আবদুল্লাহ কাফি
রাজধানীর পোস্তগোলা মহাশ্মশানে লাশ সৎকারের কাজ করেন লিটন সাধু। পাশাপাশি সদরঘাট এলাকায় ফলও বিক্রি করেন তিনি। তবে আধ্যাত্মিক ভাবনা থেকে দীর্ঘদিন ধরেই চুল–দাড়ি লম্বা রাখেন তিনি। দুই হাতে ভর্তি থাকে ধাতব বালা। ব্যতিক্রমী বেশভূষার কারণে স্থানীদের কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি। কিন্তু সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন ‘অযাচিত’ এক ঘটনার, যা তাঁর দৈনন্দিন জীবনেও এনেছে অস্বস্তি। ‘মানব কল্যাণ’–এর নামে কয়েক তরুণ জোর করে তাঁর চুল কেটে দিয়েছেন। আপত্তি জানালেও রেহাই পাননি লিটন। পুরো ঘটনা ভিডিও করে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে।
এই ভিডিওর সূত্র ধরেই সামনে আসে আরেক নাম—মাহবুবুর রহমান সরকার। মিরপুরের বাসিন্দা মাহবুব পড়াশোনার পাশাপাশি কন্টেন্ট তৈরি করেন। তাঁর ফেসবুক পেজ ‘মাহবুব ক্রিয়েশন ফোর’–এর অনুসারী ২২ লাখ। ভিডিওতে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তিনি ভাসমান ও অসহায় মানুষদের চুল–দাড়ি কেটে গোসল করান, খাবার দেন। উপস্থাপনা মানবিক মনে হলেও অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ভিন্ন ছবি। অনেক সময় জোর করে চুল কেটে দেওয়া হয়, কারও সম্মতি নেওয়া হয় না। আর এসব ভিডিওর ভিউ থেকে আসে বিদেশি ডলার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জোর করে কারও চুল কেটে দেওয়া মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার স্পষ্ট লঙ্ঘন। সেই সঙ্গে এটি ভুক্তোভোগীর মর্যাদার ওপরও সরাসরি আঘাত। এ ধরনের ঘটনা সমাজে ভীতি, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। ফলে এমন কাজ যাঁরা করছেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।
‘মাহবুব ক্রিয়েশন ফোর’ পেইজটি ঘেঁটে দেখা যায়, লাখ-লাখ মানুষ তাঁর ভিডিও দেখেন, শেয়ারও হয় হাজার হাজার। যার কারণে কোনো ভিডিও আপলোড করার সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে যায় লাখো মানুষের কাছে। একটা ভিডিওতে দেখে গেলো দুই কোটি ৮০ লাখ ভিউ। আর ভিউ যত বেশি, টাকাও তত বেশি।
অন্যদিকে একই সূত্রে খোঁজ করতে গিয়ে ‘কেএমরিয়াজ’ নামে একটা ইউটিউব চ্যানেলের খোঁজ পেয়েছে স্ট্রিম। চ্যানেলটিতে ৫ লাখের বেশি সাবস্ক্রাইবার। সেই চ্যানেলের ভিডিওগুলোও লাখ লাখ মানুষ দেখেন।
এসব পেজ বা চ্যানেলে বিজ্ঞাপনের রেভিনিউ শেয়ারিং-এর মডেলে প্লাটফর্ম থেকে যে অর্থ কনটেন্ট ক্রিয়েটররা পান, ‘ব্যবসা’ শুধু সেখানেই নয়। অনেক কনটেন্ট ক্রিয়েটরই সরাসরি ঘোষণা দিয়ে ‘অনুদান’ দেন। আমরা যে ‘মাহবুব ক্রিয়েশন ফোর’-ফেসবুক পেজটির কথা আলাপ করলাম, সেখান থেকে লাইভে এসে প্রকাশ্যেই চাওয়া হয় বিভিন্ন ‘সুবিধা’। অনেক অনুসারী আবার স্বপ্রণোদিত হয়ে এই কনটেন্ট ক্রিয়টরদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, অর্থ সহায়তা পাঠান।
সিলেটে ‘মানুষের জন্য’ নামে একটি সংগঠন পরিচালনা করেন জুনায়েদ আহমদ চৌধুরী। তিনি ভিডিওর শেষে অনুদান দিতে অনুরোধও করেন দর্শকদের কাছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্ট্রিমকে জুনায়েদ বলেন, ‘ভিডিওতে এগুলা বললেও একচুয়ালি পাওয়া যায় না। আমি অনুদানের কথাটা মূলত বলেছি একটু জমির জন্য। এই জমিটা যদি পাই, সেখানে ঘর তুলবো। বেওয়ারিশদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তুলবো।’
আমাদের এতগুলো এজেন্সি, তাদের নজরে এলো না? এটাতো ফৌজদারি অপরাধ। মানবাধিকারের প্রশ্ন। এই ফৌজদারি অপরাধের জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
কেএমরিয়াজ চ্যানেলের পরিচালক মোহাম্মদ কারুজ্জামন রিয়াজ স্ট্রিমকে বলেন, ‘প্রথম দিকে যখন আমরা শুরু করি, এটা সম্পূর্ণটাই আমরা আমাদের নিজেদের অর্থায়নেই শুরু করি। তবে যেহেতু সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে আমি ভিডিওগুলো আপলোড করেছি, সেজন্য কিন্তু আর্নিং আসছে যেহেতু এটা ৫ লাখ সাবস্ক্রাইবারের চ্যানেল। কিন্তু এটাই তো স্বাভাবিক, ঠিক না?’
রিয়াজ আরও বলেন, ‘আমার নিজের এক বড় ভাই আছেন, এ ছাড়া আমার কিছু ভাই-ব্রাদার আছেন। প্রথমদিকে তারাই আমাদের হেল্প করত। এইভাবে আমরা কাজটা চালাইয়া এই পর্যন্ত এসেছি।’
রাজধানীর ফরিদাবাদ এলাকায় থাকেন লিটন সাধু। তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে স্ট্রিমের। তিনি তাঁর চুল কাটার ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘সেইদিন আমি বাসা থেকে বের হইয়া মাল (ফল) কিনতে গেছি আড়তে। কিন্তু আমার আর মাল কিনা হয় নাই। আড়ৎ থেকে ফিরার সময় গাড়িতে উঠতে গেছি, তখন তাঁরা আমারে দাঁড়া করায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম— আপনি কে, কী করেন? এসব বলার পর তারা বলে— মানব কল্যাণ। তারপর তারা আমারে আটকাইয়া ফেলল।‘
সেদিন চুল কেটে দেওয়া ছাড়াও লুটের শিকার হয়েছেন বলেও দাবি করেছেন লিটন সাধু। তাঁর দাবি অনুযায়ী, সেদিন চুল কেটে দেওয়ার সময় তাঁর হাতে ৫০ ভরির রুপার বালা ছিল। যার আনুমানিক মূল আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা। যা লুট করে নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার জিনিসগুলার কিচ্ছুই দেয় নাই। তারা সব নিয়া গেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি বহুত অনুরোধ করলাম— বাবা, আমার কথাটা শোনো তোমরা। এরা আমার কোনো কথাই শোনে নাই। আমার ইজ্জত-সম্মান লইয়া টানাটানি শুরু কইরা দিছে। আমি কেমন জানি হইয়া গেলাম তাদের ব্যবহার, আচার দেইখা। আমার এলাকার মানুষের আচার-ব্যবহার দেইখা আমি পুরা হতভম্ব হইয়া গেলাম।’
চুল কেটে দেওয়া ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে লিটন সাধু বলেন, ‘যে বা যারা এইসব সন্ত্রাসী করে, তাদের বিচার এই বাংলার মাটিতে হইতেই হবে। এগোরে কোনো রকম ছাড় দেওয়া যাবে না। কেডা অগোরে পারমিশন দিছে? এত বড় কলিজাটা কে দিছে?’
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখা যায়, তিনজন লোক মিলে একজন বয়স্ক ব্যক্তির চুল জোরপূর্বক কেটে দিচ্ছেন। কোনোভাবেই থামাতে না পেরে এক পর্যায়ে বৃদ্ধ লোকটি হাল ছেড়ে দেন। তখন তিনি বলতে থাকেন, ‘আল্লাহ তুই দেহিস’।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে বৃদ্ধের চুলদাঁড়ি কেটে দেওয়া হয়, তার নাম হালিম উদ্দিন আকন্দ। প্রায় ৩৪ বছর ধরে এমন লম্বা চুল-দাঁড়ি রাখেন তিনি। ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কাশিগঞ্জের কোদালিয়া এলাকার আপন পাড়ার বাসিন্দা তিনি। চার মাস আগে তাঁর চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হয়। হালিম উদ্দিন আকন্দ স্থানীয়ভাবে পরিচিত এবং তিনি সন্ন্যাসীর বেশে ঘুরে বেড়ান।
সেই ভিডিও ভাইরাল হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। একের পর এক ছড়িয়ে পড়তে থাকে এমন অনেক ভিডিও। এসব ঘটনায় নিন্দা জানায় বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠন। গণমাধ্যমগুলোতেও গুরুত্ব দিয়ে খবর ছাপা হচ্ছে। এমন প্রতিক্রিয়ার পর নিজেদের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে ‘মাহবুব ক্রিয়েশন ফোর’।
শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) পেইজ থেকে লাইভে এসে মাহবুবুর রহমান সরকার বলেছেন, ‘আমি ২০২০ সালে যখন এসএসসি কমপ্লিট করে ঢাকা আসি, তখন আমার এই কাজগুলা করার ইচ্ছা জাগে। মানুষগুলাকে দেখে খুবই খারাপ লাগা শুরু করে। ২০২৩ সালের শেষের দিকে আমি এই কাজটা শুরু করি। প্রায় দুই বছরের বেশি হয়ে গেছে আমাদের এই কাজটা। এর মধ্যে আমরা কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হইনি।’
মাহবুব আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমরা এই কাজগুলো বন্ধ করে দিচ্ছি। কারণ মানুষ আমাদের নানা রকমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমাদের বাজেভাবে উপস্থাপন করছে।’
শুধু মাহবুব রহমান নন, এমন ‘জবরদস্তিমূলক মানবসেবা’ করেন আরও অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন। এর মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে স্ট্রিম। তাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ কামরুজ্জামান রিয়াজ একজন। তাঁর পরিচালিত ইউটিউব চ্যানেলের নামই ‘কেএমরিয়াজ’। সেই চ্যানেলেটিতে এখন পর্যন্ত ২০০টির মতো ভিডিও আপলোড করা হয়েছে। যার সবগুলোই এভাবে অন্যের চুল কাটার ওপর নির্মিত।
রিয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমি মূলত কাজটা শুরু করেছি অনেক আগে। তখন অফলাইনে কাজ করতাম। আড়াই বছর আগে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কাজ করা শুরু করি। অনলাইনে আসার মূল কারণ হলো মানুষের কাছে একটা মেসেজ পৌঁছানো।’
রিয়াজ আগে মানসিকভাবে অসুস্থ, ভাসমান ভিক্ষুকদের নিয়ে কাজ করতেন। তাঁদের আর্থিক সহায়তা দিতেন দাবি করে বলেন, ‘পরে দেখলাম, তাঁদের টাকা দিয়ে হেল্প করার দুদিন পরে আবার রাস্তায় ভিক্ষা করছেন, ওষুধ-পানি না খাইয়া। পরবর্তী সময়ে আমি কিছু মেসেজ নোট করলাম, তার মধ্যে একটা হইলো তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। পরে অনলাইনের মাধ্যমে অনেককেই আমরা তাঁদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছি।’
একই ধরনের কাজ করে ‘হিউম্যান সার্ভিস বাংলাদেশ’ নামে একটি পেইজ। পেইজটি চালান মাওলানা মুফতি সোহরাব হোসাইন। ‘মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে’ অনেক মানুষকে ‘পরিষ্কার’ করে দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন তিনি।
মুফতি সোহরাব স্ট্রিমকে বলেন, ‘এমন মানবিক কাজ অনেকেই করতেন। তাদের কাজগুলো দেখে আমার ভালো লাগতো। পরে আমরা দুই-তিনজন এক হই। এক হয়ে কাজটা শুরু করি। আমরা যেখানেই কাজ করি, আশেপাশে অনেক মানুষ জড়ো হন। সবাই বাহবা দেয়, ধন্যবাদ দেয় এবং আমাদের উৎসাহ দেয়। আমরা সেবা হিসেবেই কাজটা করতেছিলাম। যে মানুষটা অপরিচ্ছন্ন থাকে, কোনদিন গোসল করে না, ময়লা খায়, এদের একটু পরিচ্ছন্ন করে পরিবারের কাছে পৌঁছায়া দিচ্ছি। এটা করে আমাদের খুব ভালো লাগতো। এটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।’
সিলেটে ‘মানুষের জন্য’ নামে এক সংগঠন পরিচালনা করেন জুনায়েদ আহমদ চৌধুরী। তিনি প্রায় একই রকম কাজ করেন। তবে, ভাসমান এই মানুষদের পুনর্বাসন করতে চান তিনি। স্ট্রিমকে জুনায়েদ বলেন, ‘আমি বেওয়ারিশ মানুষের চুল কেটে, গোসল করিয়ে খাবার দেই। তাঁদের যেখান থেকে উদ্ধার করি সেখানেই আবার ছেড়ে দিই। যেহেতু আমাদের স্থায়ী কোনো বাসস্থান নেই, কোনো রাখার জায়গা নেই।’
তবে বেওয়ারিশদের পুনর্বাসনে কাজ করছেন জুনায়েদ। স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘বেওয়ারিশ হিসাবে কোনো মানুষ যখন মারা যায়, পুলিশ তাকে উদ্ধার করে এবং পরে তাকে দাফন করে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। কিন্তু এই মানুষগুলাকে আমরা বেওয়ারিশ হিসাবে মরতে দিতে চাই না। আমরা তাঁদের জন্য একটা বেওয়ারিশ সেন্টার চালু করতে চাচ্ছি। অসুস্থ যেসব বেওয়ারিশ মানুষগুলা, সেই মানুষগুলাকে নিয়ে আমাদের টার্গেট। আগামী জানুয়ারি মাসে আমাদের পুরোদমে কাজ শুরু হবে।’
বেওয়ারিশ সেন্টার চালু করতে এর মধ্যে জমির ব্যবস্থা হয়েছে বলেও জানান জুনায়েদ।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদটি ‘আইনের আশ্রয়-লাভের অধিকার’ নিয়ে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’ এর পরের অনুচ্ছেদেই ‘জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার-রক্ষণ’ শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’
এমনকি বিচার ও দণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রেও ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না’ বলেও সংবিধানের ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদের ৫ উপ-অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া স্ট্রিমকে বলেন, ‘যে গ্রুপটি এরকম কন্টেন্ট ক্রিয়েট করে পয়সা কামানোর চেষ্টা করছেন, তারা যে এটা খুব ইনোসেন্ট জায়গা থেকে কিংবা কেবল ব্যবসায়িক জায়গা থেকে অর্থ উপার্জনের একটা উপায় হিসেবে করছেন, ব্যাপারটা ততটা সরল না। আমার কাছে যেটা মনে হয়, উনারা কোন একটা বিশ্বাসের জায়গা থেকে এগুলো করছেন, যেটা খুবই ভয়ঙ্কর।’
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আরও বলেন, ‘এটা অন্যের স্পেস, অন্যের বিশ্বাসের উপরে আঘাত করা, যেটা আমাদের সংবিধান কোনোমতেই অ্যালাউ করে না। আমাদের রাষ্ট্রের এখতিয়ার নাই কারো বিশ্বাস, কারো জীবনযাপন পদ্ধতি, চালচলন, কোনো কিছুর উপরে হস্তক্ষেপ করার। রাষ্ট্রই যেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না, সেখানে একটা গ্রুপ শালীনতার নামে বা সুস্থ পথে আনার নাম করে চুল কেটে দিচ্ছে। তারপর কিন্তু এরা কোনো রকমের দায়িত্ব নিচ্ছে না, রিহ্যাবিলিটেশন করছে না।’
এসব ঘটনার জন্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দায় দেখছেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘আমাদের এতগুলো এজেন্সি, তাদের নজরে এলো না? এটাতো ফৌজদারি অপরাধ। মানবাধিকারের প্রশ্ন। এই ফৌজদারি অপরাধের জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
মানবাধিকার রক্ষা ও আইনগত সহায়তা প্রদানে কাজ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। বাংলাদেশের বেসরকারি এই সংস্থাটি বলেছে, ‘প্রকাশ্যে জোর করে চুল কেটে দেওয়া কেবল ভুক্তভোগীর মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতারই লঙ্ঘন নয়, বরং এটি তাঁর মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত। এ ধরনের ঘটনা সমাজে ভীতি, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করছে।’
সংস্থাটি আরও বলেছে, ‘এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পরিপন্থী। দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে আর কোনো নাগরিক এমন অবমাননাকর ও বেআইনি আচরণের শিকার যাতে না হন, রাষ্ট্রকে তা নিশ্চিত করতে হবে।’
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আরও বলেন, ‘বর্ণ, পরিচয় বাদ দিয়ে প্রথমেই তাদের দেশের একজন নাগরিক ভাবতে হবে। তার কতগুলো আইনি অধিকার আছে, কিছু সাংবিধানিক অধিকার আছে। সেগুলো কেউ চাইলেই ভঙ্গ করতে পারবে না। যদি ভঙ্গ করে, তাহলে আইন সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, রাষ্ট্র সেগুলো প্রটেক্ট করবে। যদি ঘটনা ঘটে যায় তাহলে প্রতিকারের চেষ্টা করবে। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে খুব সিরিয়াস, খুব স্ট্রং অ্যাকশন নেওয়া উচিত।’
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আরও বলেন, ‘প্রতিটা অপরাধীকে ধরে সাজা দেওয়া শাস্তির মূল আইডিয়া না। শাস্তি প্রদানের মূল আইডিয়াটা হচ্ছে উদাহরণ তৈরি করা, যাতে অন্যরা এ রকমের অপরাধ আর না করে। সেই উদাহরণ তৈরি করতে হবে এদেরকে শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে। রাষ্ট্র নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। এখন প্রতিকারের যে দায়টা তাদের উপর আছে, সেটা যেনো যথোপযুক্তভাবে পালন করা হয় আমরা সেই দাবি জানাই।’
রাজধানীর পোস্তগোলা মহাশ্মশানে লাশ সৎকারের কাজ করেন লিটন সাধু। পাশাপাশি সদরঘাট এলাকায় ফলও বিক্রি করেন তিনি। তবে আধ্যাত্মিক ভাবনা থেকে দীর্ঘদিন ধরেই চুল–দাড়ি লম্বা রাখেন তিনি। দুই হাতে ভর্তি থাকে ধাতব বালা। ব্যতিক্রমী বেশভূষার কারণে স্থানীদের কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি। কিন্তু সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন ‘অযাচিত’ এক ঘটনার, যা তাঁর দৈনন্দিন জীবনেও এনেছে অস্বস্তি। ‘মানব কল্যাণ’–এর নামে কয়েক তরুণ জোর করে তাঁর চুল কেটে দিয়েছেন। আপত্তি জানালেও রেহাই পাননি লিটন। পুরো ঘটনা ভিডিও করে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে।
এই ভিডিওর সূত্র ধরেই সামনে আসে আরেক নাম—মাহবুবুর রহমান সরকার। মিরপুরের বাসিন্দা মাহবুব পড়াশোনার পাশাপাশি কন্টেন্ট তৈরি করেন। তাঁর ফেসবুক পেজ ‘মাহবুব ক্রিয়েশন ফোর’–এর অনুসারী ২২ লাখ। ভিডিওতে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তিনি ভাসমান ও অসহায় মানুষদের চুল–দাড়ি কেটে গোসল করান, খাবার দেন। উপস্থাপনা মানবিক মনে হলেও অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ভিন্ন ছবি। অনেক সময় জোর করে চুল কেটে দেওয়া হয়, কারও সম্মতি নেওয়া হয় না। আর এসব ভিডিওর ভিউ থেকে আসে বিদেশি ডলার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জোর করে কারও চুল কেটে দেওয়া মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার স্পষ্ট লঙ্ঘন। সেই সঙ্গে এটি ভুক্তোভোগীর মর্যাদার ওপরও সরাসরি আঘাত। এ ধরনের ঘটনা সমাজে ভীতি, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। ফলে এমন কাজ যাঁরা করছেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।
‘মাহবুব ক্রিয়েশন ফোর’ পেইজটি ঘেঁটে দেখা যায়, লাখ-লাখ মানুষ তাঁর ভিডিও দেখেন, শেয়ারও হয় হাজার হাজার। যার কারণে কোনো ভিডিও আপলোড করার সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে যায় লাখো মানুষের কাছে। একটা ভিডিওতে দেখে গেলো দুই কোটি ৮০ লাখ ভিউ। আর ভিউ যত বেশি, টাকাও তত বেশি।
অন্যদিকে একই সূত্রে খোঁজ করতে গিয়ে ‘কেএমরিয়াজ’ নামে একটা ইউটিউব চ্যানেলের খোঁজ পেয়েছে স্ট্রিম। চ্যানেলটিতে ৫ লাখের বেশি সাবস্ক্রাইবার। সেই চ্যানেলের ভিডিওগুলোও লাখ লাখ মানুষ দেখেন।
এসব পেজ বা চ্যানেলে বিজ্ঞাপনের রেভিনিউ শেয়ারিং-এর মডেলে প্লাটফর্ম থেকে যে অর্থ কনটেন্ট ক্রিয়েটররা পান, ‘ব্যবসা’ শুধু সেখানেই নয়। অনেক কনটেন্ট ক্রিয়েটরই সরাসরি ঘোষণা দিয়ে ‘অনুদান’ দেন। আমরা যে ‘মাহবুব ক্রিয়েশন ফোর’-ফেসবুক পেজটির কথা আলাপ করলাম, সেখান থেকে লাইভে এসে প্রকাশ্যেই চাওয়া হয় বিভিন্ন ‘সুবিধা’। অনেক অনুসারী আবার স্বপ্রণোদিত হয়ে এই কনটেন্ট ক্রিয়টরদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, অর্থ সহায়তা পাঠান।
সিলেটে ‘মানুষের জন্য’ নামে একটি সংগঠন পরিচালনা করেন জুনায়েদ আহমদ চৌধুরী। তিনি ভিডিওর শেষে অনুদান দিতে অনুরোধও করেন দর্শকদের কাছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্ট্রিমকে জুনায়েদ বলেন, ‘ভিডিওতে এগুলা বললেও একচুয়ালি পাওয়া যায় না। আমি অনুদানের কথাটা মূলত বলেছি একটু জমির জন্য। এই জমিটা যদি পাই, সেখানে ঘর তুলবো। বেওয়ারিশদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তুলবো।’
আমাদের এতগুলো এজেন্সি, তাদের নজরে এলো না? এটাতো ফৌজদারি অপরাধ। মানবাধিকারের প্রশ্ন। এই ফৌজদারি অপরাধের জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
কেএমরিয়াজ চ্যানেলের পরিচালক মোহাম্মদ কারুজ্জামন রিয়াজ স্ট্রিমকে বলেন, ‘প্রথম দিকে যখন আমরা শুরু করি, এটা সম্পূর্ণটাই আমরা আমাদের নিজেদের অর্থায়নেই শুরু করি। তবে যেহেতু সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে আমি ভিডিওগুলো আপলোড করেছি, সেজন্য কিন্তু আর্নিং আসছে যেহেতু এটা ৫ লাখ সাবস্ক্রাইবারের চ্যানেল। কিন্তু এটাই তো স্বাভাবিক, ঠিক না?’
রিয়াজ আরও বলেন, ‘আমার নিজের এক বড় ভাই আছেন, এ ছাড়া আমার কিছু ভাই-ব্রাদার আছেন। প্রথমদিকে তারাই আমাদের হেল্প করত। এইভাবে আমরা কাজটা চালাইয়া এই পর্যন্ত এসেছি।’
রাজধানীর ফরিদাবাদ এলাকায় থাকেন লিটন সাধু। তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে স্ট্রিমের। তিনি তাঁর চুল কাটার ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘সেইদিন আমি বাসা থেকে বের হইয়া মাল (ফল) কিনতে গেছি আড়তে। কিন্তু আমার আর মাল কিনা হয় নাই। আড়ৎ থেকে ফিরার সময় গাড়িতে উঠতে গেছি, তখন তাঁরা আমারে দাঁড়া করায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম— আপনি কে, কী করেন? এসব বলার পর তারা বলে— মানব কল্যাণ। তারপর তারা আমারে আটকাইয়া ফেলল।‘
সেদিন চুল কেটে দেওয়া ছাড়াও লুটের শিকার হয়েছেন বলেও দাবি করেছেন লিটন সাধু। তাঁর দাবি অনুযায়ী, সেদিন চুল কেটে দেওয়ার সময় তাঁর হাতে ৫০ ভরির রুপার বালা ছিল। যার আনুমানিক মূল আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা। যা লুট করে নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার জিনিসগুলার কিচ্ছুই দেয় নাই। তারা সব নিয়া গেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি বহুত অনুরোধ করলাম— বাবা, আমার কথাটা শোনো তোমরা। এরা আমার কোনো কথাই শোনে নাই। আমার ইজ্জত-সম্মান লইয়া টানাটানি শুরু কইরা দিছে। আমি কেমন জানি হইয়া গেলাম তাদের ব্যবহার, আচার দেইখা। আমার এলাকার মানুষের আচার-ব্যবহার দেইখা আমি পুরা হতভম্ব হইয়া গেলাম।’
চুল কেটে দেওয়া ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে লিটন সাধু বলেন, ‘যে বা যারা এইসব সন্ত্রাসী করে, তাদের বিচার এই বাংলার মাটিতে হইতেই হবে। এগোরে কোনো রকম ছাড় দেওয়া যাবে না। কেডা অগোরে পারমিশন দিছে? এত বড় কলিজাটা কে দিছে?’
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখা যায়, তিনজন লোক মিলে একজন বয়স্ক ব্যক্তির চুল জোরপূর্বক কেটে দিচ্ছেন। কোনোভাবেই থামাতে না পেরে এক পর্যায়ে বৃদ্ধ লোকটি হাল ছেড়ে দেন। তখন তিনি বলতে থাকেন, ‘আল্লাহ তুই দেহিস’।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে বৃদ্ধের চুলদাঁড়ি কেটে দেওয়া হয়, তার নাম হালিম উদ্দিন আকন্দ। প্রায় ৩৪ বছর ধরে এমন লম্বা চুল-দাঁড়ি রাখেন তিনি। ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কাশিগঞ্জের কোদালিয়া এলাকার আপন পাড়ার বাসিন্দা তিনি। চার মাস আগে তাঁর চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হয়। হালিম উদ্দিন আকন্দ স্থানীয়ভাবে পরিচিত এবং তিনি সন্ন্যাসীর বেশে ঘুরে বেড়ান।
সেই ভিডিও ভাইরাল হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। একের পর এক ছড়িয়ে পড়তে থাকে এমন অনেক ভিডিও। এসব ঘটনায় নিন্দা জানায় বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠন। গণমাধ্যমগুলোতেও গুরুত্ব দিয়ে খবর ছাপা হচ্ছে। এমন প্রতিক্রিয়ার পর নিজেদের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে ‘মাহবুব ক্রিয়েশন ফোর’।
শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) পেইজ থেকে লাইভে এসে মাহবুবুর রহমান সরকার বলেছেন, ‘আমি ২০২০ সালে যখন এসএসসি কমপ্লিট করে ঢাকা আসি, তখন আমার এই কাজগুলা করার ইচ্ছা জাগে। মানুষগুলাকে দেখে খুবই খারাপ লাগা শুরু করে। ২০২৩ সালের শেষের দিকে আমি এই কাজটা শুরু করি। প্রায় দুই বছরের বেশি হয়ে গেছে আমাদের এই কাজটা। এর মধ্যে আমরা কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হইনি।’
মাহবুব আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমরা এই কাজগুলো বন্ধ করে দিচ্ছি। কারণ মানুষ আমাদের নানা রকমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমাদের বাজেভাবে উপস্থাপন করছে।’
শুধু মাহবুব রহমান নন, এমন ‘জবরদস্তিমূলক মানবসেবা’ করেন আরও অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন। এর মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে স্ট্রিম। তাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ কামরুজ্জামান রিয়াজ একজন। তাঁর পরিচালিত ইউটিউব চ্যানেলের নামই ‘কেএমরিয়াজ’। সেই চ্যানেলেটিতে এখন পর্যন্ত ২০০টির মতো ভিডিও আপলোড করা হয়েছে। যার সবগুলোই এভাবে অন্যের চুল কাটার ওপর নির্মিত।
রিয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমি মূলত কাজটা শুরু করেছি অনেক আগে। তখন অফলাইনে কাজ করতাম। আড়াই বছর আগে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কাজ করা শুরু করি। অনলাইনে আসার মূল কারণ হলো মানুষের কাছে একটা মেসেজ পৌঁছানো।’
রিয়াজ আগে মানসিকভাবে অসুস্থ, ভাসমান ভিক্ষুকদের নিয়ে কাজ করতেন। তাঁদের আর্থিক সহায়তা দিতেন দাবি করে বলেন, ‘পরে দেখলাম, তাঁদের টাকা দিয়ে হেল্প করার দুদিন পরে আবার রাস্তায় ভিক্ষা করছেন, ওষুধ-পানি না খাইয়া। পরবর্তী সময়ে আমি কিছু মেসেজ নোট করলাম, তার মধ্যে একটা হইলো তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। পরে অনলাইনের মাধ্যমে অনেককেই আমরা তাঁদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছি।’
একই ধরনের কাজ করে ‘হিউম্যান সার্ভিস বাংলাদেশ’ নামে একটি পেইজ। পেইজটি চালান মাওলানা মুফতি সোহরাব হোসাইন। ‘মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে’ অনেক মানুষকে ‘পরিষ্কার’ করে দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন তিনি।
মুফতি সোহরাব স্ট্রিমকে বলেন, ‘এমন মানবিক কাজ অনেকেই করতেন। তাদের কাজগুলো দেখে আমার ভালো লাগতো। পরে আমরা দুই-তিনজন এক হই। এক হয়ে কাজটা শুরু করি। আমরা যেখানেই কাজ করি, আশেপাশে অনেক মানুষ জড়ো হন। সবাই বাহবা দেয়, ধন্যবাদ দেয় এবং আমাদের উৎসাহ দেয়। আমরা সেবা হিসেবেই কাজটা করতেছিলাম। যে মানুষটা অপরিচ্ছন্ন থাকে, কোনদিন গোসল করে না, ময়লা খায়, এদের একটু পরিচ্ছন্ন করে পরিবারের কাছে পৌঁছায়া দিচ্ছি। এটা করে আমাদের খুব ভালো লাগতো। এটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।’
সিলেটে ‘মানুষের জন্য’ নামে এক সংগঠন পরিচালনা করেন জুনায়েদ আহমদ চৌধুরী। তিনি প্রায় একই রকম কাজ করেন। তবে, ভাসমান এই মানুষদের পুনর্বাসন করতে চান তিনি। স্ট্রিমকে জুনায়েদ বলেন, ‘আমি বেওয়ারিশ মানুষের চুল কেটে, গোসল করিয়ে খাবার দেই। তাঁদের যেখান থেকে উদ্ধার করি সেখানেই আবার ছেড়ে দিই। যেহেতু আমাদের স্থায়ী কোনো বাসস্থান নেই, কোনো রাখার জায়গা নেই।’
তবে বেওয়ারিশদের পুনর্বাসনে কাজ করছেন জুনায়েদ। স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘বেওয়ারিশ হিসাবে কোনো মানুষ যখন মারা যায়, পুলিশ তাকে উদ্ধার করে এবং পরে তাকে দাফন করে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। কিন্তু এই মানুষগুলাকে আমরা বেওয়ারিশ হিসাবে মরতে দিতে চাই না। আমরা তাঁদের জন্য একটা বেওয়ারিশ সেন্টার চালু করতে চাচ্ছি। অসুস্থ যেসব বেওয়ারিশ মানুষগুলা, সেই মানুষগুলাকে নিয়ে আমাদের টার্গেট। আগামী জানুয়ারি মাসে আমাদের পুরোদমে কাজ শুরু হবে।’
বেওয়ারিশ সেন্টার চালু করতে এর মধ্যে জমির ব্যবস্থা হয়েছে বলেও জানান জুনায়েদ।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদটি ‘আইনের আশ্রয়-লাভের অধিকার’ নিয়ে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’ এর পরের অনুচ্ছেদেই ‘জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার-রক্ষণ’ শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’
এমনকি বিচার ও দণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রেও ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না’ বলেও সংবিধানের ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদের ৫ উপ-অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া স্ট্রিমকে বলেন, ‘যে গ্রুপটি এরকম কন্টেন্ট ক্রিয়েট করে পয়সা কামানোর চেষ্টা করছেন, তারা যে এটা খুব ইনোসেন্ট জায়গা থেকে কিংবা কেবল ব্যবসায়িক জায়গা থেকে অর্থ উপার্জনের একটা উপায় হিসেবে করছেন, ব্যাপারটা ততটা সরল না। আমার কাছে যেটা মনে হয়, উনারা কোন একটা বিশ্বাসের জায়গা থেকে এগুলো করছেন, যেটা খুবই ভয়ঙ্কর।’
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আরও বলেন, ‘এটা অন্যের স্পেস, অন্যের বিশ্বাসের উপরে আঘাত করা, যেটা আমাদের সংবিধান কোনোমতেই অ্যালাউ করে না। আমাদের রাষ্ট্রের এখতিয়ার নাই কারো বিশ্বাস, কারো জীবনযাপন পদ্ধতি, চালচলন, কোনো কিছুর উপরে হস্তক্ষেপ করার। রাষ্ট্রই যেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না, সেখানে একটা গ্রুপ শালীনতার নামে বা সুস্থ পথে আনার নাম করে চুল কেটে দিচ্ছে। তারপর কিন্তু এরা কোনো রকমের দায়িত্ব নিচ্ছে না, রিহ্যাবিলিটেশন করছে না।’
এসব ঘটনার জন্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দায় দেখছেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘আমাদের এতগুলো এজেন্সি, তাদের নজরে এলো না? এটাতো ফৌজদারি অপরাধ। মানবাধিকারের প্রশ্ন। এই ফৌজদারি অপরাধের জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
মানবাধিকার রক্ষা ও আইনগত সহায়তা প্রদানে কাজ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। বাংলাদেশের বেসরকারি এই সংস্থাটি বলেছে, ‘প্রকাশ্যে জোর করে চুল কেটে দেওয়া কেবল ভুক্তভোগীর মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতারই লঙ্ঘন নয়, বরং এটি তাঁর মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত। এ ধরনের ঘটনা সমাজে ভীতি, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করছে।’
সংস্থাটি আরও বলেছে, ‘এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পরিপন্থী। দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে আর কোনো নাগরিক এমন অবমাননাকর ও বেআইনি আচরণের শিকার যাতে না হন, রাষ্ট্রকে তা নিশ্চিত করতে হবে।’
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আরও বলেন, ‘বর্ণ, পরিচয় বাদ দিয়ে প্রথমেই তাদের দেশের একজন নাগরিক ভাবতে হবে। তার কতগুলো আইনি অধিকার আছে, কিছু সাংবিধানিক অধিকার আছে। সেগুলো কেউ চাইলেই ভঙ্গ করতে পারবে না। যদি ভঙ্গ করে, তাহলে আইন সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, রাষ্ট্র সেগুলো প্রটেক্ট করবে। যদি ঘটনা ঘটে যায় তাহলে প্রতিকারের চেষ্টা করবে। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে খুব সিরিয়াস, খুব স্ট্রং অ্যাকশন নেওয়া উচিত।’
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আরও বলেন, ‘প্রতিটা অপরাধীকে ধরে সাজা দেওয়া শাস্তির মূল আইডিয়া না। শাস্তি প্রদানের মূল আইডিয়াটা হচ্ছে উদাহরণ তৈরি করা, যাতে অন্যরা এ রকমের অপরাধ আর না করে। সেই উদাহরণ তৈরি করতে হবে এদেরকে শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে। রাষ্ট্র নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। এখন প্রতিকারের যে দায়টা তাদের উপর আছে, সেটা যেনো যথোপযুক্তভাবে পালন করা হয় আমরা সেই দাবি জানাই।’
ক্ষমতায় যাওয়ার পরে অনেক শাসকই ‘লেখক’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এমন নজির আমাদের দেশেও আছে। সাবেক সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৩ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ‘কবি’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তখন দেশের সরকারি সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষভাবে ছাপা হয়েছিল তাঁর কবিতা।
২ দিন আগেআওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করেছিলেন, মায়ের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে জমিটির মালিকানা পাওয়ার বিষয়টি শেখ হাসিনা জানতে পারেন ২০০৭ সালে। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়। তবে স্ট্রিমের অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, ১৯৯৪ সালেই এর পূর্ব পাশে প্রায় ১ বিঘা জমি কিনেছিলেন শেখ হাসিনা।
৫ দিন আগেজমি বিক্রেতা ও স্থানীয়রা জানান, এলাকায় কেউ জমি বিক্রির পরিকল্পনা করছে কি না, বৈকুণ্ঠ নাথ সে সবের খোঁজ রাখতেন। বিক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতেন তিনি। পরের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করে বিক্রেতাকে টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার কাজও করতেন। তবে জমি বেচাকেনার আলোচনার সময় ক্রেতার আসল পরিচয় গোপন রাখা হতো।
৮ দিন আগেসুনামগঞ্জের হাওর অধ্যুষিত চার উপজেলায় রোগীর সেবার জন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দিলেও চালক নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় তেলের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। বিষয়টি একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও গা করেনি তারা। এখন অ্যাম্বুলেন্সগুলো একেবারে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
৯ দিন আগে