leadT1ad

খাইরুল বাসারের গানের ‘পিনিক’ ও ‘ভাইরাল’ ফর্মুলা

খাইরুল বাসারের গান কি হঠাৎ আপনার সোশ্যাল-মিডিয়া নিউজফিডে ল্যান্ড করে মাথায় গেঁথে গেছে? তাহলে লেখাটি একদম আপনার জন্য। আর যদি এখনো তাঁর গান কানে না পৌঁছায়, তাহলেও পড়তে থাকুন। কারণ, এই লেখা পড়ছেন মানেই হয়তো এলগরিদম আপনার জন্য খাইরুল বাসারের গান রেডি করে বসে আছে। এখানে পাবেন তাঁর লোকাল থেকে ভাইরাল হওয়ার গল্প, গান বাঁধার সেই বিশেষ ফর্মুলা। কেন এত মানুষ তাঁর গানে ‘পিনিক’ খুঁজে পান? আর কেনই-বা ভাইরাল হয় তাঁর গান?

প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৫, ১৯: ১৮
আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২৫, ১৯: ৩৬
সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরাল গায়ক খাইরুল বাসার। স্ট্রিম গ্রাফিকস

খাইরুল বাসারের গানকে মিউজিকের ভাষায় বিশ্লেষণ করতে গেলে নজর দিতে হবে তাঁর গানের জনরা, পারফরম্যান্স স্টাইল আর সুর ও ছন্দের গঠনের দিকে। তাঁর গান মূলত ফোক, তবে এটা ক্লাসিক 'গ্রামীণ' ফোক নয়। বরং আধুনিক সময়ের ফোকের একটা চটুল, ট্রেন্ডি ভার্শন। আর গানগুলোতে মজা আর হাস্যরসের ফিলিং থাকে, যা একটু প্যারোডি বা স্যাটায়ারিক। এই কৌতুক আর ব্যঙ্গই খাইরুল বাসারকে নেটদুনিয়ায় পরিচিত করে তুলেছে।

বর্তমানে স্যোশাল-মিডিয়ায় শুরু হয়েছে 'ভাইরাল পপ' গানের যুগ। ভাইরাল পপে কোনো গানের জনপ্রিয়তা নির্ভর করে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর। এটা আসলে কোনো অফিশিয়াল মিউজিক জনরা নয়, কিন্তু সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ট্রেন্ড হয়ে ওঠা গানগুলোকে মোটাদাগে ভাইরাল পপের কাতারেই ফেলা হয়।

দেশে দেশে ভাইরাল পপের অনেকে শিল্পী আছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁরা নিয়মিত ঝড় তোলেন। ওলিভিয়া রদ্রিগো, ডুয়া লিপা, ডোজা ক্যাট, সাবরিনা কারপেন্টারের মতো ভাইরাল পপের আইকনরা মিডিয়া ট্রেন্ডস সেট করছেন। তেমনি আমাদের খাইরুল বাসারের গানও ফেসবুক আর টিকটকে এমন ভাইরাল হয়েছে যে এখন সে বাংলাদেশি ভাইরাল পপ গানের সিনে 'এক্সক্লুসিভ' নাম।

লোকাল থেকে ন্যাশনাল ফিডে

এখন আসি খাইরুল বাসারের স্টোরিতে। তিনি পেশায় কাঠমিস্ত্রি, আর নেশায় গায়ক। কোথাও বড় কোনো স্টুডিও কিংবা প্রোডাকশনে নয়, বরং মোবাইল ক্যামেরার সামনে ঘরোয়া পরিবেশে গান গেয়ে রাতারাতি পরিচিতি পেয়েছিলেন চাঁদপুরের মতলব উপজেলার এই বাসিন্দা। গানের নেশা তাঁর অনেক পুরোনো। দেড় দশক আগে ঢাকায় এসে কিছু গান রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু সেগুলো বাজারে ছাড়েননি। কারণ, তখন সবাই মেমোরি কার্ডে গান ভরে মোবাইলে চালাত। ক্যাসেট বা অ্যালবাম বেচাটা ঝক্কির ব্যাপার ছিল। তাই অনেকটা হতাশ হয়েই গ্রামে ফিরে যান।

মেমরি কার্ডের যুগের গ্যাঁড়াকলে একসময় হতাশ হলেও খাইরুল বাসার গান গাওয়া ছাড়েননি। ২০২২ সালে তাঁর গান ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়িয়ে দেয় তাঁর ছেলে। এরপর ২০২২ সালের ৭ আগস্ট ‘বেশি ফাল পারিস না, পালাবার জায়গা পাবি না’ গানটা ফেসবুক পেজ থেকে ছাড়লে তা ভাইরাল হয়।

খাইরুল বাসারের গানের ফর্মুলা/পোস্টমর্টেম

খাইরুল বাসারের গানগুলো খুবই সরল সুরে বাঁধা। অর্থাৎ জটিল রাগ-তাল কিচ্ছু না। একদম মাথায় ধরে রাখার মতো ক্যাচি টিউন থাকে তাতে। আর ছন্দ? বেশিরভাগ গানেই ৪/৪ বা ৬/৮ বিটে চলে। মাঝেমধ্যে বিটের এনার্জি শ্রোতাকে নাচাতে না পারলেও মাথা নাড়াতে বাধ্য করে। কিন্তু খাইরুল বাসারের সব গানের সুর প্রায় একরকম। আর গলায় কোনো চড়া ওঠানামা নেই। একদম কথোপকথনের ভঙ্গি। সুরের কারণে একঘেয়ে মনে হলেও, তাঁর গানের আসল মজা থাকে লিরিকে!

‘কী বলতে চাস বন্ধুরে তুই এমনে হেমনে? ভয় পাইলে তুই প্রেম করবি বল কেমনে কেমনে?’ খাইরুল বাসারের গানের এমন সব লাইন একদম চিল টোনে গাওয়া। আর হুকলাইন গানকে আলাদা একটা রিলেটেবল টাচ দেয়।

খাইরুল বাসারের কয়েকটি ভাইরাল গানের প্রথম লাইন। স্ট্রিম গ্রাফিকস
খাইরুল বাসারের কয়েকটি ভাইরাল গানের প্রথম লাইন। স্ট্রিম গ্রাফিকস

খাইরুল বাসারের ভোকাল প্যাটার্নকে খানিকটা ‘টক-সিংগিং’ স্টাইল বলা যায়। 'খানিকটা' বললাম, এর কারণ হচ্ছে, ন্যারেটিভ ডেলিভারির হিসেব করলে পুরোপুরিভাবে তাঁর গানকে এই স্টাইল হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। বিলবোর্ড ম্যাগাজিন মনে করে, জনপ্রিয় গায়ক এড শেরেনের অনেক গান ‘টক-সিংগিং’ স্টাইলের। আর সংগীতবিষয়ক বিখ্যাত ম্যাগাজিন রোলিং স্টোন মনে করে, এই ‘অর্ধেক গান আর অর্ধেক কথা’ স্টাইল এড শেরেনের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।

আর লিরিকে? প্রেম, বিচ্ছেদ, সামাজিক রস থেকে শুরু করে এলাকার চায়ের দোকানের আসরে নজর কাড়া 'পারফেক্ট' গল্পটা–সবই দেখা যায় তাঁর গানে। যেখানে আঞ্চলিক উচ্চারণ আর লোকজ উপমার ছোঁয়া আছে। টপিক হিসেবে 'ছলনাময়ী নারী' কিংবা 'নর-নারীর সম্পর্কের অতিরঞ্জিত নাটকীয়তা' খাইরুল বাসারের কিছু জনপ্রিয় গানে দেখা গেছে।

‘ঘরের কথা' ধরনের গসিপ পাবলিক ফোরামে তোলা সোশ্যাল মিডিয়ায় হিট জিনিস। সেখানে নারীদের টিটকারি মারা হয় আর ছলনার ফাঁদে ফেলানোর গল্প শোনানো হয়। সেই ফর্মুলায়ও খাইরুল বাসারের কিছু গান স্যোশাল মিডিয়ায় হিট হয়েছে। আঞ্চলিক পালাগান, বিচারগানের কিছু 'পালা'তেও এমন দেখা যায়। সেটা অবশ্য একতরফা হয় না।

সেখানে বিতর্ক প্রতিযোগিতার মতো গানের লড়াইয়ে দুটি পক্ষ থাকে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে গানে-গানে প্রশ্ন করে। যে যত প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারে, সেই-ই হিট। আপনি জানেন কি, খাইরুল বাসারের গানের গুরু কিন্তু পালাগানের শিল্পী সুজন সরকার? ছোটবেলায় খাইরুল সাহেবের ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে পালাগানের শিল্পী হবেন।

এখন তিন লাইনে লেখার এই অংশের ইতি টানি। খাইরুল বাসারের গানের টপিক ফানি; ফোক কাঠামোয় তৈরি। এখানে প্রেম-বিরহ আর দৈনন্দিন ঝামেলার কথাবার্তা হাসির ছলে আনা হয়। সবমিলে গানের কথোপকথন স্টাইলে রিদমিক লুপস আর হুকলাইন—দিনে তিনবেলা (১+১+১) প্যারাসিটামল খাওয়ার মতো প্রেসক্রিপশন।

খাইরুল বাসারের গান কেন ভাইরাল

খাইরুল বাসারের গান ইউটিউবে শুনতে গিয়ে কমেন্টবক্সে চোখ পড়ল। এক ভক্ত লিখেছেন, ‘খাইরুল বাসারের গানে আলাদা একটা পিনিক আছে।’ এই ‘পিনিক’ আসলে 'ক্যাচি' আর লিরিকে-টিউনে রেপিটেটিভ ফর্মের কারণে হুকলাইন মুখস্ত হয়ে যাওয়া। আর সঙ্গে বাংলা ঢোলের মাথাদোলানো সাউন্ডস্কেপ।

খাইরুল বাসারের 'হুকিং' ভান্ডার কিন্তু 'নানার গোলাভরা ধান আর গোয়ালভরা গরু'র মতো। ‘কী বলতে চাস বন্ধুরে তুই এমনে হেমনে? ভয় পাইলে তুই প্রেম করবি বল কেমনে কেমনে?’; ‘আমি কল করলে তোমার মোবাইলে পাই শুধু ওয়েটিং’; ‘হাই কেমন আছে, তুমি কি ভালো আছো’; ‘হালায় কথা হুনে না’; ‘দেইক্কা লাইছি কইয়া দিমু’; ‘বেশি ফাল পারিস না’—এমন সব লাইন কাটছাঁট করে ক্যাপশন বানানো আর মিম কিংবা রিঅ্যাকশন ভিডিওতে বসানোর জন্য আদর্শ। আর সেই ক্লিপগুলো ফেসবুক-টিকটকে গান ভাইরাল হওয়ার সুপারহিট ফ্যাক্টর তৈরি করে। ফলে টিকটকাররা তাতে লিপ-সিঙ্ক করেন, ফেসবুকে মিমাররা বানান মিম।

স্যোশাল মিডিয়ায় ‘পার্টিসিপেটরি কালচার’ খাইরুল বাসারের গানকে করে তুলেছে শেয়ার-ফ্রেন্ডলি। ভার্চ্যুয়াল ফুটপ্রিন্টের 'জীবনযুদ্ধে' তো আর পিছিয়ে পড়া যাবে না! সঙ্গে নিজেদের সার্কেলে শেয়ার করতে করতে ফেসবুক-টিকটক-ইউটিউবজুড়ে গান ছড়িয়ে দেওয়া ‘হোমোফিলি নেটওয়ার্ক’ও এই টাইপের গান (পড়ুন কনটেন্ট) ভাইরাল করে তোলে।

খাইরুল বাসারের গানে ক্রিঞ্জ পপের উপাদানও পাওয়া যায়, কিন্তু তার মাত্রা ডালে লবণ কম দেওয়ার মতো। ক্রিঞ্জ পপের লিরিক, কম্পোজিশন বা পরিবেশনায় এমন কিছু ‘বেখাপ্পা’ জিনিস থাকে, যাতে শ্রোতার মনে হাসি আর স্যোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করার ডাবল ইচ্ছা জাগে। হির্মারের ‘টেকিং ক্রিঞ্জ পপ সিরিয়াসলি’ গবেষণায় এই ‘সো ব্যাড দ্যাট ইউ ক্যানট স্টপ ওয়াচিং’ ফেনোমেনন নিয়ে কথাবার্তা আছে। আগেই বলেছি খাইরুলের গানে এই মসলা কম পরিমাণে হলেও আছে। সেই মসলাই আমাদের মস্তিষ্কে সিগন্যাল পাঠায়, ‘এটা আমার ফ্রেন্ডকে না পাঠালে চলবে না!’

এরপর আসবে খাইরুল বাসারের গানে 'লোকাল অথেনটিসিটি'র কথা। ফেসবুকে আর ইউটিউবে এমন 'লোকাল' গানের ভিডিও হরহামেশাই ভাইরাল হতে দেখবেন। অর্গানিক 'ভাইব'ই এসব গানের ভাইরালিটিকে বাড়িয়ে দেয়। বাংলা স্ট্রিমে প্রকাশিত 'আমাদের কান–মন–মিম দখল করা এই দশকের ৭টি ভাইরাল গান-এর তালিকায় তাকালেই গান ভাইরালের ক্ষেত্রে লোকাল অথেনটিসিটির ভূমিকা আন্দাজ করা যাবে।

এদিকে স্যোশাল মিডিয়ায় মিম কালচারের যুগে এসে 'মিমেবল' গান স্বাভাবিকভাবেই ভাইরাল হয়। খাইরুল বাসারের গানের বেলায়ও এর প্রমাণ মিলেছে। ‘দেইক্কা লাইছি কইয়া দিমু’ লাইনটি সরকারি দলের চুরি-বাটপারির খবরের মিমে ঢুকে পড়েছে। আর জুলাই আন্দোলনের সময় ‘বেশি ফাল পারিস না, পালাইবার জায়গা পাবি না’ গানের লাইন দিয়ে বানানো মিমও দেখা গেছে। একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলাম, খাইরুল বাসারের গানের 'সিমটম আর রংতামাশা' লাইনটা যেন 'হোয়াই ইউ অ্যাক্টিং সাস' মিমের বাংলা ভার্শন।

সব মিলিয়ে খাইরুল বাসারের গান ভাইরাল হওয়া দাঁড়িয়ে আছে সাত ফর্মুলার ওপর--ক্যাচি হুক, রিলেটেবল লিরিক, সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ফরম্যাটে শেয়ার-ফ্রেন্ডলি, পার্টিসিপেটরি কালচার, শেয়ারিং নেটওয়ার্ক, খানিকটা ক্রিঞ্জ চার্ম আর লোকাল অথেনটিসিটি। এই সাতের কম্বো তাঁকে বানিয়েছে চলতি সময়ের নেটদুনিয়ায় ভাইরাল গানের চেনা-মুখ।

বিলি আইলিশ যেখানে গানে কষ্টের কথা বলেন ‘কুল’ ভঙ্গিতে, খাইরুল বাসার সেখানে বলেন হেসে-খেলে। আর খাইরুল বাসারের ফ্যানদের কাছে ‘পিনিক’ হলো আনপলিশড এনার্জি–পাশের বাড়ির উঠানে বসে বসে গাওয়ার মতো পরিবেশে হারমোনিয়াম হাতে এক টেকের গান; যা অ্যাস্থেটিক না, বরং লোকাল। মানে পাড়া-মহল্লার চেনা কারও গান, যে হয়তো একটু পরেই দেখা হলে বলবে, ‘ভাইস্তা, কি অবস্তা?’

Ad 300x250

সম্পর্কিত