leadT1ad

রাষ্ট্রের সংবেদনশীল তথ্য কোনগুলো, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট কী বলে

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ০১: ০৫
আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৫, ১১: ০০
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

সম্প্রতি বিনা অনুমতিতে রাষ্ট্রের ‘সংবেদনশীল’ তথ্য প্রকাশের অভিযোগে পুলিশ কনস্টেবল অমি দাশকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজের ওয়াকিটকি বক্তব্য প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এজন্য অফিশিয়াল সিক্রেটস এ্যাক্ট (১৯২৩)-এ একটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের ‘সংবেদনশীল; তথ্যের বিষয়টি ফের আলোচনায় এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, রাষ্ট্রের সংবেদনশীল তথ্য কোনগুলো? কী আছে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে? আইনটি ঘিরে কেন এত বিতর্ক? বাংলাদেশে এই আইনে সর্বপ্রথম ২০২১ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সাংবাদিক রোজিনাকে।

অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩-এর অধীনে সুরক্ষিত সংবেদনশীল তথ্য

সাধারণভাবে যেকোন রাষ্ট্রের জন্য সংবেদনশীল তথ্য বলতে বোঝায় এমন সব তথ্য, যা প্রকাশ করা হলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব বা জনগণের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এ ধরনের তথ্য সাধারণত গোপন রাখা হয়। এর অপব্যবহার বা অননুমোদিত প্রকাশ রাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সরকারি কার্যক্রমের যথার্থতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাও হুমকির মুখে পড়তে পারে।

ব্রিটিশ শাসকরা আইনটি করেছিল মূলত তাদের শাসন টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এবং স্থানীয়দের দমনের জন্য

অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩ বাংলাদেশের (ব্রিটিশ আমলে প্রণীত) এমন একটি আইন, যার মূল উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের গোপনীয় তথ্য সুরক্ষিত রাখা এবং গুপ্তচরবৃত্তি প্রতিরোধ করা। এ আইনে অনুমোদনহীনভাবে শ্রেণিবদ্ধ তথ্য প্রকাশ বা ব্যবহারকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে সরকারি গোপনীয়তা রক্ষার জন্য কিছু তথ্যকে সংবেদনশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন-- কোনো নিষিদ্ধ এলাকা, সামরিক স্থাপনা অথবা সরকারি নথিপত্রের যেকোনো তথ্য যা প্রকাশ পেলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

এই আইনে মোটাদাগে যেসব তথ্যকে সংবেদনশীল হিসেবে গণ্য করা হয় সেগুলো হলো:

  • রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার জন্য হুমকিস্বরূপ যেকোনো তথ্য
  • সামরিক স্থাপনা, অস্ত্রাগার, বা প্রতিরক্ষা বিষয়ক যেকোনো তথ্য
  • সরকারের গোপনীয় পরিকল্পনা, নীতি, বা কার্যক্রম সম্পর্কিত তথ্য
  • রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিষয়ক যেকোনো নথি, যেমন - গোয়েন্দা প্রতিবেদন বা সামরিক কৌশল
  • নিষিদ্ধ এলাকার যেকোনো তথ্য, যেমন - নকশা, স্কেচ, বা ছবি
  • রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত যেকোনো গোপনীয় যোগাযোগ বা নথি

আইনটি নিয়ে যত বিতর্ক

অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩ বিশেষভাবে আলোচনায় আসে ২০২১ সালে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারের ঘটনায়। সেটি ছিল দেশের ইতিহাসে এ আইনের আওতায় গ্রেপ্তারের প্রথম ঘটনা। ওই ঘটনার পর থেকেই আইনটির প্রাসঙ্গিকতা, প্রয়োগ এবং সাংবাদিকতার স্বাধীনতার ওপর এর প্রভাব নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়।

সরকারি কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় তথ্য ফাঁস করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়াই ছিল প্রধান লক্ষ্য।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তথা পরাধীনতার কালে প্রণীত হলেও স্বাধীন বাংলাদেশেও আইনটি বহাল রয়েছে। ব্রিটিশ শাসকরা আইনটি করেছিল মূলত তাদের শাসন টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এবং স্থানীয়দের দমনের জন্য। তাই আইনটি নিয়ে বিতর্ক মূলত আইনটির প্রয়োগ এবং এর প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কিত।

আইনটির কারণে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশে বাধা সৃষ্টির পাশাপাশি সাংবাদিকদেরও কণ্ঠরোধ করা যায়। এ আইনের বিস্তৃত ভাষা ও প্রয়োগের সুযোগ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করতে পারে, একই সঙ্গে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম। বিশেষ করে, ধারা ৩ ও ৫ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের ঝুঁকি আছে; এই ধারাগুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে দমন করতে কাজে লাগানো যাবে।

এই আইনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা স্বার্থের পরিপন্থী যেকোনো কর্মকাণ্ড অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু এই সংজ্ঞা অস্পষ্ট। সহজেই তা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ফলে বৈধ সাংবাদিকতাকে এই আইনের আওতায় এনে বাধাগ্রস্ত করা যেতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন ২০২১ সালে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এই আইনের সমস্যাগুলো তুলে ধরেন।

ব্রিটেনে প্রথম অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রণীত হয় ১৮৮৯ সালে। একই বছরে এটি ব্রিটিশ ভারতের উপনিবেশেও কার্যকর করা হয়। পরবর্তী কালে ঔপনিবেশিক ভারতে আইনটি সংশোধন করা হয় ১৯০৪ সালে। সর্বশেষ রূপ দেওয়া হয় ১৯২৩ সালে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল গুপ্তচরবৃত্তি সম্পর্কিত অপরাধ মোকাবিলা করা। আইনটি কখনোই সাংবাদিকদের বিচারের জন্য প্রণীত হয়নি। বরং সরকারি কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় তথ্য ফাঁস করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়াই ছিল প্রধান লক্ষ্য।

তবে আইনের ভাষা এমনভাবে সাজানো হয়েছিল, যাতে প্রায় সব ধরনের তথ্য এটির আওতায় পড়ে। এমনকি ফাঁস হওয়া তথ্য যিনি সংগ্রহ করবেন, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছিল। এ কারণেই ব্রিটেনে শুরু থেকেই আইনটি সমালোচনার মুখে পড়ে। এর বিস্তৃত ধারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা সম্ভব। বিশেষ করে, যাঁরা রাষ্ট্রীয় অনিয়ম প্রকাশ করেন বা হুইসেলব্লোয়ার হিসেবে কাজ করেন।

সমালোচনার মুখে ব্রিটেনে এই আইন কয়েকবার সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ সংশোধন করা হয় ১৯৮৯ সালে। নতুন ধারায় সরকারি তথ্য ফাঁস করার ক্ষেত্রে শাস্তি নির্ধারণ করা হয়।

উপনিবেশোত্তর সময়ে ১৯২৩ সালের আইনটি ভারত ও পাকিস্তানেও একাধিকবার সংশোধন করা হয়। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, ব্রিটিশ আইনের মতো এই সংশোধনীগুলোতে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। বরং সংশোধনী ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের চেয়েও কঠোর।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমরা সেই আইনটিই গ্রহণ করি। এ সময় ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের আনা সংশোধনীগুলোও যুক্ত করা হয়। তাই বর্তমানে বাংলাদেশে কার্যকর আইনটিতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতিসহ পাকিস্তানি সরকারের কঠোরতাও যুক্ত হয়েছে। ফলে ঔপনিবেশিক সময়ের চেয়েও বেশি কঠোর হয়েছে আইনটি।

পাকিস্তানে ১৯৬৮ সালের একটি সংশোধনে গুপ্তচরবৃত্তি (ধারা ৩) এবং তথ্য ফাঁস করার (ধারা ৫) সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়। আগে এর শাস্তি ছিল সর্বাধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড।

বর্তমানে বাংলাদেশেও এর আওতায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। এটি অন্যান্য দেশের অনুরূপ আইনগুলোর তুলনায় অনেক বেশি কঠোর।

আইনটির ধারা ৩ ও ৫-এর বিস্তৃত পরিধি এবং কঠোর শাস্তি ছাড়াও আইনের কিছু দিকও অস্পষ্ট। বিশেষ করে, আইনটিতে কোন ধরনের নথি “সরকারি গোপন” নথি হিসেবে গণ্য হবে তা স্পষ্ট করে বলা নেই। ফলে কর্তৃপক্ষের ইচ্ছামতো যেকোনো নথিকে “গোপন” হিসেবে ঘোষণা করা সম্ভব।

এ ধরনের অস্পষ্ট বিধান দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের সুবিধা দিতে পারে। তারা গোপনীয়তার আড়ালে নিজেদের অবৈধ কার্যক্রম লুকাতে পারে।

গুপ্তচরবৃত্তি সম্পর্কিত ধারা ৩-এর পরিধিও অত্যন্ত বিস্তৃত। এতে এমন অনেক ধরনের তথ্য অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যা সবসময় জাতীয় স্বার্থ বা নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত নয়।

এই আইনের আরেকটি সমালোচিত দিক হলো ধারা ৩(২)-এর আওতায় অভিযোগ প্রমাণে ব্যক্তির আচরণ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকেও দায়ী করার সুযোগ আছে। এটি সাধারণ অপরাধমূলক বিচারবিধির বিপরীত। আইনটিতে বলা হয়, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত না হলেও ‘ব্যক্তির আচরণ’, ‘জানা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ বা বিশেষ পরিস্থিতি দেখিয়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে।

এ ধরনের বিধান আইনটি অন্যায়ভাবে ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। এটি ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতির সঙ্গে স্পষ্টভাবে বিরোধপূর্ণ।

সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডেভোকেট এবং আইন বিশেষজ্ঞ ড. কাজী জাহেদ ইকবাল বলেন, ‘এই আইন ব্রিটিশরা করেছিল স্থানীয়দের দমিয়ে রাখার জন্য। তখন ছিল ব্রিটিশ রাজের শাসন। এরপর পাকিস্তানিরা আইনটি আরও কঠোর করে। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র আসার পর এই আইন আর আগের মতো রাখা উচিত হয়নি। আইনটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সুতরাং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে মিল রেখে এই আইনের সংস্কার হওয়া জরুরি। এই ক্ষেত্রে আমরা উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো থেকে শিক্ষা নিতে পারি। এমনকি ব্রিটেনও এই আইন আর আগের মতো রাখেনি। অথচ আমরা হেঁটেছি উল্টো পথে।’

এমন ঔপনিবেশিক নিপীড়নমূলক আইনের যৌক্তিকতা আমাদের সংবিধানের বাকস্বাধীনতা ও মুক্ত সংবাদপত্রের অধিকারের সঙ্গে তুলনা করে পর্যালোচনা করা উচিত। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে যে তথ্য অধিকার আইন প্রণীত হয়েছে, তাতেও এই সংবিধানিক অধিকারগুলোর প্রতিফলন ঘটেছে।

এ ছাড়া ২০১১ সালে পাবলিক ইন্টারেস্ট ইনফরমেশন ডিসক্লোজার (প্রটেকশন প্রোভিশন) আইন প্রণীত হয়েছে, যা জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশের গুরুত্ব স্বীকার করে।

তাই আমাদের আইনি কাঠামোও এমনভাবে তৈরি করা উচিত, যাতে অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও হুইসেলব্লোয়াররা জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশের জন্য আইনি সুরক্ষা পেতে পারেন।

জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশ এবং ‘জাতীয় গোপনীয়তা’- একে অপরের বিপরীতে থাকা উচিত নয়। সুশাসনের স্বার্থে এ দুটির মধ্যে সচেতন সমন্বয় স্থাপন জরুরি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত