২০২৪ সালের ১৪ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিশ্বজুড়ে মানব পাচার এবং সাইবার-আর্থিক জালিয়াতির বিরুদ্ধে অভিযানের ঘোষণা দেয়। এই অভিযানের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কম্বোডিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান ‘প্রিন্স হোল্ডিং গ্রুপ’। মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ এই গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ১৪৬ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ও গ্রুপটিকে আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র হিসেবে চিহ্নিত করে। মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ অভিযোগ করে, প্রিন্স গ্রুপ অনলাইন স্ক্যামিং অপারেশনের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে শত শত কোটি ডলার হাতিয়ে নিয়েছে।
একই সময়ে যুক্তরাজ্য সরকারও প্রিন্স গ্রুপের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ও লন্ডনে তাদের ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ১৯টি সম্পত্তি জব্দ করে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল প্রসিকিউটররা প্রিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান চীনা বংশোদ্ভূত চেন ঝি-এর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং ও জালিয়াতির অভিযোগ আনেন। পাশাপাশি চেন ঝি-এর সঙ্গে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের বিটকয়েন জব্দ করেন।
এই ঘটনা কেবল আইনি পদক্ষেপ নয়; বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (সাউথইস্ট এশিয়া) গড়ে ওঠা বিশাল ও জটিল অপরাধ জগতের উন্মোচন। কীভাবে পর্যটকদের প্রিয় এই অঞ্চলটি পরিণত হলো অপরাধীদের স্বর্গে? এর উত্তর খুঁজতে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে কম্বোডিয়ার সিহানুকভিলের সমুদ্রসৈকত থেকে মিয়ানমারের জঙ্গলঘেরা সীমান্ত পর্যন্ত।
সিহানুকভিলের রূপান্তর: পর্যটন থেকে অপরাধের রাজ্যে
এইসব ঘটনার শুরুটা খুব বেশিদিন আগের নয়। সোনালি সৈকত আর অল্প খরচের জীবনযাত্রার জন্য কম্বোডিয়ার দক্ষিণ উপকূলীয় শহর সিহানুকভিল একসময় ছিল পশ্চিমা ব্যাকপ্যাকারদের কাছে জনপ্রিয় এক শান্ত পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু ২০১৫ সালের দিকে দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টাতে শুরু করে। বিপুল পরিমাণ চীনা বিনিয়োগ আসতে শুরু করে এই শহরে। রাতারাতি গজিয়ে ওঠে আকাশচুম্বী হোটেল, অ্যাপার্টমেন্ট ও ক্যাসিনো। হাজার হাজার চীনা নাগরিক এখানে এসে বসতি গড়ে তোলেন। শহরটি পরিণত হয় ‘লিটল চায়না’য়।
এই দ্রুত নগরায়নের পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল অনলাইন জুয়া এবং ক্যাসিনো ব্যবসা। কিন্তু ২০২০ সালে যখন কোভিড-১৯ মহামারি আঘাত হানে, তখন পর্যটন ও ক্যাসিনো ব্যবসায় ধস নামে। চীন থেকে আসা জুয়াড়িরা দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন। ব্যবসার এই মন্দা কাটাতে ক্যাসিনো মালিক ও অপরাধী চক্রগুলো নতুন এক ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়ে—অনলাইন স্ক্যামিং বা সাইবার প্রতারণা। ক্যাসিনো ও হোটেলগুলোর খালি অবকাঠামোকে তারা ব্যবহার করতে শুরু করে স্ক্যাম সেন্টার হিসেবে। ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম সহজ হয়ে যাওয়ার কারণে মানি লন্ডারিং বা অবৈধ অর্থ পাচার আরও সহজ হয়ে ওঠে। এভাবেই সিহানুকভিল পরিণত হয় সাইবার প্রতারণার বৈশ্বিক কেন্দ্রে।
সাইবার দাসত্ব: অপরাধের অমানবিক দিক
এই বিশাল স্ক্যামিং ইন্ডাস্ট্রি চালানোর জন্য প্রয়োজন ছিল বিপুল জনবল। আর এখানেই শুরু হয় মানব পাচারের ভয়াবহ অধ্যায়, যাকে বলা হচ্ছে ‘সাইবার স্লেভারি’ বা সাইবার দাসত্ব। দ্য ডিপ্লোম্যাটের প্রতিবেদন বলছে, গত পাঁচ বছরে হাজার হাজার তরুণ-তরুণীকে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে। মূলত চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং এমনকি আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা থেকেও মানুষদের নিয়ে আসা হয়।
তাদের রাখা হয় কম্বোডিয়া, মিয়ানমার ও লাওসের বিভিন্ন কারাগার সদৃশ কম্পাউন্ডে। সেখানে তাদের কাজ হলো ইন্টারনেটে বসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে ঠকানো। কখনো প্রেমের ফাঁদে ফেলে (রোমান্স স্ক্যাম), কখনো বা ভুয়া ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিয়োগের লোভ দেখিয়ে তারা মানুষের সঞ্চয় হাতিয়ে নেয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিসের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র কম্বোডিয়ায় অন্তত এক লাখ মানুষ এই স্ক্যামিংয়ের শিকার হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন মতে, যারা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায় বা পালানোর চেষ্টা করে, তাদের ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। ইলেকট্রিক শকের ব্যবহার, মারধর ও অনাহারে রাখা—এসব ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়: অপরাধের ঢাল
এই বিশাল অপরাধ জগত কীভাবে এত বছর ধরে প্রশাসনের নাকের ডগায় টিকে ছিল? এর উত্তর লুকিয়ে আছে স্থানীয় রাজনীতি ও ব্যবসায়িক স্বার্থের গভীর আঁতাতের মধ্যে। প্রিন্স হোল্ডিং গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল ব্যবসার আড়ালে অপরাধই করেনি, তারা নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। প্রিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান চেন ঝি ছিলেন কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হুন মানেতের উপদেষ্টা। তিনি বিভিন্ন দাতব্য কাজের মাধ্যমে নিজের ‘জনহিতৈষী’ ভাবমূর্তি তৈরি করেছিলেন। ২০২২ সালে কম্বোডিয়ায় অনুষ্ঠিত আসিয়ান সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের উপহার দেওয়ার জন্য তিনি বিশেষ সংস্করণের ঘড়িও তৈরি করেছিলেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই অপরাধ জগত এতটাই বিস্তৃত ও প্রভাবশালী যে কেবল জাতীয় পর্যায়ের পদক্ষেপে একে নির্মূল করা সম্ভব নয়। এটি আন্তঃসীমান্ত বা ট্রান্সন্যাশনাল সমস্যা, যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। মাদক ব্যবসার মতো এই স্ক্যামিং ব্যবসাও এখন একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ।
দ্য ডিপ্লোম্যাটের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, এই রাজনৈতিক সখ্যতার কারণে প্রিন্স গ্রুপ ও এর মতো অন্যান্য চক্রগুলো আইনের ঊর্ধ্বে থেকেছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কম্বোডিয়ার পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এই স্ক্যাম কম্পাউন্ডগুলোর পাহারায় নিয়োজিত।
থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের সীমান্তেও একই চিত্র। মিয়ানমারের জান্তা সরকার এবং তাদের সহযোগী বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী বা বর্ডার গার্ড ফোর্স (বিজিএফ) এই স্ক্যামিং থেকে প্রাপ্ত অর্থের ভাগ পায়। মিয়ানমারের কোকং ও কারেন রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে গড়ে ওঠা বিশাল স্ক্যামিং হাবগুলো মূলত স্থানীয় মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণে, যারা সামরিক সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে আবদ্ধ। ফলে এই অপরাধ জগত কেবল কিছু বিচ্ছিন্ন অপরাধীর কাজ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট শিল্পে পরিণত হয়েছে।
মিয়ানমার: সংঘাত ও অপরাধের মিলনমেলা
কম্বোডিয়ার পাশাপাশি মিয়ানমারও হয়ে উঠেছে এই অপরাধ জগতের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটির অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও প্রশাসনিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে অপরাধী চক্রগুলো তাদের শিকড় আরও গভীরে ছড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে চীন ও থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের শান এবং কারেন রাজ্যে গড়ে উঠেছে বিশাল সব স্ক্যামিং জোন। এর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত হলো থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের মায়াওয়াদি এলাকায় অবস্থিত ‘কেকে পার্ক’।
এখানে অপরাধী চক্রগুলো স্থানীয় বর্ডার গার্ড ফোর্সের ছত্রছায়ায় নিরাপদে তাদের কার্যক্রম চালায়। সম্প্রতি চীন সরকারের চাপে মিয়ানমারের জান্তা ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো কিছু লোক দেখানো অভিযান চালিয়েছে। চীনের মূল টার্গেট ছিল তাদের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
২০২৩ সালের শেষের দিকে চীন মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে কোকং অঞ্চলের স্ক্যামিং অপারেশন বন্ধ করতে বাধ্য করে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ছিল সাময়িক। অপরাধীরা এক জায়গা থেকে উৎখাত হলে অন্য জায়গায় গিয়ে নতুন করে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। একে বলা হচ্ছে ‘হোয়্যাক-আ-মোল’ বা এক গর্ত বন্ধ করলে অন্য গর্ত দিয়ে বের হওয়ার মতো পরিস্থিতি।
আন্তর্জাতিক চাপ ও ভবিষ্যৎ
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা এবং আইনি পদক্ষেপ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই অপরাধ জগতের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। প্রিন্স গ্রুপের মতো ‘অস্পৃশ্য’ মনে করা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে এই অঞ্চলের সরকারগুলোর ওপরও চাপ বেড়েছে। কম্বোডিয়া সরকার সম্প্রতি সাইবার ক্রাইম টাস্কফোর্স গঠন করেছে এবং কিছু ক্যাসিনোর লাইসেন্স বাতিল করেছে। থাইল্যান্ডও সীমান্তে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে স্ক্যামারদের কার্যক্রম ব্যাহত করার চেষ্টা করছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই পদক্ষেপগুলো কি যথেষ্ট? বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই অপরাধ জগত এতটাই বিস্তৃত ও প্রভাবশালী যে কেবল জাতীয় পর্যায়ের পদক্ষেপে একে নির্মূল করা সম্ভব নয়। এটি আন্তঃসীমান্ত বা ট্রান্সন্যাশনাল সমস্যা, যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। মাদক ব্যবসার মতো এই স্ক্যামিং ব্যবসাও এখন একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। অপরাধীরা প্রযুক্তির ব্যবহার করে খুব সহজেই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। আজ কম্বোডিয়ায় অভিযান হলে তারা মিয়ানমার বা লাওসে চলে যায়।
তাছাড়া, চীন বা পশ্চিমা দেশগুলোর চাপের মুখে স্থানীয় সরকারগুলো মাঝে মাঝে যে অভিযানগুলো চালায়, সেগুলোকে অনেকেই ‘কসমেটিক’ বা লোক দেখানো বলে মনে করেন। কারণ, এই স্ক্যামিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ এত বিশাল যে তা স্থানীয় অর্থনীতি ও রাজনীতির একটি অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। প্রিন্স গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের পতনের পর সেই শূন্যস্থান পূরণে অন্য কোনো চক্র এগিয়ে আসবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গড়ে ওঠা এই সাইবার প্রতারণার সাম্রাজ্য আধুনিক বিশ্বের এক অন্ধকার দিক উন্মোচন করেছে। এখানে প্রযুক্তির অপব্যবহার, মানব পাচার ও রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির এক ভয়াবহ সংমিশ্রণ ঘটেছে। প্রিন্স গ্রুপের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থা হয়তো শুরু, কিন্তু এই যুদ্ধের শেষ এখনো অনেক দূরে।
যতদিন না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধভাবে এই অপরাধের মূল উৎপাটনে এগিয়ে আসবে ও স্থানীয় সরকারগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনবে, ততদিন সিহানুকভিল বা মায়াওয়াদির মতো জায়গাগুলো অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হিসেবেই থেকে যাবে। আর পর্দার আড়ালে চলতে থাকবে হাজারো মানুষের স্বপ্নভঙ্গ আর আধুনিক দাসত্বের নির্মম কাহিনি।
~ যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম দ্য ডিপ্লোমেটের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ।