leadT1ad

নুরাল পাগলা, হাইকোর্টের মাজারের নূরা পাগলা ও আজম খান

গোয়ালন্দের নুরাল পাগলাই কি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া বিচিত্রার প্রচ্ছদের সেই নূরা পাগলা? কেমন ছিলেন হাইকোর্টের মাজারের সেই নূরা পাগলা? আজম খান কেন ১৯৭৩ সালে তাঁকে নিয়ে গান বানিয়েছিলেন? নূরা পাগলা কেন বলেছিলেন, ‘আমি জেহাদ করব তখন, যখন ইন্ডিয়া এদেশে আসবে, যখন পাকিস্তান এদেশে আসবে।’

প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯: ০৪
আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯: ০৭
নুরাল পাগলা, হাইকোর্টের মাজারের নূরা পাগলা ও আজম খান। স্ট্রিম গ্রাফিক

সম্প্রতি রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরাল পাগলার দরবার শরিফে হামলা, ভাঙচুর আর কবর থেকে তাঁর লাশ তুলে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। এরপর ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায় ১৯৭৩ সালের ১০ আগস্টের সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র প্রচ্ছদ ‘নূরা পাগলা ও আজম: সংগীতে আধ্যাত্মিক প্রেরণা’।

প্রচ্ছদের ছবিতে দেখা যাচ্ছে রকস্টার আজম খান ও তাঁর ব্যান্ড উচ্চারণের সদস্যদের সঙ্গে নূরা পাগলার ছবি। এই ছবিকে ঘিরে শুরু হয় তর্ক-বিতর্ক। কেউ বলেন, গোয়ালন্দের নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলাই আসলে বিচিত্রার সেই ‘নূরা পাগলা’। আবার অনেকে বলেন, দুজন একেবারেই আলাদা মানুষ। ফেসবুকজুড়ে চলে পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্যের ঝড়।

হাইকোর্টের মাজারের নূরা পাগলা। ফেসবুক থেকে নেওয়া ছবি
হাইকোর্টের মাজারের নূরা পাগলা। ফেসবুক থেকে নেওয়া ছবি

বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, গোয়ালন্দের নুরাল পাগলা আর বিচিত্রার প্রচ্ছদের নূরা পাগলা এক নন। বিচিত্রায় যার ছবি দেখা যাচ্ছে, তিনি সত্তরের দশকের হাইকোর্টের মাজারের বিখ্যাত মুখ নূরা পাগলা।

১৯৭২ সালের দিকে আজম খানের সঙ্গে পরিচয় হয় নূরা পাগলার। সে সময় আজম খান নতুন ধারার গান নিয়ে সবে শহরের সাউন্ডস্কেপে হাজির হতে শুরু করেছেন। তাঁর গানের কথায় তখন আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া স্পষ্ট। সেই আধ্যাত্মিক ভাবনার উৎস ছিল হাইকোর্টের মাজারের সেই ‘ফকির’ নূরা পাগলা। ১৯৭৩ সালে আজম খান তাঁকে নিয়ে গানও বানান—

‘হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘোরে
কয়জনা আসল ফকির?
প্রেমেরও বাজারে কত প্রেমিক ঘোরে
কয়জনা আসল প্রেমিক?’

১৯৭৩ সালের প্রকাশিত ‘বিচিত্রা’য় নূরা পাগলায় বয়স লেখা হয়েছিল আশির ওপরে। তবে সত্তরের দশকে হাইকোর্টের মাজারে যাঁরা নূরা পাগলাকে দেখেছেন, তাঁদের মতে তখন তাঁর বয়স ছিল ৬০ বছরের আশেপাশে। বিচিত্রার ছবি ও বিদেশি এক ফটোগ্রাফারের তোলা নূরা পাগলার ছবিতে সেই বয়সের ছাপ পাওয়া যায়।

নূরা পাগলা বলেছিলেন, ‘গান গাইবার সময় বুকের ভেতর কান্না জমতে থাকে।’ নূরা পাগলা ও তাঁর ‘সম্প্রদায়ের’ গানে ছিল আলাদা মৌলিকত্ব। তা আজম খানও স্বীকার করেছেন। আজম খানের বাংলা ঝাঁকি (পড়ুন- রক) সংগীতে যে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়, তা কিছুটা নূরা পাগলার থেকেই এসেছে।

গোয়ালন্দের নুরাল পাগলা মারা যান এ বছরের ২৩ আগস্ট। পত্রিকার খবরে জানা যায়, মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। অন্যদিকে, হাইকোর্টের নূরা পাগলার মৃত্যু হয়েছে বহু বছর আগেই। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আনোয়ার পারভেজ হালিম ফেসবুকে জানিয়েছেন, ‘২০০৮ সালের দিকে সর্বশেষ জেনেছিলাম, নূরা পাগলা অসুস্থ। গুলশানের শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সম্ভবত ওই সময়ে বা তার কিছু পরে তিনি মারা যান।’

কবি সৈয়দ তারিকের ২০১৮ সালের লেখা থেকে জানা যায়, হাইকোর্ট পর্ব শেষে নূরা পাগলা থাকতেন ঢাকার রামপুরায়। রামপুরা এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার ফেসবুক পোস্ট অনুসারে, রামপুরা টিভি সেন্টারের পেছনের দিকে নূরা পাগলার মাজার।

১৯৭৩ সালে প্রকাশিত আজম খানের এলপি। ছবি : মিলু আমানের সৌজন্যে
১৯৭৩ সালে প্রকাশিত আজম খানের এলপি। ছবি : মিলু আমানের সৌজন্যে

অর্থাৎ ফেসবুকে ঘুরে বেড়ানো সেই প্রচ্ছদের নূরা পাগলা আর গোয়ালন্দের নুরাল পাগলা এক ব্যক্তি নন। এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়।

কেমন ছিলেন হাইকোর্টের মাজারের সেই নূরা পাগলা

ঢাকার হাইকোর্টের মাজারের নূরা পাগলা ছিলেন অদ্ভুত এক চরিত্র। মাজারপাড়া ঘুরে বেড়ানো মানুষের কাছে তিনি খুবই পরিচিত ছিলেন। তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে তিনি গাইতেন দেহতত্ত্বের গান, অনেকটা বাউল ধারার মতো। ঢোল আর দেশি বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে জমে যেত আসর। মাঝেমধ্যে জিকির করতে করতে হঠাৎ লাফিয়ে উঠতেন, কখনো গান গাইতে গাইতে সবকিছু ভুলে যেতেন।

নূরা পাগলা বলেছিলেন, ‘গান গাইবার সময় বুকের ভেতর কান্না জমতে থাকে।’ নূরা পাগলা ও তাঁর ‘সম্প্রদায়ের’ গানে ছিল আলাদা মৌলিকত্ব। তা আজম খানও স্বীকার করেছেন। আজম খানের বাংলা ঝাঁকি (পড়ুন-রক) সংগীতে যে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়, তা কিছুটা নূরা পাগলার থেকেই এসেছে।

১৯৭৩ সালের বিচিত্রায় প্রকাশিত আর্টিকেল। ছবি: হক ফারুখের সংগ্রহশালা থেকে
১৯৭৩ সালের বিচিত্রায় প্রকাশিত আর্টিকেল। ছবি: হক ফারুখের সংগ্রহশালা থেকে

হাইকোর্টের মাজারে নূরা পাগলার প্রভাব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ১৯৭৩ সালের ১০ আগস্ট প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিচিত্রার। বিচিত্রা লিখেছিল, ‘যাঁরা ঢাকায় থাকেন তাঁদের কাছে বৃহিস্পতিবারের হাইকোর্ট মাজার অচেনা কিছু নয়। একজন ফকিরের মাজারকে ঘিরে যেভাবে একটি মেলা ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে শহরবাসীদের অনেকেই তা সুনজরে দেখছেন না। যদিও মাজারে দর্শনার্থীদের গাড়ির লম্বা সারিতে একাধিক মার্সিডিজ, বিউইক, ফ্যালকন রয়েছে। মাজারে ঢোকার পথেই দর্শনার্থীরা নূরা পাগলার দর্শন লাভ করেন।’

১৯৭৩ সালে নূরা পাগলা দাবি করেছিলেন, সারা দেশে তাঁর ২৭ হাজার শিষ্য আছে। সন্তান কামনা কিংবা দুরারোগ্য রোগ—সব সমস্যার সমাধান মিলবে তাঁর কাছে, এমন বিশ্বাসে নূরা পাগলার কাছে ভিড় জমাতেন অসংখ্য মানুষ। শিষ্যরা তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র বিক্রি করত। এমনকি তিনি যে চটের বস্তায় বসতেন, সেটার সুতাও নাকি বিক্রি হতো চড়া দামে!

নূরা পাগলাকে ঘিরে নানা গল্প বাজারে প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় শিরোনামও হয়েছেন। কেউ বলত গুপ্তচর, কেউ বলত আসল ফকির। অভিযোগ ছিল, তিনি ও তাঁর শিষ্যরা মাজারে গাঁজার আসর বসান। তবে নূরা পাগলার জবাব ছিল স্পষ্ট, ‘আমি গাঁজা খাই না, পীরের নিষেধ আছে।’

নূরা পাগলার ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যায়, এমন কথাও বাজারে চালু ছিল। ১৯৭০ সালে নূরা পাগলা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘নির্বাচনে শেখ মুজিব জিতবেন।’

নোয়াখালীতে জন্ম নেওয়া নূরা পাগলা পড়াশোনা কতদূর করেছিলেন জানা যায়নি। তবে কথার মধ্যে প্রচুর ইংরেজি বলতেন। ফকিরিতে আসার আগে তাঁর পেশা নিয়ে বিচিত্রা সঠিক কিছু বলতে পারেনি। দুটি জনশ্রুতির কথা বিচিত্রা লিখেছিল, তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ আর্মিতে চাকরি করেছিলেন। আবার শিষ্যরা অনেকে বলতেন, তিনি একসময় পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ছিলেন।

ভারতে আজমিরের খাজা বাবার দরগায় গিয়ে এক ফকিরের শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন নূরা পাগলা। তিনি দাবি করতেন, চিকিৎসার সময় সেই ফকির তাঁর ভেতর ভর করতেন। বিচিত্রার প্রতিবেদন থেকে তাঁর চিকিৎসার ধরন সম্পর্কেও জানা যায়। রোগীকে পাটিতে শুইয়ে তাঁর বুকের ওপর বসতেন। হাতজোড় করে মাজারের দিকে মুখ করে আবার উঠে পড়তেন। এরপর আবার বসতেন, আবার উঠতেন।

জেহাদ করব তখন, যখন ভারত-পাকিস্তান এদেশে আসবে

নূরা পাগলার ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যায়, এমন কথাও বাজারে চালু ছিল। ১৯৭০ সালে নূরা পাগলা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘নির্বাচনে শেখ মুজিব জিতবেন।’ এ কারণে আলবদর বাহিনী তাঁকে ও তাঁর শিষ্যদের বেধড়ক পিটিয়েছিল। আবার ১৯৭৩ সালে তাঁর করা এক ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী ১০ বছরেও শেখ মুজিবের কিছু হবে না।’

হাইকোর্টের মাজারে নূরা পাগলার গানের মজমা। ১৯৭৩ সালের বিচিত্রায় প্রকাশিত। ছবি: হক ফারুখের সংগ্রহশালা থেকে
হাইকোর্টের মাজারে নূরা পাগলার গানের মজমা। ১৯৭৩ সালের বিচিত্রায় প্রকাশিত। ছবি: হক ফারুখের সংগ্রহশালা থেকে

নূরা পাগলা রাজনীতি নিয়ে ভালো ধারণা রাখতেন। ছিলেন রাজনীতি সচেতনও। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার দেশের ভেতর যাঁরা গদি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে, তাঁদের বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই। আজ শেখ গিয়ে ভাসানী আসুক, কাল আবার ভাসানী গিয়ে শেখ আসুক, আমার তাতে মাথাব্যাথা নেই। আমি জেহাদ করব তখন, যখন ইন্ডিয়া এদেশে আসবে, যখন পাকিস্তান এদেশে আসবে।’

* সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র ‘নূরা পাগলা ও আজম: সংগীতে আধ্যাত্মিক প্রেরণা’ সংখ্যাটি আমাদের দিয়েছেন ‘বাংলার রক মেটাল’ বইয়ের লেখকদ্বয় মিলু আমান ও হক ফারুখ। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

Ad 300x250

উমর পরিবারের তিন প্রজম্মের হাতে যেভাবে রূপ পেয়েছে এ অঞ্চলের রাজনীতি

নির্বাচনে সাংবাদিকদের সতর্ক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে: তথ্য উপদেষ্টা

‘অনলাইন জুয়াড়ি চক্রের হোতা’ সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার সাত, এলাকায় নেই নুরুল হকের পরিবার

নারী হল সংসদ: এগিয়ে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা

সম্পর্কিত