মোসাদ-প্রধানের কাতার সফর
স্ট্রিম ডেস্ক
গত সপ্তাহে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ডেভিড বারনিয়া কাতার সফর করেন। এই সফরকে গাজায় শান্তি আলোচনা আবার শুরু করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
গাজায় চলমান একতরফা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে আলোচনায় প্রধান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাতার ও মিসর কাজ করে আসছে অনেকদিন ধরেই।
প্রশ্ন হলো, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় মিসরের সম্পৃক্ততা স্বাভাবিক, কিন্তু কাতার কেন এ বিষয়ে এত আগ্রহী?
সাম্প্রতিক প্রবণতায় এর উত্তর পাওয়া যাবে। তালেবানের সঙ্গে গোপন আলোচনা থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে আড়ালে চলা সমঝোতা—সব জায়গাতেই এই ছোট্ট উপসাগরীয় দেশটি বিশ্বে মধ্যস্থতার অন্যতম নির্ভরযোগ্য ঠিকানা হয়ে উঠছে। এর পেছনে রয়েছে তাদের বিপুল অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও কৌশলগত অস্পষ্ট অবস্থান।
তাহলে কেন কাতার এটা করছে? আর কীভাবে তারা নিজেদের কূটনীতির ‘প্রথম সাড়াদাতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে?
কূটনৈতিক শক্তির পথে কাতার
সবসময় এমনটা ছিল না। অর্ধশতাব্দী আগেও কাতার ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মানচিত্রে প্রায় উপেক্ষিত এক জায়গা। এর ছিল না সৌদি আরবের মতো ধর্মীয় প্রভাব কিংবা মিসরের মতো সাংস্কৃতিক ক্ষমতা। এমনকি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের কয়েক দশক পরও কাতার এক গোপন, রক্ষণশীল ও অন্তর্মুখী রাজতন্ত্রের অধীনে ছিল।
তবে নব্বইয়ের দশকে পরিস্থিতি বদলায়। প্রথমেই আসে গ্যাস বুম। বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র (যা ইরানের সঙ্গে ভাগাভাগি করা) আবিষ্কার ও উত্তোলন কাতারকে শুধু বিপুল সম্পদই দেয়নি, দিয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবও।
তারপর আসে ১৯৯৫ সালের প্রাসাদ অভ্যুত্থান। কাতারকে বৈশ্বিক মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বর্তমান আমিরের বাবা শেখ হামাদ বিন খলিফা আল-থানি নিজের বাবাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন।
এক বছরের মধ্যেই কাতারভিত্তিক জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা চালু করেন তিনি। আল-জাজিরা এই অঞ্চলের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের ধারণা ভেঙে দেয়। স্পষ্টভাষী, প্যান–আরব, প্রায়ই বিতর্কিত এই চ্যানেল আরব বিশ্বের রাজনৈতিক কথোপকথনের ধরন বদলে দেয়। কাতারকে মরক্কো থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত এক পরিচিত নাম করে তোলে।
শেখ হামাদ বিন খলিফা আল-থানি দেশের পররাষ্ট্রনীতি উন্মুক্ত করেন। হ্যারডস, প্যারিস সেন্ট-জার্মেইন ও মিরাম্যাক্সের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা কিনে নেন। ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের অধিকারও অর্জন করে কাতার।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. রাজর্ষি চক্রবর্তীর মতে, কাতারের নেতৃত্বস্থানীয়রা কূটনীতিকে জাতীয় নিরাপত্তা ও পরিচয় গঠনের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছিল। তারা জানত, কেবল সেনাবাহিনী বা অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব নয়।
সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশল
একপক্ষ বেছে নেওয়ার বদলে কাতার সবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার নীতিতে চলে। ওয়াশিংটন থেকে হামাস, তালেবান থেকে ইসরায়েল—কেউই বাদ যায় না। এতে কাতারকে কেউ কেউ বাস্তববাদী হিসেবে প্রশংসা করেছে, আবার কেউ কেউ দ্বিচারী হিসেবে সন্দেহও করেছে।
২০০৮ সালে লেবাননের ১৮ মাসব্যাপী রাজনৈতিক সংকটের অবসান ঘটাতে সাহায্য করে কাতার। ২০১২ সালে এটি নির্বাসিত সিরীয় বিরোধীদের নিজেদের দেশে জায়গা দেয়। ২০২০ সালে দেশটি মার্কিন-তালেবান শান্তিচুক্তি সম্পন্ন করে।
শুধু গত বছরেই কাতারের কূটনীতিকরা গাজায় যুদ্ধবিরতি আলোচনা আয়োজন করেছে, যুক্তরাষ্ট্র-ভেনেজুয়েলার মধ্যে বন্দি বিনিময় করিয়েছে, রাশিয়া থেকে ইউক্রেনীয় শিশুদের ফেরত আনার ব্যবস্থা করেছে, এমনকি কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও রুয়ান্ডার নেতাদের ওয়াশিংটনে এনে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করিয়েছে।
অন্যান্য উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের বিপরীতে কাতার কখনো পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযানে (যেমন ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ) যোগ দেয়নি, বরং আলোচনা আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে।
এই নতুন নীতিকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয় কাতারের ২০০৩ সালের সংবিধানে। যেখানে বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার’ কাতারের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে।
সব পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্কের নীতির পেছনে আরেকটি কারণ কাতারের ভৌগোলিক অবস্থান। সৌদি আরব ও ইরানের মতো দুটি বড় রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক শক্তিধর দেশের মাঝখানে এক অস্থির ফাটলরেখায় কাতার অবস্থিত। তাই কাতারের কূটনীতি যেমন বেঁচে থাকার কৌশল, তেমনি উচ্চাকাঙ্ক্ষাও।
২০১৭ সালে উপসাগরীয় প্রতিবেশীরা কাতারকে সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলে অবরোধ আরোপ করলে এই প্রবণতা আরও জোরদার হয়। পিছিয়ে আসার বদলে কাতার দ্বিগুণ গতিতে স্বাধীন কূটনীতি চালিয়ে যায়, নতুন মিত্রতা গড়ে তোলে ও আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
কাতারের সম্পদও এ কাজে বড় ভূমিকা রেখেছে। ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের সার্বভৌম তহবিল ও বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাসভান্ডার নিয়ে কাতার ঝাঁকজমক ও আশ্বাসের জায়গা তৈরি করেছে। তারা বিভিন্ন ধরনের বিশ্বসম্মেলনে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে বিনিয়োগ করেছে, আর গড়ে তুলেছে বিশ্বমানের অবকাঠামো। ২০২২ সালের ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজন ছিল এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে দৃশ্যমান উদাহরণ।
কিন্তু সম্ভবত কাতারের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো বিচক্ষণতা। কাতার নিঃশব্দে, অনেক সময় কোনো রকম প্রচারণা ছাড়াই মধ্যস্থতা করতে আপত্তি করে না। লাইমলাইটে না এসে কাজ করার এই ধরন আড়ালে থাকতে চাওয়া বিশ্বের অপরাপর শক্তিগুলোর কাছে কাতারকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত কাতার একসঙ্গে দশটি ভিন্ন ভিন্ন আলোচনায় মধ্যস্থতা চালিয়েছে। আর এই পুরো প্রক্রিয়ার পরিচালক হলেন কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধান মধ্যস্থতাকারী ড. মোহাম্মদ বিন আবদুল আজিজ আল-খুলাইফ। তাঁকে সচরাচর একই টাইম জোনে টানা দু’দিন পাওয়া যায় না। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যেখানেই কোনো সংঘাত থাকবে, আপনি আমাদের সেখানে দেখতে পাবেন।
রাজর্ষি চক্রবর্তীর মতে, কাতারের মধ্যস্থতা কেবল সীমানা বা স্বীকৃতির প্রশ্ন নয়, এর ভেতরে আরও গভীর তাৎপর্য আছে। একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে কাতার কূটনীতির সঙ্গে বিশ্বাসকে মিলিয়ে বিশ্বমঞ্চে আলাদা পরিচয় গড়ে তুলছে। বিশ্বাস কাতারকে নৈতিক বৈধতার ভাষা দিয়েছে। যখন তারা শান্তি বা আলোচনার কথা বলে, সেটা কেবল রাজনৈতিক নয়, সেটা সভ্যতার ভাষা।
খরচ ও হিসাব–নিকাশ
তবুও, নিরপেক্ষতার মূল্য আছে। রাজর্ষি চক্রবর্তী সতর্ক করেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট ও বিতর্কিত গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের কারণে ভবিষ্যতে নজরদারির মুখে পড়তে পারে কাতার। একই সঙ্গে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আবারও সামনে আসতে পারে এবং দেশটির বিশ্বব্যাপী প্রভাবকে দুর্বল করতে পারে।
আসলেই, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ওপর কাতারের নির্ভরশীলতা তাদের কৌশলগত সুরক্ষা দেয় বটে, তবে একই সঙ্গে কাতারকে বেঁধে ফেলে ওয়াশিংটনের নিজস্ব কর্মসূচিতে। আর বহুশক্তির বিশ্বব্যবস্থায় এই এক দেশের ওপর নির্ভরতা ভবিষ্যতে কাতারের জন্য বোঝা হয়ে উঠতে পারে।
সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র-ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় কাতারের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে তেহরান। আধুনিক সময়ে প্রথমবারের মতো কাতারের মাটিতে সরাসরি সামরিক হামলার ঘটনা ছিল এটি। হামলার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে কাতার তার আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়, প্রতিরক্ষা প্রস্তুত রাখে ও ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ১৩টি আটকায়। মাত্র একটি মিসাইল কাতারে মাটিতে আঘাত হানতে সক্ষম হলেও বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে কাতার পাল্টা কোনো হামলা করেনি।
দোহা এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু আঘাত সহ্য করে কাতার কূটনীতিকে সময় দিয়েছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প কাতারের দায়িত্বশীলদের ফোন করেন। ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। ইরান-সংকট কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠকে নয়, বরং কাতারের মাধ্যমে হওয়া ফোন কলেই শেষ হয়।
রাজর্ষি চক্রবর্তী বলেন, ‘অতিরিক্ত মার্কিন নির্ভরশীলতা এখনো কাতারের পক্ষেই লাভজনক হচ্ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে চীনকেই বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে ধরা হচ্ছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র একদিন যদি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, কাতারের নেতাদের জন্য নতুন মিত্র খোঁজা বিচক্ষণ পদক্ষেপ হবে।’
কাতারের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ঝুঁকিও আছে। হামাস, তালেবান ও অন্যদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসার ইচ্ছা ইসরায়েল, মিসর আর ইউরোপের কিছু অংশকে সতর্ক করে তুলেছে। আলোচনায় ব্যর্থতা হলে কাতারের বিশ্বাসযোগ্যতাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তাই কাতারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—নিজেদের সীমার বাইরে না গিয়ে খাপ খাওয়ানো, নমনীয় থাকা, আস্থা টিকিয়ে রাখা।
(ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া। বাংলা অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ)
গত সপ্তাহে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ডেভিড বারনিয়া কাতার সফর করেন। এই সফরকে গাজায় শান্তি আলোচনা আবার শুরু করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
গাজায় চলমান একতরফা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে আলোচনায় প্রধান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাতার ও মিসর কাজ করে আসছে অনেকদিন ধরেই।
প্রশ্ন হলো, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় মিসরের সম্পৃক্ততা স্বাভাবিক, কিন্তু কাতার কেন এ বিষয়ে এত আগ্রহী?
সাম্প্রতিক প্রবণতায় এর উত্তর পাওয়া যাবে। তালেবানের সঙ্গে গোপন আলোচনা থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে আড়ালে চলা সমঝোতা—সব জায়গাতেই এই ছোট্ট উপসাগরীয় দেশটি বিশ্বে মধ্যস্থতার অন্যতম নির্ভরযোগ্য ঠিকানা হয়ে উঠছে। এর পেছনে রয়েছে তাদের বিপুল অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও কৌশলগত অস্পষ্ট অবস্থান।
তাহলে কেন কাতার এটা করছে? আর কীভাবে তারা নিজেদের কূটনীতির ‘প্রথম সাড়াদাতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে?
কূটনৈতিক শক্তির পথে কাতার
সবসময় এমনটা ছিল না। অর্ধশতাব্দী আগেও কাতার ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মানচিত্রে প্রায় উপেক্ষিত এক জায়গা। এর ছিল না সৌদি আরবের মতো ধর্মীয় প্রভাব কিংবা মিসরের মতো সাংস্কৃতিক ক্ষমতা। এমনকি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের কয়েক দশক পরও কাতার এক গোপন, রক্ষণশীল ও অন্তর্মুখী রাজতন্ত্রের অধীনে ছিল।
তবে নব্বইয়ের দশকে পরিস্থিতি বদলায়। প্রথমেই আসে গ্যাস বুম। বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র (যা ইরানের সঙ্গে ভাগাভাগি করা) আবিষ্কার ও উত্তোলন কাতারকে শুধু বিপুল সম্পদই দেয়নি, দিয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবও।
তারপর আসে ১৯৯৫ সালের প্রাসাদ অভ্যুত্থান। কাতারকে বৈশ্বিক মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বর্তমান আমিরের বাবা শেখ হামাদ বিন খলিফা আল-থানি নিজের বাবাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন।
এক বছরের মধ্যেই কাতারভিত্তিক জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা চালু করেন তিনি। আল-জাজিরা এই অঞ্চলের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের ধারণা ভেঙে দেয়। স্পষ্টভাষী, প্যান–আরব, প্রায়ই বিতর্কিত এই চ্যানেল আরব বিশ্বের রাজনৈতিক কথোপকথনের ধরন বদলে দেয়। কাতারকে মরক্কো থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত এক পরিচিত নাম করে তোলে।
শেখ হামাদ বিন খলিফা আল-থানি দেশের পররাষ্ট্রনীতি উন্মুক্ত করেন। হ্যারডস, প্যারিস সেন্ট-জার্মেইন ও মিরাম্যাক্সের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা কিনে নেন। ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের অধিকারও অর্জন করে কাতার।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. রাজর্ষি চক্রবর্তীর মতে, কাতারের নেতৃত্বস্থানীয়রা কূটনীতিকে জাতীয় নিরাপত্তা ও পরিচয় গঠনের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছিল। তারা জানত, কেবল সেনাবাহিনী বা অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব নয়।
সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশল
একপক্ষ বেছে নেওয়ার বদলে কাতার সবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার নীতিতে চলে। ওয়াশিংটন থেকে হামাস, তালেবান থেকে ইসরায়েল—কেউই বাদ যায় না। এতে কাতারকে কেউ কেউ বাস্তববাদী হিসেবে প্রশংসা করেছে, আবার কেউ কেউ দ্বিচারী হিসেবে সন্দেহও করেছে।
২০০৮ সালে লেবাননের ১৮ মাসব্যাপী রাজনৈতিক সংকটের অবসান ঘটাতে সাহায্য করে কাতার। ২০১২ সালে এটি নির্বাসিত সিরীয় বিরোধীদের নিজেদের দেশে জায়গা দেয়। ২০২০ সালে দেশটি মার্কিন-তালেবান শান্তিচুক্তি সম্পন্ন করে।
শুধু গত বছরেই কাতারের কূটনীতিকরা গাজায় যুদ্ধবিরতি আলোচনা আয়োজন করেছে, যুক্তরাষ্ট্র-ভেনেজুয়েলার মধ্যে বন্দি বিনিময় করিয়েছে, রাশিয়া থেকে ইউক্রেনীয় শিশুদের ফেরত আনার ব্যবস্থা করেছে, এমনকি কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও রুয়ান্ডার নেতাদের ওয়াশিংটনে এনে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করিয়েছে।
অন্যান্য উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের বিপরীতে কাতার কখনো পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযানে (যেমন ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ) যোগ দেয়নি, বরং আলোচনা আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে।
এই নতুন নীতিকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয় কাতারের ২০০৩ সালের সংবিধানে। যেখানে বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার’ কাতারের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে।
সব পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্কের নীতির পেছনে আরেকটি কারণ কাতারের ভৌগোলিক অবস্থান। সৌদি আরব ও ইরানের মতো দুটি বড় রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক শক্তিধর দেশের মাঝখানে এক অস্থির ফাটলরেখায় কাতার অবস্থিত। তাই কাতারের কূটনীতি যেমন বেঁচে থাকার কৌশল, তেমনি উচ্চাকাঙ্ক্ষাও।
২০১৭ সালে উপসাগরীয় প্রতিবেশীরা কাতারকে সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলে অবরোধ আরোপ করলে এই প্রবণতা আরও জোরদার হয়। পিছিয়ে আসার বদলে কাতার দ্বিগুণ গতিতে স্বাধীন কূটনীতি চালিয়ে যায়, নতুন মিত্রতা গড়ে তোলে ও আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
কাতারের সম্পদও এ কাজে বড় ভূমিকা রেখেছে। ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের সার্বভৌম তহবিল ও বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাসভান্ডার নিয়ে কাতার ঝাঁকজমক ও আশ্বাসের জায়গা তৈরি করেছে। তারা বিভিন্ন ধরনের বিশ্বসম্মেলনে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে বিনিয়োগ করেছে, আর গড়ে তুলেছে বিশ্বমানের অবকাঠামো। ২০২২ সালের ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজন ছিল এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে দৃশ্যমান উদাহরণ।
কিন্তু সম্ভবত কাতারের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো বিচক্ষণতা। কাতার নিঃশব্দে, অনেক সময় কোনো রকম প্রচারণা ছাড়াই মধ্যস্থতা করতে আপত্তি করে না। লাইমলাইটে না এসে কাজ করার এই ধরন আড়ালে থাকতে চাওয়া বিশ্বের অপরাপর শক্তিগুলোর কাছে কাতারকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত কাতার একসঙ্গে দশটি ভিন্ন ভিন্ন আলোচনায় মধ্যস্থতা চালিয়েছে। আর এই পুরো প্রক্রিয়ার পরিচালক হলেন কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধান মধ্যস্থতাকারী ড. মোহাম্মদ বিন আবদুল আজিজ আল-খুলাইফ। তাঁকে সচরাচর একই টাইম জোনে টানা দু’দিন পাওয়া যায় না। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যেখানেই কোনো সংঘাত থাকবে, আপনি আমাদের সেখানে দেখতে পাবেন।
রাজর্ষি চক্রবর্তীর মতে, কাতারের মধ্যস্থতা কেবল সীমানা বা স্বীকৃতির প্রশ্ন নয়, এর ভেতরে আরও গভীর তাৎপর্য আছে। একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে কাতার কূটনীতির সঙ্গে বিশ্বাসকে মিলিয়ে বিশ্বমঞ্চে আলাদা পরিচয় গড়ে তুলছে। বিশ্বাস কাতারকে নৈতিক বৈধতার ভাষা দিয়েছে। যখন তারা শান্তি বা আলোচনার কথা বলে, সেটা কেবল রাজনৈতিক নয়, সেটা সভ্যতার ভাষা।
খরচ ও হিসাব–নিকাশ
তবুও, নিরপেক্ষতার মূল্য আছে। রাজর্ষি চক্রবর্তী সতর্ক করেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট ও বিতর্কিত গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের কারণে ভবিষ্যতে নজরদারির মুখে পড়তে পারে কাতার। একই সঙ্গে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আবারও সামনে আসতে পারে এবং দেশটির বিশ্বব্যাপী প্রভাবকে দুর্বল করতে পারে।
আসলেই, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ওপর কাতারের নির্ভরশীলতা তাদের কৌশলগত সুরক্ষা দেয় বটে, তবে একই সঙ্গে কাতারকে বেঁধে ফেলে ওয়াশিংটনের নিজস্ব কর্মসূচিতে। আর বহুশক্তির বিশ্বব্যবস্থায় এই এক দেশের ওপর নির্ভরতা ভবিষ্যতে কাতারের জন্য বোঝা হয়ে উঠতে পারে।
সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র-ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় কাতারের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে তেহরান। আধুনিক সময়ে প্রথমবারের মতো কাতারের মাটিতে সরাসরি সামরিক হামলার ঘটনা ছিল এটি। হামলার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে কাতার তার আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়, প্রতিরক্ষা প্রস্তুত রাখে ও ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ১৩টি আটকায়। মাত্র একটি মিসাইল কাতারে মাটিতে আঘাত হানতে সক্ষম হলেও বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে কাতার পাল্টা কোনো হামলা করেনি।
দোহা এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু আঘাত সহ্য করে কাতার কূটনীতিকে সময় দিয়েছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প কাতারের দায়িত্বশীলদের ফোন করেন। ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। ইরান-সংকট কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠকে নয়, বরং কাতারের মাধ্যমে হওয়া ফোন কলেই শেষ হয়।
রাজর্ষি চক্রবর্তী বলেন, ‘অতিরিক্ত মার্কিন নির্ভরশীলতা এখনো কাতারের পক্ষেই লাভজনক হচ্ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে চীনকেই বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে ধরা হচ্ছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র একদিন যদি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, কাতারের নেতাদের জন্য নতুন মিত্র খোঁজা বিচক্ষণ পদক্ষেপ হবে।’
কাতারের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ঝুঁকিও আছে। হামাস, তালেবান ও অন্যদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসার ইচ্ছা ইসরায়েল, মিসর আর ইউরোপের কিছু অংশকে সতর্ক করে তুলেছে। আলোচনায় ব্যর্থতা হলে কাতারের বিশ্বাসযোগ্যতাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তাই কাতারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—নিজেদের সীমার বাইরে না গিয়ে খাপ খাওয়ানো, নমনীয় থাকা, আস্থা টিকিয়ে রাখা।
(ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া। বাংলা অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ)
ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ)-এর সশস্ত্র শাখা আরাকান আর্মি (এএ)। সংগঠনটি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অধিক স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার দাবির পাশাপাশি দেশে পুরো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যও লড়ছে।
৯ ঘণ্টা আগেসাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ‘নো কিং’ (কোনো রাজা মানি না) আন্দোলনের ব্যানারে দেশব্যাপী বিক্ষোভের এক জোয়ার দেখা গেছে। দেশটির ছোট-বড় শহরগুলোতে হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের স্বৈরাচারসদৃশ কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে।
১ দিন আগেতিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় এবং তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার মশাল কর্মসূচি পালন করে রংপুর বিভাগের হাজার হাজার মানুষ। আগামী ৩০ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) বেলা ১১টা থেকে ১১টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত ‘স্তব্ধ রংপুর’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি।
১ দিন আগে২০২৪ সালের শুরু থেকে জেনারেশন জেড বা জেন জিরা ১২টিরও বেশি দেশে বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছে। এই প্রজন্ম সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে তরুণ-নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনের সূত্রপাত করে।
২ দিন আগে