সুমন সুবহান

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই ছিল না। এটি ছিল সামরিক কৌশল প্রয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনী গঠিত হয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। মিত্রবাহিনীতে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ছিল প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার থেকে ২ লাখ। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার ছিলেন নিয়মিত যোদ্ধা। আর প্রায় ৭০ হাজার থেকে ৯৫ হাজার ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা। সব মিলিয়ে মিত্রবাহিনীর মোট জনবল দাঁড়ায় আনুমানিক ২ লাখ ৬০ হাজার থেকে ৩ লাখ ২৫ হাজার।
এর বিপরীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্য ছিল প্রায় ৯৩ হাজার। এদের মধ্যে প্রায় ৫৫ হাজার ছিলেন সরাসরি সশস্ত্র সৈন্য। বাকি সদস্যরা ছিলেন আধাসামরিক বাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনিক সহায়ক কর্মী। সংখ্যা ও সক্ষমতার এই ঘাটতি মোকাবিলায় পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব একটি বিশেষ প্রতিরক্ষা কৌশল গ্রহণ করে।
এই কৌশলের নাম ছিল ‘ফোর্ট্রেস কনসেপ্ট’ বা ‘দুর্গ ধারণা’। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহরকে শক্ত দুর্গে পরিণত করা। সেই দুর্গগুলোতে সৈন্য ও অস্ত্র জড়ো করে মিত্রবাহিনীকে দীর্ঘ সময় আটকে রাখা। এভাবে যুদ্ধ দীর্ঘ করে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি এই কৌশল বাস্তবায়ন করেন। তিনি সৈন্যদের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা দুর্গগুলোতে মোতায়েন করেন। এই দুর্গগুলোকে আলাদা আলাদা ‘প্রতিরোধের দ্বীপ’ হিসেবে ভাবা হয়েছিল।
পাকিস্তানের সামরিক নীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি ধারণা প্রচলিত ছিল—‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পশ্চিমে নিহিত।’ এর অর্থ ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ হলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে চাপ কমানো হবে। এই ধারণাটি পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে আইয়ুব খানের শাসনামলে গৃহীত হয়।
এর বিপরীতে মিত্রবাহিনী কোনো পুরোনো প্রতিরক্ষার ধারণা অনুসরণ করেনি। বরং তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও আধুনিক কৌশল গ্রহণ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ড ব্যবহার করে ‘বাইপাস কৌশল’ ও ‘ব্লিটজক্রিগ’।
এই কৌশলে বড় বড় দুর্গে সরাসরি আক্রমণ না করে সেগুলো পাশ কাটিয়ে এগোনো হয়। মূল লক্ষ্য ছিল দ্রুত ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া। এই গতিশীল আক্রমণের সামনে নিয়াজির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা টিকতে পারেনি। দুর্গগুলো একে একে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগ ও সমন্বয় ভেঙে যায়।
এর ফলাফল ছিল দ্রুত ও চূড়ান্ত। মাত্র ১৩ দিনের মধ্যেই ঢাকার পতন ঘটে। এই অভিযান আধুনিক সামরিক ইতিহাসে ‘ম্যানুভার ওয়ারফেয়ার’-এর একটি অন্যতম উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
‘দুর্গ ধারণা’ একটি প্রতিরক্ষামূলক সামরিক কৌশল। এই কৌশলে শহর বা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোকে শক্ত দুর্গে রূপান্তর করা হয়। দুর্গগুলোতে ভারী অস্ত্র ও প্রশিক্ষিত সৈন্য মোতায়েন থাকে। এই কৌশলের ব্যবহার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাপকভাবে দেখা যায়।
বিশেষ করে নরম্যান্ডি অভিযানের আগে জার্মানদের তৈরি ‘আটলান্টিক ওয়াল’ ছিল এর বড় উদাহরণ। চেরবুর্গের মতো গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও শহরগুলোকে তখন শক্ত দুর্গে পরিণত করা হয়েছিল। উপকূল থেকে দেশের ভেতর পর্যন্ত ধাপে ধাপে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, যাকে বলা হয় ‘ডিফেন্স ইন ডেপথ’।
এই ধরনের প্রতিরক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল শত্রুর অগ্রযাত্রা ধীর করা। এর মাধ্যমে আক্রমণকারী বাহিনীকে দীর্ঘ সময় ব্যস্ত রাখা যেত। ১৯৭১ সালে নিয়াজির পরিকল্পনার সঙ্গে এই লক্ষ্যটির স্পষ্ট মিল ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাবাহিনী পিছু হটার সময়ও এই কৌশল ব্যবহার করেছিল। হিটলারের নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ শহর, বন্দর ও যোগাযোগকেন্দ্রে ছোট কিন্তু সুসজ্জিত সেনাদল মোতায়েন করা হতো। তাদের কাজ ছিল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া।
এই প্রতিরোধের উদ্দেশ্য জয় অর্জন নয়। মূল লক্ষ্য ছিল শত্রুর গতি কমানো। এভাবে অন্য যুদ্ধক্ষেত্রে সময় ও সুযোগ তৈরি করা হতো। সামরিক ভাষায় এই কৌশলকে বলা হয় ‘হোল্ডিং ডিফেন্স’ বা ‘শহরকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা’। এর লক্ষ্য যুদ্ধ জেতা নয়, বরং আত্মসমর্পণ বিলম্বিত করা।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি এই কৌশল নিজের ইচ্ছায় নেননি। তার সামনে পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল। প্রথম এবং প্রধান সমস্যা ছিল সৈন্যের স্বল্পতা। অপারেশন সার্চলাইটের পর বাঙালিদের প্রতিরোধ বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক চাপও তীব্র হয়। একই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজন থাকায় পূর্ব পাকিস্তানে পর্যাপ্ত সংখ্যক নিয়মিত সৈন্য রাখা সম্ভব হয়নি।
এই সীমিত জনবল দিয়ে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্রতিরক্ষা বজায় রাখা নিয়াজির পক্ষে অসম্ভব ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভয়াবহ যোগাযোগ সংকট। মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ও মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। সেতু ও সড়ক পথ ভেঙে পড়ায় বড় আকারে সৈন্য চলাচল বা রসদ পাঠানো সম্ভব হয়নি। এই বাস্তবতায় নিয়াজি সৈন্যদের এক জায়গায় জড়ো করতে পারেননি। বরং তিনি বাধ্য হন শক্তিকে ছড়িয়ে দিয়ে আলাদা আলাদা দুর্গে সৈন্য মোতায়েন করতে।
নিয়াজির আরেকটি বড় উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ দীর্ঘ করা। তাই তার লক্ষ্য ছিল মিত্রবাহিনীকে প্রতিটি দুর্গে আটকে রেখে যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছিলেন তিনি। এই সময়ের মধ্যেই তিনি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ আশা করেছিলেন। বিশেষ করে জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি বা সামরিক চাপ তৈরির সুযোগ খোঁজাই ছিল তার লক্ষ্য।
এ ছাড়া নিয়াজি বিশ্বাস করতেন, পূর্ব পাকিস্তানের নদী-নালা ও জলাভূমি মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকাতে সহায়ক হবে। তিনি এই ভূ-প্রকৃতিকে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সামরিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক চাপ এবং ভৌগোলিক বাস্তবতা—এই সবকিছু মিলিয়েই নিয়াজিকে চিরাচরিত আক্রমণাত্মক কৌশল বাদ দিয়ে ‘দুর্গ ধারণা’-র ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করে।
জেনারেল এ এ কে নিয়াজি তার ‘দুর্গ ধারণা’কে দুটি প্রধান স্তরে ভাগ করে পরিকল্পনা করেছিলেন। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা ধীর করা এবং সময় নষ্ট করানো। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
প্রথম স্তর ছিল সীমান্তবর্তী এলাকা। এখানে ছোট ছোট সীমান্ত চৌকি স্থাপন করা হয়, যাকে ‘ফরোয়ার্ড জোন’ বলা হতো। এই চৌকিগুলোর উদ্দেশ্য ছিল শত্রুকে বেশি সময় আটকে রাখা নয়। মূল লক্ষ্য ছিল মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত করা।
এতে মূল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুতির সময় পাওয়া যাবে—এমনটাই ধারণা ছিল। এই সীমান্ত চৌকিগুলোতে হালকা অস্ত্রধারী ছোট সেনাদল মোতায়েন ছিল। তাদের কাজ ছিল প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
নিয়াজি আশা করেছিলেন, এসব চৌকি দখল করতে গিয়ে মিত্রবাহিনী কিছুটা সময় হারাবে। কিন্তু এই স্তরে পর্যাপ্ত সৈন্য ও রসদ ছিল না। প্রতিরক্ষা ছিল দুর্বল ও অগভীর। এটি ছিল নিয়াজির পরিকল্পনার একটি বড় দুর্বলতা। ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী খুব দ্রুত এই স্তর ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এর ফলে মূল দুর্গগুলো সরাসরি হুমকির মুখে পড়ে যায়।
দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর ছিল ‘ফর্টিফাইড আইল্যান্ড’। এটি ছিল নিয়াজির পুরো রণকৌশলের কেন্দ্রবিন্দু।
এই স্তরে ঢাকা অভিমুখী প্রধান সড়ক ও রেলপথের মোড়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোকে দুর্গে রূপান্তর করা হয়। এর মধ্যে যশোর, হিলি, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, জামালপুর, সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম ছিল উল্লেখযোগ্য।
এই শহরগুলোতে তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যক হলেও সুসংগঠিত ও শক্ত অবস্থানে থাকা সৈন্য মোতায়েন করা হয়। প্রতিটি দুর্গকে মাইন, বাঙ্কার এবং কাদা-জলঘেরা এলাকায় সুরক্ষিত করা হয়।
পরিকল্পনা ছিল, মিত্রবাহিনী এসব দুর্গে আটকে পড়বে। তাদের আলাদা আলাদাভাবে যুদ্ধ করতে হবে। এতে ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না। এই দুর্গগুলো মূল প্রতিরক্ষা রেখা থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও একেকটি স্বাধীন ‘প্রতিরোধের দ্বীপ’ হিসেবে কাজ করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল।
নিয়াজির বিশ্বাস ছিল, এইভাবে যুদ্ধ দীর্ঘ করা গেলে মিত্রবাহিনীর চূড়ান্ত বিজয় দেরি হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হবে।
জেনারেল নিয়াজির ‘ফোর্ট্রেস কনসেপ্ট’ মোকাবিলায় মিত্রবাহিনী সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ নেয়। তারা গ্রহণ করে ‘বাইপাস কৌশল’ ও ‘ব্লিটজক্রিগ’, অর্থাৎ দ্রুতগতির যুদ্ধপদ্ধতি। এই কৌশলের মূল ভাবনা ছিল সুরক্ষিত দুর্গগুলোতে সরাসরি আক্রমণ না করা। বরং সেগুলো সীমিত শক্তি দিয়ে অবরোধে রাখা। একই সঙ্গে দুর্বল প্রতিরক্ষা ভেদ করে দ্রুত ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া।
এই গতিশীল কৌশল পাকিস্তানি বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ভেঙে যায়। ফল হিসেবে মিত্রবাহিনী মাত্র ১৩ দিনের মধ্যেই ঢাকা দখল করতে সক্ষম হয়।
নিয়াজির পরিকল্পনা ছিল প্রতিটি দুর্গে মিত্রবাহিনীকে দীর্ঘ লড়াইয়ে জড়িয়ে ফেলা। এর মাধ্যমে সময় ও জনবল ক্ষয় করানোই ছিল তার লক্ষ্য। মিত্রবাহিনী এই পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দেয়। তারা বড় ও শক্ত দুর্গগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো সরাসরি আক্রমণ না করে সীমিত সংখ্যক সৈন্য দিয়ে সেগুলো অবরোধে রাখা হয়।
এই অবরোধকারী বাহিনীর কাজ ছিল একটাই। পাকিস্তানি সৈন্যদের দুর্গের ভেতরে আটকে রাখা। যাতে তারা বাইরে এসে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে। এর ফলে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সুবিধাজনক অবস্থানে যুদ্ধের সুযোগ পায়নি। এদিকে মিত্রবাহিনীর মূল আক্রমণাত্মক শক্তি দুর্বল প্রতিরক্ষা অঞ্চল দিয়ে দ্রুত ঢাকার দিকে এগিয়ে যায়।
এই কৌশলের সাফল্য শুধু বাইপাসের ওপর নির্ভর করেনি। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল গেরিলা, কমান্ডো ও বিমান হামলার সমন্বয়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দলগুলো পাকিস্তানি দুর্গগুলোর পেছনের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও রসদ সরবরাহ পথ ধ্বংস করে দেয়। ফলে দুর্গে থাকা সৈন্যরা বাইরের সহায়তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাদের মনোবল দ্রুত ভেঙে যায়।
একই সময়ে মিত্রবাহিনী সাঁজোয়া যান ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে দ্রুত অগ্রসর হয়। ফোর্ট্রেসগুলো এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল পথে ঢাকার দিকে এগোনো হয়। টাঙ্গাইলে প্যারাট্রুপার অবতরণ ছিল এই কৌশলের বড় উদাহরণ। এটি পাকিস্তানি বাহিনীকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত করে দেয়।
এর পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও চালানো হয়। নিয়মিত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। বিমান হামলার মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়।
এই সম্মিলিত, দ্রুত ও নমনীয় কৌশলের ফলে নিয়াজির বাহিনী ছড়িয়ে পড়ে এবং যোগাযোগ হারায়। ফোর্ট্রেসগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় থাকেনি। পরিণামে মাত্র ১৩ দিনের মধ্যেই ঢাকা পতন ঘটে। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি নিয়াজির পরিকল্পনার এক বড় ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিশেষ করে পাকিস্তানি বাহিনীর ‘ফোর্ট্রেস কনসেপ্ট’-এর ব্যর্থতা আধুনিক যুদ্ধকৌশল বোঝার জন্য বড় শিক্ষা দেয়।
এই যুদ্ধ দেখায়, স্থির ও রক্ষণাত্মক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক গতিশীল যুদ্ধের সামনে কতটা দুর্বল। একই সঙ্গে এটি প্রমাণ করে যে, সঠিক সিদ্ধান্ত ও দ্রুত গতি যেকোনো দুর্বল প্রতিরক্ষা ভেঙে দিতে পারে।
লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় বাহিনীর সহায়তা এবং যৌথ কমান্ডের কার্যকারিতা—সব মিলিয়ে এই যুদ্ধ সামরিক পরিকল্পনাবিদদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেস স্টাডি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আধুনিক ‘ম্যানুভার ওয়ারফেয়ার’ বা বাইপাস কৌশলের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মিত্রবাহিনী নিয়াজির শক্ত দুর্গভিত্তিক প্রতিরক্ষা সরাসরি আক্রমণ না করে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়।
এই কৌশল দেখায়, শক্ত প্রতিরক্ষার মুখোমুখি না হয়ে শত্রুর দুর্বল জায়গায় আঘাত করাই আধুনিক যুদ্ধের মূলনীতি। সীমিত সৈন্যকে অপ্রয়োজনীয় সংঘর্ষে জড়িয়ে না রেখে মূল শক্তিকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে দ্রুত ব্যবহার করাই বিজয়ের চাবিকাঠি।
এই যুদ্ধ প্রমাণ করে, সীমিত সৈন্য ও দুর্বল মনোবল নিয়ে বিশাল এলাকা কেবল দুর্গ দিয়ে রক্ষা করা বাস্তবসম্মত নয়। নিয়াজির ‘ফোর্ট্রেস কনসেপ্ট’ ছিল একটি বড় কৌশলগত ভুল। এতে সীমিত সামরিক সম্পদ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কোথাও শক্ত প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি।
এটি শেখায়, যখন স্থানীয় জনগণের সমর্থন থাকে না এবং সৈন্যদের মনোবল দুর্বল, তখন শুধু ভূ-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা করা ব্যর্থতা ডেকে আনে।
এই যুদ্ধ ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সফল যৌথ অভিযানের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ ও স্থানীয় ভূ-প্রকৃতির জ্ঞান মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রাকে অনেক সহজ করে তোলে।
পাকিস্তানি বাহিনী যখন যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতায় ভুগছিল, তখন এই সমন্বিত শক্তি দ্রুত ও কার্যকরভাবে কাজ করে।
এটি দেখায়, আধুনিক যুদ্ধে কেবল নিয়মিত বাহিনী নয়, স্থানীয় প্রতিরোধ শক্তির সহযোগিতাও বিজয়ের জন্য অপরিহার্য।
নদী-নালায় ভরা বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি সামরিক অভিযানের জন্য অত্যন্ত কঠিন। পাকিস্তান এই ভূ-প্রকৃতিকে প্রতিরক্ষার ভরসা হিসেবে ধরেছিল। কিন্তু মিত্রবাহিনী দক্ষ লজিস্টিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই বাধা অতিক্রম করে।
পন্টুন সেতু নির্মাণ, সাঁজোয়া যান পারাপার এবং হেলিকপ্টার ব্যবহারের মাধ্যমে তারা দ্রুত অগ্রসর হতে সক্ষম হয়।
এই অভিজ্ঞতা শেখায়, শুধু তাত্ত্বিক কৌশল নয়, বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই প্রস্তুতি ও কার্যকর নেতৃত্বই যুদ্ধের ফল নির্ধারণ করে।
সুন জু’র সামরিক নীতিগুলো বহু শতাব্দী ধরে যুদ্ধকৌশলের মূল ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর গৃহীত ‘বাইপাস কৌশল’ ছিল এসব নীতির আধুনিক ও কার্যকর প্রয়োগ।
জেনারেল নিয়াজির স্থির ও দুর্গভিত্তিক প্রতিরক্ষা মোকাবিলায় মিত্রবাহিনী যে দ্রুত ও গতিশীল কৌশল ব্যবহার করে, তাতে সুন জু’র প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ নীতির প্রতিফলন দেখা যায়।
মিত্রবাহিনী শুরু থেকেই তাদের মূল লক্ষ্য পরিষ্কারভাবে ঠিক করেছিল। লক্ষ্য ছিল যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা দখল করা এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা।
এই লক্ষ্য পূরণে তারা গৌণ সংঘর্ষ এড়িয়ে যায়। যশোর বা কুমিল্লার মতো শক্ত দুর্গগুলো শুধু অবরোধে রাখা হয়। মূল আক্রমণাত্মক শক্তি সরাসরি ঢাকার পথে এগিয়ে যায়।
এতে বোঝা যায়, একটি স্পষ্ট লক্ষ্য ধরে রেখে অপ্রয়োজনীয় লড়াই এড়িয়ে যাওয়াই সফল যুদ্ধের মূল চাবিকাঠি।
মিত্রবাহিনী পুরো যুদ্ধজুড়েই আক্রমণাত্মক অবস্থানে ছিল। এতে নিয়াজির প্রতিরক্ষামূলক পরিকল্পনা কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
দ্রুত গতির আক্রমণ বা ব্লিটজক্রিগের মাধ্যমে মিত্রবাহিনী সব সময় উদ্যোগ নিজের হাতে রাখে। টাঙ্গাইলে প্যারাট্রুপার অবতরণ এর বড় উদাহরণ।
এই অভিযানে ঢাকা প্রতিরক্ষার পেছন থেকে আঘাত করা হয়। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নিরবচ্ছিন্ন চাপের কারণে তারা পুনর্গঠন বা শক্তিবৃদ্ধির সুযোগ পায়নি।
মিত্রবাহিনীর সবচেয়ে বড় বিস্ময় ছিল বাইপাস কৌশল। পাকিস্তানি নেতৃত্ব ভেবেছিল, প্রতিটি দুর্গে রক্তক্ষয়ী লড়াই হবে। কিন্তু মিত্রবাহিনী সেই ধারণা ভেঙে দেয়। তারা দুর্গ এড়িয়ে নদী-নালা ও দুর্বল পথ ব্যবহার করে দ্রুত এগিয়ে যায়।
বিশেষ করে মেঘনা নদী পারাপারে হেলিকপ্টার ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার পাকিস্তানি বাহিনীর প্রত্যাশাকে সম্পূর্ণভাবে ভুল প্রমাণ করে। এই বিস্ময় পাকিস্তানি সৈন্যদের মনোবলে বড় আঘাত হানে।
মিত্রবাহিনী তাদের শক্তি ছড়িয়ে না দিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্যবিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করে। ঢাকার দিকে অগ্রসরমান বাহিনীর কাছে সাঁজোয়া যান ও ভারী অস্ত্রের বড় অংশ রাখা হয়।
ফলে এই বাহিনী দ্রুত যেকোনো প্রতিরোধ ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে অবরোধে রাখা দুর্গগুলোতে অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানো হয়নি। এটি শক্তির সঠিক ব্যবহারের একটি উদাহরণ।
বাইপাস কৌশলের মূল ভিত্তিই ছিল সম্পদের সাশ্রয়। গৌণ লক্ষ্য অর্জনে ন্যূনতম শক্তি ব্যবহার করা হয়। যশোর, কুমিল্লা বা হিলির মতো দুর্গ শুধু অবরোধে রেখে দেওয়া হয়।
এর ফলে মূল আক্রমণের জন্য বড় আকারের শক্তি সংরক্ষিত থাকে। এতে সময় ও সম্পদের অপচয় কমে যায়।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয় ছিল অসাধারণ। এটি ছিল একটি কার্যকর যৌথ কমান্ডের বাস্তব উদাহরণ।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা পাকিস্তানি দুর্গগুলোর পেছনের যোগাযোগ ও রসদ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তারা স্থানীয় ভূ-প্রকৃতির জ্ঞান দিয়ে মিত্রবাহিনীকে নিরাপদ বাইপাস পথও দেখিয়ে দেয়।
এই সমন্বয় কঠিন লজিস্টিক পরিস্থিতিতেও মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা সহজ করে তোলে।
বাংলাদেশের নদী-নালা, ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতু ও মাইন মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রায় বড় বাধা হতে পারত। কিন্তু মিত্রবাহিনী দ্রুত অভিযোজিত হয়। প্রয়োজনে পন্টুন সেতু তৈরি করা হয়। কোথাও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে সৈন্য নামানো হয়।
এই নমনীয়তা প্রমাণ করে, মিত্রবাহিনী অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে এবং বিকল্প পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সক্ষম ছিল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস নয়, বরং আধুনিক সামরিক চিন্তা ও রণকৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণও। লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজির গ্রহণ করা ‘ফোর্ট্রেস কনসেপ্ট’ ছিল মূলত একটি স্থির ও রক্ষণাত্মক কৌশল। এই পরিকল্পনায় সীমিত সামরিক শক্তিকে শহরকেন্দ্রিক দুর্গে আটকে রেখে সময় ক্ষেপণের চেষ্টা করা হয়।
নিয়াজির বিশ্বাস ছিল, প্রতিটি দুর্গ দখল করতে গিয়ে মিত্রবাহিনীকে প্রচুর সময় ও রক্তক্ষয় করতে হবে। এই বিলম্বের মধ্যেই তিনি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের আশা করেছিলেন। কিন্তু এই কৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে। যখন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন থাকে, সরবরাহ লাইন ভেঙে পড়ে এবং সৈন্যদের মনোবল দুর্বল হয়, তখন স্থির প্রতিরক্ষা দ্রুত ভেঙে পড়াই স্বাভাবিক।
নিয়াজির পরিকল্পনার ব্যর্থতা প্রমাণ করে, শুধু ভূ-প্রকৃতির সুবিধা কাজে লাগালেই যুদ্ধ জেতা যায় না। যুদ্ধের গতি, নমনীয়তা এবং সহযোগী শক্তির সমন্বয় উপেক্ষা করলে পরাজয় অনিবার্য হয়। এই কারণেই ‘ফোর্ট্রেস কনসেপ্ট’ সামরিক ইতিহাসে সীমিত সম্পদ দিয়ে বড় লক্ষ্য অর্জনের ব্যর্থ উদাহরণ হিসেবে পরিচিত।
এর বিপরীতে মিত্রবাহিনী গ্রহণ করে সম্পূর্ণ ভিন্ন কৌশল। ‘বাইপাস কৌশল’ ও ‘ব্লিটজক্রিগ’ ছিল সুন জু’র সামরিক নীতির আধুনিক প্রয়োগ। এই কৌশল গতি, বিস্ময় এবং শক্তির সঠিক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেয়। মিত্রবাহিনী শক্ত দুর্গগুলো এড়িয়ে গিয়ে ঢাকার দিকে তাদের প্রধান শক্তি কেন্দ্রীভূত করে। একই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর পেছনের যোগাযোগ ও রসদ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া হয়।
এই সিদ্ধান্ত ছিল যুগান্তকারী। এটি দেখিয়ে দেয়, যুদ্ধে শুধু সংখ্যাগত শক্তি নয়, বরং সঠিক সময়, সঠিক গতি এবং শত্রুর দুর্বল জায়গায় আঘাত করাই জয় নিশ্চিত করে। এর ফলাফল ছিল দ্রুত ও স্পষ্ট। মাত্র ১৩ দিনের মধ্যেই ঢাকা পতন ঘটে। নিয়াজির পুরো বাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এই সাফল্য বাইপাস কৌশলকে বিশ্ব সামরিক ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।
এ কারণে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সামরিক অভিজ্ঞতা ভবিষ্যৎ সামরিক পরিকল্পনাবিদদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। এটি শেখায়, স্থবির প্রতিরক্ষার চেয়ে গতিশীল ও নমনীয় কৌশলই যুদ্ধজয়ের প্রকৃত চাবিকাঠি।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই ছিল না। এটি ছিল সামরিক কৌশল প্রয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনী গঠিত হয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। মিত্রবাহিনীতে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ছিল প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার থেকে ২ লাখ। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার ছিলেন নিয়মিত যোদ্ধা। আর প্রায় ৭০ হাজার থেকে ৯৫ হাজার ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা। সব মিলিয়ে মিত্রবাহিনীর মোট জনবল দাঁড়ায় আনুমানিক ২ লাখ ৬০ হাজার থেকে ৩ লাখ ২৫ হাজার।
এর বিপরীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্য ছিল প্রায় ৯৩ হাজার। এদের মধ্যে প্রায় ৫৫ হাজার ছিলেন সরাসরি সশস্ত্র সৈন্য। বাকি সদস্যরা ছিলেন আধাসামরিক বাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনিক সহায়ক কর্মী। সংখ্যা ও সক্ষমতার এই ঘাটতি মোকাবিলায় পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব একটি বিশেষ প্রতিরক্ষা কৌশল গ্রহণ করে।
এই কৌশলের নাম ছিল ‘ফোর্ট্রেস কনসেপ্ট’ বা ‘দুর্গ ধারণা’। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহরকে শক্ত দুর্গে পরিণত করা। সেই দুর্গগুলোতে সৈন্য ও অস্ত্র জড়ো করে মিত্রবাহিনীকে দীর্ঘ সময় আটকে রাখা। এভাবে যুদ্ধ দীর্ঘ করে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি এই কৌশল বাস্তবায়ন করেন। তিনি সৈন্যদের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা দুর্গগুলোতে মোতায়েন করেন। এই দুর্গগুলোকে আলাদা আলাদা ‘প্রতিরোধের দ্বীপ’ হিসেবে ভাবা হয়েছিল।
পাকিস্তানের সামরিক নীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি ধারণা প্রচলিত ছিল—‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পশ্চিমে নিহিত।’ এর অর্থ ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ হলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে চাপ কমানো হবে। এই ধারণাটি পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে আইয়ুব খানের শাসনামলে গৃহীত হয়।
এর বিপরীতে মিত্রবাহিনী কোনো পুরোনো প্রতিরক্ষার ধারণা অনুসরণ করেনি। বরং তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও আধুনিক কৌশল গ্রহণ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ড ব্যবহার করে ‘বাইপাস কৌশল’ ও ‘ব্লিটজক্রিগ’।
এই কৌশলে বড় বড় দুর্গে সরাসরি আক্রমণ না করে সেগুলো পাশ কাটিয়ে এগোনো হয়। মূল লক্ষ্য ছিল দ্রুত ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া। এই গতিশীল আক্রমণের সামনে নিয়াজির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা টিকতে পারেনি। দুর্গগুলো একে একে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগ ও সমন্বয় ভেঙে যায়।
এর ফলাফল ছিল দ্রুত ও চূড়ান্ত। মাত্র ১৩ দিনের মধ্যেই ঢাকার পতন ঘটে। এই অভিযান আধুনিক সামরিক ইতিহাসে ‘ম্যানুভার ওয়ারফেয়ার’-এর একটি অন্যতম উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
‘দুর্গ ধারণা’ একটি প্রতিরক্ষামূলক সামরিক কৌশল। এই কৌশলে শহর বা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোকে শক্ত দুর্গে রূপান্তর করা হয়। দুর্গগুলোতে ভারী অস্ত্র ও প্রশিক্ষিত সৈন্য মোতায়েন থাকে। এই কৌশলের ব্যবহার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাপকভাবে দেখা যায়।
বিশেষ করে নরম্যান্ডি অভিযানের আগে জার্মানদের তৈরি ‘আটলান্টিক ওয়াল’ ছিল এর বড় উদাহরণ। চেরবুর্গের মতো গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও শহরগুলোকে তখন শক্ত দুর্গে পরিণত করা হয়েছিল। উপকূল থেকে দেশের ভেতর পর্যন্ত ধাপে ধাপে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, যাকে বলা হয় ‘ডিফেন্স ইন ডেপথ’।
এই ধরনের প্রতিরক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল শত্রুর অগ্রযাত্রা ধীর করা। এর মাধ্যমে আক্রমণকারী বাহিনীকে দীর্ঘ সময় ব্যস্ত রাখা যেত। ১৯৭১ সালে নিয়াজির পরিকল্পনার সঙ্গে এই লক্ষ্যটির স্পষ্ট মিল ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাবাহিনী পিছু হটার সময়ও এই কৌশল ব্যবহার করেছিল। হিটলারের নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ শহর, বন্দর ও যোগাযোগকেন্দ্রে ছোট কিন্তু সুসজ্জিত সেনাদল মোতায়েন করা হতো। তাদের কাজ ছিল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া।
এই প্রতিরোধের উদ্দেশ্য জয় অর্জন নয়। মূল লক্ষ্য ছিল শত্রুর গতি কমানো। এভাবে অন্য যুদ্ধক্ষেত্রে সময় ও সুযোগ তৈরি করা হতো। সামরিক ভাষায় এই কৌশলকে বলা হয় ‘হোল্ডিং ডিফেন্স’ বা ‘শহরকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা’। এর লক্ষ্য যুদ্ধ জেতা নয়, বরং আত্মসমর্পণ বিলম্বিত করা।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি এই কৌশল নিজের ইচ্ছায় নেননি। তার সামনে পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল। প্রথম এবং প্রধান সমস্যা ছিল সৈন্যের স্বল্পতা। অপারেশন সার্চলাইটের পর বাঙালিদের প্রতিরোধ বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক চাপও তীব্র হয়। একই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজন থাকায় পূর্ব পাকিস্তানে পর্যাপ্ত সংখ্যক নিয়মিত সৈন্য রাখা সম্ভব হয়নি।
এই সীমিত জনবল দিয়ে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্রতিরক্ষা বজায় রাখা নিয়াজির পক্ষে অসম্ভব ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভয়াবহ যোগাযোগ সংকট। মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ও মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। সেতু ও সড়ক পথ ভেঙে পড়ায় বড় আকারে সৈন্য চলাচল বা রসদ পাঠানো সম্ভব হয়নি। এই বাস্তবতায় নিয়াজি সৈন্যদের এক জায়গায় জড়ো করতে পারেননি। বরং তিনি বাধ্য হন শক্তিকে ছড়িয়ে দিয়ে আলাদা আলাদা দুর্গে সৈন্য মোতায়েন করতে।
নিয়াজির আরেকটি বড় উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ দীর্ঘ করা। তাই তার লক্ষ্য ছিল মিত্রবাহিনীকে প্রতিটি দুর্গে আটকে রেখে যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছিলেন তিনি। এই সময়ের মধ্যেই তিনি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ আশা করেছিলেন। বিশেষ করে জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি বা সামরিক চাপ তৈরির সুযোগ খোঁজাই ছিল তার লক্ষ্য।
এ ছাড়া নিয়াজি বিশ্বাস করতেন, পূর্ব পাকিস্তানের নদী-নালা ও জলাভূমি মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকাতে সহায়ক হবে। তিনি এই ভূ-প্রকৃতিকে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সামরিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক চাপ এবং ভৌগোলিক বাস্তবতা—এই সবকিছু মিলিয়েই নিয়াজিকে চিরাচরিত আক্রমণাত্মক কৌশল বাদ দিয়ে ‘দুর্গ ধারণা’-র ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করে।
জেনারেল এ এ কে নিয়াজি তার ‘দুর্গ ধারণা’কে দুটি প্রধান স্তরে ভাগ করে পরিকল্পনা করেছিলেন। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা ধীর করা এবং সময় নষ্ট করানো। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
প্রথম স্তর ছিল সীমান্তবর্তী এলাকা। এখানে ছোট ছোট সীমান্ত চৌকি স্থাপন করা হয়, যাকে ‘ফরোয়ার্ড জোন’ বলা হতো। এই চৌকিগুলোর উদ্দেশ্য ছিল শত্রুকে বেশি সময় আটকে রাখা নয়। মূল লক্ষ্য ছিল মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত করা।
এতে মূল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুতির সময় পাওয়া যাবে—এমনটাই ধারণা ছিল। এই সীমান্ত চৌকিগুলোতে হালকা অস্ত্রধারী ছোট সেনাদল মোতায়েন ছিল। তাদের কাজ ছিল প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
নিয়াজি আশা করেছিলেন, এসব চৌকি দখল করতে গিয়ে মিত্রবাহিনী কিছুটা সময় হারাবে। কিন্তু এই স্তরে পর্যাপ্ত সৈন্য ও রসদ ছিল না। প্রতিরক্ষা ছিল দুর্বল ও অগভীর। এটি ছিল নিয়াজির পরিকল্পনার একটি বড় দুর্বলতা। ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী খুব দ্রুত এই স্তর ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এর ফলে মূল দুর্গগুলো সরাসরি হুমকির মুখে পড়ে যায়।
দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর ছিল ‘ফর্টিফাইড আইল্যান্ড’। এটি ছিল নিয়াজির পুরো রণকৌশলের কেন্দ্রবিন্দু।
এই স্তরে ঢাকা অভিমুখী প্রধান সড়ক ও রেলপথের মোড়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোকে দুর্গে রূপান্তর করা হয়। এর মধ্যে যশোর, হিলি, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, জামালপুর, সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম ছিল উল্লেখযোগ্য।
এই শহরগুলোতে তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যক হলেও সুসংগঠিত ও শক্ত অবস্থানে থাকা সৈন্য মোতায়েন করা হয়। প্রতিটি দুর্গকে মাইন, বাঙ্কার এবং কাদা-জলঘেরা এলাকায় সুরক্ষিত করা হয়।
পরিকল্পনা ছিল, মিত্রবাহিনী এসব দুর্গে আটকে পড়বে। তাদের আলাদা আলাদাভাবে যুদ্ধ করতে হবে। এতে ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না। এই দুর্গগুলো মূল প্রতিরক্ষা রেখা থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও একেকটি স্বাধীন ‘প্রতিরোধের দ্বীপ’ হিসেবে কাজ করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল।
নিয়াজির বিশ্বাস ছিল, এইভাবে যুদ্ধ দীর্ঘ করা গেলে মিত্রবাহিনীর চূড়ান্ত বিজয় দেরি হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হবে।
জেনারেল নিয়াজির ‘ফোর্ট্রেস কনসেপ্ট’ মোকাবিলায় মিত্রবাহিনী সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ নেয়। তারা গ্রহণ করে ‘বাইপাস কৌশল’ ও ‘ব্লিটজক্রিগ’, অর্থাৎ দ্রুতগতির যুদ্ধপদ্ধতি। এই কৌশলের মূল ভাবনা ছিল সুরক্ষিত দুর্গগুলোতে সরাসরি আক্রমণ না করা। বরং সেগুলো সীমিত শক্তি দিয়ে অবরোধে রাখা। একই সঙ্গে দুর্বল প্রতিরক্ষা ভেদ করে দ্রুত ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া।
এই গতিশীল কৌশল পাকিস্তানি বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ভেঙে যায়। ফল হিসেবে মিত্রবাহিনী মাত্র ১৩ দিনের মধ্যেই ঢাকা দখল করতে সক্ষম হয়।
নিয়াজির পরিকল্পনা ছিল প্রতিটি দুর্গে মিত্রবাহিনীকে দীর্ঘ লড়াইয়ে জড়িয়ে ফেলা। এর মাধ্যমে সময় ও জনবল ক্ষয় করানোই ছিল তার লক্ষ্য। মিত্রবাহিনী এই পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দেয়। তারা বড় ও শক্ত দুর্গগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো সরাসরি আক্রমণ না করে সীমিত সংখ্যক সৈন্য দিয়ে সেগুলো অবরোধে রাখা হয়।
এই অবরোধকারী বাহিনীর কাজ ছিল একটাই। পাকিস্তানি সৈন্যদের দুর্গের ভেতরে আটকে রাখা। যাতে তারা বাইরে এসে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে। এর ফলে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সুবিধাজনক অবস্থানে যুদ্ধের সুযোগ পায়নি। এদিকে মিত্রবাহিনীর মূল আক্রমণাত্মক শক্তি দুর্বল প্রতিরক্ষা অঞ্চল দিয়ে দ্রুত ঢাকার দিকে এগিয়ে যায়।
এই কৌশলের সাফল্য শুধু বাইপাসের ওপর নির্ভর করেনি। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল গেরিলা, কমান্ডো ও বিমান হামলার সমন্বয়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দলগুলো পাকিস্তানি দুর্গগুলোর পেছনের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও রসদ সরবরাহ পথ ধ্বংস করে দেয়। ফলে দুর্গে থাকা সৈন্যরা বাইরের সহায়তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাদের মনোবল দ্রুত ভেঙে যায়।
একই সময়ে মিত্রবাহিনী সাঁজোয়া যান ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে দ্রুত অগ্রসর হয়। ফোর্ট্রেসগুলো এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল পথে ঢাকার দিকে এগোনো হয়। টাঙ্গাইলে প্যারাট্রুপার অবতরণ ছিল এই কৌশলের বড় উদাহরণ। এটি পাকিস্তানি বাহিনীকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত করে দেয়।
এর পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও চালানো হয়। নিয়মিত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। বিমান হামলার মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়।
এই সম্মিলিত, দ্রুত ও নমনীয় কৌশলের ফলে নিয়াজির বাহিনী ছড়িয়ে পড়ে এবং যোগাযোগ হারায়। ফোর্ট্রেসগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় থাকেনি। পরিণামে মাত্র ১৩ দিনের মধ্যেই ঢাকা পতন ঘটে। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি নিয়াজির পরিকল্পনার এক বড় ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিশেষ করে পাকিস্তানি বাহিনীর ‘ফোর্ট্রেস কনসেপ্ট’-এর ব্যর্থতা আধুনিক যুদ্ধকৌশল বোঝার জন্য বড় শিক্ষা দেয়।
এই যুদ্ধ দেখায়, স্থির ও রক্ষণাত্মক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক গতিশীল যুদ্ধের সামনে কতটা দুর্বল। একই সঙ্গে এটি প্রমাণ করে যে, সঠিক সিদ্ধান্ত ও দ্রুত গতি যেকোনো দুর্বল প্রতিরক্ষা ভেঙে দিতে পারে।
লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় বাহিনীর সহায়তা এবং যৌথ কমান্ডের কার্যকারিতা—সব মিলিয়ে এই যুদ্ধ সামরিক পরিকল্পনাবিদদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেস স্টাডি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আধুনিক ‘ম্যানুভার ওয়ারফেয়ার’ বা বাইপাস কৌশলের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মিত্রবাহিনী নিয়াজির শক্ত দুর্গভিত্তিক প্রতিরক্ষা সরাসরি আক্রমণ না করে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়।
এই কৌশল দেখায়, শক্ত প্রতিরক্ষার মুখোমুখি না হয়ে শত্রুর দুর্বল জায়গায় আঘাত করাই আধুনিক যুদ্ধের মূলনীতি। সীমিত সৈন্যকে অপ্রয়োজনীয় সংঘর্ষে জড়িয়ে না রেখে মূল শক্তিকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে দ্রুত ব্যবহার করাই বিজয়ের চাবিকাঠি।
এই যুদ্ধ প্রমাণ করে, সীমিত সৈন্য ও দুর্বল মনোবল নিয়ে বিশাল এলাকা কেবল দুর্গ দিয়ে রক্ষা করা বাস্তবসম্মত নয়। নিয়াজির ‘ফোর্ট্রেস কনসেপ্ট’ ছিল একটি বড় কৌশলগত ভুল। এতে সীমিত সামরিক সম্পদ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কোথাও শক্ত প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি।
এটি শেখায়, যখন স্থানীয় জনগণের সমর্থন থাকে না এবং সৈন্যদের মনোবল দুর্বল, তখন শুধু ভূ-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা করা ব্যর্থতা ডেকে আনে।
এই যুদ্ধ ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সফল যৌথ অভিযানের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ ও স্থানীয় ভূ-প্রকৃতির জ্ঞান মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রাকে অনেক সহজ করে তোলে।
পাকিস্তানি বাহিনী যখন যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতায় ভুগছিল, তখন এই সমন্বিত শক্তি দ্রুত ও কার্যকরভাবে কাজ করে।
এটি দেখায়, আধুনিক যুদ্ধে কেবল নিয়মিত বাহিনী নয়, স্থানীয় প্রতিরোধ শক্তির সহযোগিতাও বিজয়ের জন্য অপরিহার্য।
নদী-নালায় ভরা বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি সামরিক অভিযানের জন্য অত্যন্ত কঠিন। পাকিস্তান এই ভূ-প্রকৃতিকে প্রতিরক্ষার ভরসা হিসেবে ধরেছিল। কিন্তু মিত্রবাহিনী দক্ষ লজিস্টিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই বাধা অতিক্রম করে।
পন্টুন সেতু নির্মাণ, সাঁজোয়া যান পারাপার এবং হেলিকপ্টার ব্যবহারের মাধ্যমে তারা দ্রুত অগ্রসর হতে সক্ষম হয়।
এই অভিজ্ঞতা শেখায়, শুধু তাত্ত্বিক কৌশল নয়, বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই প্রস্তুতি ও কার্যকর নেতৃত্বই যুদ্ধের ফল নির্ধারণ করে।
সুন জু’র সামরিক নীতিগুলো বহু শতাব্দী ধরে যুদ্ধকৌশলের মূল ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর গৃহীত ‘বাইপাস কৌশল’ ছিল এসব নীতির আধুনিক ও কার্যকর প্রয়োগ।
জেনারেল নিয়াজির স্থির ও দুর্গভিত্তিক প্রতিরক্ষা মোকাবিলায় মিত্রবাহিনী যে দ্রুত ও গতিশীল কৌশল ব্যবহার করে, তাতে সুন জু’র প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ নীতির প্রতিফলন দেখা যায়।
মিত্রবাহিনী শুরু থেকেই তাদের মূল লক্ষ্য পরিষ্কারভাবে ঠিক করেছিল। লক্ষ্য ছিল যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা দখল করা এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা।
এই লক্ষ্য পূরণে তারা গৌণ সংঘর্ষ এড়িয়ে যায়। যশোর বা কুমিল্লার মতো শক্ত দুর্গগুলো শুধু অবরোধে রাখা হয়। মূল আক্রমণাত্মক শক্তি সরাসরি ঢাকার পথে এগিয়ে যায়।
এতে বোঝা যায়, একটি স্পষ্ট লক্ষ্য ধরে রেখে অপ্রয়োজনীয় লড়াই এড়িয়ে যাওয়াই সফল যুদ্ধের মূল চাবিকাঠি।
মিত্রবাহিনী পুরো যুদ্ধজুড়েই আক্রমণাত্মক অবস্থানে ছিল। এতে নিয়াজির প্রতিরক্ষামূলক পরিকল্পনা কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
দ্রুত গতির আক্রমণ বা ব্লিটজক্রিগের মাধ্যমে মিত্রবাহিনী সব সময় উদ্যোগ নিজের হাতে রাখে। টাঙ্গাইলে প্যারাট্রুপার অবতরণ এর বড় উদাহরণ।
এই অভিযানে ঢাকা প্রতিরক্ষার পেছন থেকে আঘাত করা হয়। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নিরবচ্ছিন্ন চাপের কারণে তারা পুনর্গঠন বা শক্তিবৃদ্ধির সুযোগ পায়নি।
মিত্রবাহিনীর সবচেয়ে বড় বিস্ময় ছিল বাইপাস কৌশল। পাকিস্তানি নেতৃত্ব ভেবেছিল, প্রতিটি দুর্গে রক্তক্ষয়ী লড়াই হবে। কিন্তু মিত্রবাহিনী সেই ধারণা ভেঙে দেয়। তারা দুর্গ এড়িয়ে নদী-নালা ও দুর্বল পথ ব্যবহার করে দ্রুত এগিয়ে যায়।
বিশেষ করে মেঘনা নদী পারাপারে হেলিকপ্টার ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার পাকিস্তানি বাহিনীর প্রত্যাশাকে সম্পূর্ণভাবে ভুল প্রমাণ করে। এই বিস্ময় পাকিস্তানি সৈন্যদের মনোবলে বড় আঘাত হানে।
মিত্রবাহিনী তাদের শক্তি ছড়িয়ে না দিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্যবিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করে। ঢাকার দিকে অগ্রসরমান বাহিনীর কাছে সাঁজোয়া যান ও ভারী অস্ত্রের বড় অংশ রাখা হয়।
ফলে এই বাহিনী দ্রুত যেকোনো প্রতিরোধ ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে অবরোধে রাখা দুর্গগুলোতে অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানো হয়নি। এটি শক্তির সঠিক ব্যবহারের একটি উদাহরণ।
বাইপাস কৌশলের মূল ভিত্তিই ছিল সম্পদের সাশ্রয়। গৌণ লক্ষ্য অর্জনে ন্যূনতম শক্তি ব্যবহার করা হয়। যশোর, কুমিল্লা বা হিলির মতো দুর্গ শুধু অবরোধে রেখে দেওয়া হয়।
এর ফলে মূল আক্রমণের জন্য বড় আকারের শক্তি সংরক্ষিত থাকে। এতে সময় ও সম্পদের অপচয় কমে যায়।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয় ছিল অসাধারণ। এটি ছিল একটি কার্যকর যৌথ কমান্ডের বাস্তব উদাহরণ।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা পাকিস্তানি দুর্গগুলোর পেছনের যোগাযোগ ও রসদ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তারা স্থানীয় ভূ-প্রকৃতির জ্ঞান দিয়ে মিত্রবাহিনীকে নিরাপদ বাইপাস পথও দেখিয়ে দেয়।
এই সমন্বয় কঠিন লজিস্টিক পরিস্থিতিতেও মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা সহজ করে তোলে।
বাংলাদেশের নদী-নালা, ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতু ও মাইন মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রায় বড় বাধা হতে পারত। কিন্তু মিত্রবাহিনী দ্রুত অভিযোজিত হয়। প্রয়োজনে পন্টুন সেতু তৈরি করা হয়। কোথাও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে সৈন্য নামানো হয়।
এই নমনীয়তা প্রমাণ করে, মিত্রবাহিনী অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে এবং বিকল্প পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সক্ষম ছিল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস নয়, বরং আধুনিক সামরিক চিন্তা ও রণকৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণও। লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজির গ্রহণ করা ‘ফোর্ট্রেস কনসেপ্ট’ ছিল মূলত একটি স্থির ও রক্ষণাত্মক কৌশল। এই পরিকল্পনায় সীমিত সামরিক শক্তিকে শহরকেন্দ্রিক দুর্গে আটকে রেখে সময় ক্ষেপণের চেষ্টা করা হয়।
নিয়াজির বিশ্বাস ছিল, প্রতিটি দুর্গ দখল করতে গিয়ে মিত্রবাহিনীকে প্রচুর সময় ও রক্তক্ষয় করতে হবে। এই বিলম্বের মধ্যেই তিনি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের আশা করেছিলেন। কিন্তু এই কৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে। যখন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন থাকে, সরবরাহ লাইন ভেঙে পড়ে এবং সৈন্যদের মনোবল দুর্বল হয়, তখন স্থির প্রতিরক্ষা দ্রুত ভেঙে পড়াই স্বাভাবিক।
নিয়াজির পরিকল্পনার ব্যর্থতা প্রমাণ করে, শুধু ভূ-প্রকৃতির সুবিধা কাজে লাগালেই যুদ্ধ জেতা যায় না। যুদ্ধের গতি, নমনীয়তা এবং সহযোগী শক্তির সমন্বয় উপেক্ষা করলে পরাজয় অনিবার্য হয়। এই কারণেই ‘ফোর্ট্রেস কনসেপ্ট’ সামরিক ইতিহাসে সীমিত সম্পদ দিয়ে বড় লক্ষ্য অর্জনের ব্যর্থ উদাহরণ হিসেবে পরিচিত।
এর বিপরীতে মিত্রবাহিনী গ্রহণ করে সম্পূর্ণ ভিন্ন কৌশল। ‘বাইপাস কৌশল’ ও ‘ব্লিটজক্রিগ’ ছিল সুন জু’র সামরিক নীতির আধুনিক প্রয়োগ। এই কৌশল গতি, বিস্ময় এবং শক্তির সঠিক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেয়। মিত্রবাহিনী শক্ত দুর্গগুলো এড়িয়ে গিয়ে ঢাকার দিকে তাদের প্রধান শক্তি কেন্দ্রীভূত করে। একই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর পেছনের যোগাযোগ ও রসদ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া হয়।
এই সিদ্ধান্ত ছিল যুগান্তকারী। এটি দেখিয়ে দেয়, যুদ্ধে শুধু সংখ্যাগত শক্তি নয়, বরং সঠিক সময়, সঠিক গতি এবং শত্রুর দুর্বল জায়গায় আঘাত করাই জয় নিশ্চিত করে। এর ফলাফল ছিল দ্রুত ও স্পষ্ট। মাত্র ১৩ দিনের মধ্যেই ঢাকা পতন ঘটে। নিয়াজির পুরো বাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এই সাফল্য বাইপাস কৌশলকে বিশ্ব সামরিক ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।
এ কারণে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সামরিক অভিজ্ঞতা ভবিষ্যৎ সামরিক পরিকল্পনাবিদদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। এটি শেখায়, স্থবির প্রতিরক্ষার চেয়ে গতিশীল ও নমনীয় কৌশলই যুদ্ধজয়ের প্রকৃত চাবিকাঠি।

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডি সমুদ্র সৈকতে রবিবার এক ভয়াবহ বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় এক পথচারী সাহসিকতার সঙ্গে হামলাকারীদের একজনকে নিরস্ত্র করেন। ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
৫ ঘণ্টা আগে
সদ্য মুক্তি পাওয়া একটি বলিউডি গোয়েন্দা সিনেমা ভারত ও পাকিস্তানে প্রশংসা যেমন কুড়াচ্ছে, তেমনি বিতর্কও সৃষ্টি করছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার দীর্ঘদিনের তিক্ত উত্তেজনাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করায় সিনেমাটি আলোচনায় উঠে এসেছে।
১ দিন আগে
আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ কি কনভেনশনাল যুদ্ধ নাকি ইনসারজেন্সি অপারেশন? অনেকেরই এই বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার নয়। তবে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে শুরুতেই জানতে হবে ইনসারজেন্সি এবং কাউন্টার ইনসারজেন্সি অপারেশন কী?
২ দিন আগে
বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দাবি দীর্ঘদিনের। গত বছর ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে মানবাধিকার কমিশন ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই উদ্যোগে গত ৯ নভেম্বর সরকার একটি অধ্যাদেশ জারি করে। এর ধারাবাহিকতায়
২ দিন আগে