leadT1ad

যেভাবে এল গর্ভনিরোধ, বাংলাদেশে যে অবস্থা

আজ বিশ্ব গর্ভনিরোধ দিবস। ২০০৭ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য ছিল পরিবার গঠনে ও সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে নারীর অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু কীভাবে এল গর্ভনিরোধ? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গর্ভনিরোধের কী অবস্থা?

প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪: ৪১
যেভাবে এল গর্ভনিরোধ, বাংলাদেশে যে অবস্থা। স্ট্রিম গ্রাফিক

‘ফ্যামিলিস আর ক্রিয়েটেড বাই চয়েস, নট বাই চান্স।’ কথাটা বলেছিলেন ইউএনএফপিএ-এর প্রয়াত এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. নাফিস সাদিক। তাঁর এই কথার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ‘কন্ট্রাসেপশন ডে’ বা গর্ভনিরোধ দিবসের কনসেপ্ট।

২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রথমবার বিশ্বজুড়ে গর্ভনিরোধ দিবস পালিত হয়। জাতিসংঘ, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও বৈজ্ঞানিক কমিটিগুলো অংশ নেয় এতে। এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য ছিল পরিবার গঠনে ও সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে নারীর অধিকার নিশ্চিত করা। শুধু তাই নয়, প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়াও ছিল এর একটি অন্যতম লক্ষ্য।

ইউএনএফপির বরাতে, এই মুহূর্তে বিশ্বের ২৫ কোটির বেশি গর্ভধারণে অনিচ্ছুক নারী কোনোপ্রকার গর্ভনিরোধ সামগ্রী ব্যবহারের সুযোগের বাইরে রয়ে গেছেন। আমাদের মতো দেশে বেশির ভাগ নারী কখন সন্তান নেবেন, কয়টা সন্তান নেবেন, পরিবার কীভাবে গড়বেন—সে বিষয়ে নিজেদের কোনো মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা পান না। এমনকি তাঁদের মতামত গ্রাহ্যও করা হয় না।

নিরাপদ গর্ভধারণ, যৌনরোগ ও সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া এবং গর্ভপাতের সংখ্যা প্রতিরোধ করার জন্য গর্ভনিরোধ প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তাই এটি কেবল নারীর অধিকার নয়, তাঁর সুস্বাস্থ্য ও প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য আবশ্যিকও বটে।

এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় নেমেছেন নারীরা। ছবি: সংগৃহীত
এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় নেমেছেন নারীরা। ছবি: সংগৃহীত

যুগে যুগে গর্ভনিরোধ প্রক্রিয়া

সুপ্রাচীন কাল থেকেই গর্ভনিরোধ প্রক্রিয়া চালু ছিল মানবসমাজে। প্রাচীন মিশরের পেট্রি প্যাপিরাসে (খৃষ্টপূর্ব ১৮৫০) উৎকীর্ণ লিপিতে দেখা গেছে মিশরীয়রা সোডিয়াম কার্বনেট ও মধু মিশ্রিত পেসারি ব্যবহার করত গর্ভনিরোধের জন্য। আরেক জায়গায় কুমিরের নাদি থেকে তৈরি পেস্ট ব্যবহারের প্রমাণ মেলে।

প্রাচীন গ্রিস ও রোমে ব্যবহৃত হতো কপার ও আয়রন সালফেট। গর্ভনিরোধ সামগ্রী আবিস্কারের আগে দম্পতিরা এবসটিনেন্ট পদ্ধতি মানে মাসিকের ক্যালেন্ডার দেখে ওভুলেশনের সময় বাদ দিয়ে যৌন সংসর্গ করা বা কয়টাস ইনটারাপটাস মানে সংসর্গের সময় শুক্রাণু উইথড্র করার মতো পদ্ধতি ব্যবহার করত।

এখনো অনেকেই এই পদ্ধতিগুলো মেনে চলেন। বেশির ভাগ গর্ভনিরোধ সামগ্রীর আবিস্কার উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। যদিও অষ্টাদশ শতাব্দীতে কাসানোভায় ‘রক্ষিতা’ বা মিসট্রেসদের গর্ভধারণ প্রতিরোধে কনডম বা ক্যাপ ব্যবহৃত হত। ১৯০৯ সালে রিচার্ড রিকটার প্রথম সাফল্যের সঙ্গে ইন্ট্রাইউটেরাইন ডিভাইস আবিস্কার করেন।

ইউএনএফপিএর সাম্প্রতিক তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে গর্ভনিরোধ সামগ্রীর ব্যবহারের হার শতকরা ৬২ ভাগ। ২০০৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহারের হার বৃদ্ধি এসে আটকে গেছে ৬ শতাংশে।

কিন্তু খুব দ্রুতই গর্ভনিরোধ সামগ্রীর ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক, সমালোচনা ও প্রতিরোধ শুরু হয় সমাজে। ক্রমে বিষয়টা একটা বিরাট রাজনৈতিক বিতর্কে পরিণত হয়, মূলত ব্রিটেনে। ১৮৭০ সালে পশ্চিমে নারীবাদীরা ভলান্টারি মাদারহুড বা স্বেচ্ছায় মাতৃত্বের অধিকারের আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৮৭৭ সালের জুলাইয়ে আদালতে অ্যানি বেসান্ত ও চার্লস ব্রাডলাফের নোলটনস ট্রায়াল চারদিকে সাড়া ফেলে। জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যাখ্যা নিয়ে রচিত বই ফ্রুটস অব ফিলোসফি প্রকাশের দায়ে তাঁদের আসামি করা হয়।

অ্যানি বেসান্ত আদালতে বলেছিলেন, ‘ভ্রুণ হত্যা, নবজাতক হত্যা এবং খাদ্যের অভাবে সন্তানকে তিলে তিলে হত্যার চাইতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ নৈতিকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য।’ এই ট্রায়ালের পর দিকে দিকে বইটির চাহিদা বাড়তে থাকে এবং গর্ভনিরোধ সামগ্রীর ওপর মানুষের ব্যাপক আগ্রহ গড়ে ওঠে।

১৯১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মার্গারেট স্যাঙ্গার প্রথম একটি বার্থ কনট্রোল ক্লিনিক খোলেন। কিন্তু মাত্র নয় দিনের মাথায় তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি। সাঙ্গারকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু মার্গারেটের পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে, সূত্রপাত হয় বার্থ কন্ট্রোল একটিভিজমের।

জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী আবিস্কার ও বিতরণের জন্য ফান্ড গড়ে উঠতে থাকে দিকে দিকে। ১৯১৮ সালে মেরি স্টো্পস লেখেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘ম্যারিড লাভ’। বইটি প্রথম বছরেই পাঁচবার মুদ্রিত হয়। এর পরে লেখেন ‘ওয়াইজ প্যারেন্টহুড: এ বুক ফর ম্যারিড পিপল’। এ বইটা ছিল আরও জনপ্রিয়।

ভারতীর উপমহাদেশে প্রথম জন্মনিয়ন্ত্রণ ক্লিনিক

মেরি স্টোপস, ডোরা রাসেল, স্টেলা ব্রাউনি প্রমুখ নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্টদের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বৃটিশ কলোনি ভারতীয় উপমহাদেশে গর্ভনিরোধ পদ্ধতি ও সামগ্রী আসে। ১৯২১ সালে প্রবল বিতর্কের মুখে মুম্বাইতে অধ্যাপক রঘুনাথ ধন্দ কার্ভের প্রচেষ্টায় চালু হয় প্রথম জন্মনিয়ন্ত্রণ ক্লিনিক। তিনি একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন ‘সমাজস্বাস্থ্য’ নামে, যেখানে এসব বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হতে থাকে।

গর্ভনিরোধ সামগ্রী ব্যবহার নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, যৌনরোগ প্রতিরোধ, অপরিকল্পিত গর্ভধারণজনিত জটিলতা এবং অনিরাপদ গর্ভপাত প্রতিরোধের জন্য জরুরি। সংগৃহীত ছবি
গর্ভনিরোধ সামগ্রী ব্যবহার নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, যৌনরোগ প্রতিরোধ, অপরিকল্পিত গর্ভধারণজনিত জটিলতা এবং অনিরাপদ গর্ভপাত প্রতিরোধের জন্য জরুরি। সংগৃহীত ছবি

নিজের শরীর ও গর্ভের ওপর নারীর অধিকার গড়ে তুলতে যুগে যুগে এভাবে অ্যাক্টিভিস্ট ও নারীবাদীরা সোচ্চার হয়েছেন। এ এক দীর্ঘ পদযাত্রা যার মাধ্যমে নারীরা নিজের শরিরের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এখনো লড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে কী অবস্থা

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করে। এর ফলে ১৯৭৫ সালে যেখানে প্রজনন হার বা ফার্টিলটি রেট ছিল ৬ দশমিক ৩, সেখানে ১৯৯৪ সালে তা নেমে হয় ৩ দশমিক ৪। আর ২০১১ সালে প্রজনন হার ছিল ২ দশমিক ৩। সেই সঙ্গে অতি দ্রুত কমে আসতে থাকে মাতৃমৃত্যুর হার। এই সাফল্য বিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিতি এনে দেয়।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই অগ্রগতির হার গত ২০-২২ বছরে ক্রমেই থিতিয়ে এসেছে। ইউএনএফপিএর সাম্প্রতিক তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে গর্ভনিরোধ সামগ্রীর ব্যবহারের হার শতকরা ৬২ ভাগ। ২০০৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহারের হার বৃদ্ধি এসে আটকে গেছে ৬ শতাংশে।

দুঃখের বিষয় এই যে বাংলাদেশে ৬২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। আর ২৪ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়সের আগে। এই অল্প বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে গর্ভনিরোধ সামগ্রী ব্যবহারের হার সর্বনিন্ম। ফলে অল্প বয়সে মাতৃত্ব এবং তার দ্বারা জটিলতার হার ক্রমশ বাড়ছে। এর কারণ, বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের মধ্যে এ বিষয়ে অসচেতনতা ও অজ্ঞানতা। গর্ভনিরোধ সামগ্রীর সহজলভ্য নয় তাঁদের কাছে।

নিজের শরীর ও গর্ভের ওপর নারীর অধিকার গড়ে তুলতে যুগে যুগে এভাবে অ্যাক্টিভিস্ট ও নারীবাদীরা সোচ্চার হয়েছেন। এ এক দীর্ঘ পদযাত্রা যার মাধ্যমে নারীরা নিজের শরিরের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এখনো লড়ে যাচ্ছে।

অনিরাপদ গর্ভপাত এখনো বাংলাদেশে ১৩ শতাংশ মাতৃমৃত্যুর কারণ। যা সঠিক সচেতনতা ও বৈজ্ঞানকিভাবে গর্ভনিরোধক ব্যবহারের মাধ্যমে ঠেকানো যেত। এর ফলে ২০১২ সালে লন্ডন সামিট অন ফ্যামিলি প্লানিংয়ে দেওয়া ২০২১ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ গর্ভনিরোধক ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ।

সাম্প্রতিককালে দেশে এ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রচারণা, গর্ভনিরোধক সামগ্রীর সহজলভ্যতা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেবাদানে ভাটা পড়েছ। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী ও নেতিবাচক হতে চলেছে। এগিয়ে যেতে গিয়েও যেন দেশ এভাবে পিছিয়ে পড়তে শুরু করেছে এই ক্ষেত্রে।

কেন জরুরি?

নারীর নিজের গর্ভের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা, পরিবারে নিজের চয়েস বা ইচ্ছের প্রতিফলন প্রকাশের বাইরেও গর্ভনিরোধ সামগ্রী ব্যবহার নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, যৌনরোগ প্রতিরোধ, অপরিকল্পিত গর্ভধারণজনিত জটিলতা এবং অনিরাপদ গর্ভপাত প্রতিরোধের জন্য জরুরি।

তাই এটি কেবল একটি ‘চয়েস’ নয়, নারীস্বাস্থ্যের জন্য একটি খুবই জরুরি বিষয়ও বটে। ‘মাই বডি মাই চয়েস’ কথাকে এখানে প্রায়ই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। এমন ধারণা সমাজে প্রচার করা হয় যে এ কথার অর্থ নারীর স্বেচ্ছাচারিতা। আসলে তা নয়। ‘আমার শরীর, আমার সিদ্ধান্ত’ কথাটির অর্থ হচ্ছে, একজন নারী কখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন, কখন সন্তান নেবেন, কয়টি সন্তান নেবেন, আদৌ নেবেন কি না, আর কী ধরণের গর্ভনিরোধক সামগ্রী ব্যবহার করবেন—সেসব বিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার।

একই সঙ্গে সঠিক তথ্য পাওয়ার এবং সহজে গর্ভনিরোধ সামগ্রী লাভের নিশ্চয়তাও। বিশ্ব গর্ভনিরোধ দিবসে তাই যে শ্লোগান ব্যবহৃত হয় তা হলো, ‘ফ্রিডম টু প্ল্যান, পাওয়ার টু চুজ’। বলা যায়, গর্ভনিরোধের অধিকার নারীর মুক্তি এবং ক্ষমতায়নের একটি অপরিহার্য অংশ।

লেখক: চিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক

Ad 300x250

সম্পর্কিত