মো. ইসতিয়াক
বাংলাদেশের রাজনীতির রঙ যেন সীমান্তে আটকে থাকে না। কিছুদিন আগেও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে দলটির নেতারা বিদেশে গেলে সেখানে জড়ো হতেন বিএনপিসহ বিরোধীদলের নেতাকর্মীরা। বিক্ষোভ করতেন, প্ল্যাকার্ড দেখিয়ে প্রতিবাদ জানাতেন। এখন একই চিত্রে দেখা যায় আওয়ামী লীগের প্রবাসী শাখাগুলোকেও। সরকারের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় মুখ, কিন্তু সংস্কৃতি একই— নিউইয়র্কের এয়ারপোর্টে ডিম নিক্ষেপ কিংবা লন্ডনের রাস্তায় পাল্টাপাল্টি মিছিল।
শুধু বিক্ষোভ-প্রতিবাদ নয়, বিভিন্ন দলীয় ও জাতীয় দিবসগুলোতে কর্মসূচিও পালন করতেও দেখা যায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রবাসী নেতাকর্মীদের। এমনকি সম্প্রতি প্রতিবেশী ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের দলীয় অফিস খোলার খবরও গণমাধ্যমে। গতবছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ থেকে পালিয়ে দেশটিতে অবস্থান করছেন দলটির প্রধান শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতাদের অনেকেই।
প্রতিবেশী ভারত হোক কিংবা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ— যেখানেই উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশি প্রবাসী বাস করেন, সেখানেই দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শাখা আছে। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলের প্রকাশ দেখা যায় তাদের মধ্যেও। অথচ আইন বলছে, কোনো দল বিদেশে শাখা খুলতে পারে না।
প্রশ্ন হলো— এসব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য আসলে কী? এসব কর্মকাণ্ড আসলে কাদের জন্য? প্রবাসীদের কল্যাণে, নাকি কেবল বিদেশের মাটিতে দেশের দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার বোঝা টেনে নিয়ে যাওয়া? নিউইয়র্কের বিমানবন্দরে এনসিপি নেতা আখতার হোসেনের ওপর হামলা এই প্রশ্নকে আরো প্রবল করেছে।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) স্পষ্টভাবে বলে যেকোনো রাজনৈতিক দলের সংবিধানে দেশের বাইরে শাখা রাখার অনুমতি নেই; অর্থাৎ বিদেশে দলীয় শাখা গঠন আইনগতভাবে বৈধ নয়। তবুও আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাসদসহ বড় দলগুলো বিস্তারিতভাবে কেন্দ্রীয় অনুমোদন দিয়ে প্রবাসে কমিটি, সম্মেলন ও মিছিল-সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের নীরবতায় আইনপ্রয়োগ কার্যত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, যারা প্রবাসে সংগঠন চালায় তাদের জন্য হোস্ট-দেশেরও আলাদা নিয়ম-কানুন আছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি এজেন্ট নিবন্ধন আইন (ফারা) অনুযায়ী বিদেশি সাংগঠনিক বা রাজনৈতিক কাজে লিপ্ত হলে নিবন্ধন ও আর্থিক-সাংগঠনিক স্বচ্ছতা বাধ্যতামূলক।
আবার যুক্তরাজ্যে কোম্পানি হাউস বা দাতব্য সংস্থার নিবন্ধন অনুযায়ী, কোনো সংগঠন নন-প্রফিট বা দাতব্য হিসেবে কাজ করতে চাইলে সঠিকভাবে নিবন্ধিত হওয়া লাগে, আর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করলে সেটি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হয়। কিন্তু প্রবাসী আওয়ামী লীগ বা বিএনপির শাখাগুলো অনেক সময় সাংস্কৃতিক সংগঠনের নামে নিবন্ধন করলেও কার্যত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালায়।
আর তাই এগুলো আইনি কাঠামোর বাইরে থেকে ‘ধূসর’ এলাকায় টিকে থাকে, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার কিংবা জরিমানাসহ জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের আইন ও রাজনৈতিক দল নিবন্ধনবিধি পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় পরিষ্কার কোনো রাজনৈতিক দলের বিদেশে শাখা খোলার অনুমোদন নেই। রাজনৈতিক দলগুলো দেশের অভ্যন্তরে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালাবে — এটিই আইন ও সংবিধানের মূল ভাব। অর্থাৎ, বিদেশে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নামে শাখা গঠনের বৈধতা আইনেই নেই।
প্রবাসী শাখার নেতারা যুক্তি দেন, তাঁরা জাতীয় দিবস পালন করেন, প্রবাসীদের সংগঠিত রাখেন এবং দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
বেশির ভাগ কর্মকাণ্ড সীমিত থাকে নেতাদের ব্যক্তিগত সুবিধা হাসিল, কেন্দ্রীয় নেতাদের বিদেশ সফরে অভ্যর্থনা দেওয়া কিংবা বিমানবন্দর ঘেরাও করার মতো কর্মসূচিতে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রকৃত কল্যাণ বা অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে এসব শাখার কার্যত কোনো ভূমিকা নেই। বরং বিভাজন, সংঘর্ষ ও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে তারা বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ায়। এর পাশাপাশি আর্থিক দিকও একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রবাসী সংগঠনগুলোর অন্যতম কাজ হলো অর্থ সংগ্রহ, বিশেষ করে সরকারি দলের শাখাগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে বিপুল অর্থ দেশে পাঠায়, যা নির্বাচনী তহবিল হিসেবে ব্যবহার হয়। অথচ এই অর্থ কোথা থেকে আসে, কীভাবে স্থানান্তর হয়, তার স্বচ্ছতা কোথাও নেই। বেশিরভাগ সময় প্রবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা, অনুদান কিংবা অনুষ্ঠানের নামে অর্থ সংগ্রহ করা হয়, আর অভিযোগ আছে যে এই অর্থ সংগ্রহ প্রায়শই চাপের মাধ্যমে হয় ‘দলীয় কর্মী’ পরিচয়ে ব্যবসায়ী বা রেস্টুরেন্ট মালিকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়। অনেক প্রবাসী এ কারণে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন।
আন্তর্জাতিকভাবে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি এজেন্ট নিবন্ধন আইন (ফারা) অথবা যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক দল, নির্বাচন ও গণভোট আইন অনুযায়ী বিদেশি রাজনৈতিক দানের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম বিদ্যমান। কিন্তু বাংলাদেশের দলগুলো এসব আইন এড়িয়ে চলে, যা ভবিষ্যতে বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঝুঁকি তৈরি করছে।
প্রশ্ন আসে, অন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কি বিদেশে এমন শাখা পরিচালনা করে? ভারতের কথা ধরা যাক। কোটি কোটি ভারতীয় প্রবাসী থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বা কংগ্রেস বিদেশে দলীয় শাখা খোলেনি। বরং প্রবাসীরা স্থানীয়ভাবে সাংস্কৃতিক সংগঠন বা প্রবাসী কল্যাণ সংগঠন গড়ে তোলে, যেখানে দেশীয় সংস্কৃতি প্রচার, ভাষা শিক্ষা কিংবা মানবিক সহায়তাই প্রধান কাজ।
পাকিস্তান বা নেপালের ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা। দলীয় রাজনীতি বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া নয়, বরং প্রবাসীদের ঐক্য বজায় রেখে মাতৃভূমির ভাবমূর্তি উন্নত করাই মূল লক্ষ্য। অথচ বাংলাদেশের দলগুলো সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হেঁটেছে।
বিদেশে বাংলাদেশিরা সাধারণত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য বা মানবিক উদ্যোগের মাধ্যমে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রবাসী রাজনৈতিক শাখাগুলো এই ঐক্যকে ভেঙে দিয়েছে। লন্ডনে দেখা গেছে, একই শহরে দুটি ‘বাংলাদেশি কমিউনিটি সেন্টার’ একটি আওয়ামী লীগ-ঘেঁষা, অন্যটি বিএনপি-ঘেঁষা।
নিউইয়র্কে জাতীয় দিবস পালনে একই দিনে আলাদা অনুষ্ঠান হয়, যেখানে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে অবজ্ঞা করে। এমনকি দুবাইয়ের প্রবাসী শ্রমিক সমাজেও এই বিভাজন ছড়িয়ে পড়েছে, যার ফলে শ্রমজীবী প্রবাসীরা নিজেদের অধিকার রক্ষার পরিবর্তে রাজনৈতিক পোস্টার টানায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে প্রবাসীদের সম্মিলিত পরিচয় ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এবং বিদেশি সমাজে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিভক্ত ও নেতিবাচক হয়ে উঠছে।
এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সরাসরি প্রভাব পড়ছে প্রবাসী সমাজে। একই ভাষা, সংস্কৃতি ও পাসপোর্টধারী মানুষ দলীয় লাইন অনুসারে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। লন্ডনের বাংলাদেশি সম্প্রদায় বা নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমাবেশ প্রায়ই হাতাহাতিতে গড়াত।
এতে স্থানীয় মিডিয়ায় নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ পায়, যা বাংলাদেশিদের সুনাম নষ্ট করে। অথচ প্রবাসীদের একটাই পরিচয় থাকা উচিত বাংলাদেশি। যদি তারা দেশের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতেন, তাহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিদেশে উজ্জ্বল হতো। কিন্তু দলীয় বিভক্তি সেই সুযোগটিকে নষ্ট করছে।
বিদেশের মাটিতে গিয়ে অন্য দেশের আইন ভাঙা, গোলযোগ সৃষ্টি করা বা স্থানীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অচল করে দেওয়া নৈতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য?
অনেক সময় দেখা যায়, এয়ারপোর্ট অবরোধ বা রাস্তায় মিছিলের কারণে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ লাগে। এতে শুধু বাংলাদেশের ভাবমূর্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, ব্যক্তিগতভাবে প্রবাসীদেরও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ফলে নৈতিক প্রশ্ন থেকেই যায়, যে কর্মকাণ্ডে দেশের কোনো লাভ নেই, বরং ক্ষতি বাড়ছে, তা কি রাজনৈতিক কর্মসূচি নামে চালানো উচিত?
বিদেশে বসে দলীয় রাজনীতি করার পরিবর্তে প্রবাসীদের উচিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, বাংলাদেশি সংস্কৃতি প্রচার, মাতৃভূমির সংকটে মানবিক সহায়তা এসব কাজে তাদের শক্তি খরচ হওয়া উচিত।
রাজনৈতিক নেতারাও সচেতন হতে পারেন বিদেশে বিভাজন তৈরি করে তাঁরা দেশের কোনো উপকার করছেন না; বরং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, প্রবাসীরা বিব্রত হচ্ছেন। একটি নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন।
নির্বাচন কমিশনকে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে এবং অবৈধ বিদেশি শাখাগুলোকে দলীয় সংবিধান থেকে বাদ দিতে হবে। বিদেশে কোনো সংগঠন থাকলে তা স্থানীয় আইনে সাংস্কৃতিক বা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধন করতে হবে।
সংগঠনের অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয় স্বচ্ছ হতে হবে, অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করা জরুরি। রাজনৈতিক বিভাজনের বদলে প্রবাসীদের ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগে উৎসাহ দেওয়া এবং দলের শীর্ষ নেতাদের সফরের সময় কর্মীদের উত্তেজিত না করে সংযত থাকা প্রয়োজন।
প্রবাসী রাজনীতি বাংলাদেশের জন্য এক দ্বিমুখী তলোয়ার। একদিকে এটি দেশপ্রেম ও সংযোগের অনুভূতি জাগায়, অন্যদিকে বিভাজন, সহিংসতা ও ভাবমূর্তি নষ্ট করে। আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ, সামাজিকভাবে বিভেদ সৃষ্টিকারী, অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছ এবং কূটনৈতিকভাবে ক্ষতিকর এই চার দিক থেকেই প্রবাসী রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ। তাই সবার আগে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি প্রবাসের মাটিতে ‘আওয়ামী লীগার’ বা ‘বিএনপি কর্মী’ হয়ে থাকব? নাকি আগে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়টাকে অগ্রাধিকার দেব? দেশের সুনাম, প্রবাসীদের মর্যাদা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে উত্তরটি স্পষ্ট হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের রাজনীতির রঙ যেন সীমান্তে আটকে থাকে না। কিছুদিন আগেও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে দলটির নেতারা বিদেশে গেলে সেখানে জড়ো হতেন বিএনপিসহ বিরোধীদলের নেতাকর্মীরা। বিক্ষোভ করতেন, প্ল্যাকার্ড দেখিয়ে প্রতিবাদ জানাতেন। এখন একই চিত্রে দেখা যায় আওয়ামী লীগের প্রবাসী শাখাগুলোকেও। সরকারের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় মুখ, কিন্তু সংস্কৃতি একই— নিউইয়র্কের এয়ারপোর্টে ডিম নিক্ষেপ কিংবা লন্ডনের রাস্তায় পাল্টাপাল্টি মিছিল।
শুধু বিক্ষোভ-প্রতিবাদ নয়, বিভিন্ন দলীয় ও জাতীয় দিবসগুলোতে কর্মসূচিও পালন করতেও দেখা যায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রবাসী নেতাকর্মীদের। এমনকি সম্প্রতি প্রতিবেশী ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের দলীয় অফিস খোলার খবরও গণমাধ্যমে। গতবছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ থেকে পালিয়ে দেশটিতে অবস্থান করছেন দলটির প্রধান শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতাদের অনেকেই।
প্রতিবেশী ভারত হোক কিংবা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ— যেখানেই উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশি প্রবাসী বাস করেন, সেখানেই দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শাখা আছে। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলের প্রকাশ দেখা যায় তাদের মধ্যেও। অথচ আইন বলছে, কোনো দল বিদেশে শাখা খুলতে পারে না।
প্রশ্ন হলো— এসব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য আসলে কী? এসব কর্মকাণ্ড আসলে কাদের জন্য? প্রবাসীদের কল্যাণে, নাকি কেবল বিদেশের মাটিতে দেশের দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার বোঝা টেনে নিয়ে যাওয়া? নিউইয়র্কের বিমানবন্দরে এনসিপি নেতা আখতার হোসেনের ওপর হামলা এই প্রশ্নকে আরো প্রবল করেছে।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) স্পষ্টভাবে বলে যেকোনো রাজনৈতিক দলের সংবিধানে দেশের বাইরে শাখা রাখার অনুমতি নেই; অর্থাৎ বিদেশে দলীয় শাখা গঠন আইনগতভাবে বৈধ নয়। তবুও আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাসদসহ বড় দলগুলো বিস্তারিতভাবে কেন্দ্রীয় অনুমোদন দিয়ে প্রবাসে কমিটি, সম্মেলন ও মিছিল-সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের নীরবতায় আইনপ্রয়োগ কার্যত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, যারা প্রবাসে সংগঠন চালায় তাদের জন্য হোস্ট-দেশেরও আলাদা নিয়ম-কানুন আছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি এজেন্ট নিবন্ধন আইন (ফারা) অনুযায়ী বিদেশি সাংগঠনিক বা রাজনৈতিক কাজে লিপ্ত হলে নিবন্ধন ও আর্থিক-সাংগঠনিক স্বচ্ছতা বাধ্যতামূলক।
আবার যুক্তরাজ্যে কোম্পানি হাউস বা দাতব্য সংস্থার নিবন্ধন অনুযায়ী, কোনো সংগঠন নন-প্রফিট বা দাতব্য হিসেবে কাজ করতে চাইলে সঠিকভাবে নিবন্ধিত হওয়া লাগে, আর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করলে সেটি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হয়। কিন্তু প্রবাসী আওয়ামী লীগ বা বিএনপির শাখাগুলো অনেক সময় সাংস্কৃতিক সংগঠনের নামে নিবন্ধন করলেও কার্যত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালায়।
আর তাই এগুলো আইনি কাঠামোর বাইরে থেকে ‘ধূসর’ এলাকায় টিকে থাকে, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার কিংবা জরিমানাসহ জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের আইন ও রাজনৈতিক দল নিবন্ধনবিধি পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় পরিষ্কার কোনো রাজনৈতিক দলের বিদেশে শাখা খোলার অনুমোদন নেই। রাজনৈতিক দলগুলো দেশের অভ্যন্তরে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালাবে — এটিই আইন ও সংবিধানের মূল ভাব। অর্থাৎ, বিদেশে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নামে শাখা গঠনের বৈধতা আইনেই নেই।
প্রবাসী শাখার নেতারা যুক্তি দেন, তাঁরা জাতীয় দিবস পালন করেন, প্রবাসীদের সংগঠিত রাখেন এবং দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
বেশির ভাগ কর্মকাণ্ড সীমিত থাকে নেতাদের ব্যক্তিগত সুবিধা হাসিল, কেন্দ্রীয় নেতাদের বিদেশ সফরে অভ্যর্থনা দেওয়া কিংবা বিমানবন্দর ঘেরাও করার মতো কর্মসূচিতে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রকৃত কল্যাণ বা অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে এসব শাখার কার্যত কোনো ভূমিকা নেই। বরং বিভাজন, সংঘর্ষ ও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে তারা বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ায়। এর পাশাপাশি আর্থিক দিকও একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রবাসী সংগঠনগুলোর অন্যতম কাজ হলো অর্থ সংগ্রহ, বিশেষ করে সরকারি দলের শাখাগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে বিপুল অর্থ দেশে পাঠায়, যা নির্বাচনী তহবিল হিসেবে ব্যবহার হয়। অথচ এই অর্থ কোথা থেকে আসে, কীভাবে স্থানান্তর হয়, তার স্বচ্ছতা কোথাও নেই। বেশিরভাগ সময় প্রবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা, অনুদান কিংবা অনুষ্ঠানের নামে অর্থ সংগ্রহ করা হয়, আর অভিযোগ আছে যে এই অর্থ সংগ্রহ প্রায়শই চাপের মাধ্যমে হয় ‘দলীয় কর্মী’ পরিচয়ে ব্যবসায়ী বা রেস্টুরেন্ট মালিকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়। অনেক প্রবাসী এ কারণে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন।
আন্তর্জাতিকভাবে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি এজেন্ট নিবন্ধন আইন (ফারা) অথবা যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক দল, নির্বাচন ও গণভোট আইন অনুযায়ী বিদেশি রাজনৈতিক দানের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম বিদ্যমান। কিন্তু বাংলাদেশের দলগুলো এসব আইন এড়িয়ে চলে, যা ভবিষ্যতে বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঝুঁকি তৈরি করছে।
প্রশ্ন আসে, অন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কি বিদেশে এমন শাখা পরিচালনা করে? ভারতের কথা ধরা যাক। কোটি কোটি ভারতীয় প্রবাসী থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বা কংগ্রেস বিদেশে দলীয় শাখা খোলেনি। বরং প্রবাসীরা স্থানীয়ভাবে সাংস্কৃতিক সংগঠন বা প্রবাসী কল্যাণ সংগঠন গড়ে তোলে, যেখানে দেশীয় সংস্কৃতি প্রচার, ভাষা শিক্ষা কিংবা মানবিক সহায়তাই প্রধান কাজ।
পাকিস্তান বা নেপালের ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা। দলীয় রাজনীতি বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া নয়, বরং প্রবাসীদের ঐক্য বজায় রেখে মাতৃভূমির ভাবমূর্তি উন্নত করাই মূল লক্ষ্য। অথচ বাংলাদেশের দলগুলো সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হেঁটেছে।
বিদেশে বাংলাদেশিরা সাধারণত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য বা মানবিক উদ্যোগের মাধ্যমে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রবাসী রাজনৈতিক শাখাগুলো এই ঐক্যকে ভেঙে দিয়েছে। লন্ডনে দেখা গেছে, একই শহরে দুটি ‘বাংলাদেশি কমিউনিটি সেন্টার’ একটি আওয়ামী লীগ-ঘেঁষা, অন্যটি বিএনপি-ঘেঁষা।
নিউইয়র্কে জাতীয় দিবস পালনে একই দিনে আলাদা অনুষ্ঠান হয়, যেখানে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে অবজ্ঞা করে। এমনকি দুবাইয়ের প্রবাসী শ্রমিক সমাজেও এই বিভাজন ছড়িয়ে পড়েছে, যার ফলে শ্রমজীবী প্রবাসীরা নিজেদের অধিকার রক্ষার পরিবর্তে রাজনৈতিক পোস্টার টানায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে প্রবাসীদের সম্মিলিত পরিচয় ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এবং বিদেশি সমাজে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিভক্ত ও নেতিবাচক হয়ে উঠছে।
এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সরাসরি প্রভাব পড়ছে প্রবাসী সমাজে। একই ভাষা, সংস্কৃতি ও পাসপোর্টধারী মানুষ দলীয় লাইন অনুসারে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। লন্ডনের বাংলাদেশি সম্প্রদায় বা নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমাবেশ প্রায়ই হাতাহাতিতে গড়াত।
এতে স্থানীয় মিডিয়ায় নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ পায়, যা বাংলাদেশিদের সুনাম নষ্ট করে। অথচ প্রবাসীদের একটাই পরিচয় থাকা উচিত বাংলাদেশি। যদি তারা দেশের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতেন, তাহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিদেশে উজ্জ্বল হতো। কিন্তু দলীয় বিভক্তি সেই সুযোগটিকে নষ্ট করছে।
বিদেশের মাটিতে গিয়ে অন্য দেশের আইন ভাঙা, গোলযোগ সৃষ্টি করা বা স্থানীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অচল করে দেওয়া নৈতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য?
অনেক সময় দেখা যায়, এয়ারপোর্ট অবরোধ বা রাস্তায় মিছিলের কারণে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ লাগে। এতে শুধু বাংলাদেশের ভাবমূর্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, ব্যক্তিগতভাবে প্রবাসীদেরও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ফলে নৈতিক প্রশ্ন থেকেই যায়, যে কর্মকাণ্ডে দেশের কোনো লাভ নেই, বরং ক্ষতি বাড়ছে, তা কি রাজনৈতিক কর্মসূচি নামে চালানো উচিত?
বিদেশে বসে দলীয় রাজনীতি করার পরিবর্তে প্রবাসীদের উচিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, বাংলাদেশি সংস্কৃতি প্রচার, মাতৃভূমির সংকটে মানবিক সহায়তা এসব কাজে তাদের শক্তি খরচ হওয়া উচিত।
রাজনৈতিক নেতারাও সচেতন হতে পারেন বিদেশে বিভাজন তৈরি করে তাঁরা দেশের কোনো উপকার করছেন না; বরং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, প্রবাসীরা বিব্রত হচ্ছেন। একটি নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন।
নির্বাচন কমিশনকে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে এবং অবৈধ বিদেশি শাখাগুলোকে দলীয় সংবিধান থেকে বাদ দিতে হবে। বিদেশে কোনো সংগঠন থাকলে তা স্থানীয় আইনে সাংস্কৃতিক বা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধন করতে হবে।
সংগঠনের অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয় স্বচ্ছ হতে হবে, অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করা জরুরি। রাজনৈতিক বিভাজনের বদলে প্রবাসীদের ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগে উৎসাহ দেওয়া এবং দলের শীর্ষ নেতাদের সফরের সময় কর্মীদের উত্তেজিত না করে সংযত থাকা প্রয়োজন।
প্রবাসী রাজনীতি বাংলাদেশের জন্য এক দ্বিমুখী তলোয়ার। একদিকে এটি দেশপ্রেম ও সংযোগের অনুভূতি জাগায়, অন্যদিকে বিভাজন, সহিংসতা ও ভাবমূর্তি নষ্ট করে। আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ, সামাজিকভাবে বিভেদ সৃষ্টিকারী, অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছ এবং কূটনৈতিকভাবে ক্ষতিকর এই চার দিক থেকেই প্রবাসী রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ। তাই সবার আগে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি প্রবাসের মাটিতে ‘আওয়ামী লীগার’ বা ‘বিএনপি কর্মী’ হয়ে থাকব? নাকি আগে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়টাকে অগ্রাধিকার দেব? দেশের সুনাম, প্রবাসীদের মর্যাদা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে উত্তরটি স্পষ্ট হওয়া উচিত।
ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে দুটিতে ছবিতে চোখ আটকে গেল। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, মার্কিন প্রেসিডেন্টে ডোনাল্ড ট্রাম্প, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেফ তাইয়্যেপ এরদোয়ান, কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল থানি এবং সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান এক সঙ্গে এক টেবি
৩১ মিনিট আগেপাহাড়ি জনপদে ধর্ষণ কি খুব সহজ হয়ে উঠেছে? প্রশ্ন জাগল। কারণ, কিছুদিন পরপরই পার্বত্য অঞ্চল থেকে গণমাধ্যমে উঠে আসছে বিভীষিকাময় সব ধর্ষণের খবর। ২০১৮ সালে ২২ জানুয়ারি রাঙামাটির বিলাইছড়িতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন দুই মারমা তরুণী। এ বছর ১৮ জুলাই বিবিসি বাংলা ছেপেছিল ‘দলবদ্ধ ধর্ষণে’র একটি বিশ্লেষণী সংবাদ।
১ ঘণ্টা আগেএই বছর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের সময় প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে ছয় প্রভাবশালী রাজনীতিক নিউ ইয়র্কে উপস্থিত রয়েছেন। অধিবেশনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে একটি বিশেষ বৈঠকেও অংশ নেবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
২ ঘণ্টা আগেআওয়ামী লীগের রুদ্ধ শাসনামলে দেশের ভেতর কথা বলা যেত না, রাজনীতি করা যেত না বলেই বিদেশে বসে বা বিদেশে গিয়ে অ্যাক্টিভিজম হয়েছে, রাজনীতি হয়েছে, কূটনীতি হয়েছে, এমনকি সাংবাদিকতা হয়েছে। শেখ হাসিনা বিদেশে সফরে গেলে বিশেষত লন্ডন ও নিউইয়র্কে বিএনপিপন্থী প্রবাসীরা প্রতিবাদ জানাতেন।
১ দিন আগে