখানোর সৌন্দর্য – এমন এক অতীতের জন্য নস্টালজিয়া যা আসলে কখনও ছিলই না।

এই ধরুন, রেস্তোরাঁর দেয়াল থেকে প্লাস্টার তুলে ফেলে পুরোনো ইট বের করে রাখা, ফ্যাক্টরির মতো দেখতে হলদে বাতি ঝুলিয়ে দেওয়া, আর ভাঙা জাহাজের কাঠ দিয়ে বানানো টেবিল, সে টেবিলের গায়ে আবার রিকশা পেইন্ট করা, যা দেখে মনে হবে কত ‘র’ বা ‘কাঁচা’, কত ‘আসল’। কিন্তু এই পারফরম্যান্সের আড়ালে চাপা পড়ে যায় সেই শ্রম, সেই সংগ্রাম আর সেই সাধারণ মানুষজন, যারা একসময় এই তথাকথিত ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল’ বা ‘র’ জায়গাগুলোতে বাস করত। এইটা এমন এক ফ্যান্সি ওয়ার্ল্ডের কথা বলে, যেখানে একজন শ্রমিক বা রিকশাওয়ালার কায়দা করে বেঁচে থাকার কায়দা রপ্ত না করেই তাদের জীবনকে ভদ্দরলোকিভাবে উদযাপনের একটা ঢঙ করা হয়।

শুধু যে ফ্যান্সি মাসালা চায়ের দামই বেড়ে যায় এক্ষেত্রে তা নয়; বলা চলে আমাদের কালচারের আত্মা, যাকে অনেকে বলে কি না ফোক, তাকে সুন্দর মোড়কে পুরে দোকানের শেলফে সাজিয়ে রাখা হয়।

আরো উদাহরণ খুঁজতে চান আপনার আশেপাশে? কলকাত্তাই শিল্পীদের ‘বাঙাল’ ভাষায় গাওয়া ‘মিষ্টি’ ফোক গান শুনে দেখতে পারেন। দেখবেন, গানগুলোকে একদম ভদ্দরলোক বানিয়ে ছাড়া হয়েছে। বাংলাদেশে একটা বিশেষ কোমল পানীয়ের নামে খোলা স্টুডিওতে যেসব গান গাওয়া হয়, কেউ কেউ সেসব গানকে কেউ কেউ একই কাতারে ফেলতে চায়।

বা, এই ধরেন কাঁথা স্টিচ। যা একসময় ছিল গ্রামের মহিলাদের মনের মাধুরী মেশানো এক শিল্পকর্ম, যেখানে ব্যক্তির ছোঁয়া থাকত (ভুলো না আমায়), বুকে হাত দিয়ে বলেন দেখি, এখন যেসব কাঁথা স্টিচের শাড়ি থেকে সালোয়ার-কামিজ-বিছানার চাদর গাদাগুচ্ছের যেসব বস্তু বিক্রি হয়, সেসব যে ফরমায়েশি কাজ, আপনি জানতেন না? মোদ্দা কথা এই যে, এসব শাড়ি কাঁথা গেঞ্জি জাঙ্গিয়া আর যা হোক না কেন, ‘ফোক’ অবশ্যই না।

কথা হচ্ছে, এই ভদ্দরলোকিপনার সবচেয়ে বড় শিকার কারা? শিকার হলো সেই পরেশ কাকা বা আমার দাদীর মতো মানুষেরা, যাদের কালচারকে চুরি করে নতুন সিটিজেনদের চোখের সামনে স্রেফ একটা স্যুভেনিয়ার বানিয়ে রাখা হয়। তাদের জ্যান্ত, হ্যাপেনিং কালচারকে পরিচ্ছন্ন, সরল ও সহজপাচ্য করে পুনরায় প্যাকেজিং করা হয়। পাড়ার মোড়ের টং দোকানটা, যা একসময় আড্ডার কেন্দ্র ছিল, তার জায়গায় গজিয়ে ওঠে অর্গানিক কফি শপ। স্প্রে পেইন্ট দিয়ে দেয়ালে মারা গ্রাফিতি বা চিকা, যা একসময় প্রতিবাদের ভাষা ছিল, তা মুছে ফেলা হয় অথবা আরও ভয়ংকরভাবে সেটাকে ‘ম্যুরাল’ নাম দিয়ে ইনস্টাগ্রামের ছবির ব্যাকড্রপ বানানো হয়।

এই অবিরাম পণ্যকরণের ইঞ্জিন হলো লেট ক্যাপিটালিজমের ধান্দা। তাত্ত্বিক ফ্রেডরিক জেমসন যেমনটা বলেছেন, এই পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য হলো এক নতুন "গভীরতাহীনতা", যেখানে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মুছে যায় এবং সবকিছুই একটা ছবি, একটা উপভোগ করার মতো দৃশ্যে পরিণত হয়। এই জগতে, কালচার আর বিজনেসের মধ্যে কোনো তফাৎ থাকে না। শিল্প, সঙ্গীত, খাবার দ্রুত বিপণনযোগ্য পণ্যে রূপান্তরিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে, ‘অথেনটিক’ জিনিসটাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে দামি পণ্য।

কিন্তু অথেনটিক ব্যাপারটা কী? আয়রনির ব্যাপার হচ্ছে, অথেনটিসিটি খোঁজার প্রক্রিয়াতেই তার খাঁটিত্ব ধ্বংস হয়ে যায়। সত্যিকারের ফোক কোনো স্থির বস্তু নয় যে তাকে জাদুঘরে সাজিয়ে রাখা যাবে বা বুটিক শপে বিক্রি করা হবে। এটা একটা জীবন্ত প্রক্রিয়া, যা একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ফলে যখন আপনি কোনো সাংস্কৃতিক চর্চাকে তার শিকড় থেকে তুলে আনেন, তখন তার ইতিহাস ও অর্থকে কেড়ে নেন, তখন যা অবশিষ্ট থাকে তা একটি ফাঁপা খোলস ছাড়া আর কিছুই নয়।

স্প্রে পেইন্ট দিয়ে দেয়ালে মারা গ্রাফিতি বা চিকা, যা একসময় প্রতিবাদের ভাষা ছিল, তা মুছে ফেলা হয় অথবা আরও ভয়ংকরভাবে সেটাকে ‘ম্যুরাল’ নাম দিয়ে ইনস্টাগ্রামের ছবির ব্যাকড্রপ বানানো হয়।

বনানীর ওই আড়াইশো টাকার স্টিমড রাইস ফ্লাওয়ার কেক সার্ভড উইথ মাস্টার্ড অ্যান্ড কোরিয়েন্ডার ডিপের (মানে ওই চিতই পিঠা) স্বাদ কখনোই দাদীর পিঠার মতো হতে পারবে না, কারণ শুধু এটাই নয় যে এর আসল উপাদান দামী সর্ষে বা ধনেপাতা না হয়ে ছিল দাদীর আদরের ধারণা। আর, আপনি ঠিক জানতেও পারবেন না যে দাদী ঠিক ভালোবেসে পিঠা বানাতো, নাকি গ্রামের বউ হিসেবে এ পিঠা বানানো তাঁর জন্য ছিল বাধ্যতামূলক অবৈতনিক কাজ।

এই প্রক্রিয়া এখন শুধু বাইরের সংস্কৃতিতেই সীমাবদ্ধ না, এটা আমাদের নিজেদেরকেও পণ্য বানানোর প্রক্রিয়া। এমন এক বিশ্বে যেখানে আমাদের আইডেন্টিটি ক্রমবর্ধমানভাবে নির্ভর করে আমরা কী কিনি, কোন ব্র্যান্ড পরি, এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের কোন ছবিটি তুলে ধরি তার ওপর, সেখানে আমরা নিজেরা এক একটা ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে উঠতে উৎসাহিত হই।

ইনস্টাগ্রাম এবং টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে, ব্যক্তিদের তাদের জীবনকে সর্বদা হ্যাপেনিং করার তাগাদা দেওয়া হয়, তাদের শখ, সম্পর্ক এবং এমনকি তাদের দুর্বলতাগুলোও আয়ের উৎসে পরিণত হয়। এটাই লেট ক্যাপিটালিজমের চূড়ান্ত বিজয়: মানবসত্তাকে একটি বিপণনযোগ্য পণ্যে রূপান্তর।

তাইলে উপায় কী? এই সবকিছুকে বিক্রি করাকে আমরা কীভাবে ঠেকাইতে পারি? সত্যি বলতে এর সাদাকালো কোনো উত্তর নেই, তবে শুরুটা হতে পারে এসব ভদ্দরলোকি কালচারকে প্রশ্ন করা, ক্রিটিকাল হয়ে ওঠা থেকে। আমাদের চিনতে শিখতে হবে কীভাবে ‘খাঁটি’ জিনিসকে প্যাকেজিং করে আমাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।

একটা উপায় হতে পারে, ট্রেন্ডি নতুন রেস্তোরাঁর ‘ডিকনস্ট্রাকটেড’ খাবারের পরিবর্তে পুরনো খাবারটিকে খুঁজে বের করা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একই রকম সুস্বাদু, আর সত্যিকারের খাবার, হোক তা যতই নন হ্যাপেনিং, পরিবেশন করে আসছে। আরেকটা হতে পারে, সোশ্যাল মিডিয়ার অন্তহীন স্ক্রোলিং থেকে বিরতি নিয়ে আমাদের চারপাশের মানুষ এবং সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাস্তব ও অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে সময় খাটানো।

আর লড়াই কিন্তু একা করে ঠিক অতটা লাভ নেই, চেষ্টা করতে হবে ফোকের পক্ষে যত পারা যায় লোক এককাট্টা করা। নাহলে দেখা যাবে যাত্রাবিরতিতে স্টিমড রাইস ফ্লাওয়ার কেক সার্ভড উইথ মাস্টার্ড অ্যান্ড কোরিয়েন্ডার ডিপ খাওয়ার জন্য প্রাডা থেকে অথেনটিক কোলাপুরি চপ্পল, আর জারা থেকে অথেনটিক লুঙ্গি কিনতে ছুটতে হতে পারে।

Ad 300x250

মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সসীমা নির্ধারণে হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি হবে

সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বৈধতা প্রশ্নে রুলের শুনানি শেষ, রায় ২ সেপ্টেম্বর

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার কত বড়, বাংলাদেশিদের জন্য কতটা সম্ভাবনাময়

বাংলাদেশে জলবায়ু অর্থায়নে অশনিসংকেত

নতুন জাপার স্বীকৃতি চায় আনিসুল-হাওলাদার কমিটি; এখন পর্যন্ত কতবার ভাঙল দলটি

সম্পর্কিত