রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকার কর্মী এবং আঞ্চলিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এসব আন্দোলনের ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে কাঠামোগত দুর্বলতা, কৌশলগত সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক-রাজনৈতিক বাধা। এসব বাধা পেরিয়ে আসা এখন জেনারেশন জেড-এর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
মাহবুবুল আলম তারেক
২০২৪ সালের শুরু থেকে জেনারেশন জেড বা জেন জিরা ১২টিরও বেশি দেশে বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছে। এই প্রজন্ম সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে তরুণ-নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনের সূত্রপাত করে। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া ও নেপাল হয়ে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকার মাদাগাস্কার ও মরক্কো পর্যন্ত।
নেপালের #নেপোকিডস আন্দোলন, কেনিয়ার করবিরোধী বিক্ষোভ, আর মাদাগাস্কারের বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে প্রতিবাদ—সবকিছু মিলিয়ে এই তরুণদের আন্দোলন একাধিক সরকারকে চাপে ফেলেছে। কোথাও সরকার পদত্যাগ করেছে, কোথাও সংসদ বাতিল হয়েছে, কোথাও বিতর্কিত বিল প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও গঠনমূলক, দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন এখনো অধরা।
কারণ এসব আন্দোলন অনেক সময় কৌশলগত কিছু সফলতা পেলেও, পরবর্তীতে তা থেমে যায়। কখনও তা সরকার দ্বারা দমন হয়, কখনও দলীয় রাজনীতিতে ব্যবহার হয়ে মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে যায়। অনেক সময় তা সমাজে অস্থিরতা বাড়ায়, কিন্তু কাঠামোগত সংস্কার এনে দিতে পারে না। ফলে এই সব অভ্যুত্থান কাঙ্ক্ষিত সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার এনে দিতে পারছে না।
কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস এর গবেষক জানজিরা সোমবাতপুনসিরি বলেন, ‘যদিও গণআন্দোলনের ফলে সরকার বা শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি রূপান্তর নিশ্চিত হয় না।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকার কর্মী এবং আঞ্চলিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এসব আন্দোলনের ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে কাঠামোগত দুর্বলতা, কৌশলগত সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক-রাজনৈতিক বাধা। এসব বাধা পেরিয়ে আসা এখন জেনারেশন জেড-এর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ন্যায়বিচার, জবাবদিহি ও হারানো ভবিষ্যৎ পুনরুদ্ধার
জেনারেশন জেড-এর মূল দাবি হলো একটি পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবস্থায় টিকে থাকার ন্যায্য অধিকার। যেখানে বিশ্বজুড়ে তরুণদের বেকারত্ব ১৪ শতাংশ, সেখানে তারা চায় ন্যায্য চাকরি। মূল্যস্ফীতির মধ্যে চায় প্রয়োজনীয় পণ্যের সাশ্রয়ী দাম, চায় শক্তিশালী জনসেবা এবং অভিজাত শ্রেণির আধিপত্যের অবসান।
নেপালে আন্দোলনকারীরা ‘নেপো কিডস’ অর্থাৎ রাজনীতিকদের বিলাসী সন্তানদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে। তারা শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানো ও দুর্নীতি দূর করার দাবি তোলে। কেনিয়ায় বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল—সব ডাক্তারদের বেতন পরিশোধ, মেডিকেল ইন্টার্ন নিয়োগ, স্কুলে অর্থায়ন, সরকারি খরচ কমানো ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীদের বরখাস্ত।
তাদের আরো কিছু দাবি হলো—জলবায়ু ন্যায়বিচার, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সহজপ্রাপ্তি এবং অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা। তারা স্পষ্টভাবে অস্বীকার করছে তথাকথিত ‘প্রদর্শনশীল বিশেষাধিকার’—যেখানে রাজনীতিক ও অভিজাতরা সাধারণ মানুষের কষ্ট উপেক্ষা করে বিলাসী জীবনযাপন করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই তরুণরা আসলে গণপ্রতিনিধিত্বের দাবি করছে। সোয়াস এর সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক সুবীর সিনহা বলেন, ‘পুরোনো শাসক শ্রেণি জেনারেশন জেড-এর প্রতিদিনের বাস্তবতা ও উদ্বেগগুলো বুঝতে পারছে না।’
২০২৫ সালে ৩২টি দেশে পরিচালিত গ্লোবস্ক্যানের জরিপ অনুযায়ী, ৬৪ শতাংশ জেন জেড তরুণ দুর্নীতিকে ‘গুরুতর সমস্যা’ বলে মনে করে। এই হার আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশি। এছাড়াও তারা বেকারত্ব ও শ্রমিক শোষণ নিয়েও উদ্বিগ্ন।
মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শদাতা ইশরাথ মুবিন বলেন, ‘আজকের তরুণরা ক্ষুব্ধ, কারণ তারা চাকরি ও স্থিতিশীলতার জন্য লড়ছে, আর রাজনীতিকদের সন্তানরা ভোগে মত্ত।’ ইন্দোনেশিয়ার শিক্ষার্থী ডেরি বলেন, ‘আমাদের দাবি স্পষ্ট—মানবিক ও অধিকারভিত্তিক শাসনব্যবস্থার জন্য মৌলিক কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার চাই।’
মাদাগাস্কারের তরুণ রবার্ট বলেন, ‘আমরা এমন একটি ভবিষ্যৎ চাই, যেখানে তরুণরা আর কেবল দর্শক হয়ে থাকবে না।’
তাদের এই ক্ষোভ একাধিক সংকট থেকে জন্ম নিয়েছে—২০০৮ সালের আর্থিক বিপর্যয়, কোভিড-১৯ মহামারির বিশৃঙ্খলা, জলবায়ু সংকট এবং ২০২০ সালের পর ধনীদের হাতে বৈশ্বিক সম্পদের ৬৩ শতাংশ চলে যাওয়ার মতো চরম বৈষম্য।
হিমাল সাউথএশিয়ান পত্রিকার সম্পাদক রোমান গৌতম বলেন, ‘তরুণদের রাগের মূল কারণ হলো, এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা প্রমাণ করেছে—তারা দুর্নীতিগ্রস্ত এবং দেশকে নতুন পথে নিতে অক্ষম।’
জয়ের ভ্রান্ত ধারণা: কৌশলগত সাফল্য, কিন্তু কৌশলগত গভীরতা নেই
নেপালে সংসদ বাতিল বা কেনিয়ায় কর বাড়ানোর বিল প্রত্যাহারের মতো প্রাথমিক সাফল্য আন্দোলনে উদ্দীপনা আনে। কিন্তু এগুলো আন্দোলনের ভঙ্গুরতা ও সীমাবদ্ধতাও প্রকাশ করে। এই আন্দোলনগুলো নেতৃত্বহীন ও বিকেন্দ্রীকৃত। টিকটক ও ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে দ্রুত সংগঠিত হতে পারলেও, তারা ক্ষোভকে স্থায়ী কর্মসূচিতে রূপান্তর করতে ব্যর্থ হয়।
নেপালে প্রথমে অভিজাতদের বিলাসিতার বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ শুরু হয়। পরে তা সহিংস রূপ নেয়—পঞ্চাশের বেশি মৃত্যু ঘটে, ভবন আগুনে পুড়ে যায়। তবুও অন্তর্বর্তী সরকার শুধু প্রতীকী কিছু পদক্ষেপ নেয়, বাস্তব কোনো পরিবর্তন আনে না।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পল স্ট্যানিল্যান্ড বলেন, ‘যখন কোনো নির্দিষ্ট ইস্যুতে বিক্ষোভ জোরালো হয়ে ওঠে, তখন সরকারগুলো একঘরে হয়ে পড়ে। নেপাল ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে, আর সামরিক বাহিনী পরিবর্তনের মধ্যস্থতায় মুখ্য ভূমিকা নেয়।’
এই পরিস্থিতিকে বলা হচ্ছে ‘নতুন ধরনের অস্থির রাজনীতি’। কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যর্থতা ও জনসেবা সংকট সরকারের ওপর আস্থা নষ্ট করেছে। ফলে সরকারগুলো স্বল্পমেয়াদে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, কিন্তু তরুণদের হাতে কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য পর্যাপ্ত চাপ বা ক্ষমতা থাকছে না।
মাদাগাস্কারে প্রেসিডেন্ট রাজারোলিনার মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ায় তাৎক্ষণিক আন্দোলন দমন হয়। কিন্তু তার পদত্যাগের দাবিও অব্যাহত থাকে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, বিক্ষোভে ২২ জন নিহত হয়েছে। এটা দেখায়—কিছু ছাড় দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করা গেলেও, সমস্যার মূল জায়গা ঠিক থাকে।
জানজিরা সোমবাতপুনসিরি সতর্ক করেন, ‘যেসব আন্দোলন ন্যায্য দাবি নিয়ে শুরু হয় কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের অ্যালগরিদম-নির্ভর হয়ে পড়ে, তা অনেক সময় সহিংস মবে রূপ নেয়।’ এই চিত্র নেপাল ও বাংলাদেশ উভয় জায়গাতেই দেখা গেছে।
ফলে গণআন্দোলনের সাফল্যের হার কমছে। জার্নাল অব ডেমোক্রেসি অনুসারে, ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে যেখানে গণআন্দোলনের সফলতার হার ছিল ৬৫ শতাংশ, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ৩৪ শতাংশে।
প্রভাবশালীদের দখলদারি: বিপ্লব থেকে শুরু হয়ে ঘুরেফিরে সেই ক্ষমতার খেলা
জেনারেশন জেড-এর নেতৃত্বে যেসব আন্দোলন শুরু হয়, সেগুলোর বড় একটি দুর্বলতা হলো—পরবর্তীতে সেগুলো আটকা পড়ে পুরনো রাজনৈতিক খেলার ফাঁদে। বিক্ষোভের চাপে কোনো নেতা পদত্যাগ করলেও, সুশাসনের আশা পূরণ হয় না। কারণ একই ধরনের পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি ও ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী—এক কথায় ‘মাফিয়া-সদৃশ’ কাঠামো-সংলাপে বসে আবার পুরনো মানুষদেরই ফিরিয়ে আনে। বাংলাদেশেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
দ্য ডিপ্লোম্যাট সতর্ক করেছে, যদি তরুণদের আন্দোলনকে একটি গঠনমূলক সংস্কারের কাঠামোর মধ্যে প্রবাহিত করা না যায়, তবে সেই শক্তি আবারও নতুন অস্থিরতার চক্রে হারিয়ে যাবে।
ইন্দোনেশিয়া ও মরক্কোয় সংস্কারপন্থীরা অনেক সময় আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে আন্দোলনকে শুধু নেতৃত্ব বদলের মধ্যেই সীমিত রাখে। এতে সমস্যার শিকড় থেকে কোনো পরিবর্তন হয় না।
সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার এর ভাষায়, এই কৌশল আন্দোলনের মনোভাবকে কেবল নির্বাচনে বন্দী করে রাখে, যেখানে আবারও ঋণের বোঝা ও নিওলিবারেল নীতির ফাঁদ অপেক্ষা করে।
নাইরোবির সংগঠক সোফিয়া বলেন, ‘শ্রমিক ইউনিয়নগুলো এখনো নতুন প্রজন্মের ঝুঁকিপূর্ণ চাকরিগুলোকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। তারা নিজস্ব অবস্থানে অনড়, বদলাতে চায় না।’ আফ্রিকার ৮৫ শতাংশ শ্রমিক যেহেতু অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে, তাই সংগঠিত শ্রম আন্দোলনের সঙ্গে তরুণরা সংযুক্ত না হলে এসব বিক্ষোভ অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়ে প্রভাব হারায়।
গঠনতান্ত্রিক পচন ও আমলাতান্ত্রিক জড়তা: সংস্কার যেন থেমে থাকা একটি চাকা
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে দশকজুড়ে চলে আসা কাঠামোগত পচন—যেমন বেকারত্ব, বৈষম্য ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা—এই বিক্ষোভের পেছনে প্রধান ইন্ধন। বেকারত্ব, দীর্ঘমেয়াদি শাসন ব্যর্থতা এবং দুর্নীতি—সব মিলিয়ে সংকট তীব্র। তবে এসব সমস্যার সমাধান বড় ধরণের কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়, আর তা আমলাতন্ত্রের কঠোর প্রতিরোধে আটকে থাকে।
নেপালে আন্দোলনের এক মাস পরও, দুর্নীতি বিরোধী যেসব তদন্তের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর অগ্রগতি নেই বললেই চলে। কোনো উচ্চপদস্থ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর ফলে জনগণের আস্থা নষ্ট হচ্ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত লোক রাজ বরাল বলেন, ‘এই সময়টা পুরনো দলগুলোর জন্য নিজেদের সংশোধনের সুযোগ ছিল। কিন্তু তারা এখনো চেয়ারের লড়াইয়ে ব্যস্ত। এখন তাদের শিক্ষা নেওয়ার কথা।’
তবে এইসব অন্তর্বর্তী সরকার ও দলগুলোর মধ্যে আস্থার ঘাটতি এখন ২০২৬ সালের নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন ও অন্তর্বর্তী প্রশাসনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। নেপালের জেন-জেড মুভমেন্ট অ্যালায়েন্সের সদস্য ২৪ বছর বয়সী অমিত খানাল বলেন, ‘যদি তদন্ত না হয়, তাহলে এই বিশাল আন্দোলনের কোনো অর্থ থাকবে না।’
আফ্রিকার প্রসঙ্গে বিশ্লেষক মোহামেদ কেইতা বলেন, ‘আর্থ-সামাজিক অবনতি, জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি, শাসনের ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক দমন—সব মিলিয়ে তরুণদের জন্য বিপজ্জনক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে।’
নেপালের পর্যটন খাতের অভিজ্ঞ সুমন পাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সবকিছু যেন একটা “সংগীতচেয়ারের খেলা”। নতুন কিছু আশা করলেও আসলে সবকিছু সেই পুরনো মাফিয়ার হাতে।’
দমন-পীড়নের দ্বিমুখী ধাক্কা: শক্তির প্রসার, আবার ক্ষয়ও
ডিজিটাল টুল বা প্রযুক্তি তরুণদের ক্ষমতায়ন করেছে। বিভিন্ন দেশের তরুণরা একে অপরের কৌশল গ্রহণ করছে। তবে একইসাথে, এই প্রযুক্তির ব্যবহারে দমননীতির পথও প্রশস্ত হয়েছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্টিভেন ফেল্ডস্টেইন বলেন, স্বৈরশাসকরা এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের মতো কৌশলের মাধ্যমে নাগরিকদের সংগঠিত হওয়া রোধ করছে। এতে ‘ক্ষমতা নির্মাণের’ সুযোগ কমে যায় এবং তরুণদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়।
বাংলাদেশ ও নেপাল-এ দমনপীড়নের ফলে কিছু সময়ের জন্য আন্দোলন আরও জোরালো হয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি ছড়িয়েছে ভুল তথ্য ও গুজব, যা আন্দোলনের ফোকাসকে দুর্বল করে দিয়েছে।
নেপালের ২৫ বছর বয়সী আন্দোলনকারী তনুজা পাণ্ডে বলেন, ‘আমরা পরিবর্তন চেয়েছিলাম, বিপ্লব নয়।’
আফ্রিকার প্রেক্ষাপটে মোহামেদ কেইতা বলেন, ‘আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাগত সংস্কার চাই। কারণ আমরা তরুণরা এই সমাজের ভবিষ্যৎ। কিন্তু দমনপীড়নই প্রমাণ করে—সরকার কতটা ব্যর্থ।’
স্থবিরতার মাঝেও জেগে ওঠার আশা
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জেনারেশন জেড-এর এই বিদ্রোহ আসলে নাগরিক চেতনার একটি নবজাগরণ। গ্লোবস্ক্যানের জরিপ বলছে— ৬৪ শতাংশ তরুণ দুর্নীতিকে ‘অত্যন্ত গুরুতর’ সমস্যা মনে করে, যা আগের প্রজন্মের তুলনায় অনেক বেশি।
দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক উইল শোকি বলেন, ‘আজকের তরুণরা সেইসব সংকটের দায় বইছে, যা তারা সৃষ্টি করেনি। অথচ এমন এক অর্থনীতিতে তারা কাজ পাচ্ছে না, যেখানে তাদের শ্রমের প্রয়োজনই নেই।’
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, যদি এই ডিজিটাল ক্ষোভকে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিতে রূপান্তর করা না যায়, যেমন শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে সংহতি অথবা তরুণদের জন্য সংরক্ষিত রাজনৈতিক আসন, তাহলে এই পরিবর্তন হবে অগভীর ও ক্ষণস্থায়ী।
দ্য ডিপ্লোম্যাট এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলে, ‘এই বিপ্লব আসলেই কি মৌলিক পরিবর্তন আনবে, নাকি আবারও আরেকটি অচল চক্রে পরিণত হবে?’ বিশ্লেষক লোক রাজ বরাল বলেন, সংস্কারের জন্য এখনই সময়। তবে ইতিহাস, বিশেষ করে আরব বসন্তের অভিজ্ঞতা, আমাদের বলে—দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
এই আন্দোলনগুলো ব্যর্থতা নয়; বরং তারা বিশ্বের স্থবির ও বন্ধ ব্যবস্থায় ফাটল ধরাচ্ছে। এখন প্রয়োজন—জেনারেশন জেড যেন শুধু প্রতিবাদকারী না থেকে, হয়ে ওঠে ভবিষ্যতের স্থপতি।
মোহামেদ কেইতা বলেন, যদি এই শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে তা ফিরিয়ে আনতে পারে ‘নাগরিক ক্ষমতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা।’ আর যদি উপেক্ষা করা হয়, তবে আন্দোলনের আগুন আবারও রাস্তায় ছড়িয়ে পড়বে।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, দ্য ডিপ্লোম্যাট, ভিশন অব হিউম্যানিটি ডট ওআরজি, দ্য নিউ হিউম্যাটিনিটারিয়ান ডট ওআরজি
২০২৪ সালের শুরু থেকে জেনারেশন জেড বা জেন জিরা ১২টিরও বেশি দেশে বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছে। এই প্রজন্ম সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে তরুণ-নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনের সূত্রপাত করে। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া ও নেপাল হয়ে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকার মাদাগাস্কার ও মরক্কো পর্যন্ত।
নেপালের #নেপোকিডস আন্দোলন, কেনিয়ার করবিরোধী বিক্ষোভ, আর মাদাগাস্কারের বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে প্রতিবাদ—সবকিছু মিলিয়ে এই তরুণদের আন্দোলন একাধিক সরকারকে চাপে ফেলেছে। কোথাও সরকার পদত্যাগ করেছে, কোথাও সংসদ বাতিল হয়েছে, কোথাও বিতর্কিত বিল প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও গঠনমূলক, দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন এখনো অধরা।
কারণ এসব আন্দোলন অনেক সময় কৌশলগত কিছু সফলতা পেলেও, পরবর্তীতে তা থেমে যায়। কখনও তা সরকার দ্বারা দমন হয়, কখনও দলীয় রাজনীতিতে ব্যবহার হয়ে মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে যায়। অনেক সময় তা সমাজে অস্থিরতা বাড়ায়, কিন্তু কাঠামোগত সংস্কার এনে দিতে পারে না। ফলে এই সব অভ্যুত্থান কাঙ্ক্ষিত সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার এনে দিতে পারছে না।
কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস এর গবেষক জানজিরা সোমবাতপুনসিরি বলেন, ‘যদিও গণআন্দোলনের ফলে সরকার বা শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি রূপান্তর নিশ্চিত হয় না।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকার কর্মী এবং আঞ্চলিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এসব আন্দোলনের ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে কাঠামোগত দুর্বলতা, কৌশলগত সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক-রাজনৈতিক বাধা। এসব বাধা পেরিয়ে আসা এখন জেনারেশন জেড-এর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ন্যায়বিচার, জবাবদিহি ও হারানো ভবিষ্যৎ পুনরুদ্ধার
জেনারেশন জেড-এর মূল দাবি হলো একটি পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবস্থায় টিকে থাকার ন্যায্য অধিকার। যেখানে বিশ্বজুড়ে তরুণদের বেকারত্ব ১৪ শতাংশ, সেখানে তারা চায় ন্যায্য চাকরি। মূল্যস্ফীতির মধ্যে চায় প্রয়োজনীয় পণ্যের সাশ্রয়ী দাম, চায় শক্তিশালী জনসেবা এবং অভিজাত শ্রেণির আধিপত্যের অবসান।
নেপালে আন্দোলনকারীরা ‘নেপো কিডস’ অর্থাৎ রাজনীতিকদের বিলাসী সন্তানদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে। তারা শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানো ও দুর্নীতি দূর করার দাবি তোলে। কেনিয়ায় বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল—সব ডাক্তারদের বেতন পরিশোধ, মেডিকেল ইন্টার্ন নিয়োগ, স্কুলে অর্থায়ন, সরকারি খরচ কমানো ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীদের বরখাস্ত।
তাদের আরো কিছু দাবি হলো—জলবায়ু ন্যায়বিচার, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সহজপ্রাপ্তি এবং অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা। তারা স্পষ্টভাবে অস্বীকার করছে তথাকথিত ‘প্রদর্শনশীল বিশেষাধিকার’—যেখানে রাজনীতিক ও অভিজাতরা সাধারণ মানুষের কষ্ট উপেক্ষা করে বিলাসী জীবনযাপন করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই তরুণরা আসলে গণপ্রতিনিধিত্বের দাবি করছে। সোয়াস এর সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক সুবীর সিনহা বলেন, ‘পুরোনো শাসক শ্রেণি জেনারেশন জেড-এর প্রতিদিনের বাস্তবতা ও উদ্বেগগুলো বুঝতে পারছে না।’
২০২৫ সালে ৩২টি দেশে পরিচালিত গ্লোবস্ক্যানের জরিপ অনুযায়ী, ৬৪ শতাংশ জেন জেড তরুণ দুর্নীতিকে ‘গুরুতর সমস্যা’ বলে মনে করে। এই হার আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশি। এছাড়াও তারা বেকারত্ব ও শ্রমিক শোষণ নিয়েও উদ্বিগ্ন।
মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শদাতা ইশরাথ মুবিন বলেন, ‘আজকের তরুণরা ক্ষুব্ধ, কারণ তারা চাকরি ও স্থিতিশীলতার জন্য লড়ছে, আর রাজনীতিকদের সন্তানরা ভোগে মত্ত।’ ইন্দোনেশিয়ার শিক্ষার্থী ডেরি বলেন, ‘আমাদের দাবি স্পষ্ট—মানবিক ও অধিকারভিত্তিক শাসনব্যবস্থার জন্য মৌলিক কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার চাই।’
মাদাগাস্কারের তরুণ রবার্ট বলেন, ‘আমরা এমন একটি ভবিষ্যৎ চাই, যেখানে তরুণরা আর কেবল দর্শক হয়ে থাকবে না।’
তাদের এই ক্ষোভ একাধিক সংকট থেকে জন্ম নিয়েছে—২০০৮ সালের আর্থিক বিপর্যয়, কোভিড-১৯ মহামারির বিশৃঙ্খলা, জলবায়ু সংকট এবং ২০২০ সালের পর ধনীদের হাতে বৈশ্বিক সম্পদের ৬৩ শতাংশ চলে যাওয়ার মতো চরম বৈষম্য।
হিমাল সাউথএশিয়ান পত্রিকার সম্পাদক রোমান গৌতম বলেন, ‘তরুণদের রাগের মূল কারণ হলো, এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা প্রমাণ করেছে—তারা দুর্নীতিগ্রস্ত এবং দেশকে নতুন পথে নিতে অক্ষম।’
জয়ের ভ্রান্ত ধারণা: কৌশলগত সাফল্য, কিন্তু কৌশলগত গভীরতা নেই
নেপালে সংসদ বাতিল বা কেনিয়ায় কর বাড়ানোর বিল প্রত্যাহারের মতো প্রাথমিক সাফল্য আন্দোলনে উদ্দীপনা আনে। কিন্তু এগুলো আন্দোলনের ভঙ্গুরতা ও সীমাবদ্ধতাও প্রকাশ করে। এই আন্দোলনগুলো নেতৃত্বহীন ও বিকেন্দ্রীকৃত। টিকটক ও ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে দ্রুত সংগঠিত হতে পারলেও, তারা ক্ষোভকে স্থায়ী কর্মসূচিতে রূপান্তর করতে ব্যর্থ হয়।
নেপালে প্রথমে অভিজাতদের বিলাসিতার বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ শুরু হয়। পরে তা সহিংস রূপ নেয়—পঞ্চাশের বেশি মৃত্যু ঘটে, ভবন আগুনে পুড়ে যায়। তবুও অন্তর্বর্তী সরকার শুধু প্রতীকী কিছু পদক্ষেপ নেয়, বাস্তব কোনো পরিবর্তন আনে না।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পল স্ট্যানিল্যান্ড বলেন, ‘যখন কোনো নির্দিষ্ট ইস্যুতে বিক্ষোভ জোরালো হয়ে ওঠে, তখন সরকারগুলো একঘরে হয়ে পড়ে। নেপাল ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে, আর সামরিক বাহিনী পরিবর্তনের মধ্যস্থতায় মুখ্য ভূমিকা নেয়।’
এই পরিস্থিতিকে বলা হচ্ছে ‘নতুন ধরনের অস্থির রাজনীতি’। কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যর্থতা ও জনসেবা সংকট সরকারের ওপর আস্থা নষ্ট করেছে। ফলে সরকারগুলো স্বল্পমেয়াদে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, কিন্তু তরুণদের হাতে কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য পর্যাপ্ত চাপ বা ক্ষমতা থাকছে না।
মাদাগাস্কারে প্রেসিডেন্ট রাজারোলিনার মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ায় তাৎক্ষণিক আন্দোলন দমন হয়। কিন্তু তার পদত্যাগের দাবিও অব্যাহত থাকে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, বিক্ষোভে ২২ জন নিহত হয়েছে। এটা দেখায়—কিছু ছাড় দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করা গেলেও, সমস্যার মূল জায়গা ঠিক থাকে।
জানজিরা সোমবাতপুনসিরি সতর্ক করেন, ‘যেসব আন্দোলন ন্যায্য দাবি নিয়ে শুরু হয় কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের অ্যালগরিদম-নির্ভর হয়ে পড়ে, তা অনেক সময় সহিংস মবে রূপ নেয়।’ এই চিত্র নেপাল ও বাংলাদেশ উভয় জায়গাতেই দেখা গেছে।
ফলে গণআন্দোলনের সাফল্যের হার কমছে। জার্নাল অব ডেমোক্রেসি অনুসারে, ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে যেখানে গণআন্দোলনের সফলতার হার ছিল ৬৫ শতাংশ, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ৩৪ শতাংশে।
প্রভাবশালীদের দখলদারি: বিপ্লব থেকে শুরু হয়ে ঘুরেফিরে সেই ক্ষমতার খেলা
জেনারেশন জেড-এর নেতৃত্বে যেসব আন্দোলন শুরু হয়, সেগুলোর বড় একটি দুর্বলতা হলো—পরবর্তীতে সেগুলো আটকা পড়ে পুরনো রাজনৈতিক খেলার ফাঁদে। বিক্ষোভের চাপে কোনো নেতা পদত্যাগ করলেও, সুশাসনের আশা পূরণ হয় না। কারণ একই ধরনের পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি ও ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী—এক কথায় ‘মাফিয়া-সদৃশ’ কাঠামো-সংলাপে বসে আবার পুরনো মানুষদেরই ফিরিয়ে আনে। বাংলাদেশেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
দ্য ডিপ্লোম্যাট সতর্ক করেছে, যদি তরুণদের আন্দোলনকে একটি গঠনমূলক সংস্কারের কাঠামোর মধ্যে প্রবাহিত করা না যায়, তবে সেই শক্তি আবারও নতুন অস্থিরতার চক্রে হারিয়ে যাবে।
ইন্দোনেশিয়া ও মরক্কোয় সংস্কারপন্থীরা অনেক সময় আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে আন্দোলনকে শুধু নেতৃত্ব বদলের মধ্যেই সীমিত রাখে। এতে সমস্যার শিকড় থেকে কোনো পরিবর্তন হয় না।
সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার এর ভাষায়, এই কৌশল আন্দোলনের মনোভাবকে কেবল নির্বাচনে বন্দী করে রাখে, যেখানে আবারও ঋণের বোঝা ও নিওলিবারেল নীতির ফাঁদ অপেক্ষা করে।
নাইরোবির সংগঠক সোফিয়া বলেন, ‘শ্রমিক ইউনিয়নগুলো এখনো নতুন প্রজন্মের ঝুঁকিপূর্ণ চাকরিগুলোকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। তারা নিজস্ব অবস্থানে অনড়, বদলাতে চায় না।’ আফ্রিকার ৮৫ শতাংশ শ্রমিক যেহেতু অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে, তাই সংগঠিত শ্রম আন্দোলনের সঙ্গে তরুণরা সংযুক্ত না হলে এসব বিক্ষোভ অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়ে প্রভাব হারায়।
গঠনতান্ত্রিক পচন ও আমলাতান্ত্রিক জড়তা: সংস্কার যেন থেমে থাকা একটি চাকা
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে দশকজুড়ে চলে আসা কাঠামোগত পচন—যেমন বেকারত্ব, বৈষম্য ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা—এই বিক্ষোভের পেছনে প্রধান ইন্ধন। বেকারত্ব, দীর্ঘমেয়াদি শাসন ব্যর্থতা এবং দুর্নীতি—সব মিলিয়ে সংকট তীব্র। তবে এসব সমস্যার সমাধান বড় ধরণের কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়, আর তা আমলাতন্ত্রের কঠোর প্রতিরোধে আটকে থাকে।
নেপালে আন্দোলনের এক মাস পরও, দুর্নীতি বিরোধী যেসব তদন্তের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর অগ্রগতি নেই বললেই চলে। কোনো উচ্চপদস্থ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর ফলে জনগণের আস্থা নষ্ট হচ্ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত লোক রাজ বরাল বলেন, ‘এই সময়টা পুরনো দলগুলোর জন্য নিজেদের সংশোধনের সুযোগ ছিল। কিন্তু তারা এখনো চেয়ারের লড়াইয়ে ব্যস্ত। এখন তাদের শিক্ষা নেওয়ার কথা।’
তবে এইসব অন্তর্বর্তী সরকার ও দলগুলোর মধ্যে আস্থার ঘাটতি এখন ২০২৬ সালের নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন ও অন্তর্বর্তী প্রশাসনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। নেপালের জেন-জেড মুভমেন্ট অ্যালায়েন্সের সদস্য ২৪ বছর বয়সী অমিত খানাল বলেন, ‘যদি তদন্ত না হয়, তাহলে এই বিশাল আন্দোলনের কোনো অর্থ থাকবে না।’
আফ্রিকার প্রসঙ্গে বিশ্লেষক মোহামেদ কেইতা বলেন, ‘আর্থ-সামাজিক অবনতি, জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি, শাসনের ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক দমন—সব মিলিয়ে তরুণদের জন্য বিপজ্জনক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে।’
নেপালের পর্যটন খাতের অভিজ্ঞ সুমন পাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সবকিছু যেন একটা “সংগীতচেয়ারের খেলা”। নতুন কিছু আশা করলেও আসলে সবকিছু সেই পুরনো মাফিয়ার হাতে।’
দমন-পীড়নের দ্বিমুখী ধাক্কা: শক্তির প্রসার, আবার ক্ষয়ও
ডিজিটাল টুল বা প্রযুক্তি তরুণদের ক্ষমতায়ন করেছে। বিভিন্ন দেশের তরুণরা একে অপরের কৌশল গ্রহণ করছে। তবে একইসাথে, এই প্রযুক্তির ব্যবহারে দমননীতির পথও প্রশস্ত হয়েছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্টিভেন ফেল্ডস্টেইন বলেন, স্বৈরশাসকরা এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের মতো কৌশলের মাধ্যমে নাগরিকদের সংগঠিত হওয়া রোধ করছে। এতে ‘ক্ষমতা নির্মাণের’ সুযোগ কমে যায় এবং তরুণদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়।
বাংলাদেশ ও নেপাল-এ দমনপীড়নের ফলে কিছু সময়ের জন্য আন্দোলন আরও জোরালো হয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি ছড়িয়েছে ভুল তথ্য ও গুজব, যা আন্দোলনের ফোকাসকে দুর্বল করে দিয়েছে।
নেপালের ২৫ বছর বয়সী আন্দোলনকারী তনুজা পাণ্ডে বলেন, ‘আমরা পরিবর্তন চেয়েছিলাম, বিপ্লব নয়।’
আফ্রিকার প্রেক্ষাপটে মোহামেদ কেইতা বলেন, ‘আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাগত সংস্কার চাই। কারণ আমরা তরুণরা এই সমাজের ভবিষ্যৎ। কিন্তু দমনপীড়নই প্রমাণ করে—সরকার কতটা ব্যর্থ।’
স্থবিরতার মাঝেও জেগে ওঠার আশা
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জেনারেশন জেড-এর এই বিদ্রোহ আসলে নাগরিক চেতনার একটি নবজাগরণ। গ্লোবস্ক্যানের জরিপ বলছে— ৬৪ শতাংশ তরুণ দুর্নীতিকে ‘অত্যন্ত গুরুতর’ সমস্যা মনে করে, যা আগের প্রজন্মের তুলনায় অনেক বেশি।
দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক উইল শোকি বলেন, ‘আজকের তরুণরা সেইসব সংকটের দায় বইছে, যা তারা সৃষ্টি করেনি। অথচ এমন এক অর্থনীতিতে তারা কাজ পাচ্ছে না, যেখানে তাদের শ্রমের প্রয়োজনই নেই।’
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, যদি এই ডিজিটাল ক্ষোভকে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিতে রূপান্তর করা না যায়, যেমন শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে সংহতি অথবা তরুণদের জন্য সংরক্ষিত রাজনৈতিক আসন, তাহলে এই পরিবর্তন হবে অগভীর ও ক্ষণস্থায়ী।
দ্য ডিপ্লোম্যাট এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলে, ‘এই বিপ্লব আসলেই কি মৌলিক পরিবর্তন আনবে, নাকি আবারও আরেকটি অচল চক্রে পরিণত হবে?’ বিশ্লেষক লোক রাজ বরাল বলেন, সংস্কারের জন্য এখনই সময়। তবে ইতিহাস, বিশেষ করে আরব বসন্তের অভিজ্ঞতা, আমাদের বলে—দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
এই আন্দোলনগুলো ব্যর্থতা নয়; বরং তারা বিশ্বের স্থবির ও বন্ধ ব্যবস্থায় ফাটল ধরাচ্ছে। এখন প্রয়োজন—জেনারেশন জেড যেন শুধু প্রতিবাদকারী না থেকে, হয়ে ওঠে ভবিষ্যতের স্থপতি।
মোহামেদ কেইতা বলেন, যদি এই শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে তা ফিরিয়ে আনতে পারে ‘নাগরিক ক্ষমতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা।’ আর যদি উপেক্ষা করা হয়, তবে আন্দোলনের আগুন আবারও রাস্তায় ছড়িয়ে পড়বে।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, দ্য ডিপ্লোম্যাট, ভিশন অব হিউম্যানিটি ডট ওআরজি, দ্য নিউ হিউম্যাটিনিটারিয়ান ডট ওআরজি
ফিলিস্তিনের জনপ্রিয় কারাবন্দী নেতা মারওয়ান বারঘুতির পরিবার তার জীবন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি ইসরায়েলি কারারক্ষীদের হাতে বারঘুতি নির্মম প্রহারের শিকার হয়েছেন বলে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর এই আশঙ্কা আরও তীব্র হয়েছে। তাঁর ছেলে আরব বারঘুতি আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, ইসরায়েলি সরকার বন্দীদের,
১৩ ঘণ্টা আগেসবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—এটা কেবল নোবেল কমিটির ভুল সিদ্ধান্ত নয়, বরং এমন এক পদক্ষেপ যা ট্রাম্পকে আরও বেশি সামরিক হস্তক্ষেপ ও শক্তি প্রদর্শনের পথ খুলে দিয়েছে। এর মাধ্যমে লাতিন আমেরিকায় বন্দুকনির্ভর কূটনীতি আবারও জোরদার হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
১ দিন আগেমতানৈক্যের কারণে রাজনৈতিক দলের জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার বিষয়টি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য সংকট তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২ দিন আগেইংল্যান্ডের ম্যাগনা কার্টা থেকে শুরু করে নেপালের শান্তি প্রক্রিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার ফ্রিডম চার্টার, স্পেনের মোনক্লোয়া চুক্তি ও চিলির কনসারটাসিওন—প্রতিটিই নিজ নিজ প্রেক্ষাপটে ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। তবে এই চুক্তিগুলো যেমন ঐকমত্যের নজির স্থাপন করেছে, তেমনি বিভেদ ও আপত্তির ইতিহাসও কম নয়।
২ দিন আগে