.png)
আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী
আজ ১২ রবিউল আউয়াল। হিজরি সনের এই মাসেই নবীজির (সা.) জন্ম। এ মাসেই তাঁর ওফাত। সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে আজকের দিনটি তাই পবিত্র। আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী। দুনিয়াজুড়ে ইসলাম ধর্মালম্বী মানুষেরা তাঁদের প্রিয় নবীর জন্ম-মৃত্যর এ দিনটি বিশেষ মর্যাদায় স্মরণ করে। ইতিহাসের অন্ধকার যুগে জন্ম নিয়ে দুনিয়া পাল্টে দেওয়া হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কর্মধারা ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতির নিরীক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে দুনিয়া পাল্টে দিয়েছিলেন এই মহামানব? বিশ্বসেরা কবি-লেখক ও দার্শনিকেরা কীভবে দেখেছেন তাঁকে—এ লেখায় তুলে ধরা হয়েছে সেই বিত্তান্ত।

সালেহ ফুয়াদ

আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে ধূসর আরবের মরুভূমিতে জন্মেছিলেন এক মহামানব। পরবর্তী সময়ে নিজের কর্মধারার মধ্য দিয়ে বদলে দিয়েছিলেন দুনিয়ার ইতিহাস; তিনি হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর জন্ম এই মহাপৃথিবীর জন্য এক বিরাট ঘটনা।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশে। জন্মের আগেই তিনি হয়ে পড়েন পিতৃহারা। প্রথমে পিতামহ, পরে চাচার হাতে লালিত হন। ধর্মপ্রধান হওয়ার আগেই নৈতিক গুণ দিয়ে মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হন সবার। জীবনের শুরু থেকেই চারিত্রিক শুভ্রতা, নেতৃত্বের গুণ, মানবিক বোধ আর সক্রিয়তায় তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম।
৪০ বছর বয়সে লাভ করেন নবুয়ত। হেরার আলোয় উজ্জ্বল করে তোলেন চারপাশ। তাঁর সেই আলো ছড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়ায়। ঐশী বাণী প্রচারের তাঁর এ লড়াই সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন।
ইতিহাসের অন্ধকার যুগে জন্ম নিয়ে দুনিয়া পাল্টে দেওয়া তাঁর কর্মধারা ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতির নিরীক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সময়টা মূর্খতার। সময়টা হিংস্রতার। শুকনো অতৃপ্ত মরুভূমি রক্তের জন্য উতলা। পশুকে পানি পান করাতে গিয়ে সৃষ্ট কাজিয়ার সূত্রে বছরের পর বছর ধরে লড়াই চলছে অবিরাম। ধনী আর নির্ধনের বিরোধ চরমে। কালো আর ধলোর শ্রেণি–তফাত মাত্রাহীন।
আরব আর অনারবের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে অহেতুক আভিজাত্যের বড়াই। মানুষের দাম তখন খুব অল্প। দাসত্বের শৃঙ্খলে পেঁচিয়ে অর্থবিত্তে অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর ওপর সারা বিশ্বে চলছে অসহ্য নির্যাতন। আরবরা এক হাতে শিল্পের চর্চা করছে, অন্য হাতে করছে নারীর অপমান। এতটাই অপমান যে কোনো পিতা কন্যাসন্তানের দায় নিতে চান না কোনোভাবে। এরপরও কন্যাশিশুর জন্ম হলে তাকে গর্তে ফেলে জীবন্ত দাফন করছেন খোদ জন্মদাতা। তাই যুগটা কাব্যমুশায়েরার জন্য উৎকৃষ্ট হলেও সভ্য দুনিয়া সেই সময়টার নাম দিয়েছে জাহেলি যুগ বা আইয়ামে জাহেলিয়া। হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জন্ম এই সময়েই।

এরপরের ইতিহাস সবার জানা। তাঁর স্পর্শে কেমন করে পাল্টে গেল দুনিয়া। ঘুঁচে গেল আরব-অনারব বিরোধ। শ্রেণী-বর্ণের তফাত থাকল না। নারীর সম্মান ফিরল আবার। মানুষে মানুষে ভালোবাসা আবারও উঠল জমে। হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর নাম জপে বহু পাপিষ্ঠ পৃথিবীতেই পেল বেহেশতের সুসংবাদ। নবীর জন্ম তাই দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাঁকে নিয়ে দুনিয়ায় স্বতন্ত্র কোনো জাদুঘর নেই আজও। নেই তাঁর কোনো ভাস্কর্য, মূর্তি বা ছবি। তবু কী এক পাগল করা ভালোবাসায় মুসলমানদের হৃদয়ের উচ্চাসনে তাঁর স্থান। পৃথিবীতে এমন দ্বিতীয় মানবজনমের নজির আর নেই। পবিত্র কোরআনে নবীজির প্রতি মুসলমানদের এই ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে এভাবে, ‘নবী বিশ্বাসীদের কাছে তাঁদের নিজেদের চেয়েও বেশি আপনজন এবং নবীর স্ত্রীরা তাদের মাতা।’(সুরা আল আহজাব, আয়াত: ০৬)
একেকজন বেদুইন আরবকে নবীজি সভ্যতা শিখিয়েছেন। ধৈর্য, প্রজ্ঞা আর ভালোবাসা দিয়ে জয় করে নিয়েছেন খোলা তরবারি হাতে খুন করতে আসা রাগী যুবক উমরের (রা.)-এর হৃদয়। দাস হিসেবে নামানুষী জীবন কাটানো বেলাল তাঁর স্পর্শে এসে হয়ে গেলেন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। হাবশি গোলামের মর্যাদা হয়ে গেল আকাশছোঁয়া। অখ্যাত আবু হুরাইরা (রা.) হয়ে গেলেন হাদিসশাস্ত্রের বিখ্যাত পণ্ডিত। ভয়ংকর যোদ্ধা আলী (রা.) তাঁর স্পর্শ থেকে শিখলেন যুদ্ধের ময়দানেও ব্যক্তিগত আক্রোশকে কীভাবে প্রশ্রয় না দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে হয়।

লড়াইরত অবস্থায় ভূপাতিত শত্রু যখন আলীর মুখে থুতু ছিটিয়ে দেয়, তখন তিনি অস্ত্র ছেড়ে তাকে মুক্তি দিয়ে দেন। এমন উদারতা আগে কখনো দেখেনি দুনিয়া। তায়েফের ময়দানে রক্তাক্ত হয়েও প্রার্থনা করেছেন তাদের সুবুদ্ধির জন্য যিনি—তিনিই আমাদের শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)। অথচ পুরো তায়েফ ভূমিকে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল তাঁর হাতে। যারা উহুদের যুদ্ধে তাঁর দাঁত ভেঙে দিয়েছিল অথবা তাঁকে মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য করেছিল, নবীজি মক্কা জয়ের পর তাদেরই উদারভাবে ক্ষমা করেছিলেন। এমন উদারতা এর আগে কোনো বিজেতা দেখিয়েছিলেন?
সাহাবি আবুজর গিফারি (রা.) নবীজিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত মোট কতজন নবী-রাসুল এসেছেন। নবীজি বলেছিলেন, ১ লাখ ২৪ হাজার। মানবধারায় আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম ও প্রিয়পাত্র হচ্ছেন এই নবীরা। কিন্তু কী অবাক ব্যাপার, ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই মানুষগুলোই বস্তুবাদী দুনিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বহীন। রাজা-বাদশাহদের জীবনের ছোট ছোট ঘটনাও ঐতিহাসিকেরা লিখে রেখেছেন। কিন্তু আদম (আ.) থেকে নিয়ে ঈসা মসিহ (আ.) পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকজন নবী ছাড়া কারও কথা ঐতিহাসিকেরা ইতিহাসের আদলে লেখেননি আজও।
দেখা যায়, যে কয়েকজন নবীর ইতিহাস লিখিত আছে, তাঁরাও কোনো না কোনোভাবে রাজত্ব বা বীরত্ব পেয়েছিলেন। হজরত দাউদ (আ.) ইসরায়েলি সম্রাটের সেনা ছিলেন। জালুত নামের এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধাকে হারিয়ে তিনি সম্রাটের কন্যাকে বিয়ে করেন। একপর্যায়ে হজরত দাউদ (আ.)–এর হাতে সাম্রাজ্য আসে। দাউদ (আ.)–পর পুত্র সুলাইমান (আ.) হন পরবর্তী উত্তরাধিকারী। স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে ঘটনাচক্রে ইউসুফ (আ.) হয়ে যান মিসরের বাদশাহ। এঁদের কথা ইতিহাসে লেখা আছে। কিন্তু বাকিদের কথা নেই।

বহু বছর ধর্মের দিকে আহ্বানের পরও হজরত ইয়াহইয়া (আ.)–এর কোনো অনুসারী মেলেনি। যাদের পরম মমতায় ধর্মের দিকে ডেকেছিলেন, তারাই তাঁকে হত্যা করে। হজরত লুত (আ.) যখন স্বগোত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন, তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই মেয়ে। তাঁর স্ত্রীও তাঁকে ত্যাগ করেন। তওরাতের বয়ানমতে, হজরত নুহ (আ.) তাঁর কিশতিতে মাত্র আটজন মানুষ নিয়ে ভেসেছিলেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) যখন ইরাক ত্যাগ করেন, তখন সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী সারাহ আর ভাতিজা লুত। পরবর্তী সময়ে দুই সন্তান ইসমাইল ও ইসহাক এ কাফেলায় শামিল হয়েছিলেন। বাইবেলের বর্ণনামতে, সারা জীবন ধর্ম প্রচারের পর হজরত ঈসা (আ.) পেয়েছিলেন মাত্র ১২ জন ‘হাওয়ারি’ বা সঙ্গী। তাঁরাও শেষ পর্যন্ত তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। এই হলো পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের অবস্থা। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা এঁদের ব্যাপারে বলেন, ‘আফসোস সেই বান্দাদের জন্য, যখনই তাদের কাছে কোনো নবী এসেছেন, তারা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ৩০)
কিন্তু এ জায়গায় শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) ব্যতিক্রম। নির্জন হেরা গুহায় যে আলোর দেখা তিনি পেয়েছিলেন, সেই আলোর বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন ঘরে ঘরে। এর জন্য সব ধরনের নির্যাতন তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। আল্লাহ তাঁর এই প্রিয় বান্দাকে সাফল্য দিয়েছেন। ওফাতের আগে তিনি দেখে গেছেন হাজারো অনুসারী তাঁর জন্য জীবন দিতে তৈরি। জন্মের ১৪০০ বছর পর আজও তাঁকে নিয়ে লেখা চলছে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। শুধু মুসলমানদের মধ্যেই যে তিনি প্রিয় তা নয়, দুনিয়ার বহু অমুসলিম তাঁকে হৃদয় উজাড় করে আজও ভালোবেসে চলেছে। মানবসভ্যতার জন্য তাঁর যে অবদান, অন্ধ না হলে তা কি অস্বীকার করা যায়!
বিশ্বের প্রভাবশালী শত মনীষীকে নিয়ে লেখা বই ‘দ্য হান্ড্রেড’-এ সর্বোচ্চ প্রভাবশালী ও মর্যাদাবান মানুষ হিসেবে সর্বাগ্রে রাখা হয়েছে নবীজিকে। লেখক ড. মাইকেল এইচ হার্ট জন্মগতভাবে একজন খ্রিষ্টান এবং শিক্ষাগত দিক থেকে একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। তবু ঈসাহ মসিহ (আ.) বা নিউটনকে প্রথম স্থানটি না দিয়ে নিরপেক্ষভাবে তিনি প্রথম স্থানটি দিয়েছেন নবী মুহাম্মদ (সা.)–কে। লিখেছেন, ‘তিনি ছিলেন ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয় স্তরেই সর্বোচ্চ সফল।’ এই এক চরণের বক্তব্যে মাইকেল এইচ হার্ট তাঁর ওপর আরোপিত সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।
আরেক ইংরেজ ঐতিহাসিক থমাস কার্লাইল তাঁর ‘অন হিরোজ, হিরো ওরশিপ অ্যান্ড দ্য হিরোইক ইন হিস্টোরি’ (লন্ডন, ১৮৪১) বইয়ে মহানবীকে মানবসভ্যতার ‘নায়ক’ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

যখন তিনি গ্যেটের কবিতায়, তলস্তয়ের দর্শনের প্রেরণায় আর নজরুলের সুর-সংগীতে
জার্মান কবি জোহান উলফগ্যাং ভন গ্যেটে (১৭৪৯-১৮৩২) হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর ওপর দীর্ঘ কবিতা লিখে গেছেন। শেখ সাদির ‘গুলিস্তাঁ’র জার্মান অনুবাদ তাঁকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৮১২ সালে হাফিজের জার্মান অনুবাদ হলে গ্যেটে ইসলামে প্রজ্ঞা, নিষ্কলুষতা আর শান্তি দেখতে পান। তাঁর মতে, পাশ্চাত্যের এগুলোর খুব দরকার ছিল।
জীবন চালানোর জন্য মানুষ পকেটে যেভাবে পয়সা নিয়ে ঘোরেন, রুশ সাহিত্যিক লিও তলস্তয় সেভাবে নবীজির বাণী নিয়ে ঘুরতেন। তাঁর মৃত্যুর পর ওভারকোটের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল নবীজির ৪৫১টি নির্বাচিত হাদিসের সংকলন।
সুদূর আরবে জন্ম নেওয়া এই মহামানব প্রভাবিত করেছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকেও। নজরুল হতে চেয়েছিলেন আরবের মাটি। যে মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে যাবেন নবী হজরত। গান ধরেছেন, ‘আমি যদি আরব হতাম/ মদিনারই পথ/ এই পথে মোর চলে যেতেন/ নূর নবী হজরত।’
সূত্র: ‘আল-কোরআনুল করিম’, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০১২, ঢাকা; মওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান, ‘পয়গম্বরে ইনকিলাব’, গুডওয়ার্ড, ২০১২, নয়াদিল্লি; ড. মাইকেল এইচ হার্ট, ‘দ্য হান্ড্রেড’, নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৮; ফিলিপ কে হিটি, ‘ইসলাম অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট, ইসলাম ইন ওয়ের্স্টান লিটারেচার’, নিউ ইয়র্ক, ১৯৬২।

আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে ধূসর আরবের মরুভূমিতে জন্মেছিলেন এক মহামানব। পরবর্তী সময়ে নিজের কর্মধারার মধ্য দিয়ে বদলে দিয়েছিলেন দুনিয়ার ইতিহাস; তিনি হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর জন্ম এই মহাপৃথিবীর জন্য এক বিরাট ঘটনা।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশে। জন্মের আগেই তিনি হয়ে পড়েন পিতৃহারা। প্রথমে পিতামহ, পরে চাচার হাতে লালিত হন। ধর্মপ্রধান হওয়ার আগেই নৈতিক গুণ দিয়ে মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হন সবার। জীবনের শুরু থেকেই চারিত্রিক শুভ্রতা, নেতৃত্বের গুণ, মানবিক বোধ আর সক্রিয়তায় তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম।
৪০ বছর বয়সে লাভ করেন নবুয়ত। হেরার আলোয় উজ্জ্বল করে তোলেন চারপাশ। তাঁর সেই আলো ছড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়ায়। ঐশী বাণী প্রচারের তাঁর এ লড়াই সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন।
ইতিহাসের অন্ধকার যুগে জন্ম নিয়ে দুনিয়া পাল্টে দেওয়া তাঁর কর্মধারা ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতির নিরীক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সময়টা মূর্খতার। সময়টা হিংস্রতার। শুকনো অতৃপ্ত মরুভূমি রক্তের জন্য উতলা। পশুকে পানি পান করাতে গিয়ে সৃষ্ট কাজিয়ার সূত্রে বছরের পর বছর ধরে লড়াই চলছে অবিরাম। ধনী আর নির্ধনের বিরোধ চরমে। কালো আর ধলোর শ্রেণি–তফাত মাত্রাহীন।
আরব আর অনারবের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে অহেতুক আভিজাত্যের বড়াই। মানুষের দাম তখন খুব অল্প। দাসত্বের শৃঙ্খলে পেঁচিয়ে অর্থবিত্তে অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর ওপর সারা বিশ্বে চলছে অসহ্য নির্যাতন। আরবরা এক হাতে শিল্পের চর্চা করছে, অন্য হাতে করছে নারীর অপমান। এতটাই অপমান যে কোনো পিতা কন্যাসন্তানের দায় নিতে চান না কোনোভাবে। এরপরও কন্যাশিশুর জন্ম হলে তাকে গর্তে ফেলে জীবন্ত দাফন করছেন খোদ জন্মদাতা। তাই যুগটা কাব্যমুশায়েরার জন্য উৎকৃষ্ট হলেও সভ্য দুনিয়া সেই সময়টার নাম দিয়েছে জাহেলি যুগ বা আইয়ামে জাহেলিয়া। হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জন্ম এই সময়েই।

এরপরের ইতিহাস সবার জানা। তাঁর স্পর্শে কেমন করে পাল্টে গেল দুনিয়া। ঘুঁচে গেল আরব-অনারব বিরোধ। শ্রেণী-বর্ণের তফাত থাকল না। নারীর সম্মান ফিরল আবার। মানুষে মানুষে ভালোবাসা আবারও উঠল জমে। হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর নাম জপে বহু পাপিষ্ঠ পৃথিবীতেই পেল বেহেশতের সুসংবাদ। নবীর জন্ম তাই দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাঁকে নিয়ে দুনিয়ায় স্বতন্ত্র কোনো জাদুঘর নেই আজও। নেই তাঁর কোনো ভাস্কর্য, মূর্তি বা ছবি। তবু কী এক পাগল করা ভালোবাসায় মুসলমানদের হৃদয়ের উচ্চাসনে তাঁর স্থান। পৃথিবীতে এমন দ্বিতীয় মানবজনমের নজির আর নেই। পবিত্র কোরআনে নবীজির প্রতি মুসলমানদের এই ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে এভাবে, ‘নবী বিশ্বাসীদের কাছে তাঁদের নিজেদের চেয়েও বেশি আপনজন এবং নবীর স্ত্রীরা তাদের মাতা।’(সুরা আল আহজাব, আয়াত: ০৬)
একেকজন বেদুইন আরবকে নবীজি সভ্যতা শিখিয়েছেন। ধৈর্য, প্রজ্ঞা আর ভালোবাসা দিয়ে জয় করে নিয়েছেন খোলা তরবারি হাতে খুন করতে আসা রাগী যুবক উমরের (রা.)-এর হৃদয়। দাস হিসেবে নামানুষী জীবন কাটানো বেলাল তাঁর স্পর্শে এসে হয়ে গেলেন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। হাবশি গোলামের মর্যাদা হয়ে গেল আকাশছোঁয়া। অখ্যাত আবু হুরাইরা (রা.) হয়ে গেলেন হাদিসশাস্ত্রের বিখ্যাত পণ্ডিত। ভয়ংকর যোদ্ধা আলী (রা.) তাঁর স্পর্শ থেকে শিখলেন যুদ্ধের ময়দানেও ব্যক্তিগত আক্রোশকে কীভাবে প্রশ্রয় না দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে হয়।

লড়াইরত অবস্থায় ভূপাতিত শত্রু যখন আলীর মুখে থুতু ছিটিয়ে দেয়, তখন তিনি অস্ত্র ছেড়ে তাকে মুক্তি দিয়ে দেন। এমন উদারতা আগে কখনো দেখেনি দুনিয়া। তায়েফের ময়দানে রক্তাক্ত হয়েও প্রার্থনা করেছেন তাদের সুবুদ্ধির জন্য যিনি—তিনিই আমাদের শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)। অথচ পুরো তায়েফ ভূমিকে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল তাঁর হাতে। যারা উহুদের যুদ্ধে তাঁর দাঁত ভেঙে দিয়েছিল অথবা তাঁকে মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য করেছিল, নবীজি মক্কা জয়ের পর তাদেরই উদারভাবে ক্ষমা করেছিলেন। এমন উদারতা এর আগে কোনো বিজেতা দেখিয়েছিলেন?
সাহাবি আবুজর গিফারি (রা.) নবীজিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত মোট কতজন নবী-রাসুল এসেছেন। নবীজি বলেছিলেন, ১ লাখ ২৪ হাজার। মানবধারায় আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম ও প্রিয়পাত্র হচ্ছেন এই নবীরা। কিন্তু কী অবাক ব্যাপার, ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই মানুষগুলোই বস্তুবাদী দুনিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বহীন। রাজা-বাদশাহদের জীবনের ছোট ছোট ঘটনাও ঐতিহাসিকেরা লিখে রেখেছেন। কিন্তু আদম (আ.) থেকে নিয়ে ঈসা মসিহ (আ.) পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকজন নবী ছাড়া কারও কথা ঐতিহাসিকেরা ইতিহাসের আদলে লেখেননি আজও।
দেখা যায়, যে কয়েকজন নবীর ইতিহাস লিখিত আছে, তাঁরাও কোনো না কোনোভাবে রাজত্ব বা বীরত্ব পেয়েছিলেন। হজরত দাউদ (আ.) ইসরায়েলি সম্রাটের সেনা ছিলেন। জালুত নামের এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধাকে হারিয়ে তিনি সম্রাটের কন্যাকে বিয়ে করেন। একপর্যায়ে হজরত দাউদ (আ.)–এর হাতে সাম্রাজ্য আসে। দাউদ (আ.)–পর পুত্র সুলাইমান (আ.) হন পরবর্তী উত্তরাধিকারী। স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে ঘটনাচক্রে ইউসুফ (আ.) হয়ে যান মিসরের বাদশাহ। এঁদের কথা ইতিহাসে লেখা আছে। কিন্তু বাকিদের কথা নেই।

বহু বছর ধর্মের দিকে আহ্বানের পরও হজরত ইয়াহইয়া (আ.)–এর কোনো অনুসারী মেলেনি। যাদের পরম মমতায় ধর্মের দিকে ডেকেছিলেন, তারাই তাঁকে হত্যা করে। হজরত লুত (আ.) যখন স্বগোত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন, তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই মেয়ে। তাঁর স্ত্রীও তাঁকে ত্যাগ করেন। তওরাতের বয়ানমতে, হজরত নুহ (আ.) তাঁর কিশতিতে মাত্র আটজন মানুষ নিয়ে ভেসেছিলেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) যখন ইরাক ত্যাগ করেন, তখন সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী সারাহ আর ভাতিজা লুত। পরবর্তী সময়ে দুই সন্তান ইসমাইল ও ইসহাক এ কাফেলায় শামিল হয়েছিলেন। বাইবেলের বর্ণনামতে, সারা জীবন ধর্ম প্রচারের পর হজরত ঈসা (আ.) পেয়েছিলেন মাত্র ১২ জন ‘হাওয়ারি’ বা সঙ্গী। তাঁরাও শেষ পর্যন্ত তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। এই হলো পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের অবস্থা। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা এঁদের ব্যাপারে বলেন, ‘আফসোস সেই বান্দাদের জন্য, যখনই তাদের কাছে কোনো নবী এসেছেন, তারা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ৩০)
কিন্তু এ জায়গায় শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) ব্যতিক্রম। নির্জন হেরা গুহায় যে আলোর দেখা তিনি পেয়েছিলেন, সেই আলোর বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন ঘরে ঘরে। এর জন্য সব ধরনের নির্যাতন তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। আল্লাহ তাঁর এই প্রিয় বান্দাকে সাফল্য দিয়েছেন। ওফাতের আগে তিনি দেখে গেছেন হাজারো অনুসারী তাঁর জন্য জীবন দিতে তৈরি। জন্মের ১৪০০ বছর পর আজও তাঁকে নিয়ে লেখা চলছে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। শুধু মুসলমানদের মধ্যেই যে তিনি প্রিয় তা নয়, দুনিয়ার বহু অমুসলিম তাঁকে হৃদয় উজাড় করে আজও ভালোবেসে চলেছে। মানবসভ্যতার জন্য তাঁর যে অবদান, অন্ধ না হলে তা কি অস্বীকার করা যায়!
বিশ্বের প্রভাবশালী শত মনীষীকে নিয়ে লেখা বই ‘দ্য হান্ড্রেড’-এ সর্বোচ্চ প্রভাবশালী ও মর্যাদাবান মানুষ হিসেবে সর্বাগ্রে রাখা হয়েছে নবীজিকে। লেখক ড. মাইকেল এইচ হার্ট জন্মগতভাবে একজন খ্রিষ্টান এবং শিক্ষাগত দিক থেকে একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। তবু ঈসাহ মসিহ (আ.) বা নিউটনকে প্রথম স্থানটি না দিয়ে নিরপেক্ষভাবে তিনি প্রথম স্থানটি দিয়েছেন নবী মুহাম্মদ (সা.)–কে। লিখেছেন, ‘তিনি ছিলেন ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয় স্তরেই সর্বোচ্চ সফল।’ এই এক চরণের বক্তব্যে মাইকেল এইচ হার্ট তাঁর ওপর আরোপিত সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।
আরেক ইংরেজ ঐতিহাসিক থমাস কার্লাইল তাঁর ‘অন হিরোজ, হিরো ওরশিপ অ্যান্ড দ্য হিরোইক ইন হিস্টোরি’ (লন্ডন, ১৮৪১) বইয়ে মহানবীকে মানবসভ্যতার ‘নায়ক’ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

যখন তিনি গ্যেটের কবিতায়, তলস্তয়ের দর্শনের প্রেরণায় আর নজরুলের সুর-সংগীতে
জার্মান কবি জোহান উলফগ্যাং ভন গ্যেটে (১৭৪৯-১৮৩২) হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর ওপর দীর্ঘ কবিতা লিখে গেছেন। শেখ সাদির ‘গুলিস্তাঁ’র জার্মান অনুবাদ তাঁকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৮১২ সালে হাফিজের জার্মান অনুবাদ হলে গ্যেটে ইসলামে প্রজ্ঞা, নিষ্কলুষতা আর শান্তি দেখতে পান। তাঁর মতে, পাশ্চাত্যের এগুলোর খুব দরকার ছিল।
জীবন চালানোর জন্য মানুষ পকেটে যেভাবে পয়সা নিয়ে ঘোরেন, রুশ সাহিত্যিক লিও তলস্তয় সেভাবে নবীজির বাণী নিয়ে ঘুরতেন। তাঁর মৃত্যুর পর ওভারকোটের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল নবীজির ৪৫১টি নির্বাচিত হাদিসের সংকলন।
সুদূর আরবে জন্ম নেওয়া এই মহামানব প্রভাবিত করেছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকেও। নজরুল হতে চেয়েছিলেন আরবের মাটি। যে মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে যাবেন নবী হজরত। গান ধরেছেন, ‘আমি যদি আরব হতাম/ মদিনারই পথ/ এই পথে মোর চলে যেতেন/ নূর নবী হজরত।’
সূত্র: ‘আল-কোরআনুল করিম’, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০১২, ঢাকা; মওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান, ‘পয়গম্বরে ইনকিলাব’, গুডওয়ার্ড, ২০১২, নয়াদিল্লি; ড. মাইকেল এইচ হার্ট, ‘দ্য হান্ড্রেড’, নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৮; ফিলিপ কে হিটি, ‘ইসলাম অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট, ইসলাম ইন ওয়ের্স্টান লিটারেচার’, নিউ ইয়র্ক, ১৯৬২।
.png)

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব ড. আনু মাহমুদ। এখন পর্যন্ত লিখেছেন শতাধিক বই। এর মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ পরিবারকে নিয়েই ত্রিশের বেশি বই আছে তাঁর।
৪ দিন আগে
১০ তলা ভবন। ৩৪ হাজার বর্গফুটের সুবিশাল অফিস। কিন্তু এসবের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। গত বছরের ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালানোর পর জনতার ক্ষোভের আগুনে পুড়ে এই রাজনৈতিক কার্যালয় এখন ধ্বংসপ্রায়।
৭ দিন আগে
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত জাতীয় পার্টিতে (জাপা) এবার দলের নির্বাচনী প্রতীক ‘লাঙ্গল’ নিয়ে শুরু হয়েছে টানাটানি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারও (সিইসি) নিশ্চিত নন লাঙলের আসল মালিক ভেঙে যাওয়া জাপার তিন উপদলের মধ্যে কোন পক্ষ।
১০ দিন আগে
সড়কে চলাচলকারীদের রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে যানবাহন থামার স্থানগুলোতে নির্মাণ করা হয় যাত্রীছাউনি। তবে রাজধানীর বনানী থেকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এমন কিছু যাত্রীছাউনি চোখে পড়বে যেগুলো রোদ দূরে থাক বৃষ্টি থেকেও যাত্রীদের বাঁচাতে পারে না।
১০ দিন আগে