বগুড়ার দত্তবাড়িয়ায় বিড়ালকে জবাই করে হত্যা কিংবা পাবনার ঈশ্বরদীতে সদ্যজাত আটটি কুকুর ছানাকে বস্তায় ভরে পুকুরে ফেলে মেরে ফেলার ঘটনা—সম্প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সন্তান হারিয়ে মা কুকুরের আর্তনাদের ভিডিও নাড়া দিয়েছে মানুষের বিবেককে।
শখ করে অনেকেই বাড়িতে পশু-পাখি পোষেন। কেউ খাঁচায় টিয়া, কেউ অ্যাকুরিয়ামে মাছ, আবার কুকুর-বিড়াল তো অনেকেরই নিত্যসঙ্গী। কিন্তু আপনার শখের প্রাণীটি পোষা আদতে বৈধ কি না, কিংবা কোনো প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের শাস্তি কী—তা হয়তো অনেকেরই অজানা।
বাংলাদেশে প্রাণী রক্ষা ও পালনের ক্ষেত্রে বর্তমানে দুটি প্রধান আইন বলবৎ রয়েছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২০১২ সালে প্রণীত হয় ‘বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন’। অন্যদিকে, ব্রিটিশ আমলের ১৯২০ সালের আইন রদ করে প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা রোধে তৈরি হয় ‘প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯’। এই দুই আইনের আলোকেই নির্ধারিত হয় কোন প্রাণী পোষা যাবে আর কোনটি দণ্ডনীয় অপরাধ।
বন্যপ্রাণী, পোষা প্রাণী আর গৃহপালিত প্রাণী কোনগুলো
সহজ কথায়, বনের প্রাণীকে বন্যপ্রাণী আর মানুষের আশ্রয়ে থাকতে অভ্যস্ত প্রাণীকে পোষা প্রাণী বলা হয়। তবে আইনের ভাষায় এর সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে।
বন্যপ্রাণী আইনের ধারা ২(২৫) অনুযায়ী, বিভিন্ন প্রকার ও জাতের প্রাণী যারা বনে জন্মায় এবং যাদের জীবনচক্রের বিকাশ বন্য পরিবেশে হয়, তারাই বন্যপ্রাণী। যেমন: বাঘ, হাতি, হরিণ, বনের পাখি, সরীসৃপ ইত্যাদি।
অন্যদিকে প্রাণিকল্যাণ আইনের ধারা ২(১০) অনুযায়ী, গৃহপালিত প্রাণী (যেমন গরু-ছাগল) ব্যতীত এমন কোনো প্রাণী যা মানুষের মানসিক প্রশান্তি বা নিরাপত্তার কাজে ব্যবহারের জন্য গৃহে বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে খামারে প্রতিপালন করা হয়, তাই পোষা প্রাণী। যেমন: কুকুর, বিড়াল। গৃহপালিত প্রাণীর সংজ্ঞায় (ধারা ২-৬) বলা হয়েছে, যে প্রাণী মানুষের উপকারে আসে, প্রকৃতিগতভাবে হিংস্র নয় এবং গৃহে বা খামারে লালন-পালন করা হয়।
ঘরে কোন প্রাণী পোষা যাবে না
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী, প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় থাকা দেশীয় বন্যপ্রাণী ধরা, মারা বা পোষা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
এই তালিকায় আছে দেশীয় প্রজাতির পাখি। যেমন: টিয়া, ময়না, শালিক, মুনিয়া, ঘুঘু বা অতিথি পাখি ধরা বা খাঁচায় পোষা দণ্ডনীয় অপরাধ। আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, লাইসেন্স ছাড়া কোনো বন্যপ্রাণী শিকার বা নিজের দখলে রাখা যাবে না। বানর, হনুমান, সজারু, বন বিড়াল, বাঘ, হাতি বা এ জাতীয় কোনো প্রাণীও ব্যক্তিগতভাবে পোষা যাবে না।
শাস্তির ক্ষেত্রে, এই আইনের ১ ও ২ নম্বর তফসিলে বর্ণিত প্রাণী (যেমন বাঘ বা হাতি) হত্যা বা নিজের দখলে রাখলে তা জামিন অযোগ্য অপরাধ। আইনের ৩৬ ও ৩৭ ধারা অনুযায়ী, বাঘ বা হাতি হত্যার জন্য সর্বনিম্ন ২ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। সাধারণ পাখি বা পরিযায়ী পাখি আটকে রাখলে বা হত্যা করলে আইনের ৩৮ ধারা অনুযায়ী ১ বছরের কারাদণ্ড বা ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।
ঘরে কোন প্রাণী পোষা যাবে
প্রাণিকল্যাণ আইন ও প্রচলিত বিধি অনুসারে, যেসব প্রাণী ঐতিহাসিকভাবে মানুষের সাথে বসবাস করে আসছে এবং যারা বন্য পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল নয়, তাদের পোষা যাবে। যেমন—কুকুর ও বিড়াল। এছাড়া বন্যপ্রাণী আইনের আওতাভুক্ত নয় এমন বিদেশি প্রজাতির পাখি (যেমন: লাভ বার্ড, বাজরিগর, বিদেশি ঘুঘু, ম্যাকাও) লালন-পালন করা বৈধ। কারণ এগুলো বাংলাদেশের বন্য পরিবেশে প্রাকৃতিকভাবে জন্মায় না।
তবে কেউ যদি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হরিণ, কুমির বা নির্দিষ্ট কিছু বন্যপ্রাণীর খামার করতে চান, তবে বন্যপ্রাণী আইনের ২৪ ধারা অনুযায়ী তাকে বন বিভাগের ‘চিফ ওয়ার্ডেন’-এর কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। লাইসেন্স ছাড়া হরিণ পোষা অপরাধ।
প্রাণী পোষার ক্ষেত্রে যা মানতেই হবে
বৈধ প্রাণী পুষলেই দায়িত্ব শেষ নয়। প্রাণিকল্যাণ আইন অনুযায়ী প্রাণীর প্রতি সদয় আচরণ বাধ্যতামূলক। আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী, প্রাণীকে এমন কোনো খাঁচায় রাখা যাবে না যেখানে সে নড়াচড়া করতে পারে না। তাকে পর্যাপ্ত খাবার ও পানি দিতে হবে।
কুকুরকে একটানা ২৪ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় শেকলে বেঁধে রাখা বা আটকে রাখা যাবে না। প্রাণী অসুস্থ হলে রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি সার্জন দ্বারা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কুকুর-বিড়াল বা পোষা প্রাণীর খামার বা বংশবিস্তার করাতে চাইলে ৯ ধারা অনুযায়ী নিবন্ধন বা লাইসেন্স নেয়া বাধ্যতামূলক।
কেন এই বিধিনিষেধ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনের পশুপাখি বনে থাকলেই বাস্তুতন্ত্র ঠিক থাকে। যেমন—পেঁচা ফসলের ক্ষতিকর ইঁদুর খায়। পেঁচা ধরে খাঁচায় পুষলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। এছাড়া বন্যপ্রাণী থেকে অনেক জুনোটিক ডিজিজ (প্রাণী থেকে মানুষে ছড়াতে পারে এমন রোগ) মানুষের শরীরে ছড়াতে পারে। সর্বোপরি বন্যপ্রাণীর স্বভাব বনে মুক্ত থাকা; তাদের খাঁচায় আটকে রাখা চরম নিষ্ঠুরতা।
আইন কতটা কার্যকর
আইনে সুরক্ষা থাকলেও এর বাস্তবতা ও প্রয়োগ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন প্রাণী অধিকারকর্মীরা। আইনটির প্রায়োগিক সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাকিব মাহবুব বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এই আইনের প্রয়োগ সাধারণ নাগরিকের (সিটিজেন) হাতে নেই। কর্তৃপক্ষের সংজ্ঞায় আছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা তার নিকট থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত অধিদপ্তরের কোনো ভেটেরিনারি সার্জন। অর্থাৎ অধিদপ্তরের লোক ছাড়া আপনি সরাসরি মামলা করতে পারবেন না। মূলত প্রাণিকল্যাণ আইনের বড় বাধা এখানেই।’
প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা মাহফুজুর রহমান স্ট্রিমকে বলেন, ‘বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ মূলত বন্যপ্রাণীদের সংরক্ষণ ও তফসিলভুক্ত করার বিষয়গুলো নিশ্চিত করে, সেখানে প্রাণী অধিকারের বিষয়টি খুব বেশি নেই। অন্যদিকে, প্রাণিকল্যাণ আইন-২০১৯ অধিকার নিয়ে কথা বললেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। চাইলেই যেকোনো থানায় বা আদালতে এই আইনের অধীনে মামলা করা যায় না; বিচারিক এখতিয়ার নিয়েও অস্পষ্টতা রয়েছে। অনেক সময় কোন আদালতে মামলা করলে বিচার পাওয়া যাবে, তা নির্ধারণ করতেই হিমশিম খেতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটি প্রাণীর ওপর নিষ্ঠুরতা হয়েছে কি না, তা প্রমাণ করতে সরকারি ল্যাবের ফরেনসিক রিপোর্টের প্রয়োজন হয়, যা সংগ্রহ করা সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত দুরূহ। এ ছাড়া, নিষ্ঠুরতা বা অপরাধের মাত্রা নির্ধারণে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে সুনির্দিষ্ট কোনো ‘এনিমেল ওয়েলফেয়ার বোর্ড’ নেই। সব মিলিয়ে বিদ্যমান আইনগুলো এখনো পুরোপুরি যুগোপযোগী হয়ে ওঠেনি।’