leadT1ad

কপ৩০: আন্তর্জাতিক অর্থায়নের অনিশ্চয়তার মুখে বাংলাদেশের অভিযোজন পরিকল্পনা

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৯: ২২
স্ট্রিম গ্রাফিক

ব্রাজিলের বেলেমে আয়োজিত কপ৩০ সম্মেলনের জাঁকজমকপূর্ণ দশ দিন শেষ হলেও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি, ফলে আলোচনা আরও একদিন বর্ধিত হয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানির বৈশ্বিক জাস্ট ট্রানজিশনের রোডম্যাপ নিয়ে দেশগুলোর অবস্থান এখনও ব্যাপকভাবে বিপর্যস্থ এবং শুক্রবার প্রকাশিত নতুন খসড়া পাঠ থেকেও এই রোডম্যাপকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের জ্বালানি সচিব এড মিলিব্যান্ড বলেছেন, বাধ্যতামূলক না হলেও অন্তত স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কোনো উদ্যোগের মাধ্যমে রোডম্যাপকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর এক প্রতিনিধি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে আমরা যেন রোবটের সঙ্গে তর্ক করছি।’ পর্যবেক্ষকদের দাবি, আরব গ্রুপ স্পষ্টভাবে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, চূড়ান্ত পাঠ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি ফেইজ আউটের কথা উল্লেখ থাকলে আলোচনা পন্ড হয়ে যেতে পারে। ২২টি মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশ রোডম্যাপ সংক্রান্ত যেকোনো ভাষা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং আফ্রিকান গ্রুপও তাদের সমর্থন দেখিয়েছে। তবে আফ্রিকার অভ্যন্তরেই বিরোধ দেখা দিয়েছে, কারণ বহু আফ্রিকান দেশ প্রকাশ্যে বা পরোক্ষভাবে রোডম্যাপের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। প্যারিস চুক্তির প্রণেতা লরেন্স টুবিয়ানা স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে রোডম্যাপ নিয়ে এগোতে ভয় না পেতে আহ্বান জানিয়েছেন।

ব্রাজিলের বেলেমে কপ৩০ সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও প্রথম খসড়ায় থাকা ‘ট্রানজিশন এওয়ে ফ্রম ফসিল ফুয়েলস’ বাক্যটি ব্রাজিলের আপডেটেড খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তীব্র অসন্তোষ জানিয়ে বলেছে, বর্তমান পাঠ্য ‘কপ অব ট্রুথ’–এর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এতে নেই বিজ্ঞানভিত্তিক সংকেত, নেই জীবাশ্ম জ্বালানির রূপান্তর বা গ্লোবাল স্টকটেক, বরং গত বছরের অর্থায়ন প্রতিশ্রুতিকেও লঙ্ঘন করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বার্ষিক এনডিসি ফলো-আপ ও ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা জোরালোভাবে তুলে ধরে বলেছে, মিটিগেশনে উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখালে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু অর্থায়নে নমনীয় হবে। ল্যাটিন আমেরিকাও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে এই পাঠ্যকে দুর্বল, বিজ্ঞানবিচ্ছিন্ন এবং প্রকৃতি ও জলবায়ুর সাথে সংযোগহীন বলে সমালোচনা করেছে।

যুক্তরাজ্যের জ্বালানি সচিব এড মিলিব্যান্ড জোর দিয়ে বলেন, এটি বাধ্যতামূলক না হলেও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত বা ভিন্ন কোনো সৃজনশীল পদ্ধতিতে অন্তত প্রক্রিয়াটিকে জীবিত রাখতে হবে। ব্রাজিলিয়ান কপ৩০ সভাপতিত্ব বলছে, ৮০টির বেশিও দেশ সমর্থন করার পরও সৌদি আরবের আপত্তির কারণে জীবাশ্ম জ্বালানি ফেইজ আউটের রোডম্যাপকে আলোচনার টেবিলেই রাখা সম্ভব হয়নি। বিতর্কিত বিষয়গুলোর ওপর ‘হাডল’ আলোচনার প্রস্তাব দিলেও রাশিয়া ও সৌদি আরব এ ধরনের আলোচনায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে জলবায়ু আলোচনার অচলাবস্থাকে আরও সংকটময় করে তুলেছে। চীন রোডম্যাপ ব্লকিংয়ে অংশ নিচ্ছে না, তবে ভারত পুনর্ব্যক্ত করেছে যে, ঐতিহাসিক দায়–দায়িত্বের ভিত্তিতে উন্নত দেশগুলোর ওপর বেশি দায়িত্ব আরোপ করা উচিত। এদিকে তুরস্ক ও অস্ট্রেলিয়া কপ৩১ আয়োজনে চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছেছে। তুরস্ক হবে আয়োজক ও সভাপতিপক্ষ, আর অস্ট্রেলিয়ার জ্বালানি মন্ত্রী ক্রিস বোয়েন হবেন আলোচনার সহসভাপতি।

বেলেমে কপ৩০-এর উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনায় শেষ পর্যায়ে একদিকে যেমন দ্রুত সমঝোতায় পৌঁছানোর তাগিদ, অন্যদিকে গভীর অনিশ্চয়তা, এই দুইয়ের মধ্যে দোলাচল স্পষ্ট। খসড়া ‘গ্লোবাল মুটিরাঁও’ পাঠে জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে তীব্র বিভাজন দেখা দিয়েছে। এই খসড়া প্রতি বছরে ২০৩৫ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু কর্মপরিকল্পনার স্বীকৃতি, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ৩০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ এবং অভিযোজন অর্থায়ন তিনগুণ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিকে সামনে এনেছে, পাশাপাশি বেলেম ফ্যাসিলিটি ও কাঠামোগত সংস্কারের ইঙ্গিত দিয়েছে। উন্নত দেশগুলো এই নির্দিষ্ট সংখ্যাকে দুর্বল ভাষায় প্রতিস্থাপন, আইনি বাধ্যবাধকতাকে শিথিল করা এবং ঋণনির্ভর প্রবাহকে ‘উদ্ভাবনী অর্থায়ন’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের এই প্রচেষ্টাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে বহুদিন পূর্বের প্রতিশ্রুত ১০০ বিলিয়ন ডলার সত্যিই পূরণ হবে কি না তা ঘিরে বিতর্কে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে আরও গভীর সংকট তৈরি হয়েছে।

নাগরিক সমাজ, যুব নেটওয়ার্ক এবং কিছু প্রগতিশীল উন্নত দেশ বলছে, সমস্যা এখন আর প্রতিশ্রুতির বা পরিমাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাস্তবায়নযোগ্যতার। তাই বিশ্বাস পুনর্গঠনের জন্য সঠিক হিসাব, বাধ্যতামূলক দায়বদ্ধতা, অনুদান ও স্বল্পসুদে অর্থের নিশ্চয়তা এবং কঠোর হিসাবব্যবস্থা জরুরি। উন্নয়নশীল দেশগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জলবায়ু অর্থায়ন কোনো দয়া নয়, বরং প্যারিস চুক্তির আর্টিকেল ৯ দশমিক ১ অনুসারে উন্নত এবং সর্বাধিক নির্গমনকারী দেশগুলোর জন্য একটি বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। অভিযোজন ও ক্ষতিপূরণ তহবিল অবশ্যই অনুদানভিত্তিক হওয়া উচিত। ক্ষতিপূরণ তহবিলকেও প্রতীকী পর্যায় থেকে বাস্তব প্রাতিষ্ঠানিক রূপে উন্নীত করতে হবে, যার মধ্যে থাকবে ন্যূনতম পুনঃপূরণের বাধ্যতামূলক শর্ত, কয়েক বছরের জন্য স্থিতিশীল অবদান নিশ্চিত করা, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ও সম্প্রদায়ের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক অর্থপ্রাপ্তি এবং জাতীয় কোষাগারের বাইরে স্থানীয় রক্ষক ও সম্প্রদায়ের সরাসরি অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ। একই সঙ্গে কার্বন সম্পর্কিত বৈষম্য ও উপনিবেশবাদ মোকাবেলাও জরুরি। পাশাপাশি কার্বন কর, সরবরাহ–শৃঙ্খলের বিধিনিষেধ এবং জলবায়ু–সামঞ্জস্যপূর্ণ বাণিজ্য নীতি এমনভাবে প্রয়োগ করা উচিত যাতে নির্গমন হ্রাসের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়।

তবে এসব নীতি যেন সংবেদনশীল অর্থনীতি, শ্রমিক ও রপ্তানিকারকদের ক্ষতির কারণ না হয়ে ওঠে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। কপ৩০-কে প্রতিশ্রুতির সম্মেলন নয়, বরং এটি হতে হবে বাস্তবায়নের কপ, যেখানে ঋণ নয় বরং ন্যায্য অর্থায়ন হবে টিকে থাকার উপায়। একই সঙ্গে, প্যারিস চুক্তি তার প্রকৃত লক্ষ্য পূরণ করবে সেই শুকনো অঞ্চল, উপকূলীয় ডেল্টা ও সীমান্ত এলাকায়, যেখানে সহায়তার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

কপ৩০–কে ‘সত্যের কপ’ বলা হলেও, জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর কাছে সত্য মানে কোনো ব্র্যান্ডিং নয়, বরং এমন এক ব্যবস্থার উন্মোচন, যেখানে ফিজি, মোজাম্বিক, বাংলাদেশ, হাইতি, বলিভিয়া বা সামোয়ার মতো সবচেয়ে কম দূষণকারী দেশগুলোকে টিকে থাকার জন্যও সুদসহ ঋণ নিতে হয়। বাংলাদেশের উপকূলীয় ঝুঁকি, পানিসংকট, ক্ষয়িষ্ণু অবকাঠামো ও ক্রমবর্ধমান অভিযোজনের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ তার অভিযোজন পরিকল্পনা ও দুর্যোগ প্রস্তুতির যে ভিত্তি আন্তর্জাতিক সহায়তার নিশ্চয়তার ওপর দাঁড় করিয়ে তৈরি করেছে, সেটি এখন ব্যাপক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। দেশের মন্দা, ঋণখেলাপি বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয়ের সম্প্রসারণের ফলে বাজেট সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এর ফলে জলবায়ু অভিযোজন ও স্থিতিশীলতার জন্য পর্যাপ্ত অভ্যন্তরীণ অর্থ বরাদ্দ কঠিন হয়ে উঠছে। উপরন্তু, বহিরাগত সহায়তার বড় অংশই যেহেতু ঋণ, তাই সামগ্রিক ম্যাক্রোইকোনমিক চাপ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতির তহবিল নিয়ে প্রত্যাশিত অগ্রগতি না হওয়ায় উদ্বেগ আরও বেড়ে গিয়েছে, কারণ ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন ও লবণাক্ততা–বিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য জরুরি ও কার্যকর একটি তহবিলের প্রয়োজন।

একইভাবে, মিটিগেশনের এর আলোচনায় উন্নত দেশগুলোর নিজস্ব লক্ষ্যপূরণে পিছিয়ে থাকা এবং নতুন প্রস্তাব উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উদ্বিগ্ন করেছে। বাংলাদেশ তার ন্যায্যতার নীতিতে অটল থেকে জানিয়েছে যে, পর্যাপ্ত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপানো যাবে না।

অভিযোজন লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও বিভাজন তীব্র আকার ধারণ করেছে। আলোচনার সব মঞ্চেই বাংলাদেশ জীবিকা, জীববৈচিত্র্য, সামাজিক সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়নকে একসাথে বিবেচনায় রেখে অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের পথকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা যদি বাস্তবসম্মত সহায়তায় না রূপান্তরিত হয়, তবে জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য প্রতিশ্রুতি কেবল কাগুজে প্রতিশ্রুতি হিসেবে থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে কপ৩০–এ নেওয়া সিদ্ধান্ত বা অমীমাংসিত রাখার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অভিযোজন, অর্থনৈতিক স্থিতি এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নপথে গভীর প্রভাব ফেলবে, যার রেশ এদেশের নদী, উপকূল আর কোটি মানুষের জীবনে বহু বছর ধরে প্রতিধ্বনিত হবে। পরিস্থিতি বলছে, বাংলাদেশ যে আশা আর দাবি নিয়ে এবারের কপ৩০ সম্মেলনে যোগদান করেছিল, সেই আশার ঝুড়িতে হয়তো প্রতিবারের মতো এবারও হতাশা নিয়েই ফিরতে হবে।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)

Ad 300x250

সম্পর্কিত