leadT1ad

কপ৩০: সম্মেলন কেন্দ্রে আগুন এবং হারিয়ে যাওয়া জলবায়ু রোডম্যাপ

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৪: ২০
স্ট্রিম গ্রাফিক

ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলনে দশম দিনের আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুরো দিনের উচ্চস্তরের আলোচনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে প্যাভিলিয়ন এলাকার ভেতরে সম্ভবত একটি মাইক্রোওয়েভ এর বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। ফলে সেই স্থানটি দ্রুত ধোঁয়ায় ভরে ওঠে এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে সম্পূর্ণ ভেন্যু খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা বাহিনী ও দমকল কর্মীর প্রচেষ্টায় অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও ধোঁয়ায় শ্বাস নেওয়ার কারণে কমপক্ষে ১৩ জনকে ঘটনাস্থলেই তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। বিকেল ২টার পর ভেন্যুতে প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, যার ফলে চলমান বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দরকষাকষি, বিভিন্ন সাইড ইভেন্ট, এবং "মুটিরাঁও” সিদ্ধান্তের নতুন খসড়া নিয়ে প্রেসিডেন্সির গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক স্থগিত হয়ে যায়। কপ৩০-এর ব্লু জোনে অগ্নিকাণ্ডের ফলে আলোচনা সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে গেলে সময়সীমা ঘনিয়ে আসায় জলবায়ু চুক্তি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ে। ঘটনাটি দিনব্যাপী কূটনৈতিক আলোচনা ও সমঝোতার প্রক্রিয়ায় অনিশ্চয়তা তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিভাজনও স্পষ্ট: হোয়াইট হাউস বলছে অন্য দেশগুলো মার্কিন তেল-গ্যাস চাইছে, আর কপ৩০-এ উপস্থিত একমাত্র ফেডারেল প্রতিনিধি সিনেটর শেলডন হোয়াইটহাউস দাবি করেছেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের নয়, জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের স্বার্থই প্রতিনিধিত্ব করেন।

এক সংবাদ সম্মেলনে ন্যান্সি পেলোসি ডোনাল্ড ট্রাম্পের জলবায়ুবিরোধী অবস্থানকে কঠোরভাবে সমালোচনা করে তাকে “আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রতারক” বলে উল্লেখ করেন। ট্রাম্প আগে জাতিসংঘে জলবায়ু সঙ্কটকে "বৈশ্বিক প্রতারণা" বলেছিলেন, যার জবাবে পেলোসি বলেন এটি তারই রাজনৈতিক 'প্রজেকশন'। যুক্তরাষ্ট্র কপ৩০-এ কোনো সরকারি প্রতিনিধি না পাঠানোতে ডেমোক্র্যাটরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। যদিও সিনেটর শেলডন হোয়াইটহাউস ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত ছিলেন এবং ট্রাম্পের জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সমালোচনা করেন। পেলোসি বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোর দীর্ঘদিনের 'জলবায়ু বিভ্রান্তি প্রচারণা' যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে পিছিয়ে দিয়েছে। নতুন জরিপে দেখা যায়, অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী জলবায়ু পদক্ষেপ এবং জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে ফেইজ আউটের পক্ষে। হাকিম জেফ্রিজ কপ৩০ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিকে "লজ্জাজনক” বলে উল্লেখ করেন। পেলোসি বলেন, ট্রাম্পের শিক্ষা, অস্ত্র সহিংসতা এবং পরিবেশ নীতির ব্যর্থতা তাকে “আমেরিকার শিশুদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রেসিডেন্ট” বানিয়েছে।

কপ৩০-এ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বিশ্বকে সতর্ক করে বলেন, "আর কত কষ্ট সহ্য করতে হবে?”, জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সম্মুখসারির জনগোষ্ঠী আর কোনো অজুহাত শুনতে রাজি নয়, তারা এখন কার্যকর সিদ্ধান্ত চাইছে। বেলেমে উপস্থিত হয়ে তিনি দেশগুলোকে শেষ মুহূর্তে সমঝোতায় পৌঁছে দ্রুত জলবায়ু পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান, কারণ বর্তমানে গৃহীত অঙ্গীকারগুলো পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রির বেশি বাড়াতে পারে, যা বহু জাতির জন্য মৃত্যুদণ্ডের সমান। তিনি স্বীকার করেন যে, ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম অবশ্যম্ভাবী, যা তাপমাত্রা, দারিদ্র ও ক্ষুধা, দুর্যোগ ও বাস্তুচ্যুতি আরও বৃদ্ধি করবে এবং আমাজনসহ বহু অঞ্চলে অপরিবর্তনীয় ক্ষতির ঝুঁকি তৈরি করবে। তবুও দ্রুত পদক্ষেপ নিলে শতাব্দীর শেষে তাপমাত্রা আবার ১.৫ ডিগ্রিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ন্যায়সঙ্গত ও পর্যায়ক্রমিক উত্তরণের রোডম্যাপে অগ্রগতি জরুরি হলেও পেট্রোস্টেটগুলোর বাধার কারণে এটি চ্যালেঞ্জিং বলে তিনি উল্লেখ করেন। গুতেরেস অভিযোজন অর্থায়ন তিনগুণ বৃদ্ধির জোর দাবি জানান এবং বলেন, অভিযোজন অনেকের জন্য টিকে থাকা বা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পার্থক্য তৈরি করে। তিনি জাস্ট ট্রানজিশন এবং পূর্বানুমানযোগ্য, সহজপ্রাপ্য ও নিশ্চয়তাপ্রাপ্ত জলবায়ু অর্থায়নের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুত ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার বার্ষিক সহায়তা প্রাপ্তি নিয়ে এখনও দ্বন্দ্ব চলছে।

অবশেষে বহুল প্রতীক্ষিত কপ৩০-এর সর্বশেষ খসড়া পাঠ থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি ফেইজ আউট রোডম্যাপ পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে। সৌদি আরব, রাশিয়া, ভারতসহ কয়েকটি পেট্রোস্টেটের চাপেই রোডম্যাপ ও “জীবাশ্ম জ্বালানি” শব্দ দুটি বাদ পড়েছে বলে জানা যায়। আগের খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত রোডম্যাপের ধারণাটি বাধ্যতামূলক ছিল না, সব দেশ নিজ নিজ পথ বেছে নিতে পারত। তবু “লাইক-মাইন্ডেড ডেভেলপিং কান্ট্রিজ”-এর বিরোধিতায় এই শব্দ দুটি বাতিল হয়। অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ভানুয়াতুর মতো ৮০টিরও বেশি দেশ রোডম্যাপের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা বলছে দুর্বল, অস্পষ্ট খসড়া পাঠ গৃহীত হলে কপ৩০ ব্যর্থ হবে। আলোচনার শেষ সময়ে এই ইস্যুই সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, পাশাপাশি ১.৫°C লক্ষ্যমাত্রা রক্ষায় দুর্বল জাতীয় পরিকল্পনা, অভিযোজন ও জলবায়ু অর্থায়ন, বাণিজ্য ও স্বচ্ছতার প্রশ্নও এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। কপ৩০ আলোচনায় “লাইক-মাইন্ডেড ডেভেলপিং কান্ট্রিজ”-সহ (যাদের মধ্যে তেল- কয়লা উৎপাদনকারী দেশও আছে) বহু দেশের আপত্তিতে জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তরণের রোডম্যাপ খসড়া থেকে বাদ পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ব্রাজিলীয় সভাপতিত্বের হঠাৎ গোপন পদ্ধতিতে আলোচনা চালানোর কারণে অনিশ্চয়তা বেড়েছে, যদিও সৌদি আরব ও চীন শর্তসাপেক্ষে রোডম্যাপ বিবেচনায় আগ্রহ দেখিয়েছে। একই সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশগুলো দাবি করছে, ধনী দেশগুলোকে আরও বেশি অভিযোজন তহবিল দিতে হবে, যেটি বর্তমান ৪০ বিলিয়ন ডলার থেকে অন্তত তিনগুণ হবে। উন্নত দেশগুলো আর্টিকেল ৯.১ অনুযায়ী বাধ্যতামূলক জলবায়ু অর্থায়নে আলোচনার নতুন পরিসর তৈরি করতে অনাগ্রহী, যা দক্ষিণ বিশ্বে তীব্র ক্ষোভ তৈরি করেছে। তাদের অভিযোগ, ধনী দেশগুলো সব আলোচনাকে বৃহৎ আর্থিক আলোচনার মধ্যে মিশিয়ে দিয়ে মূল বাধ্যবাধকতা এড়িয়ে যায়, ফলে অভিযোজন, ক্ষয়ক্ষতির তহবিল ও প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যগুলো পূরণ অসম্ভব হয়ে পড়ছে।

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা কপ৩০ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে ঘোষণা দেন যে, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণের তার রোডম্যাপটি তিনি জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে নিয়ে যাবেন এবং সেখানে এটি নিয়ে প্রচার চালাবেন, যদিও রাশিয়া, চীন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন পেট্রোস্টেট এই পরিকল্পনা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ৮২টি দেশ রোডম্যাপের প্রতি সমর্থন জানালেও তারা কেবল বৈশ্বিক উৎপাদনের ৭% প্রতিনিধিত্ব করে, ফলে বড় উৎপাদকদের বিরোধিতায় খসড়া থেকে পরিকল্পনাটি বাদ পড়েছে বলে জানা গেছে। তবুও লুলা এটিকে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বাড়ানো জলবায়ু সংকট মোকাবিলার জন্য অত্যাবশ্যক হিসেবে দেখছেন এবং জি৭-জি২০ সবখানেই লড়াইয়ের সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। আলোচনাগুলো এখন গোপনীয় হয়ে পড়ায় অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে, যদিও সৌদি আরব ও চীনের কূটনীতিকরা শর্তসাপেক্ষে রোডম্যাপে আগ্রহ দেখিয়েছেন। তবে স্বল্পোন্নত দেশগুলো আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেলে মনোভাব বদলাতে পারে। এছাড়াও ব্রাজিলের অভ্যন্তরীণ পেট্রোকেমিক্যাল ও কৃষিখাতের চাপ লুলার জন্য জটিলতা তৈরি করছে।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)

Ad 300x250

সম্পর্কিত