বাংলা অঞ্চলে প্রচলিত লোককাহিনি থেকে নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ শুরু হয় ‘রূপবান’ নামটিকে ঘিরে। আজ থেকে ষাট বছর আগে সালাহউদ্দিন নির্মিত এই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রের বাঁকবদল ঘটে—যা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক। সুদীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত একটি লোককাহিনিকে চলচ্চিত্রে রূপায়ণের ফলে কীভাবে এটি একটি নির্দিষ্ট ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক বোধ ও আত্মপরিচয় সৃষ্টিতে প্রবল প্রভাব সৃষ্টি করে, তা নিয়েই মূলত এই আলোচনা। তার আগে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের দিকে একটু মুখ ফেরানো যাক।
চলচ্চিত্রের ইতিহাস বলতে আসলে কী বোঝায়? কোন চলচ্চিত্র কত সালে নির্মিত হয়েছে, দু-চার লাইনে কাহিনি উল্লেখ, অভিনয়শিল্পী কারা ছিলেন এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব কত—এই জাতীয় তথ্য নাকি এর বাইরে অন্যকিছু? সব ঘটনা যেমন ইতিহাস নয়, তেমনি নির্মিত সকল চলচ্চিত্রও ইতিহাসের চিহ্ন বহন করে না। সেক্ষেত্রে বলা যায়, কোনো সুনির্দিষ্ট সময় কিংবা প্রেক্ষাপট পরিবর্তন বা ধারণ করার ক্ষেত্রে যদি কোনো চলচ্চিত্র প্রভাববিস্তারী ভূমিকা সৃষ্টি করে এবং তা পরবর্তীকালেও দৃষ্টান্ত হয় তখন তা ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে। সাহিত্য কিংবা শিল্পকলার অন্যান্য শাখার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ‘রূপবান’ বাংলা চলচ্চিত্রে সত্যিকার অর্থে ইতিহাস সৃষ্টি করে। ‘রূপবান’ চলচ্চিত্রের ইতিহাস সৃষ্টির প্রসঙ্গ নিয়ে এবার আলোচনা করা যাক।
পাকিস্তানের উর্দুভাষার চলচ্চিত্রের বিপরীতে বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র যখন মুখ থুবড়ে মার খেতে থাকে, তখন ‘রূপবান’ এগিয়ে আসে। এই ‘রূপবান’ কিন্তু বাংলা অঞ্চলের লোককাহিনি। বর্তমান আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলেজেন্সির যুগে লোককাহিনির গুরুত্ব ও কাজ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে। তো লোকমুখে প্রচলিত এসব কাহিনি কোনো জনগোষ্ঠীর জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে জনগণের মনে জীবন্ত থাকে—যা দ্বারা নিজস্ব সংস্কৃতির প্রাচীনত্বকে খুঁজে বের করা যায়। বিশ্বসভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিটি সভ্যতার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে—যা ওই অঞ্চলের ইতিহাসকে উপস্থাপন করে। এই ঘরানার ইতিহাসকে অন্বেষণ করার অন্যতম উৎস হলো লোকসাহিত্য, লোকসংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এই লোকসংস্কৃতি, লোকসাহিত্য বা কিংবদন্তিগুলো কোনো অঞ্চলের সাধারণ বা নিরক্ষর জনগণের মুখে মুখে রচিত জ্ঞানতাত্ত্বিক স্তর বা কাঠামো। এই জ্ঞান মানুষের যাপিত জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা (সুখ ও দুঃখ) থেকে উৎসারিত। ফলে এর সঙ্গে বাস্তবের একধরনের সংযোগসূত্র রয়েছে। প্রাচীন বাংলার জনগোষ্ঠী দ্বারা সৃষ্ট ও প্রচলিত লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য মূলত অনার্য কৃষিভিত্তিক সমাজকে রেপ্রিজেন্টেশন করে। ফলে বলা যায়, লোককাহিনি কোনো সুনির্দিষ্ট অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবনের বহুবিচিত্র ঘটনাবলির বয়ান যুগ যুগ ধরে বহন করে। ষাটের দশকে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘রূপবানে’র ক্ষেত্রেও তেমনটি লক্ষ করা যায়। যার প্রমাণ এর দর্শকশ্রেণি।
রূপবান সিনেমার বিজ্ঞাপন। সংগৃহীত ছবিবাংলা অঞ্চলে প্রচলিত যাত্রাপালার মঞ্চে ‘রূপবান’ দীর্ঘকাল ধরে যাত্রা হিসেবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করে এবং দর্শকপ্রিয় হয়। ‘রূপবান’ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও প্রচলিত এই পালার কাহিনি উঠে এসেছে। যেহেতু চলচ্চিত্র গণমাধ্যমের ভূমিকা পালন করে ফলে এর সঙ্গে দর্শক হিসেবে অধিক সংখ্যক জনগণের সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ ঘটে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৫ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘রূপবান’ গণমানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়। ষাটের দশকে ‘রূপবানে’র দর্শক কারা ছিল? বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজে যারা এর কাহিনি ও সংগীতের সঙ্গে একাত্মবোধ করে তারা। তো কী ছিল রূপবানের কাহিনিতে?
একাব্বর বাদশার সন্তান না-হওয়ার বিষয়টিকে প্রজারা রাজ্যের অশান্তি ও দুঃখের কারণ হিসেবে মনে করে। ফলে বাদশা মনের দুঃখে বনবাসে যায়। সেখানে বাদশার অসাবধানতায় ধ্যানমগ্ন এক দরবেশের ধ্যান ভেঙে যায় এবং সে বাদশাকে অভিশাপ দেয় যে, তার একটি পুত্র হবে এবং বারো দিনের মাথায় শিশুটি মৃত্যুবরণ করবে। এমন অভিশাপে বাদশা কাতর হলে দরবেশ বলে, যদি বারো দিনের পুত্রের সঙ্গে বারো বছরের মেয়ের বিয়ে দিয়ে বনবাসে পাঠানো হয় তবে শাপমুক্তি ঘটবে। বাদশা রাজ্যে ফিরে আসে, যথাসময়ে পুত্র সন্তান লাভ করে এবং পুত্রের বিয়ের জন্য রাজ্যজুড়ে বারো বছরের কন্যার সন্ধান চালাতে থাকে। পুত্র রহিমের বয়স বারো হওয়ার আগের দিন রাজজ্যোতিষী জানায়, উজিরের কন্যা রূপবানের বয়স আগামীকাল বারো বছর হবে। কিন্তু উজির তার কন্যার সঙ্গে রহিমের বিয়ের প্রস্তাবে সায় দেয় না, ফলে তাকে বন্দী করে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়। নিজের পিতাকে মুক্ত করতে রূপবান বারো দিনের শিশু রহিমকে বিয়ে করে এবং তাদেরকে বনবাসে পাঠানো হয়। বনে রূপবান কখনো বাঘের কবলে, কখনো ডাকাতের কবলে পড়ে এবং একজন জংলি সর্দার তাকে সর্বদা রক্ষা করে। তারপর রূপবান গ্রামে এক বৃদ্ধার কাছে আশ্রয় নেয়। রহিম পাঠশালায় যাওয়া শুরু করে এবং সেখানে রাজার মেয়ে তাজেল তার সহপাঠী হয়। তাজেল রহিমকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় কিন্তু মেধাবী ছাত্র রহিম তা প্রত্যাখ্যান করে। রহিমকে তাজেলের পিতা বন্দী করে এবং রূপবানকে অপহরণ করতে আসে। আবারও জংলি সর্দার পরিত্রাতা হয়। এক পর্যায়ে তাদের বনবাসের বারো বছর অতিক্রান্ত হয়, রহিমের পিতা একাব্বর বাদশা তার সৈন্য নিয়ে আসে এবং তাদেরকে মুক্ত করে প্রাসাদে ফিরে যায়। সংক্ষেপে এই হলো ‘রূপবান’ চলচ্চিত্রের কাহিনি। তো এই কাহিনি কীভাবে বাংলাভাষী দর্শকের মনে আত্মপরিচয়ের চেতনা সৃষ্টি করে? এবার সে প্রসঙ্গে বলা যাক।
পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলের সভ্যতাকেন্দ্রিক সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভিত্তিতে সেই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় উঠে আসে। বিশেষ করে লোককাহিনি বা লোকপুরাণে বর্ণিত কোনো জাতীয় বীর বা নারীর উল্লেখ ওই অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় নির্মাণ ও নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। আর ঔপনিবেশিক বা পরাধীন কোনো জনগোষ্ঠীর মনে জাতীয় চেতনা তৈরিতে এই লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভূমিকা অপরিহার্য। কারণ লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্বতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করে এবং সজাগ হয়। এর ভিত্তিতে বলা যায়, যে জনগোষ্ঠীর লোকসংস্কৃতির ইতিহাস যত পুরনো সেই জাতি তত বেশি ঐতিহ্যবাহী ও বনেদি। কারণ লেখার পদ্ধতি আবিষ্কারের পূর্বে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত লোকগাথা, লোকগান, লোককাহিনি, লোকছড়া প্রভৃতি প্রজন্মের পর প্রজন্মে প্রবাহিত হয়েছে—যা জনমনে আবেগী স্থান করে নিয়েছে। আর জনমনের এই আবেগ হলো সেন্টিমেন্ট—যা জাতীয় চেতনার অন্যতম প্রধান উপাদান। ‘রূপবান’ চলচ্চিত্রে এই সেন্টিমেন্টকে যেমন প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তেমনি ভিন্নভাষী চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেতনাকেও জাগ্রত করার প্রচেষ্টা রয়েছে। এ বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখা যাক।
রূপবান সিনেমার পোস্টার। সংগৃহীত ছবি১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলা ভাষায় নির্মিত ১৮টি চলচ্চিত্রের বিপরীতে উর্দু ভাষার ১৯টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এর অন্যতম কারণ ছিল উর্দু চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয়তা। বাংলা ছবিকে এই সংকট থেকে রক্ষা করে বক্তব্য প্রধান বা মহান শিল্প ভাবনায় নির্মিত কোনো ছবি নয় বরং ফোক ছবি রূপবান। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে একদিকে ভারতীয় ছবি আমদানি বন্ধ হয়ে যায়, অন্যদিকে পূর্ব-পাকিস্তানবাসী গ্রহণ করেন রূপবানকে।
ওই সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রের কাহিনিতে ‘রূপবান’-এর যুক্ত হওয়া একটি বড় ঘটনার মতো। বিশেষ করে উর্দু চলচ্চিত্রের আধিপত্যবাদী চরিত্র ও ধারণাকে পুরোপুরি ‘চ্যালেঞ্জ’ করে ‘রূপবান’ পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী দর্শকদের সামনে নতুন ধারা সৃষ্টি করে। দর্শকের মনে ‘রূপবান’ চলচ্চিত্রের প্রভাব সৃষ্টির চিত্রটি ছিল একরম:
কোন জনপদের নিজস্ব জীবন, ভাষা ও বয়ানরীতির মধ্য থেকে জন্মানো ও বেড়ে ওঠা লোককাহিনী সেই জনপদের পরিচয় ও জীবনচর্চাকে প্রতিফলিত করে। ফলে সেটি যখন চলচ্চিত্রায়িত হয়, তখন তা জনপদের একটা বড় অংশকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তেমনই একটি সৃষ্টি রূপবান। গ্রামীণ অপেরা থেকে রূপবানকে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়া হয়। এর পরিচালক মঞ্চের ঐতিহ্যবাহী প্রবেশ-সংলাপ-প্রস্থানশৈলীকে চলচ্চিত্রে সফলভাবে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মূল যাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছিল এমন কয়েকটি জনপ্রিয় লোকগানও চলচ্চিত্রটিতে ব্যবহার করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামীণ জনসমাজ চলচ্চিত্রের মতো একটি পশ্চিমা, আধুনিক এবং প্রযুক্তিগত মাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে যেখানে অন্যান্য বাংলা চলচ্চিত্রের মাত্র চার বা পাঁচটি রিলিজ ছাপা হতো, সেখানেও রূপবানের ১৭টি রিলিজ প্রকাশ হয়েছিল। শুধু রূপবানের প্রদর্শনীর জন্য গ্রামীণ এলাকায় অনেক অস্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ তৈরি করা হয়েছিল। টিনের চালার এইসব প্রেক্ষাগৃহ, অ্যানালগ সিনেমা হলের পর্দা আর কাঠের বেঞ্চের ছারপোকার ছড়াছড়ির মধ্যেই নিজেদের স্থান করে নিতেন রূপবানের দর্শকেরা। ঢাকার স্টার সিনেমা হলে প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় ছিল নারীদের জন্য বিশেষ শো এর ব্যবস্থা।
রূপবান চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয়তা শুধু একটি চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক সাফল্য নয়, একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় নির্মাণের ইতিহাসও বটে। যখন এদেশের চলচ্চিত্র মাধ্যম থেকে উর্দু ভাষার দাপটে বাংলা ভাষা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল তখন লোককাহিনির চলচ্চিত্র রূপবানের অভিষেকের মধ্য দিয়ে এদেশের চলচ্চিত্র পুনরায় বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষা ফিরে পাওয়ার স্পর্ধা অর্জনে সক্ষম হয়।
রূপবান সিনেমার একটি দৃশ্যের স্থিরচিত্র। সংগৃহীত ছবি১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম ভিত্তি হলেও সাহিত্য-অঙ্গনের মতো চলচ্চিত্র জগতে তা তেমন প্রভাববিস্তারী হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা স্বীকৃতি পাওয়ার পরেও পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র নির্মিত হতে থাকে। তবে রূপবান চলচ্চিত্র মুক্তির পর এই দৃশ্যপট পালটে যায়। রূপবানের সাফল্যে ঢাকার ছবি থেকে প্রায় নির্বাসিত বাংলা ভাষা আবার ফিরে আসে। নির্মাতারা লোকছবির মাধ্যমে বাংলা ভাষায় ফিরে এলেন। বলা যায়, ঢাকায় বাংলা ছবির স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘটে। এখানে ঢাকায় বাংলা ছবির স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বিষয়টি এই অর্থে গুরুত্বপূর্ণ যে, রূপবান বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে বাঙালি দর্শকদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে আত্মপরিচয় নবরূপে নির্মাণ করে। কারণ হিসেবে কাহিনির কেন্দ্রে থাকে আবহমানকাল ধরে প্রচলিত ‘রূপবান’ লোককাহিনি। এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির বলেন, ‘Miraculously it was discovered in what came to be known as `folk’ cinema. Director Salauddin thought that popular folk-lores, is filmed, should also prove popular.’
রূপবান চলচ্চিত্রের এই দর্শকপ্রিয়তার কারণ কী? ‘রূপবান’ চলচ্চিত্রে লোককাহিনির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লোকগান। এই দুইয়ের সংমিশ্রণ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রাচীন ধারাকে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করেছে। আর এর মধ্য দিয়ে দর্শক তার নিজস্ব সংস্কৃতির শেকড়কেন্দ্রিক আত্মপরিচয়ের সঙ্গে জ্ঞানে ও নির্জ্ঞানে যুক্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে কার্ল ইয়ুং সামূহিক নির্জ্ঞান সম্পর্কে যে ধারণা দেন তার সূত্র ধরে বলা যায়, রূপবানের কাহিনি যা দর্শকের পূর্বপুরুষদের মনে বিদ্যমান ছিল, তা প্রবাহিত হয়ে তাদের মধ্যে চলে আসে, আর তারা যখন এটাকে ভিজ্যুলাইজড করেছে, তখন তাদের চেতনা ও বাস্তবতা একই সঙ্গে ক্রিয়াশীল হয়। ফলে চলচ্চিত্রে রূপবানের দুঃখের দৃশ্যের সঙ্গে দর্শকেরা আচ্ছন্ন হয় আবার সুখের দৃশ্যে হয় আপ্লুত। বিশেষ করে চলচ্চিত্রে গানের মাধ্যমে ঘটনা ও কাহিনি বর্ননার যে রীতি অনুসরণ করা হয়েছে তা আবহমান বাংলার পালাগানের সংস্কৃতির চিত্র। এর মধ্য দিয়ে বাঙালি দর্শকেরা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে মেলবন্ধন স্থাপন করেছে। আর সারাদেশের প্রেক্ষাগৃহে একই সঙ্গে যখন অনেক দর্শক তা উপভোগ করে তখন তারা হয়ে ওঠে ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’ বা কল্পিত সম্প্রদায়। ফলে তারা একই কাহিনিচিত্রকে ভিন্ন স্থানে দর্শক হিসেবে বসে দেখলেও তাদের চেতনায় একধরনের কাল্পনিক বন্ধন সৃষ্টি হয়—যা জাতীয় চেতনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে অপরিহার্য। তবে একটি প্রশ্ন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একটি নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রকে কীভাবে স্বীকৃতি দিল?
পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে একটি নারী চরিত্রকে প্রাধান্য দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ সাহসী পদক্ষেপ। বিশেষ করে তৎকালীন পাকিস্তান নামক একটি ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের দিক থেকে তা ছিল আরও ‘চ্যালেঞ্জিং’—যা একই সঙ্গে দর্শকের গ্রহণযোগ্যতার বিষয় ও চলচ্চিত্রে অর্থলগ্নির ব্যাপারটিকেও যুক্ত করেছিল। তবে নির্মাতা সালাহউদ্দিন আবহমান বাংলায় প্রচলিত যাত্রাপালার কাহিনিকে চলচ্চিত্রে রূপান্তর করলেন নারী রূপবানকে প্রধান চরিত্র হিসেবে রেখে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস থেকে বলা যায়, নারীকেন্দ্রিক প্রথম চলচ্চিত্র হলো রূপবান। যাত্রা হিসেবে রূপবান কৃষিভিত্তিক সমাজের নারীপরিসরে যে সমাদর পেয়েছিল চলচ্চিত্র হিসেবে তা আরও গভীর প্রভাব সৃষ্টি করে। প্রচলিত তথ্যমতে, রূপবান চলচ্চিত্র দেখতে গিয়ে প্রেক্ষাগৃহে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদও পাওয়া যায়। তখন প্রশ্ন তৈরি হয়, রূপবান নারীসমাজে কেন এত জনপ্রিয় হলো? বলা যায়, শুরু থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত চলচ্চিত্রটিতে একটি নারীর দুঃখগাথা উঠে এসেছে।
রূপবান সিনেমার পোস্টার। সংগৃহীত ছবিরূপবান চলচ্চিত্র মূলতঃ নারীর দুঃখ, বেদনাবোধ ও আত্মত্যাগের চিত্র। ধ্যানভঙ্গের দায়ে দরবেশ যখন একাব্বর বাদশাকে অভিশাপ দেয় তা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বলে, বারো দিনের শিশু পুত্রের সঙ্গে বারো বছরের কন্যার বিয়ে দিয়ে বারো বছরের জন্য বনবাস দিতে হবে। এখানে লক্ষণীয় যে, বারো বছরের কন্যাটিকে এই কঠিন শর্তের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হলো। দরবেশ অন্যকোনো অভিশাপ দিতে পারতেন কিন্তু কেন বারো বছরের কন্যাকে শাস্তির আওতায় নিলেন? কিংবা বাদশাকে শাস্তি দিতে গিয়ে দরবেশ কেন একটি বারো বছরের কন্যাকে যুক্ত করলেন? বলা যায়, বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক বা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোতে নারী কখনোই তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত বা মতামত উৎপাদন করতে পারে না, ফলে পুরুষের মতামতকেই তার প্রাধান্য দিতে হয় এবং সেটাই তার ভাগ্যনিয়ন্তা হিসেবে কাজ করে। রূপবানের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটেছে। ফলে একটি বারো দিনের শিশুপুত্রের সঙ্গে বারো বছরের মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে কন্যা শিশুটির মতামত গ্রহণের বিষয়টিকে কোনোভাবেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। দরবেশ অভিশাপ দেওয়ার ক্ষেত্রে যেমন নারীর বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়নি, তেমনি একাব্বর বাদশাও তার পুত্রের জীবন রক্ষার জন্য তা বিবেচনা করেনি। ফলে রূপবানকে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে বন্দী হতে হয়। এমনকি তার উজির পিতাকে বাদশার হুকুমে জল্লাদ যখন হত্যা করার জন্য প্রস্তুত হয়, তখন রূপবান তার পিতাকে বাঁচানোর জন্য বারো দিনের শিশুকে বিয়ে করতে সম্মতি দেয়। এখানে লক্ষণীয় যে, রূপবান একই সঙ্গে দুইটি জীবন রক্ষা করে:
ক. তার পিতাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচায় ও
খ. বারো দিনের শিশু রহিমকে মৃত্যু থেকে বাঁচায়।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রূপবানের আত্মত্যাগ এই চলচ্চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রূপবান এখানে জন্মভূমির মতো সর্বংসহা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। রূপবানের বনবাসের বিষয়টিতে বন নারীর প্রতিকৃতি হিসেবে উঠে এসেছে:
বন= প্রকৃতি= নারী (রূপবান)।
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, সুদীর্ঘকাল ধরে মানুষ যেখানে বসবাস করে সেখানেই সে তার আত্মপরিচয় নির্মাণ করে। ফলে রূপবান যখন বনে বসবাস করা শুরু করে সেটাই তার দেশ বা ভূমি হয়ে ওঠে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকেরা তেমনটি মনে করে না। ফলে তারা উপনিবেশক ও উপনিবেশিত অর্থাৎ শাসক ও শোষকের সম্পর্ক সৃষ্টি করে। এই অঞ্চলের সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক ইতিহাসে লক্ষ করা যায়, ইংরেজরা কখনোই নিজেদের ভারতীয় ভাবেনি বা ভারতীয় হওয়ার চেষ্টা করেনি। তারা মূলত এদেশের সম্পদ থেকে অর্জিত অর্থ ইংল্যান্ডে পাচার করেছে। কিন্তু মুঘল শাসকদের ক্ষেত্রে চিত্রটি পুরোপুরি বিপরীত। তারা বহিরাগত হয়ে ভারতে এসে নিজেদের আত্মপরিচয় নির্মাণ করে। এই আত্মপরিচয় নির্মাণের চেতনা ব্যক্তির জন্য খুবই জরুরি হয়ে ওঠে যখন সে আত্মপরিচয়ের সংকটে পড়ে। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে উর্দুকে ঘোষণা করার পর বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে আত্মপরিচয়ের সংকট সৃষ্টি হয়। এর ফলে তারা এর বিরোধিতা করে। শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এই বিরোধিতা মূলত জাতীয় চেতনা থেকে উদ্ভূত। এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্রের রূপবান চরিত্রাভিনেত্রী সুজাতা বলেন, ‘রূপবানের পর উর্দু ছবি আমাদের পূর্ব বাংলা থেকে বিদায় নিল, ভারতীয় ছবি বিদায় নিল শুধু ইংরেজি ছবি গুলিস্তান সিনেমা হলের উপরে ছিল নাম ছিল নাজ সেই প্রেক্ষাগৃহে চলতো। সব পরিচালক উর্দু ছবি বাদ দিয়ে লোকগাথা ছবি শুরু করল। বায়ান্নো সালের পর আর একবার পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জেগে উঠল, সোচ্চার হলো। আমরা বাঙালি আমরা কেন উর্দু ছবি বানাব? কেন আমরা উর্দু ছবি দেখব?’
রূপবান চরিত্রে অভিনেত্রী সুজাতা। সংগৃহীত ছবিঅভিনেত্রী সুজাতার এই বক্তব্য ভাষাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উপস্থাপন করেছে। তখন প্রশ্ন জাগে, এই চেতনা সমাজের কোন শ্রেণির জনগোষ্ঠীর মধ্যে কাজ করেছিল? আর তখনই খোঁজ মিলবে কৃষিভিত্তিক সমাজ কাঠামোর নরনারীর—যারা ছিল রূপবানের দর্শক। ফলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাতারাতি কৃষক, শ্রমিক, নিরক্ষর জনতার চৈতন্য জাগ্রত হয়েছিল এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল ব্যাপারটি তেমন নয়। বরং রূপবান ঘরানার চলচ্চিত্র ও সাংষ্কৃতিক কর্মকাণ্ড তাদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের চেতনার উন্মেষে কাজ করেছিল। অর্থাৎ এই সব চলচ্চিত্র বা সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে তারা ‘আত্ম’ ও ‘অপর’ বিষয়টিকে উপলব্ধি করে। ইতিহাসে দেখা যায়, ‘রূপবান’ চলচ্চিত্র মুক্তির পূর্বে ঢাকায় উর্দু ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হতো। ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তির পর থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলা ও উর্দু মিলিয়ে প্রায় চল্লিশটির মতো চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। কিন্তু বাংলা ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র সেভাবে দর্শকপ্রিয়তা পায়নি। বলা যায়, রূপবান প্রথম চলচ্চিত্র যা বাঙালি দর্শকদের মনে আগ্রহ সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সুজাতা বলেন, ‘রূপবান মুক্তি পাওয়ার পর ছবিঘরে মানুষের ঢল নামলো।’ এর কারণ মূলত রূপবানের কাহিনি—যার সঙ্গে দর্শক একাত্ম হয়ে ওঠে। কারণ এই লোককাহিনি বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য ও চেতনাকে তুলে এনেছে। জাতীয় চেতনার বৈশিষ্ট্য থেকে জানা যায়, লোকসংস্কৃতি কোনো জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সম্পদ—যা থেকে তারা আত্মপরিচয়ের উপাদান পায়। আর রূপবান চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিই দর্শকের জ্ঞান ও নির্জ্ঞান মনে প্রভাববিস্তারী হয়ে ওঠে।
‘রূপবান’ চলচ্চিত্রে জংলি সর্দার ও ডাকাত চরিত্রটির বিশেষ একটি দিক আছে। এখানে জংলি সর্দারকে যদি অনার্য হিসেবে ভূমিপুত্র বা দেশীয় ধরা হয়, তবে ডাকাত হলো বিদেশি ঔপনিবেশক। অর্থাৎ
জংলি সর্দার (অনার্য) = ভূমিপুত্র। ডাকাত (ঔপনিবেশক) = লুণ্ঠনকারী।
চলচ্চিত্রে ডাকাত দল ঔপনিবেশিক শাসকের মতো লুণ্ঠনকারীর ভূমিকায় থাকে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে ভারতীয়রা যে প্রতিরোধ-সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল চলচ্চিত্রে জংলি সর্দারের দলকে এর দ্বারা প্রতিস্থাপন করা যায়। রূপবানকে জংলি সর্দার মা হিসেবে সম্বোধন করার মধ্য দিয়ে তাকে দেশমাতৃকার রূপক হিসেবে দেখা যায়, ভূমিপুত্ররা যার রক্ষাকারী।
পরিশেষে বলা যায়, ষাটের দশকে উর্দুভাষী চলচ্চিত্রের বিপরীতে ‘রূপবান’ বাংলা চলচ্চিত্র জগতে যেমন নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তেমনি দর্শকদের মনে বাংলা লোককাহিনিভিত্তিক জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছে। ফলে ‘রূপবান’ চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত লোকসংস্কৃতি বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে নতুন পরিচিতি প্রদান করেছে।
তথ্যঋণ:
আহমেদ আমিনুল ইসলাম (২০১৪), বাংলাদেশের চলচ্চিত্র চলচ্চিত্রে বাংলাদেশ, ভাষাচিত্র, ঢাকা;
সুজাতা আজিম (২০২১), চলচ্চিত্রে আমার ৫৫ বছর, অক্ষর প্রকাশন, ঢাকা;
হোসাইন মোহাম্মদ জাকি, ‘রূপবান সিনেমা ও বাংলা চলচ্চিত্র’, বিডিনিউজ টুয়েন্টি ফোর ডট কম, ৬ ডিসেম্বর ২০২২, ঢাকা।