আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস
আজ ২৭ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব পর্যটন দিবস। অনেকের মনে প্রশ্ন আসে, কী করে ভ্রমণ করতে হয়? কোথায় যাব, কেন যাব, কী দেখব! কিন্তু জানব কী করে? আর কার সঙ্গে ভ্রমণ করবো? ব্যাগে কী কী নেব? টাকা-পয়সা কীভাবে জোগাড় করব? লিখেছেন ভূ-পর্যটক তারেক অণু।
তারেক অণু
আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পরামর্শ পেয়েছি যে বিষয়ে লেখার জন্য তা হচ্ছে, কী করে ভ্রমণ শুরু করবেন। আর যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি তা হচ্ছে, ‘হৈ মিয়া, এত এনার্জি, সময় আর টাকা আসে কোথা থেকে?’
অনেক সময় ভেবেছি, কোনো এক অবসরে গুছিয়ে লিখব। কিন্তু সেই অবসর আর মেলে না। ঘুরতে গেলে সেখানে তো ব্যস্ততা আরও বেশি! তাই এই চটজলদি বিরতির মাঝেই জলবৎ তরলং করে একান্ত নিজের মতো করেই বলি ব্যাপারখানা।
অবশ্য অনেক ভ্রমণবিদের পথপ্রদর্শকগ্রন্থ বিখ্যাত পরিব্রাজক রাহুল স্যাংকৃত্যায়নের ‘ভবঘুরে শাস্ত্র’ পড়ে দেখতে পারেন। আমিও পড়েছি অনেক আগ্রহ নিয়ে। সেখানে ভবঘুরে হতে হলে প্রথমে ইচ্ছা ব্যতীত কোনো কিছু প্রয়োজন নেই বলা হলেও, পরে নানা অধ্যায়ে কিছু গুণাবলি আয়ত্তে আনার সুপরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেমন সেলাই, রান্না, গান, নাচ, ভাষা শিক্ষা, কায়িক পরিশ্রমে অভ্যস্ত হওয়া, যে কোন পেশাকে স্বাগত জানানো ইত্যাদি। যথার্থই এগুলো পথচলার তাগিদে শেখা অত্যুত্তম।
কিন্তু আমার মনে হলো—আরে ভাই, এতই যদি সকল কাজের কাজি হব, তাহলে আর ভবঘুরে হওয়া কেন? রাহুল অবশ্য ‘খাই-শুই-ঘুরফির’ টাইপের ভবঘুরের কথা বলেন নি। তিনি বলেছেন গৌতম বুদ্ধ, চার্লস ডারউইন, কলম্বাসের মতো ভবঘুরের কথা। কিন্তু রাস্তায় বেরোলেই কি সে রকম হওয়া যায়! কাজেই দুনিয়া পরিবর্তনের আশাতে নয়, যুগের নায়ক হবার জন্যও নয়, কেবলই হয়ত নিজের উপভোগের জন্য কিভাবে ভ্রমণ করা যেতে পারে, সেই নিয়ে একটু-আধটু পাকনামি করি। চলুন মাঠে নামে যাক।
ভ্রমণের মূল কথা, একেবারে প্রথম শর্ত এবং সূত্র—পথ চলার জন্য টান থাকতে হবে। তা সত্যিকারের ভালবাসার মতো, পোড় খাওয়া সারেংয়ের মনটা যেমন সমুদ্দুরে না ভাসলে খাঁ খাঁ করে, তেমনটা আপনারও করলে বুঝবেন ‘খবর আছে, পৃথিবী ডাকছে। এখন ঝোলা (অধুনা ব্যাকপ্যাক) কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ার সময়।’
এর উত্তর বের করতে হবে আপনাকেই। ছোটবেলায় এক মামা বলতেন, ‘ভাগ্নে পৃথিবী এক আজব জায়গা। কেউ মদ বেচে দুধ খায়, আবার কেউ দুধ বেচে মদ খায়।’ কাজেই চাওয়াটা আপনার নিজের উপর। হতে পারে আপনি আমাদের ওডিনদার মত হিমালয়প্রেমী, পৃথিবীর সব জায়গার চেয়ে ভুটানের কমলা বাগিচাময় উপত্যকা আর তিব্বতের গুম্ফা আপনাকে বেশী টানে। হতে পারে আপনি সারা জীবনে একবার হলেও লাগ ভেগাসে গিয়ে ক্যাসিনো খেলতে চান, ফাহিম ভাইয়ের মতো হয়ত আমাজনের বৃষ্টি-অরণ্য আপনাকে সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট করে। আবার হয়ত তারেক অণু এবং সবজান্তার মতো জীবনে একটাই লক্ষ্য আছে আপনার, কোনো এক চাঁদনী রাতে মানস সরোবরের পাশে বসে হেঁড়ে গলায় সংগীত চর্চা করা।
মূল কথা, ঘোরার উদ্দেশ্য নিজের কাছে। কেউ জাদুঘর পছন্দ করে, কেউ প্রকৃতি পছন্দ করে, কেউ পানশালা পছন্দ করে, কেউ অট্টালিকা পছন্দ করে, কেউ কেউ আবার সবই একসঙ্গে পছন্দ করে। যে নেপালে সারা দুনিয়া থেকে মানুষ আসে হিমালয়দর্শনে, সেই নেপালেই লাখ ট্যুরিস্ট যায় ক্যাসিনো আকর্ষণে। কাঠমান্ডুতেই এক বন্ধুর সঙ্গে একচোট হয়েছিল, হলে সিনেমা দেখতে চাওয়ায়। বেচারার আর কী দোষ! সে প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখতে চাইতেই পারে, কিন্তু তার চেয়ে নাগার্জুনের বনে পাখি দেখতে যাওয়াকে আমার কাছে বেশী উপভোগ্য মনে হয়েছিল। কাজেই কী দেখবেন এবং কেন দেখবেন সেটি আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
হ্যাঁ, জীবনে প্রথম যখন দেশের বাইরে গেলাম (একা একা দিল্লী পর্যন্ত), তখন থেকেই আমার সাথী ‘লোনলি প্ল্যানেট’ এর মতো গাইড বই। বইটি একাধিকবার আসলেই জীবনরক্ষার মতো তথ্য দিয়েছে বিদেশ বিভূঁইতে। এখন বেশী তাড়াহুড়ো থাকলে অনেক সময় স্থানীয় গ্রন্থাগার থেকে লোনলি প্ল্যানেট, লেটস গো অথবা ডিসকভারি, এমনকি ন্যাশনাল জিওগ্রাফীর গাইড বুক পর্যন্ত এনে রাখি। বিমানযাত্রার সময় চোখ বুলিয়ে মূল পরিকল্পনার খসড়া করে ফেলি।
তবে অবশ্যই বইয়ের চাইতেও ভাল হয়, যদি স্থানীয় কোন বন্ধু থাকে। স্থানীয় মানে সেই দেশের বা শহরের লোক বুঝিয়েছি, সেখানে বসবাসরত বাঙালি নয়। কারণ, তাঁরা ভ্রমণপ্রিয় না হলে বা আপনার সঙ্গে রুচিতে না মিললে কতখানি জায়গা তাঁরা ঘুরিয়ে দেখাবেন, সেই বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, সারা জীবন তো বাঙালি দেখেছেন-ই, অল্প কদিন না হয় বিদেশি মানুষদের সঙ্গে মিশে সেই দেশের সংস্কৃতি-আচার-ব্যবহার সম্পর্কে জানলেন! তবে হ্যাঁ, যদি সেখানে আপনার বাল্যবন্ধু থাকে, বা এমন কেউ যার আশাতেই যাচ্ছেন, সেই ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আলাদা। সে আপনাকে এমন সব জায়গাতে নিয়ে যেতে পারে, যার হদিশ অধিকাংশ গাইড বই পায়নি।
অবশ্য এখন আবার ইন্টানেটের যুগ। তাই চাইলেই ‘ট্রিপ অ্যাডভাইজার’সহ বেশকিছু ওয়েবপেজে ঢুঁ মারতে পারেন। সেখানে বৈকাল হ্রদ থেকে আরম্ভ করে গ্যালোপাগোস দ্বীপ পর্যন্ত, কোথায় গেলে কী মিলবে, কোন হোটেলের কী ভালো-কী মন্দ, কোন রেস্তোরাঁয় চায়ে চিনির বদলে লবণ দেয়, সবই জেনে যাবেন। আর বাংলাদেশের ভেতরে ভ্রমণ করতে চাইলেও নানা জনপ্রিয় গন্তব্যে নিয়ে লিফলেট পাওয়া যায়। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্্যে ভরা, ঐতিহাসিক কিন্তু অজনপ্রিয় বা প্রায় অজানা জায়গাগুলো নিয়ে এমন রেডিমেড তথ্য খুবই অপ্রতুল। সেই ক্ষেত্রে উপায় একমাত্র রবি ঠাকুরকে ডাকা, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে।’
বছর খানেক আগে পরিচিত এক ভাই বলেছিল, ‘চলেন, সামনের ছুটিতে একসঙ্গে কোথাও যাওয়া যাক। কী বলেন?’ মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি বরাবরের মতোই ভর করল। সরাসরি বলে ফেললাম, দেখেন ভাই, প্রিয় কবি শেখ সাদি বলেছেন, ‘ভ্রমণের সঙ্গী যদি মনের সঙ্গী না হয়, তবে সেই ভ্রমণ বিষবৎ!’
মানে আপনার পছন্দ-অপছন্দ, রুচি সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। রাস্তায় নামার পর খাবার সময় হলে আবিস্কার করলাম আপনি খাবার নিয়ে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে। এখন অভিযানে নামতে হবে পারফেক্ট খাবারের খোঁজে। আবার দেখা গেল, আপনার অপছন্দের জিনিস আপনার সামনে খেলে অসুবিধা। তাহলে কী আর আনন্দ মতো ভ্রমণ করা যায়, বলুন?
আর শুধু খাবারই নয়, আমি রাতে বিশ্রামের সময় আলো জ্বালিয়ে একটু টিনটিন পড়তে বা লেখালেখি করতে পছন্দ করি। অন্যদিকে অমাবস্যার আঁধারের মতো অন্ধকার ঘরে না থাকলে আপনার ঘুম হয় না। আবার দেখা গেল, আমার ঘুম ভীষণ পাতলা আর আপনার নাসিকা গর্জন কুম্ভকর্ণের মতো। গেল তো ভ্রমণের মজা উবে!
আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফিনিশ তরুণী নোরা হেলেনা যতবারই প্রিয় সঙ্গীসমেত দূরদেশে গেছে, ততবারই তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে! কারণ হিসেবে নোরা বলেছে, ‘আসলে ভ্রমণে গেলেই সত্যিকার অর্থে মানুষে চেনা যায়। বাইরে গেলে তুমি বুঝতে পারবে তোমাদের সত্যিকারের মিল কতটুকু।’ বেচারীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব এখন পর্যন্ত টিকে থাকার একমাত্র কারণ মনেহয়, আমরা একসঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাইনি! হাহা।
কিন্তু নোরার কথা যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়ার মতো। আমার বাংলাভাষী এক রুমমেটের কথাই ধরা যাক। যার সঙ্গে ডর্মের তিন বছরের জীবনে কোনোদিন দুকথা হয় নি, সেই বেচারাকে ভ্রমণ শুরুর মাত্র তিন দিনের মাথায় বলে ফেললাম, একসঙ্গে আর কোনোদিন ভ্রমণের পরিকল্পনা করা যাবে না!
কাজেই, ভ্রমণের সঙ্গী নির্বাচন করুন অত্যধিক সতর্কতার সঙ্গে। না হলে গেল সবকিছু ভেস্তে!
শারীরিক সক্ষমতাও ভ্রমণের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। ব্রুস লির মত পাকানো দড়ি হবার দরকার নেই বা র্যাম্বোর মত পেশিমানব। কিন্তু যে জায়গায় যাচ্ছেন তা ভালভাবে দেখে ফিরে আসার মতো সক্ষমতা যেন আপনার অবশ্যই থাকে। যদি বান্দরবানে হাইকিং-এ বা নেপালের অন্নপূর্ণা সার্কিটে যেতে চান, অবশ্যই নিজেকে প্রস্তত করবেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে হেঁটে বা দৌড়ে বা সাইকেল চালিয়ে কোনো একটা উপায়ে নিজেকে ফিট রাখার। দেখা গেল, যে শহর ভ্রমণে গেছেন তা হাঁটতে হবেই, পায়ে বা লাঠির উপরে ভর দিয়ে। যেমন কুমিল্লার শালবন বিহার, প্যারিস, রোম, বেইজিং ইত্যাদি। তাই প্রস্তত থাকুন যাত্রা শুরুর আগেই।
গন্তব্য অনুযায়ী ঝোলা মানে ব্যাকপ্যাক তৈরি রাখুন। যেখানে যাবেন, সেই হিসেবে ব্যাগ গোছান। কী করে ব্যাগ গোছাতে হবে এই নিয়ে জেরোম কে জেরোমের ক্ল্যাসিক ‘থ্রি ম্যান ইন এ বোট’-এর অনুবাদ সেবা প্রকাশনীর ‘ত্রিরত্নের নৌবিহার’ পড়ে নিতে পারেন। আর তারা যে পন্থায় কাজ করে তার সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে শুরু করুন।
ধরুন, যাচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে হাইকিংয়ে, অবশ্যই সুঁইসুতা নেবেন, যদি কাপড় ছিঁড়ে যায়! লবণ অপরিহার্য, কারণ ছড়া পেরোনোর সময় যদি জোঁক ধরে! অল্প কিছু ঔষধপত্র, বিশেষ করে জ্বরের এবং সেই সাথে স্যালাইন, পেটের গোলযোগ দেখা দিক বা না দিক, সারা দিন ঘামার পরে বিশ্রামের সময় স্যালাইন নেহাত খারাপ জিনিস নহে। গামছা, তোয়ালে নেবেন। কাপড় নেবেন প্রয়োজন অনুযায়ী। মানে দরকারের অতিরিক্ত নিলে বহন তো করতে হবে আপনাকেই।
ও আচ্ছা, আপনি ফাঁকা ব্যাগ নিয়ে গেছেন? সেখানের বাহারি পোশাক কিনে ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে আসবেন। দুঃখিত, এই ব্যাপারে ভালো জ্ঞান রাখি না! জুতা, স্যান্ডেল আর দরকার মনে হলে অবশ্যই অবশ্যই টয়লেট পেপার। আর পানির বোতল নেবেন। জায়গা বিশেষে কিছু জিনিস নিতে হয়। যেমন যুক্তরাজ্য গেলে, আর কিছু না হলেও আধ ডজন ছাতা নিয়ে যাবেন অবশ্যই!
যেখানে যাবেন সেখানের আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাক বাছাই করা আপনার দায়িত্ব। ঠাণ্ডা, গরম, বৃষ্টিময় যেখানেই যান না কেন। সেই সাথে ভিসা নামের ইহজগতের পুলসিরাতের ব্যবস্থা কিন্তু করে নিতে হবে নিজেকেই, এই নিয়ে কথা না আর বাড়াই। বিদেশে গেলে নিজেকে হারালেও, পাসপোর্ট আর টাকা হারিয়ে যায়। আর টাকা যদি ভাগ্যচক্রে হারিয়ে ফেলেন, তাহলে দয়া করে সব একসঙ্গে হারিয়ে ফেলবেন না। তাহলে ঘোর বিপদ!
আরও যা কিছু বলার
নিরাপত্তা অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতি শহরেই কিছু ঝামেলার এলাকা থাকে, সেগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। আর গেলেও সতর্ক থাকুন। টাকা ভাগ করে করে কয়েক জায়গায় রাখুন, যাতে সব একসঙ্গে খোয়া না যায়। বাংলাদেশে একা বা কয়েকজন মিলে কোনো এলাকা বেড়াতে গেলে অবশ্যই ভালো মতো খোঁজখবর নিয়ে যাবেন। এই বিষয়ে নিজে যা জানতাম, তার অনেকখানিই পরিবর্তন হয়ে গেছে বিগত এক দশকে। তাই এই নিয়ে আপাতত বেশি আলোকপাত করতে পারছি না।
ভ্রমণের সময় অবশ্যই খেয়াল রাখবেন, সাধারণত কোনো পরিকল্পনাই শতকরা ১০০ ভাগ সফল হয়না। আর এত নিখুঁত হওয়ার প্রয়োজনও নেই। কিছুটা ছাড় তো দিতেই হবে। এসি বাস না পেলে বাদুড়ঝোলা হয়ে বাসে গেলেন না-হয় একদিন! না হয় ভিনদেশের কোনো বাস টার্মিনালের বেঞ্চে কফির মগ নিয়ে কেটেই গেল একটা নির্ঘুম রাত, যেহেতু বাস মিস হয়ে গেছে। এক বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাঁর সেবা করতে না হয় একটা দিন ঘোরা বন্ধই থাকল। এসব মিলেই জীবন এবং ভ্রমণ।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো মোটামুটি শেষ। এখন শেষ কথা, অর্থ সমাগম। এই বিষয়ে কথা বলার আগেই আমার বন্ধু ব্লগার অবনীল রীতিমতো হুংকার দিয়ে বলছে, ‘সত্যজিৎ রায়ের আগন্তক সিনেমাটি দেখে ভ্রমণের টাকা কিভাবে জোগাড় করা যায়, তা জানা যাবে।’ এই ধরনের উচ্চমার্গীয় কথা বলা যাবে না!
অর্থ হয়ত আপনার পকেটেই আছে, সে আপনি ছাত্র হোন বা চাকরিজীবী। কিন্তু মূল ব্যাপারটি হচ্ছে, আপনি ভ্রমণের জন্য কত টাকা জমা করতে পারছেন। সেখান থেকেও কিন্তু বোঝা যায় যে, ভ্রমণের জন্য আপনি কতখানি নিজেকে ছাড় দিতে প্রস্তত।
দেখা গেল আপনি ছাত্র, প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের খরচ জোগাড় তো করেনই, মাঝেমধ্যে বাবা-মাকেও সাহায্য করতে হয়। এখন অর্থ সমাগম ঘটবে কী ভাবে? পথটি সহজ নয় হয়ত, কিন্তু অসম্ভব বলে কিছুই নেই। হয়ত আপনার সিগারেটের খরচ কমালে সেটা থেকে বছরে একটা ছোট ভ্রমণ হয়ে যেতেও পারে। হয়ত কোনো কেনাকাটার শখকে বলি দিয়ে সেটাকে আগামী শীতের উত্তরবঙ্গকে দেখার জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। হয়ত রকি পর্বত বা পলিনেশিয়া আমাদের জন্য এক চাঁদ দূরত্বেই অবস্থান করে, কিন্তু সেখানে যেতে না পারলেও আমরা যেন দেশের আশেপাশেই, বিশেষ করে দেশেই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ভ্রমণ অব্যাহত রাখি।
এসব নিয়ে আমার ভ্রমণগুরু ইনাম আল হকের একটা কথা আগেও বলেছি। কথাটা এতই খাঁটি যে আরেকবার বলছি। বিবিসি তাঁকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনার যেহেতু বর্তমানে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আছে, সেই কারণেই কি আপনি এই ধরনের কাজ যেমন ভ্রমণ, পাখি দেখা, ছবি তোলা, পাহাড়ে চড়া এইগুলি করতে পারেন?’
ইনাম ভাইয়ের উত্তর, ‘দেখুন, ঘোরাঘুরি তো আমি আজকে করছি না। যখন আমি ছাত্র ছিলাম, নিজস্ব সঞ্চয় ছিল না, তখন থেকেই করছি। এখন বিমানে চেপে অনেক দূরে যাই, কিন্তু তখনও সুযোগ পেলেই পায়ে হেঁটে, বাসে, নৌকায়, ভ্যানে চেপে দূরের শহর, গ্রামে যেতাম। তখনো পাখি দেখতাম, কিন্তু দূরবীন আর টেলিস্কোপ ছাড়াই। আনন্দটা কিন্তু পেতাম পুরোদমেই! আমাদের সমাজের অধিকাংশই মানুষকেই প্রশ্ন করুন জীবনের চাহিদা নিয়ে। সবাই বলবে চাকরি, বাড়ি, গাড়ি, সংসার। কিন্তু কয়জন বলবে, বাংলাদেশের ৬৪ জেলা আমার ঘোরা থাকতে হবে, পায়ে হেঁটে হলেও! কজন ভাবে, বান্দরবানের পাহাড়গুলো আমার চড়া থাকতেই হবে! টেঁকনাফ থেকে তেতুলিয়ার সৌন্দর্য একবার হলেও দেখতেই হবে?’
সেইসঙ্গে ইনাম ভাই অনেক আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই কিন্তু ঘুরলেই সন্তুষ্ট হন না, সেই ঘোরা যখন অন্য মানুষ জানে তখনই তাঁদের ভ্রমণ যেন ষোল আলা সার্থক হয়।’
মানে আপনি লন্ডন গেলেই হবে না, ফিরে এসে সবাইকে বলবেন, ব্যাটা, জানিস লন্ডন গেছিলাম। তার পরেই যেন ভ্রমণের সবকিছু উসুল হলো! কিন্তু এই বাঁধা অতিক্রম করতে হবে আপনাকেই। আপনি দেখবেন, ঘুরবেন কেবল জানার আনন্দে, ভাল লাগার আবেশে। যদি সেই ভ্রমণ নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে হয়, ছবি প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে, অবশ্যই করুন। কিন্তু সেটা যেন আপনার ভ্রমণের ইচ্ছেকে ছাপিয়ে না যায়। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, যদি ইস্টার দ্বীপে যেতে পারতাম! কিংবা মালির টিম্বাকটু, তিব্বতের মানস সরোবর! আর কেউ না জানলেও বিশ্বের সুখীতম মানুষটি হয়ে যেতাম আপনা থেকেই।
মোদ্দা কথা, অনিশ্চয়তা নিয়ে বেশি ভাববেন না। পথে নামুন, ভ্রমণের আনন্দে ভ্রমণ করুন। কিছু পেতে হলে কিছু হারাতেই হয় জীবনে।
আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পরামর্শ পেয়েছি যে বিষয়ে লেখার জন্য তা হচ্ছে, কী করে ভ্রমণ শুরু করবেন। আর যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি তা হচ্ছে, ‘হৈ মিয়া, এত এনার্জি, সময় আর টাকা আসে কোথা থেকে?’
অনেক সময় ভেবেছি, কোনো এক অবসরে গুছিয়ে লিখব। কিন্তু সেই অবসর আর মেলে না। ঘুরতে গেলে সেখানে তো ব্যস্ততা আরও বেশি! তাই এই চটজলদি বিরতির মাঝেই জলবৎ তরলং করে একান্ত নিজের মতো করেই বলি ব্যাপারখানা।
অবশ্য অনেক ভ্রমণবিদের পথপ্রদর্শকগ্রন্থ বিখ্যাত পরিব্রাজক রাহুল স্যাংকৃত্যায়নের ‘ভবঘুরে শাস্ত্র’ পড়ে দেখতে পারেন। আমিও পড়েছি অনেক আগ্রহ নিয়ে। সেখানে ভবঘুরে হতে হলে প্রথমে ইচ্ছা ব্যতীত কোনো কিছু প্রয়োজন নেই বলা হলেও, পরে নানা অধ্যায়ে কিছু গুণাবলি আয়ত্তে আনার সুপরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেমন সেলাই, রান্না, গান, নাচ, ভাষা শিক্ষা, কায়িক পরিশ্রমে অভ্যস্ত হওয়া, যে কোন পেশাকে স্বাগত জানানো ইত্যাদি। যথার্থই এগুলো পথচলার তাগিদে শেখা অত্যুত্তম।
কিন্তু আমার মনে হলো—আরে ভাই, এতই যদি সকল কাজের কাজি হব, তাহলে আর ভবঘুরে হওয়া কেন? রাহুল অবশ্য ‘খাই-শুই-ঘুরফির’ টাইপের ভবঘুরের কথা বলেন নি। তিনি বলেছেন গৌতম বুদ্ধ, চার্লস ডারউইন, কলম্বাসের মতো ভবঘুরের কথা। কিন্তু রাস্তায় বেরোলেই কি সে রকম হওয়া যায়! কাজেই দুনিয়া পরিবর্তনের আশাতে নয়, যুগের নায়ক হবার জন্যও নয়, কেবলই হয়ত নিজের উপভোগের জন্য কিভাবে ভ্রমণ করা যেতে পারে, সেই নিয়ে একটু-আধটু পাকনামি করি। চলুন মাঠে নামে যাক।
ভ্রমণের মূল কথা, একেবারে প্রথম শর্ত এবং সূত্র—পথ চলার জন্য টান থাকতে হবে। তা সত্যিকারের ভালবাসার মতো, পোড় খাওয়া সারেংয়ের মনটা যেমন সমুদ্দুরে না ভাসলে খাঁ খাঁ করে, তেমনটা আপনারও করলে বুঝবেন ‘খবর আছে, পৃথিবী ডাকছে। এখন ঝোলা (অধুনা ব্যাকপ্যাক) কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ার সময়।’
এর উত্তর বের করতে হবে আপনাকেই। ছোটবেলায় এক মামা বলতেন, ‘ভাগ্নে পৃথিবী এক আজব জায়গা। কেউ মদ বেচে দুধ খায়, আবার কেউ দুধ বেচে মদ খায়।’ কাজেই চাওয়াটা আপনার নিজের উপর। হতে পারে আপনি আমাদের ওডিনদার মত হিমালয়প্রেমী, পৃথিবীর সব জায়গার চেয়ে ভুটানের কমলা বাগিচাময় উপত্যকা আর তিব্বতের গুম্ফা আপনাকে বেশী টানে। হতে পারে আপনি সারা জীবনে একবার হলেও লাগ ভেগাসে গিয়ে ক্যাসিনো খেলতে চান, ফাহিম ভাইয়ের মতো হয়ত আমাজনের বৃষ্টি-অরণ্য আপনাকে সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট করে। আবার হয়ত তারেক অণু এবং সবজান্তার মতো জীবনে একটাই লক্ষ্য আছে আপনার, কোনো এক চাঁদনী রাতে মানস সরোবরের পাশে বসে হেঁড়ে গলায় সংগীত চর্চা করা।
মূল কথা, ঘোরার উদ্দেশ্য নিজের কাছে। কেউ জাদুঘর পছন্দ করে, কেউ প্রকৃতি পছন্দ করে, কেউ পানশালা পছন্দ করে, কেউ অট্টালিকা পছন্দ করে, কেউ কেউ আবার সবই একসঙ্গে পছন্দ করে। যে নেপালে সারা দুনিয়া থেকে মানুষ আসে হিমালয়দর্শনে, সেই নেপালেই লাখ ট্যুরিস্ট যায় ক্যাসিনো আকর্ষণে। কাঠমান্ডুতেই এক বন্ধুর সঙ্গে একচোট হয়েছিল, হলে সিনেমা দেখতে চাওয়ায়। বেচারার আর কী দোষ! সে প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখতে চাইতেই পারে, কিন্তু তার চেয়ে নাগার্জুনের বনে পাখি দেখতে যাওয়াকে আমার কাছে বেশী উপভোগ্য মনে হয়েছিল। কাজেই কী দেখবেন এবং কেন দেখবেন সেটি আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
হ্যাঁ, জীবনে প্রথম যখন দেশের বাইরে গেলাম (একা একা দিল্লী পর্যন্ত), তখন থেকেই আমার সাথী ‘লোনলি প্ল্যানেট’ এর মতো গাইড বই। বইটি একাধিকবার আসলেই জীবনরক্ষার মতো তথ্য দিয়েছে বিদেশ বিভূঁইতে। এখন বেশী তাড়াহুড়ো থাকলে অনেক সময় স্থানীয় গ্রন্থাগার থেকে লোনলি প্ল্যানেট, লেটস গো অথবা ডিসকভারি, এমনকি ন্যাশনাল জিওগ্রাফীর গাইড বুক পর্যন্ত এনে রাখি। বিমানযাত্রার সময় চোখ বুলিয়ে মূল পরিকল্পনার খসড়া করে ফেলি।
তবে অবশ্যই বইয়ের চাইতেও ভাল হয়, যদি স্থানীয় কোন বন্ধু থাকে। স্থানীয় মানে সেই দেশের বা শহরের লোক বুঝিয়েছি, সেখানে বসবাসরত বাঙালি নয়। কারণ, তাঁরা ভ্রমণপ্রিয় না হলে বা আপনার সঙ্গে রুচিতে না মিললে কতখানি জায়গা তাঁরা ঘুরিয়ে দেখাবেন, সেই বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, সারা জীবন তো বাঙালি দেখেছেন-ই, অল্প কদিন না হয় বিদেশি মানুষদের সঙ্গে মিশে সেই দেশের সংস্কৃতি-আচার-ব্যবহার সম্পর্কে জানলেন! তবে হ্যাঁ, যদি সেখানে আপনার বাল্যবন্ধু থাকে, বা এমন কেউ যার আশাতেই যাচ্ছেন, সেই ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আলাদা। সে আপনাকে এমন সব জায়গাতে নিয়ে যেতে পারে, যার হদিশ অধিকাংশ গাইড বই পায়নি।
অবশ্য এখন আবার ইন্টানেটের যুগ। তাই চাইলেই ‘ট্রিপ অ্যাডভাইজার’সহ বেশকিছু ওয়েবপেজে ঢুঁ মারতে পারেন। সেখানে বৈকাল হ্রদ থেকে আরম্ভ করে গ্যালোপাগোস দ্বীপ পর্যন্ত, কোথায় গেলে কী মিলবে, কোন হোটেলের কী ভালো-কী মন্দ, কোন রেস্তোরাঁয় চায়ে চিনির বদলে লবণ দেয়, সবই জেনে যাবেন। আর বাংলাদেশের ভেতরে ভ্রমণ করতে চাইলেও নানা জনপ্রিয় গন্তব্যে নিয়ে লিফলেট পাওয়া যায়। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্্যে ভরা, ঐতিহাসিক কিন্তু অজনপ্রিয় বা প্রায় অজানা জায়গাগুলো নিয়ে এমন রেডিমেড তথ্য খুবই অপ্রতুল। সেই ক্ষেত্রে উপায় একমাত্র রবি ঠাকুরকে ডাকা, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে।’
বছর খানেক আগে পরিচিত এক ভাই বলেছিল, ‘চলেন, সামনের ছুটিতে একসঙ্গে কোথাও যাওয়া যাক। কী বলেন?’ মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি বরাবরের মতোই ভর করল। সরাসরি বলে ফেললাম, দেখেন ভাই, প্রিয় কবি শেখ সাদি বলেছেন, ‘ভ্রমণের সঙ্গী যদি মনের সঙ্গী না হয়, তবে সেই ভ্রমণ বিষবৎ!’
মানে আপনার পছন্দ-অপছন্দ, রুচি সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। রাস্তায় নামার পর খাবার সময় হলে আবিস্কার করলাম আপনি খাবার নিয়ে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে। এখন অভিযানে নামতে হবে পারফেক্ট খাবারের খোঁজে। আবার দেখা গেল, আপনার অপছন্দের জিনিস আপনার সামনে খেলে অসুবিধা। তাহলে কী আর আনন্দ মতো ভ্রমণ করা যায়, বলুন?
আর শুধু খাবারই নয়, আমি রাতে বিশ্রামের সময় আলো জ্বালিয়ে একটু টিনটিন পড়তে বা লেখালেখি করতে পছন্দ করি। অন্যদিকে অমাবস্যার আঁধারের মতো অন্ধকার ঘরে না থাকলে আপনার ঘুম হয় না। আবার দেখা গেল, আমার ঘুম ভীষণ পাতলা আর আপনার নাসিকা গর্জন কুম্ভকর্ণের মতো। গেল তো ভ্রমণের মজা উবে!
আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফিনিশ তরুণী নোরা হেলেনা যতবারই প্রিয় সঙ্গীসমেত দূরদেশে গেছে, ততবারই তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে! কারণ হিসেবে নোরা বলেছে, ‘আসলে ভ্রমণে গেলেই সত্যিকার অর্থে মানুষে চেনা যায়। বাইরে গেলে তুমি বুঝতে পারবে তোমাদের সত্যিকারের মিল কতটুকু।’ বেচারীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব এখন পর্যন্ত টিকে থাকার একমাত্র কারণ মনেহয়, আমরা একসঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাইনি! হাহা।
কিন্তু নোরার কথা যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়ার মতো। আমার বাংলাভাষী এক রুমমেটের কথাই ধরা যাক। যার সঙ্গে ডর্মের তিন বছরের জীবনে কোনোদিন দুকথা হয় নি, সেই বেচারাকে ভ্রমণ শুরুর মাত্র তিন দিনের মাথায় বলে ফেললাম, একসঙ্গে আর কোনোদিন ভ্রমণের পরিকল্পনা করা যাবে না!
কাজেই, ভ্রমণের সঙ্গী নির্বাচন করুন অত্যধিক সতর্কতার সঙ্গে। না হলে গেল সবকিছু ভেস্তে!
শারীরিক সক্ষমতাও ভ্রমণের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। ব্রুস লির মত পাকানো দড়ি হবার দরকার নেই বা র্যাম্বোর মত পেশিমানব। কিন্তু যে জায়গায় যাচ্ছেন তা ভালভাবে দেখে ফিরে আসার মতো সক্ষমতা যেন আপনার অবশ্যই থাকে। যদি বান্দরবানে হাইকিং-এ বা নেপালের অন্নপূর্ণা সার্কিটে যেতে চান, অবশ্যই নিজেকে প্রস্তত করবেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে হেঁটে বা দৌড়ে বা সাইকেল চালিয়ে কোনো একটা উপায়ে নিজেকে ফিট রাখার। দেখা গেল, যে শহর ভ্রমণে গেছেন তা হাঁটতে হবেই, পায়ে বা লাঠির উপরে ভর দিয়ে। যেমন কুমিল্লার শালবন বিহার, প্যারিস, রোম, বেইজিং ইত্যাদি। তাই প্রস্তত থাকুন যাত্রা শুরুর আগেই।
গন্তব্য অনুযায়ী ঝোলা মানে ব্যাকপ্যাক তৈরি রাখুন। যেখানে যাবেন, সেই হিসেবে ব্যাগ গোছান। কী করে ব্যাগ গোছাতে হবে এই নিয়ে জেরোম কে জেরোমের ক্ল্যাসিক ‘থ্রি ম্যান ইন এ বোট’-এর অনুবাদ সেবা প্রকাশনীর ‘ত্রিরত্নের নৌবিহার’ পড়ে নিতে পারেন। আর তারা যে পন্থায় কাজ করে তার সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে শুরু করুন।
ধরুন, যাচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে হাইকিংয়ে, অবশ্যই সুঁইসুতা নেবেন, যদি কাপড় ছিঁড়ে যায়! লবণ অপরিহার্য, কারণ ছড়া পেরোনোর সময় যদি জোঁক ধরে! অল্প কিছু ঔষধপত্র, বিশেষ করে জ্বরের এবং সেই সাথে স্যালাইন, পেটের গোলযোগ দেখা দিক বা না দিক, সারা দিন ঘামার পরে বিশ্রামের সময় স্যালাইন নেহাত খারাপ জিনিস নহে। গামছা, তোয়ালে নেবেন। কাপড় নেবেন প্রয়োজন অনুযায়ী। মানে দরকারের অতিরিক্ত নিলে বহন তো করতে হবে আপনাকেই।
ও আচ্ছা, আপনি ফাঁকা ব্যাগ নিয়ে গেছেন? সেখানের বাহারি পোশাক কিনে ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে আসবেন। দুঃখিত, এই ব্যাপারে ভালো জ্ঞান রাখি না! জুতা, স্যান্ডেল আর দরকার মনে হলে অবশ্যই অবশ্যই টয়লেট পেপার। আর পানির বোতল নেবেন। জায়গা বিশেষে কিছু জিনিস নিতে হয়। যেমন যুক্তরাজ্য গেলে, আর কিছু না হলেও আধ ডজন ছাতা নিয়ে যাবেন অবশ্যই!
যেখানে যাবেন সেখানের আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাক বাছাই করা আপনার দায়িত্ব। ঠাণ্ডা, গরম, বৃষ্টিময় যেখানেই যান না কেন। সেই সাথে ভিসা নামের ইহজগতের পুলসিরাতের ব্যবস্থা কিন্তু করে নিতে হবে নিজেকেই, এই নিয়ে কথা না আর বাড়াই। বিদেশে গেলে নিজেকে হারালেও, পাসপোর্ট আর টাকা হারিয়ে যায়। আর টাকা যদি ভাগ্যচক্রে হারিয়ে ফেলেন, তাহলে দয়া করে সব একসঙ্গে হারিয়ে ফেলবেন না। তাহলে ঘোর বিপদ!
আরও যা কিছু বলার
নিরাপত্তা অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতি শহরেই কিছু ঝামেলার এলাকা থাকে, সেগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। আর গেলেও সতর্ক থাকুন। টাকা ভাগ করে করে কয়েক জায়গায় রাখুন, যাতে সব একসঙ্গে খোয়া না যায়। বাংলাদেশে একা বা কয়েকজন মিলে কোনো এলাকা বেড়াতে গেলে অবশ্যই ভালো মতো খোঁজখবর নিয়ে যাবেন। এই বিষয়ে নিজে যা জানতাম, তার অনেকখানিই পরিবর্তন হয়ে গেছে বিগত এক দশকে। তাই এই নিয়ে আপাতত বেশি আলোকপাত করতে পারছি না।
ভ্রমণের সময় অবশ্যই খেয়াল রাখবেন, সাধারণত কোনো পরিকল্পনাই শতকরা ১০০ ভাগ সফল হয়না। আর এত নিখুঁত হওয়ার প্রয়োজনও নেই। কিছুটা ছাড় তো দিতেই হবে। এসি বাস না পেলে বাদুড়ঝোলা হয়ে বাসে গেলেন না-হয় একদিন! না হয় ভিনদেশের কোনো বাস টার্মিনালের বেঞ্চে কফির মগ নিয়ে কেটেই গেল একটা নির্ঘুম রাত, যেহেতু বাস মিস হয়ে গেছে। এক বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাঁর সেবা করতে না হয় একটা দিন ঘোরা বন্ধই থাকল। এসব মিলেই জীবন এবং ভ্রমণ।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো মোটামুটি শেষ। এখন শেষ কথা, অর্থ সমাগম। এই বিষয়ে কথা বলার আগেই আমার বন্ধু ব্লগার অবনীল রীতিমতো হুংকার দিয়ে বলছে, ‘সত্যজিৎ রায়ের আগন্তক সিনেমাটি দেখে ভ্রমণের টাকা কিভাবে জোগাড় করা যায়, তা জানা যাবে।’ এই ধরনের উচ্চমার্গীয় কথা বলা যাবে না!
অর্থ হয়ত আপনার পকেটেই আছে, সে আপনি ছাত্র হোন বা চাকরিজীবী। কিন্তু মূল ব্যাপারটি হচ্ছে, আপনি ভ্রমণের জন্য কত টাকা জমা করতে পারছেন। সেখান থেকেও কিন্তু বোঝা যায় যে, ভ্রমণের জন্য আপনি কতখানি নিজেকে ছাড় দিতে প্রস্তত।
দেখা গেল আপনি ছাত্র, প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের খরচ জোগাড় তো করেনই, মাঝেমধ্যে বাবা-মাকেও সাহায্য করতে হয়। এখন অর্থ সমাগম ঘটবে কী ভাবে? পথটি সহজ নয় হয়ত, কিন্তু অসম্ভব বলে কিছুই নেই। হয়ত আপনার সিগারেটের খরচ কমালে সেটা থেকে বছরে একটা ছোট ভ্রমণ হয়ে যেতেও পারে। হয়ত কোনো কেনাকাটার শখকে বলি দিয়ে সেটাকে আগামী শীতের উত্তরবঙ্গকে দেখার জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। হয়ত রকি পর্বত বা পলিনেশিয়া আমাদের জন্য এক চাঁদ দূরত্বেই অবস্থান করে, কিন্তু সেখানে যেতে না পারলেও আমরা যেন দেশের আশেপাশেই, বিশেষ করে দেশেই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ভ্রমণ অব্যাহত রাখি।
এসব নিয়ে আমার ভ্রমণগুরু ইনাম আল হকের একটা কথা আগেও বলেছি। কথাটা এতই খাঁটি যে আরেকবার বলছি। বিবিসি তাঁকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনার যেহেতু বর্তমানে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আছে, সেই কারণেই কি আপনি এই ধরনের কাজ যেমন ভ্রমণ, পাখি দেখা, ছবি তোলা, পাহাড়ে চড়া এইগুলি করতে পারেন?’
ইনাম ভাইয়ের উত্তর, ‘দেখুন, ঘোরাঘুরি তো আমি আজকে করছি না। যখন আমি ছাত্র ছিলাম, নিজস্ব সঞ্চয় ছিল না, তখন থেকেই করছি। এখন বিমানে চেপে অনেক দূরে যাই, কিন্তু তখনও সুযোগ পেলেই পায়ে হেঁটে, বাসে, নৌকায়, ভ্যানে চেপে দূরের শহর, গ্রামে যেতাম। তখনো পাখি দেখতাম, কিন্তু দূরবীন আর টেলিস্কোপ ছাড়াই। আনন্দটা কিন্তু পেতাম পুরোদমেই! আমাদের সমাজের অধিকাংশই মানুষকেই প্রশ্ন করুন জীবনের চাহিদা নিয়ে। সবাই বলবে চাকরি, বাড়ি, গাড়ি, সংসার। কিন্তু কয়জন বলবে, বাংলাদেশের ৬৪ জেলা আমার ঘোরা থাকতে হবে, পায়ে হেঁটে হলেও! কজন ভাবে, বান্দরবানের পাহাড়গুলো আমার চড়া থাকতেই হবে! টেঁকনাফ থেকে তেতুলিয়ার সৌন্দর্য একবার হলেও দেখতেই হবে?’
সেইসঙ্গে ইনাম ভাই অনেক আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই কিন্তু ঘুরলেই সন্তুষ্ট হন না, সেই ঘোরা যখন অন্য মানুষ জানে তখনই তাঁদের ভ্রমণ যেন ষোল আলা সার্থক হয়।’
মানে আপনি লন্ডন গেলেই হবে না, ফিরে এসে সবাইকে বলবেন, ব্যাটা, জানিস লন্ডন গেছিলাম। তার পরেই যেন ভ্রমণের সবকিছু উসুল হলো! কিন্তু এই বাঁধা অতিক্রম করতে হবে আপনাকেই। আপনি দেখবেন, ঘুরবেন কেবল জানার আনন্দে, ভাল লাগার আবেশে। যদি সেই ভ্রমণ নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে হয়, ছবি প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে, অবশ্যই করুন। কিন্তু সেটা যেন আপনার ভ্রমণের ইচ্ছেকে ছাপিয়ে না যায়। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, যদি ইস্টার দ্বীপে যেতে পারতাম! কিংবা মালির টিম্বাকটু, তিব্বতের মানস সরোবর! আর কেউ না জানলেও বিশ্বের সুখীতম মানুষটি হয়ে যেতাম আপনা থেকেই।
মোদ্দা কথা, অনিশ্চয়তা নিয়ে বেশি ভাববেন না। পথে নামুন, ভ্রমণের আনন্দে ভ্রমণ করুন। কিছু পেতে হলে কিছু হারাতেই হয় জীবনে।
কোক স্টুডিও বাংলার ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয়েছে নতুন গান ‘মহা জাদু’। হাবিব ওয়াহিদের কণ্ঠ-সুর আর তাজাকিস্তানের শিল্পী মেহরনিগরি রুস্তমের কণ্ঠে গানটি নতুনভাবে হাজির হয়েছে শ্রোতাদের সামনে।
২০ ঘণ্টা আগে১৯৮৩ সালের বসন্ত। হঠাৎ ব্রিটিশ গণমাধ্যমে আলোড়ন উঠল একটি ডায়েরিকে ঘিরে। জার্মান সাময়িকী ‘স্টার্ন’ আর ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য সানডে টাইমস’ ঘোষণা দিল, তারা নাকি খুঁজে পেয়েছে এক যুগান্তকারী নথি; অ্যাডলফ হিটলারের ‘গোপন’ ব্যক্তিগত ডায়েরি।
১ দিন আগেআজ ২৫ সেপ্টেম্বর জাফর ইকবালের জন্মদিন। আমরা তাঁকে চিনি বাংলা সিনেমার ‘স্টাইলিশ হিরো’ হিসেবে। কিন্তু জানেন কি, সিনেমার নায়ক হবার আগে তিনি ছিলেন গায়ক, গিটারবাদক ও ব্যান্ডলিডার?
২ দিন আগেআজ বিশ্ব গর্ভনিরোধ দিবস। ২০০৭ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য ছিল পরিবার গঠনে ও সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে নারীর অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু কীভাবে এল গর্ভনিরোধ? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গর্ভনিরোধের কী অবস্থা?
২ দিন আগে