leadT1ad

নির্বাচনে আরও কার্যকর হতে বিচারিক ক্ষমতা চায় সেনাবাহিনী

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা

প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ০০: ১০
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নিরাপত্তা–ঝুঁকি ও অপতৎপরতা প্রতিরোধে সেনাবাহিনীকে আরও কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তাদের বক্তব্য, নির্বাচনকালে কেন্দ্র দখল, হামলা, ব্যালট ছিনতাই বা সাইবার-প্রভাবিত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তাৎক্ষণিক আইনগত অ্যাকশন নিতে এই ক্ষমতা দিলে দ্রুততা ও কার্যকারিতা বাড়বে। নির্বাচনের প্রাকপ্রস্তুতি সভার এক কার্যবিবরণীতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

কার্যবিবরণী অনুসারে ৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনী বাংলাদেশে সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা ক্ষমতার অধীনে নিযুক্ত আছে। পরে একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সরকার সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান করে। যদিও নির্বাচন কমিশনারদের একজন মত দিয়েছেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী কমিশন নিজে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিতে পারে না।

গতকাল রোববার (৯ নভেম্বর) নির্বাচন কমিশনের উপসচিব মো. মনির হোসেন সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মতবিনিময় সভার কার্যবিবরণীতে এ বিষয়গুলো উল্লেখ করেন। এই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই চেক পয়েন্ট বসিয়ে প্রয়োজনে বর্ডার ও সি-রুট সিল করা, দেশকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন—তিন জোনে ভাগ করে নিরাপত্তার পরিকল্পনা সাজানোসহ ২২টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

ইসি সূত্র জানায়, সংসদ নির্বাচন নিয়ে কয়েক দফায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে। এরই অংশ হিসাবে ২০ অক্টোবর ইসিতে প্রথম বৈঠক হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এম এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রুদ্ধদ্বার ওই বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন। গত ৯ নভেম্বর ওই বৈঠকের কার্যবিবরণী সংশ্লিষ্ট সবার কাছে পাঠানো হয়েছে। চলতি মাসে আরেকবার এ ধরনের বৈঠক হওয়ার কথা আছে।

কার্যবিবরণীতে বলা হয়, নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপর হামলা, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, ভোটগ্রহণে বাধা, কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ওপর হামলা— এসব ঝুঁকি এড়াতে নির্বাচনের দিনসহ মোট ৮ দিন সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখা যেতে পারে। সেনাবাহিনী জানিয়েছে, প্রয়োজন হলে তারা অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়ক নিরাপত্তা ও দ্রুত রেসপন্সে আর্মি এভিয়েশন প্রস্তুত রাখতে পারবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানও চলমান রাখতে হবে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি।

কত সদস্য মোতায়েন হবে

৪৯২ উপজেলায় বিজিবির ১১ হাজার ৬০ প্লাটুন সদস্য মোতায়েনের সক্ষমতা আছে। কক্সবাজারে প্রতি বিওপিতে থাকবে ২৫ সদস্য। সেনাবাহিনী ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ সদস্য মোতায়েন করতে পারবে। র‌্যাবের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার সদস্য ড্রোন ও হেলিকপ্টারসহ ভ্রাম্যমাণ টিম চালাবে। কোস্টগার্ড ৯ জেলায় ৩ হাজার সদস্য নিয়োগ দিতে পারবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে অন্তত একটি বডিওর্ন ক্যামেরা রাখার প্রস্তাবও এসেছে।

তবে সীমান্তের ২ কিলোমিটারের মধ্যে সেনা মোতায়েন না করার সুপারিশ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট বাহিনী। তাদের প্রস্তাব, ৬০ উপজেলায় বিজিবি-র‌্যাব, ৩৭৭ উপজেলায় বিজিবি-সেনাবাহিনী যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে।

৮ হাজার ২২৬টি অধিক কেন্দ্র অতি ঝুঁকিপূর্ণ

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সারা দেশে ২৮ হাজার ৬৬৩টি কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে ৮ হাজার ২২৬টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।

সভায় এসবির পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, ৮ হাজার ২২৬ টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ, ২০ হাজার ৪৩৭টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৩ হাজার ৪০০টি সাধারণ ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত করেছে। এক্ষেত্রে ভোটকেন্দ্রের ভৌত অবকাঠামো, থানা থেকে দূরত্ব, কেন্দ্রের নিকটবর্তী প্রভাবশালীদের বাসস্থান ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, সীমান্তবর্তী ভোটকেন্দ্র, সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত ভোটকেন্দ্রের তালিকা শনাক্ত করা হয়েছে।

মাঠ কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনে বাহিনীর আন্তকমান্ড নির্বাচন কমিশন হতে নির্ধারণ করা যেতে পারে বলেও অভিমত দেয় এসবি। নির্বাচনকালীন সময়ে অবৈধ অস্ত্রের যোগান আসতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে এসবি অবৈধ অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে সিআইডিকে দায়িত্ব প্রদানের কথাও বলেছে।

নিরাপত্তা পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের কৌশল

প্রধান নির্বাচন কমিশনার সভায় বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্রবাহিনীকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান কমিশন সশস্ত্রবাহিনীকে আইন প্রয়োগকারীর সংস্থার সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। নির্বাচনে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর কতসংখ্যক নিয়োগ হলো, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা পেশাদারিত্ব ও আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে কি না। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে সমন্বয়ের বিকল্প নেই।

সিইসি জানান, স্টেট অ্যাসেসমেন্ট করে ডেপ্লয়মেন্ট প্ল্যান করতে হবে। রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে বিভক্ত করে নিরাপত্তা পরিকল্পনা করা যেতে পারে। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। নির্বাচনী কার্যক্রমকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।

নির্বাচন কমিশন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিতে পারে না

নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন কঠিন হবে না। নির্বাচনী কাজে সফলতার জন্য সমন্বয়ের বিকল্প নেই। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সুসমন্বয় অত্যাবশ্যক।

নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ ২০২৬ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব বিবেচনা করে বাহিনীগুলোকে প্রস্তুত থাকতে বলেন। তিনি নিশ্চিত করেন, কমিশন গোপনে কোনো নির্দেশনা দেবে না, সব নির্দেশনা আইন ও বিধি মোতাবেক প্রকাশ্যে দেওয়া হবে। সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কমিশন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

তিনি প্রযুক্তি ব্যবহার, সাইবার বুলিং প্রতিরোধ, ভুয়া তথ্য (ভয়েস ক্লোন) মোকাবিলায় দ্রুত ভালো তথ্য সরবরাহ এবং গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের গুরুত্ব তুলে ধরেন। এ ছাড়া অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার, বর্ডার ও সি-রুট সিল করা এবং কালো টাকার ব্যবহার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলেন।

তিনি সতর্ক করেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্যাবোটাজ হতে পারে এবং যেকোনো ঝুঁকি মোকাবিলায় বাহিনীগুলোকে প্রস্তুত থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশন একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলেও দায়িত্বপ্রাপ্তরাই এর বাস্তবায়নকারী।

নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিতে পারে না। দায়িত্বপ্রাপ্তরা কমিশনের পক্ষ হয়ে কাজ করছেন। যে কারণে মাঠ কার্যালয়ে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারীদের অনিয়মের দায়ভার কমিশনকে নিতে হচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্যেক কর্মকর্তাকে নিজেকে কমিশন মনে করে কাজ করতে হবে। নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে এবং প্রো অ্যাকটিভ হয়ে কাজ করতে হবে।

বৈঠকে ২২ সিদ্ধান্ত

ওই বৈঠকে ২২টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, নাশকতা প্রতিরোধে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। জুলাই সনদ অনুযায়ী গণভোট করতে গেলে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। বিষয়টি সমন্বয় করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। নির্বাচনপূর্ব কিছু অস্বাভাবিক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, সে জন্য বাহিনীগুলোকে আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্বাচন কার্যালয় ও নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত