leadT1ad

বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের নাম কেন ‘হোন্ডা’

‘দুইটা হোন্ডা, ছয়টা গুন্ডা, সবকিছু ঠান্ডা’ কিংবা ‘হোন্ডা-গুন্ডার রাজনীতি’ কথাগুলো প্রায়ই শোনা যায়। এখানে ‘হোন্ডা’ মানে মোটরসাইকেল। আজও গ্রাম থেকে শহর, বহু মানুষের কাছে যেকোনো কোম্পানির মোটরসাইকেলই ‘হোন্ডা’ নামে পরিচিত। সত্তর-আশি এমনকি নব্বইয়ের দশকে হোন্ডা ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড। ১৯৪৮ সালের আজকের এই দিনে (২৪ সেপ্টেম্বর) জাপানে চালু হয়েছিল হোন্ডা মোটর কোম্পানি। কিন্তু কেন ও কীভাবে বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের প্রতিশব্দ হয়ে উঠল হোন্ডা?

তাহমীদ চৌধুরী
বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের নাম কেন ‘হোন্ডা’। স্ট্রিম গ্রাফিক

আশির দশকের শেষভাগ। মানিকগঞ্জের কোনো এক জমজমাট পাটের হাট। সবেমাত্র মৌসুমের সেরা দামে পাট বিক্রি করে এক কৃষকের মুখে ফুটে উঠেছে তৃপ্তির হাসি। আড়তদার তাঁর হাতে টাকা তুলে দিয়ে পরামর্শের সুরে বললেন, ‘মিয়া, বাকি টাকা দিয়া একখান হোন্ডা কিনেন। খেতও দেখলেন, বাজারও ধরলেন।’

এই সংক্ষিপ্ত কথোপকথনটি আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ মনে হলেও, এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, আড়তদার ‘মোটরসাইকেল’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তিনি বাহনটিকে ‘হোন্ডা’ নামে সম্বোধন করেছেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি এটিকে বিলাসিতার বস্তু নয়, বরং কৃষি ও বাণিজ্যের একটি অপরিহার্য সরঞ্জাম হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

ভাষাবিজ্ঞানে ‘ব্র্যান্ড জেনেরিসাইড’ একটি পরিচিত ধারণা। যেখানে একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের নাম এতটাই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে সেটা সেই ধরনের সমগ্র পণ্য শ্রেণিকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হতে শুরু করে। বাংলাদেশের সামাজিক ও ভাষাগত ইতিহাসে এর শক্তিশালী উদাহরণ ‘হোন্ডা’। কয়েক দশক ধরে এদেশের সাধারণ মানুষের কাছে দুই চাকার ইঞ্জিনচালিত বাহনটি ‘মোটরসাইকেল’ নামের চেয়ে ‘হোন্ডা’ নামে অধিক পরিচিত।

কিন্তু কীভাবে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নাম মানুষের কাছে একটি সম্পূর্ণ পণ্যশ্রেণির প্রতিশব্দ হয়ে ওঠে? কীভাবে বাংলাদেশে মোটরসাইকেল জনসাধারণের কাছে 'হোন্ডা' হয়ে উঠল?

সত্তর দশকে পত্রিকায় হোন্ডার বিজ্ঞাপন। ফেসবুক থেকে নেওয়া ছবি
সত্তর দশকে পত্রিকায় হোন্ডার বিজ্ঞাপন। ফেসবুক থেকে নেওয়া ছবি

হোন্ডার জন্ম ও বৈশ্বিক উত্থান

১৯৪৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরের কথা। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জাপানের পুনর্গঠনের সময়। জাপানের প্রকৌশলী সইচিরো হোন্ডা স্বপ্ন দেখতেন সাধারণ মানুষের জন্য সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য পরিবহনের। সেই স্বপ্ন থেকেই আজকের এই দিনে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন হোন্ডা মোটর কোম্পানির।

কোম্পানি চালু করার এক বছরের মধ্যেই বাজারে আসে মোটরসাইকেল। নাম ‘ড্রিম ডি-টাইপ’। এরপর বিশ্বব্যাপী হোন্ডাকে পরিচিত করে তোলে ১৯৫৮ সালে বাজারে আসা ‘হোন্ডা সুপার কাব’ মডেলটি। সহজ ব্যবহার, বেশি মাইলেজ এবং মজবুত গঠনের কারণে এটি ইতিহাসের সর্বাধিক বিক্রিত মোটরযানে পরিণত হয়। এখন পর্যন্ত এই বাইকটি ১১০ মিলিয়নেরও বেশি ইউনিট বিক্রি হয়েছে। এরপর ১৯৬৯ সালে চার-সিলিন্ডার ইঞ্জিনের সিবি৭৫০ মডেল এনে মোটরসাইকেলের জগতে বিপ্লব নিয়ে আসে হোন্ডা।

বাংলাদেশের জরুরত ও হোন্ডার আগমন

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ ছিল এক সম্ভাবনাময় কিন্তু বিপর্যস্ত ভূখণ্ড। দেশের অর্থনীতি ছিল কৃষিভিত্তিক। কিন্তু গ্রামীণ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে শহুরে বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করার মতো অবকাঠামো ছিল প্রায় অনুপস্থিত। ভাঙাচোরা রাস্তা, অপ্রতুল গণপরিবহন এবং দুর্বল যোগাযোগব্যবস্থা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে ছিল বিশাল প্রতিবন্ধকতা।

১৯৭০-৮০-এর দশকে, এই পরিস্থিতিতে একজন স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য প্রত্যন্ত গ্রামে চিকিৎসা সেবা দেওয়া কিংবা একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জন্য নিজের কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানোর মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি নির্ভরযোগ্য, সাশ্রয়ী এবং সহজে পরিচালনযোগ্য বাহনের চাহিদা ছিল তীব্র।

আশির দশকে এটলাস মটরসের কারখানায় হোন্ডা মটরসাইকেল এসেম্বল চলছে। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
আশির দশকে এটলাস মটরসের কারখানায় হোন্ডা মটরসাইকেল এসেম্বল চলছে। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

এই শূন্যস্থান পূরণের জন্যই মোটরসাইকেলের বিক্রি শুরু হয় এবং সেই মঞ্চে হোন্ডা তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান তৈরি করে নেয়। সত্তরের দশকের শেষভাগ এবং আশির দশকে হোন্ডার সিডিআই ১০০, হোন্ডা ৫০ এবং সিজি ১২৫ মডেলগুলো দেশের গ্রামীণ ও শহরের রাস্তায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে।

বিশেষ করে গ্রামীণ কাঁচা ও ভাঙা রাস্তার জন্য হোন্ডার মজবুত ‘বিল্ড কোয়ালিটি’ এবং কম রক্ষণাবেক্ষণ খরচের বিষয়টি ব্যবহারকারীদের কাছে একে অপরিহার্য করে তোলে। এই দীর্ঘস্থায়ী পারফরম্যান্সের কারণেই মানুষের মনে মোটরসাইকেল মানেই হোন্ডা—এই ধারণাটি গেঁথে যায়। আবার তখন এই কোম্পানির বাইরে তেমন জনপ্রিয় মোটরবাইক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অবস্থান তেমন পাকাপোক্ত ছিল না। হোন্ডা এমন এক ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করে যে অন্য কোম্পানির মোটরসাইকেলকেও সাধারণ মানুষ ‘হোন্ডা’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করে।

হোন্ডার ম্যাজিকটা কী?

যেকোনো পণ্যের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য নির্ভর করে বাজারের চাহিদার সঙ্গে তার উপযোগিতার ওপর, যা ‘প্রোডাক্ট-মার্কেট ফিট’ নামে পরিচিত। হোন্ডার আশির দশকের মডেলগুলো, বিশেষত সিডিআই ১০০ ও সিজি ১২৫ ছিল সেই সময়ের প্রকৌশলগত উপযোগিতার দারুণ উদাহরণ। বাংলাদেশের কাঁচা, কর্দমাক্ত এবং উঁচু-নিচু রাস্তায় চলার জন্য যে ধরনের মজবুত চেসিস, শক্তিশালী সাসপেনশন এবং সহনশীল ইঞ্জিন প্রয়োজন ছিল, হোন্ডার এই মডেলগুলোতে তার সব কটিই উপস্থিত ছিল।

হোন্ডা সিজি ১২৫ এক্ষেত্রে একটি আদর্শ কেস স্টাডি। ১৯৭৬ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিকূল পরিবেশের কথা মাথায় রেখেই এর ওভারহেড ভালভ ইঞ্জিনটি ডিজাইন করা হয়। এই ইঞ্জিনের গঠন ছিল অত্যন্ত সরল, কিন্তু কার্যকারিতা ছিল অসাধারণ। রক্ষণাবেক্ষণ খরচও তুলনামূলকভাবে অনেক কম ছিল। এই প্রকৌশলগত নির্ভরযোগ্যতা হোন্ডাকে ব্যবহারকারীদের কাছে প্রশ্নাতীত আস্থা অর্জনে সহায়তা করেছিল।

হোন্ডা মোটরসাইকেলে চড়ে আছেন নাট্যকার বৃন্দাবন দাস এবং শাহনাজ খুশি। নব্বই দশকের ছবি। ছবি: সংগৃহীত
হোন্ডা মোটরসাইকেলে চড়ে আছেন নাট্যকার বৃন্দাবন দাস এবং শাহনাজ খুশি। নব্বই দশকের ছবি। ছবি: সংগৃহীত

অন্যদিকে, সেই সময়ে হোন্ডা মোটরসাইকেলের ‘পার্টস এসেম্বল’ বাংলাদেশেই হতো। আর এর যন্ত্রাংশ ছিল বেশ সহজলভ্য। রাজধানী থেকে শুরু করে মফসসলেও এর স্পেয়ার পার্টস পাওয়া যেত। এর ফলে, স্থানীয় মোটর মেকানিকরা সহজেই হোন্ডার মোটরবাইক মেরামত কিংবা পার্টস রিপ্লেস করতে পারতেন।

আস্থার অর্থনীতি

যখন গণমাধ্যম কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রভাব আজকের মতো ছিল না, তখন সবচেয়ে শক্তিশালী বিপণন মাধ্যম ছিল মানুষের মুখের কথা বা জনশ্রুতি। হোন্ডা মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে এই ‘মাউথ টু মাউথ’ বিজ্ঞাপন ছিল আশীর্বাদ। এর স্থায়িত্ব ও নির্ভরযোগ্যতার গল্প মানুষের মুখে মুখে ফিরত। একজন ব্যবহারকারীর ইতিবাচক অভিজ্ঞতাই অন্য দশজন সম্ভাব্য ক্রেতাকে প্রভাবিত করত।

এই ‘অর্গানিক’ প্রচারণার ফলে হোন্ডা ব্র্যান্ডটি ধীরে ধীরে একটি ‘কাল্ট স্ট্যাটাস’ লাভ করে। যখন একটি পণ্য দশকের পর দশক ধরে বাজারের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং সবচেয়ে দৃশ্যমান বিকল্প হিসেবে টিকে থাকে, তখন মানুষের মনস্তত্ত্বে সেই পণ্যের নামটিই সমগ্র শ্রেণির পরিচায়ক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক এই প্রক্রিয়াতেই ‘হোন্ডা’ শব্দটি ‘মোটরসাইকেল’-এর ‘জেনেরিক নেম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ বাজারে বহু মোটসাইকেল ব্র্যান্ডের সমাহার, তবুও ‘হোন্ডা’ শব্দটি এখনো বাংলাদেশের বহু মানুষের কাছে মোটরসাইকেলের সমার্থক।

Ad 300x250

সম্পর্কিত