leadT1ad

ইসরায়েলের কারাগারে 'ফিলিস্তিনি ম্যান্ডেলা': বারঘুতিকে নিয়ে এত ভীত কেন ইসরায়েল

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা
প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ০৯
ইসরায়েলের কারাগারে দুই দশকের বেশি সময় ধরে বন্দি মারওয়ান বারঘুতি। ফাইল ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনের জনপ্রিয় কারাবন্দী নেতা মারওয়ান বারঘুতির পরিবার তার জীবন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি ইসরায়েলি কারারক্ষীদের হাতে বারঘুতি নির্মম প্রহারের শিকার হয়েছেন বলে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর এই আশঙ্কা আরও তীব্র হয়েছে। তাঁর ছেলে আরব বারঘুতি আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, ইসরায়েলি সরকার বন্দীদের, বিশেষ করে তাঁর বাবাকে, হত্যা করতে পারে।

গত সোমবার (১৩ অক্টোবর) যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় ইসরায়েলের কারাগার থেকে প্রথম ধাপে মুক্তি পেয়েছেন ৮৮ জন ফিলিস্তিনি। মুক্তিপ্রাপ্তদের কয়েকজন অভিযোগ করেছেন, ২০২৫-এর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে কারাগার পরিবর্তনের সময় ৬৬ বছর বয়সী মারওয়ান বারঘুতিকে আটজন রক্ষী মিলে অজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত মারধর করে। খবরে বলা হয়েছে, এই হামলায় তার পাঁজরের চারটি হাড় ভেঙে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, গত দুই বছরে এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো কারারক্ষীদের হাতে এমন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বারঘুতি।

এই ঘটনার আগে, ২০২৫-এর আগস্টে ইসরায়েলের কট্টর-ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘বারঘুতির অবস্থা যে মারাত্মকভাবে খারাপ হয়েছে, তাতে আমি গর্বিত।’

আরব বারঘুতি জোর দিয়ে বলেছেন, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাঁর বাবাকে ‘চুপ করিয়ে’ দিতে চাইছে অথবা তাঁকে দীর্ঘমেয়াদী অক্ষমতার দিকে ঠেলে দিতে চাইছে, যাতে তিনি ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য একজন সাহসী নেতা হিসেবে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করতে না পারেন।

কে এই মারওয়ান বারঘুতি?

মারওয়ান বারঘুতি ফিলিস্তিনের একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং ফাতাহ আন্দোলনের অন্যতম সদস্য। বারঘুতিকে প্রায়শই ফিলিস্তিনের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৫৯ সালে পশ্চিম তীরের কোবার গ্রামে তাঁর জন্ম। অল্প বয়সেই তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয়তা শুরু হয়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি ‘ফাতাহ’তে যোগ দেন। ফাতাহের যুব আন্দোলন ‘শাবিবা’র সহ-প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে মাত্র ১৮ বছর বয়সে বারঘুতি প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের হাতে বন্দী হন। ওই সময় কারাবন্দী থাকা অবস্থাতেই তিনি হিব্রু ভাষা শেখেন এবং মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন।

১৯৯৬ সালে ফিলিস্তিনের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে নির্বাচিত হওয়ার পর অসলো চুক্তির একজন সমর্থক ছিলেন বারঘুতি। কিন্তু একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অগ্রগতির অভাবে তিনি ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়েন। ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন—প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় বারঘুতি একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

২০০০ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময়, বারঘুতি ফাতাহ-এর সশস্ত্র শাখা তানজিমের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।

ফিলিস্তিনি মুক্তি ও দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের প্রতীক
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন মতে, বহু ফিলিস্তিনির কাছে মারওয়ান বারঘুতি মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হন। তাঁকে প্রায়শই দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে তুলনা করা হয়। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কারাবন্দী থাকা সত্ত্বেও তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা গেছে, বর্তমান ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের উত্তরসূরি হিসেবে তিনি সবচেয়ে পছন্দের প্রার্থী। এমনকি গাজার প্রতিরোধ শক্তি হামাস কিংবা ফাতাহের অন্যান্য নেতাদের চেয়েও তিনি এগিয়ে থাকেন।

ফিলিস্তিনের বিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ দূর করার সক্ষমতার মধ্যেই বারঘুতির গুরুত্ব নিহিত রয়েছে। ফাতাহ-এর নেতা হওয়া সত্ত্বেও, তিনি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হামাসসহ অন্যান্য দলগুলোর কাছেও সম্মানিত। যেকোনো ভবিষ্যৎ ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের জন্য এই আন্তঃদলীয় গ্রহণযোগ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।

কারাগার থেকেও বারঘুতি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় রয়েছেন। ২০০৬-এর ‘ফিলিস্তিনি বন্দী দলিল’-এর অন্যতম প্রধান লেখক ছিলেন বারঘুতি। এই দলিল ফাতাহ, হামাস ও অন্যান্য গোষ্ঠীর কারাবন্দী নেতাদের স্বাক্ষরিত একটি জাতীয় ঐক্যমত্যের প্রস্তাবনা। এই দলিল কার্যকরভাবে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানকে সমর্থন করে। বারঘুতি এই পথের পক্ষেই তাঁর সমর্থন অব্যাহত রেখেছেন এবং এর সঙ্গে দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ‘শান্তিপূর্ণ গণপ্রতিরোধ’ গড়ে তোলার কথা বলেছেন।

গ্রেপ্তার ও বিচার
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ইসরায়েল বারঘুতিকে আল-আকসা মার্টায়ার্স ব্রিগেডের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত করে। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি ফাতাহ-এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর অভিযোগ ছিল বারঘুতির বিরুদ্ধে। ২০০১ সালে তাঁকে হত্যার একটি ব্যর্থ চেষ্টার পর, ২০০২ সালের এপ্রিলে রামাল্লা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করে।

ইসরায়েলি বেসামরিক আদালতে বারঘুতির বিচার করা হয়, কিন্তু তিনি সেই আদালতের বৈধতাকে প্রত্যাখ্যান করেন। বারঘুতি যুক্তি দেন, একজন নির্বাচিত ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা হিসেবে তাঁকে বিচার করার কোনো এখতিয়ার এই আদালতের নেই। এই বিচার প্রক্রিয়া স্বাধীন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দ্বারাও সমালোচিত হয়েছিল। ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন জানায়, তারা আন্তর্জাতিক আইনের এমন অসংখ্য লঙ্ঘন খুঁজে পেয়েছে, যার ফলে বারঘুতি একটি সুষ্ঠু বিচার পেয়েছেন—এমন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হচ্ছে না।

২০০৪ সালে, পাঁচজন ইসরায়েলি হত্যার অভিযোগে বারঘুতিকে যাবজ্জীবন এবং অতিরিক্ত ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

কেন ইসরায়েল তাঁকে বন্দী করে রেখেছে?
ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো, মারওয়ান বারঘুতি একজন সন্ত্রাসী। বারঘুতি ইসরায়েলের নাগরিকদের বিরুদ্ধে মারাত্মক হামলা পরিচালনার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তাঁর ক্রমাগত কারাবাসের পেছনে এই দণ্ডকেই কারণ হিসেবে দেখানো হয় এবং হামাসের বারবার দাবি সত্ত্বেও ইসরায়েল বন্দী বিনিময়ের সময় তাঁকে মুক্তি দিতে রাজি হয়নি।

তবে বহু বিশ্লেষক মনে করেন যে বারঘুতিকে মুক্তি দিতে ইসরায়েলের অনিচ্ছার নেপথ্যে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক ভীতি: ফিলিস্তিনি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার বারঘুতির অসাধারণ ক্ষমতা।

মুক্ত বারঘুতিকে এমন এক নেতা হিসেবে দেখা হয়, যিনি ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যেকার বিভেদ দূর করে একটি সুসংহত ও বৈধ ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব তৈরি করতে পারেন। ফিলিস্তিনিদের এই ঐক্য দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে পারে। ভবিষ্যতে যেকোনো শান্তি আলোচনার জন্য শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। ফলে দখলদার ইসরায়েলের কাছে বারঘুতি হুমকি বলেই বিবেচিত হবেন।

দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক মতামতে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিশেষজ্ঞ হোসে মার্টিন পেরেজ দে নানক্লারেস দাবি করেছেন, ‘বারঘুতিই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি হামাস ও ফাতাহসহ বিভিন্ন ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীকে একত্রিত করে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানকে নতুন করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।’

এ ছাড়া ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের প্রতি তাঁর সমর্থন আন্তর্জাতিকভাবেও বারঘুতিকে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে পারে। বারঘুতিকে কারাগারে রেখে ইসরায়েল একাধারে যেমন তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়কে সন্ত্রাসবাদের আড়ালে চাপা দিতে পারে। একই সঙ্গে বিশ্বদরবারে প্রমাণ করতে চায়, ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এমন কোনো নেতৃত্ব নেই যার সঙ্গে অর্থবহ আলোচনা সম্ভব।

ইসরায়েলি কৌশলবিদরা দীর্ঘদিন ধরে বিভক্ত ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব পছন্দ করে আসছেন। বিভক্ত নেতৃত্বকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ এবং রাষ্ট্র অর্জনের ক্ষেত্রে তারা কম সক্ষম। এর বিপরীতে বারঘুতি সম্পূর্ণ বিপরীত এক নেতা, যিনি তাঁর জনগণকে একত্রিত করতে এবং একটি সার্বভৌম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করতে সক্ষম।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মারওয়ান বারঘুতিকে মুক্তি দেওয়া হলে ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি নেতা হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে একটি বিশ্বাসযোগ্য শান্তি আলোচনা সম্ভব। ইসরায়েল এই ধরনের নেতার অভাবের কথাদীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে।

মারওয়ান বারঘুতির কারাবাস মুলত ইসরায়েলের গভীর রাজনৈতিক ভয়ের প্রতিচ্ছবি। যে নেতাকে মুক্তি দিলে শান্তির পথ খুলতে পারে, তাকেই সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েল একদিকে যেমন আলোচনার টেবিলে একজন যোগ্য প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করছে, তেমনি ফিলিস্তিনিদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকেও দমন করছে। বারঘুতির মুক্তি তাই শুধু বন্দি বিনিময়ে আটকে নেই, বরং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা।

Ad 300x250

সম্পর্কিত