leadT1ad

পপ কালচার না বুঝলে যেভাবে আপনি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে পারেন

জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ফেনোমেননকে এড়িয়ে গেলে একটা সময় হয়তো আপনি নিজেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তে পারেন। হ্যারি পটার ফেনোমেননকে নিয়ে ক্লাসিক এই লেখাটি লিখেছেন বিখ্যাত মার্কিন পপ কালচার ক্রিটিক চাক ক্লস্টারম্যান।

চাক ক্লস্টারম্যান
প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২৫, ১৯: ২৩
আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২৫, ২২: ২৯
পপ কালচার না বুঝলে যেভাবে আপনি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে পারেন। স্ট্রিম গ্রাফিক

হ্যারি পটার নিয়ে আমি যা জানি: নাথিং!

তাকে নিয়ে লেখা একটা উপন্যাসও আমি পড়িনি, তার একটা সিনেমাও আমার দেখা নেই। এইটুকু জানি যে উপন্যাসগুলো লিখেছেন জে কে রাওলিং নামের মধ্যবয়স্ক এক ধনাঢ্য ব্রিটিশ নারী। তবে জে এবং কে আদ্যক্ষর দুইটি দিয়ে কী বুঝায় সে বিষয়ে আমার কোন ধারণাই নেই।

হ্যারি পটারের সিনেমার অভিনেতার নামও আমি জানি না। তবে আমার ধারণা, তিনি চশমা পরেন। বাকি ছোটখাটো চরিত্রের নামও আমার অজানা। সিনেমার প্লট আর ন্যারেটিভ সম্পর্কেও আমি জানি না।

হ্যারি পটারের গল্পগুলো কোথায় ঘটে? অতীতে না ভবিষ্যতে? কিছুদিন আগেই একজন আমাকে বললেন, সপ্তম বইয়ের ক্লাইম্যাক্সেও হ্যারি মরে নি (এবং এই তথ্য নাকি খুব জরুরি!)। অথচ হ্যারি যে অসুস্থ ছিল এটাই তো আমি জানতাম না!

ক্রিস্টোফার হিচেন্স দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ এই সিরিজ নিয়ে কিছু একটা লিখেছিলেন। আমার পড়া হয় নি। তবে তিনি নিক্সনকে উল্লেখ করেছিলেন বলে মনে হয় না। আমার ধারণা, বইগুলোর ভেতর অনেক ড্রাগন, গ্রিফিন, ওয়্যারউলফ আর কিছু সমকামী ফ্র্যাংকেনস্টাইন আছে।

সত্যি বলতে কি, এই ধারণা ঠিক বা ভুল হলেও আমার কিছু যায় আসে না। কেউ যদি এসে বলে যে, হ্যারি পটার উপন্যাস আদতে কোরানের একটা সাংকেতিক তাফসির যার সাহায্যে আমার মনের কথা পড়ে ফেলা সম্ভব, আমি বলতাম ‘কী জানি! হতেও পারে।’ কারণ যাই হোক না কেন, হ্যারি পটার একটা সাংস্কৃতিক ফেনোমেনন— যা আমি পুরোপুরি মিস করে গেছি (মূলত, স্বেচ্ছায়)।

আবার ভেবে বসবেন না, বইগুলো আমার অপছন্দের। বইগুলোকে অপছন্দ করি না। আমার এক সহকর্মী তো মনে করেন ২১ বছরের বেশি বয়সী কেউ যদি হ্যারি পটারের বই পড়ে, তাহলে বিনা বিচারে তাঁকে শাস্তি দেওয়া দরকার। অন্যদিকে, কোনো কারণ ছাড়াই আমি মাঝে মাঝে ভাবতে থাকি, এই বইগুলো যদি ১৩ বছর বয়সের ব্রিটিশ কিশোর-কিশোরীর উপযোগী হয়ে থাকে, ৯০ শতাংশ আমেরিকান প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য সেটাই যে একেবারে আদর্শ হবে না—কেউ কি তা হলফ করে বলতে পারেন? আমার তো হ্যারি পটারের জন্য কোনো ঘৃণা নাই-ই, বরং নিঃসন্দেহে বলতে পারি, তাঁকে নিয়ে লেখা উপন্যাস যথেষ্ট ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি রাখে।

তার চেয়েও বড় যে ঘটনা, আধুনিক কিশোর-কিশোরীদের কাছে জাদুকর নিয়ে ৫০০ পাতার একটা লেখা আছে, যা তাদের এক জায়গায় ধরে রাখতে পারে। এমন সমন্বিত সাংস্কৃতিক পুঁজি আমাকে চমৎকৃত করে। এই ঘটনা এত বেশি বিরল যে দলগতভাবে সবাই এটাকে সাধারণ ঘটনা হিসেবে দেখি। এই মুহূর্তে জে কে রাওলিং থেকে জনপ্রিয় কোনো গায়ক কিংবা সিনেমার তারকা নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই বইগুলো (এবং এই বইগুলো থেকে নেওয়া চিন্তাগুলোই) হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের জনপ্রিয় সংস্কৃতির মূলধারার প্রতিধ্বনি। হ্যারি পটার একচ্ছত্রভাবে সেই ভবিষ্যৎ সংস্কৃতির কমন অংশ হতে চলেছে, যা সবার কাছেই উপস্থিত থাকবে।

মাঝে মাঝে ভাবি, সেটা কত বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে? আজ হ্যারি পটার পড়ছে যে কিশোর বা কিশোরী, সে হয়তো কাল দুনিয়া শাসন করবে না। কিন্তু গণমাধ্যম তো তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ১৫ বছর পর তাঁরা বই লিখবে, সিনেমা বানাবে, অপ্রস্তুত পরিস্থিতি নিয়ে মজা নিয়ে কৌতুক লিখবে। নিঃসন্দেহে আমাদের মাথায় সরাসরি সেগুলোই থেকে যাবে। সব প্রজন্মের শিল্পীর মতোই তারাও তাদের নিজেদের নস্টালজিয়া রেখে যাবে। নিজেদের জানাশোনা জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা দিয়ে সেই জনপরিসরটা সাজিয়ে দেবে। তো, আমার কৌতূহল হয় —- যেহেতু আমি হ্যারি পটার বুঝি না, আমি কি বাকি সবকিছুও আর বুঝতে পারব না?

আমার এক বন্ধু স্টার ওয়ার্সের কোনো সিনেমা দেখে নি। দি অফিস নিয়ে ঠাট্টা করলে সে বোঝে না, হাসতে পারে না। কলেজের একজনকে চিনতাম, বিটলসের তিনটা গানের নামও বলতে পারত না। শুধু ‘টুইস্ট এন্ড শাউট’ গানটা চিনত। কারণ Ferris Bueller's Day Off সিনেমায় এই গানটা ব্যবহৃত হয়েছিল। বাস্তব জীবনে এই জিনিসগুলোকে না চিনলে কেউ জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে যায় না। আপনারা কেউ কেউ নিশ্চয়ই তর্ক করবেন যে, এসব পাত্তা না দিয়েও তাঁরা ভালো আছেন।

কিন্তু বেশিরভাগ আমেরিকান যাকে সাধারণ জ্ঞান হিসেবে মেনে নিয়েছে, তা থেকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া একটা সমস্যা। যে কখনো স্টার ওয়ার্স দেখে নি, সে যে কেভিন স্মিথের সিনেমা ভালোবাসবে না কিংবা যে বিটলস চেনে না, সে যে কখনও দ্য এপেল ইন স্টেরিও ভালোবাসবে না, এমন কিন্তু নয়। তবে খুব একটা স্পষ্ট না হলেও একটা কথা কিন্তু বেশ গুরুত্ব রাখে: যেকোনো সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যে জিনিসটা সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, সেটিকে দিয়ে অবচেতনেই আমরা সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃতিকে বোঝাই।

একটা জটিল পরিস্থিতিতে, নিজের সঙ্গে তথ্যের বোঝাপড়াকে তিনভাবে দেখা যায়:

১। আমি জানি, এই তথ্য আমার পরিচিত।

২। আমি জানি, আমি এই তথ্যটি জানি না।

৩। আমি জানতেই পারি না, আমি এই তথ্যটি জানি কি না।

আমি মনে করতে চেয়েছি, আমার আর হ্যারি পটারের সম্পর্ক ২য় ক্যাটাগরির তথ্যের ভেতরে পড়ে। আমি জে কে রাওলিংয়ের বইগুলো এমন কিছু হিসেবে দেখি, যা আমি বুঝি না এবং না-বোঝার বিষয়টি আমি সচেতনভাবে বুঝতে পেরেছি। তবে, আসলে আমার এই মনে করতে চাওয়াটা ভুল। প্রকৃতপক্ষে, এই বইগুলো নিয়ে এমন এক ফেনোমেনন আছে, যার কারণে আমি নিজের অজ্ঞতার এই পরিণতি থেকে নিজেকে আলাদা রাখতে পারিনি। ঠিকভাবে বলতে গেলে আমার ও হ্যারি পটারের সম্পর্ক তিন নম্বর ক্যাটাগরিতেই পড়তে পারে: আমি আন্দাজ করার ভানও করতে পারি না যে ৩২৫ মিলিয়ন কপি বইয়ের সামাজিক প্রভাব আসলে কি আকারে আমার সামনে আসবে? বছর যাবে। এই কিশোর জাদুকরের গল্প এমনভাবেই ছড়াবে যে, প্রভাবটা আলাদা করে কারো চোখেও পড়বে না। দুই দশকের মধ্যে আমি হ্যারি পটারের রেফারেন্স দেখা নিয়ে আর কোনো দ্বিধাই দেখাব না। যদিও প্রায় সময় আমি বুঝতেই পারব না, কী নিয়ে এই রেফারেন্স দেয়া হয়েছে। আমি জানবই না, আমি যে কি জানি না! আমার কেবল বোরিং লাগবে। আর আমি জানবও না, কেন লাগছে!

আমি হ্যারি পটার সংক্রান্ত উপন্যাস নিয়ে কল্পনা করি, হ্যারি ছিল একজন অনাথ। বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুব খারাপ (অনেকটা টম ক্রুজের সিনেমার মতন)। সে কোনো একটা উপায়ে দারিদ্র্য থেকে পালিয়েছে। তারপর সে ঠিক করে সে জাদুকর হবে। তারপর সেখানকার জাদুবিদ্যার কলেজে পড়তে যায়। একদল উদ্ভট জাদুকরের সঙ্গে তার দেখা হয়। হয়তোবা একটা প্রেমেও সে পড়ে, তবে কখনোই প্রেমিকার সঙ্গে হ্যারির যৌনসম্পর্ক হয়নি। হয়তোবা সেখানে আছেন একজন ভালো শিক্ষক, একজন খারাপ শিক্ষক। (আমি নিশ্চিত) তাঁদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত একটা যুদ্ধ হবেই। তারপর হয়তো আমার আগের জানাশোনা তত্ত্বের কিছু খল চরিত্র এসে পরিকল্পনা করবে পৃথিবীকে ধ্বংস করার। সেই জাদুকর ছেলেমেয়েদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড রক্ষা করতে তখন একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। হয়তোবা একটা কলড্রনে তারা কালো বিড়ালদের সেদ্ধ করে ফেলবে, আর বজ্রপাত ছুঁড়ে মারবে টেরোডাকটাইলের (বিলুপ্ত ডাইনোসরের একটি প্রজাতি) দিকে। জীবন নিয়ে, শূন্যতা নিয়ে, নেতৃত্ব নিয়ে বিভিন্ন কিছু শিখে গেল হ্যারি, আর তারপরেও সে বেঁচে রইল। সমাপ্তি।

এখন আমি বুঝি, এসব খুঁটিনাটি নিয়ে আন্দাজ করার দরকার নেই আমার। আমি জানি, ৪০০ পাতার প্লটটা উইকিপিডিয়ার ৪০০ শব্দ দিয়ে জেনে নিতে পারব। একটা হাইস্কুলের ভেতরে গেলেও হবে। নেশা করতে ব্যস্ত না এমন প্রথম যে বাচ্চাটাকে পাব, তাকেই দুয়েকটা প্রশ্ন করে আমি প্লটটা জেনে নিতে পারব। আমি চাইলে সহজে বইগুলো কিনেও নিতে পারি। নিজে নিজে পড়ে ফেলতে পারি। আমি আগেও বলেছি, বইগুলো ভালো হবে বলেই আমার ধারণা। কিন্তু আমি এসবের কিছুই করব না। এটা আমার কাছে দরকারি লাগে না। যদিও আমি জানি, এটা আসলে দরকারি। এই এক আত্মনিহিত দ্বন্দ্ব। মানে, আমাকে কি বইগুলোকে পড়তেই হবে? আমি যদি না চাই তাহলেও? হয়তোবা তা-ই? অনেকভাবেই এই জাতীয় ফেনোমেনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি এসক্যোয়ার থেকে অর্থকড়ি পাই। ধরে নিচ্ছি, ভবিষ্যতেও ঘটনা তা-ই ঘটবে। দীর্ঘ মেয়াদে আমার অর্থনৈতিক সুবিধার কথা মাথায় রেখে হ্যারি পটার পড়াই যায়। হ্যারি পটারকে পাত্তা না দেওয়া, আর আমার ৪০১(কে) নিয়ে বিনিয়োগ না করা তো একই রকম। আমি যদি আরও দায়িত্বশীল নাগরিক হতাম, তাহলে আমি আমাকে এই ঘাড়ে থাকা জাদুকর নিয়ে পাওয়া সবকিছুই জোর করে গেলাতাম। স্রেফ নিজের অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য। তারপরও আমি এটা নিজে নিজে করতে পারছি না। দিনের শেষ (কিংবা শুরু, কিংবা যেকোনো বেলায়) আমি পরোয়া করি না—আমি হ্যারি পটার বুঝিনা।

আমার এই অবস্থান প্রকাশ্যে বলা খুব বিপজ্জনক, আমি জানি। আমি ইচ্ছে করেই আমার নিজের প্রজন্মের সঙ্গে নিজের একটা দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছি। আজ এই সিদ্ধান্ত নিয়ে, আগামী দিনগুলো ভালভাবে পাড়ি দিতে আমি পারব না। বিনোদনের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আমার করা চিন্তাকে বলা হবে সেকেলে, আর আমার সাথে ২০২৫ সালের হিপস্টারদের ভাষার দূরত্বও আমার আর দূর হবে না। আমি হয়ে পড়ব টেরোডাকটাইল, আমি হয়ে যাব নিহত। মাত্র আর কিছু সময়ের অপেক্ষা।

লেখাটি অ্যামেরিকান ম্যাগাজিন এস্কয়্যার- এ প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। স্ট্রিমের জন্য তর্জমা করেছেন শৈলী আখন্দ।

Ad 300x250

মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এনসিপি প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ

জুলাই ঘোষণাপত্রকে ‘প্রতারণা’ আখ্যা দিয়ে ৬০ ছাত্রনেতার প্রত্যাখ্যান

মৃত্যুর আগে শেষ বার্তায় যা লিখেছিলেন আল-জাজিরার সাংবাদিক আনাস

গণতন্ত্রে ফেরার পথে ষড়যন্ত্র হচ্ছে: তারেক রহমান

জুলাই ঘোষণাপত্রে ‘ইতিহাসের অবহেলা’র অভিযোগ, সংশোধনের দাবি

সম্পর্কিত