ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটবদ্ধ হলেও নিজ দলের প্রতীকেই ভোট করতে হবে প্রার্থীদের। এই বিধান রেখে সংশোধন করা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) আর পরিবর্তনের আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ১৩ নভেম্বর থেকে ১৯ নভেম্বর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে ৪৭টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। সেখান কিছু রাজনৈতিক দল যৌথ প্রতীকে নির্বাচনের অনুমতি এবং আচরণবিধির কিছু ধারা শিথিলের প্রস্তাব দেয়।
এ নিয়ে কমিশন বলেছে, সংবিধান, বিদ্যমান আরপিও ও নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা অনুযায়ী রাজনৈতিক দল ও তাদের প্রার্থীদের নিজস্ব প্রতীকে ভোটগ্রহণই একমাত্র বৈধ কাঠামো। আগামী নির্বাচনে নিজ দলের প্রতীকেই ভোট হবে। এই নির্বাচনের আগে আরপিও আবার পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ আপাতত নেই।
ইসির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনের আগে আরপিও সংশোধন করতে গেলে আইনি জটিলতা তৈরি হবে। আবার পরিবর্তন করার মতো যথেষ্ট সময়ও নেই। তাই এই মাসেই গেজেট হওয়া আরপিও এবং নির্বাচন বিধিমালা অনুযায়ীই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালিত হবে।
তাঁরা আরও জানান, আরপিও সংশোধনের প্রক্রিয়া একটি দীর্ঘ কর্মযজ্ঞ এবং এটি অপরিবর্তিত থাকলে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা স্থিতিশীল ও অভিন্ন থাকে। নির্বাচনী পরিবেশ ও প্রস্তুতির স্বার্থে এখন আর তাই আইন পরিবর্তনের সুযোগ নেই। এ ছাড়া সংবিধানসম্মতভাবে দলীয় প্রতীকই নির্বাচনের ভিত্তি, এটি বদলালে ভোটারদের মধ্যেও বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, ‘নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণযোগ্য ধারাগুলো নিয়েই আরপিও সংশোধিত হয়েছে। সব প্রক্রিয়া যথাযথভাবে পালন শেষে আরপিও এবং আচরণবিধির গেজেটও হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আসলে পরিবর্তনের সুযোগ আর নেই।’
অবশ্য একটি পথ খোলা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটি মাত্র পথ হলো, যদি সব রাজনৈতিক দল একসঙ্গে হয়ে সংশোধনী চায়, তবে বিবেচনায় আসতে পারে।’
তবে ১৩ থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের ধারা বলছে, সবাই মিলে সংশোধন চাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ, ওই সময় বিএনপি ও তাদের সমমনা জাতীয়তাবাদী ডেভেলপমেন্ট পার্টি (এনডিএম), বাংলাদেশ লেবার পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মতো কিছু দল নিজ প্রতীকে নির্বাচনের বিধান পরিবর্তনের দাবি তোলে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশ কিছু দল নিজ প্রতীকের ভোটের সিদ্ধান্তেকে সমর্থন করে।
এ ছাড়া তুলনামূলক কম জনসমর্থন থাকা কিছু দল প্রার্থীর জামানত ৫০ হাজার টাকার পরিবর্তে আগের মতো ২০ হাজার করার প্রস্তাব দেয়। যদিও কোনো বৃহৎ রাজনৈতিক দল এই দাবির পক্ষে অবস্থান নেয়নি। আর পোস্টার নিষিদ্ধকরণ এবং পরিবেশবান্ধব প্রচারের যে ধারা এবার আচরণবিধিতে আনা হয়েছে তাকে বাস্তবতাবর্জিত বলে জানায় এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি দল। প্রচার ব্যয়বহুল হবে দাবি করে কিছু ধারা পরিবর্তনের প্রস্তাবও দেয় তারা। তবে কোনো দাবিতেই সব দল সমর্থন জানায়নি।
গণভোটের সচেতনতা বাড়াতে প্রচারে নামছে নির্বাচন কমিশন
আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একই দিনে জুলাই সনদের ওপর গণভোটও হবে।
সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে ভোটারদের মধ্যে ধারণা থাকলেও গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষ এখনো গণভোট সম্পর্কে কম সচেতন। এমন পরিস্থিতিতে ভোটারদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে সংসদ নির্বাচনের প্রচারের সঙ্গে গণভোটের প্রচার চালানোর পরিকল্পনা করেছে ইসি।
ইসি সূত্র জানায়, সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের জন্য ইতোমধ্যে কমিশনকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই প্রেক্ষাপটে ভোটারদের মধ্যে গণভোট সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা ইসির মূল চ্যালেঞ্জ। এজন্য কয়েকটি পরিকল্পনাও নিয়েছে সংস্থাটি।
পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে—গণভোটবিষয়ক ভিডিও তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার, বিটিভি ও অন্যান্য মাধ্যমে সম্প্রচার, সাংবাদিকদের জন্য গণভোটবিষয়ক প্রশিক্ষণ, সংসদ নির্বাচনের প্রচারণার সঙ্গে গণভোটের প্রচারণা যুক্ত করা ইত্যাদি।
বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ অন্যান্য মাধ্যমে ভোটদান প্রক্রিয়া নিয়ে গণসচেতনতা বৃদ্ধির টিভিসি, কাউন্টডাউন, স্লোগান, পথনাটক, র্যালি, বিজ্ঞাপন, লিফলেট ও পোস্টার তৈরি করে নির্বাচনী এলাকায় প্রচার করবে ইসি।
এ ছাড়া এআই ও ফেইক নিউজ শনাক্তকরণ, গুজব প্রতিরোধে বিটিভির মাধ্যমে ফ্ল্যাশ নিউজ প্রচার এবং নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়া নিয়েও ব্যাপক প্রচারণা চলবে।
সরকার থেকে গণভোটের আনুষ্ঠানিক চিঠির বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানান, গত বৃহস্পতিবার একটি চিঠি এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে যে গণভোট আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন এবং এটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই হবে।
গণভোট আয়োজনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, ‘গণভোটের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখছি না। ইসি আশাবাদী, রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রার্থীরা সহযোগিতা করলে সুন্দর নির্বাচন করা সম্ভব।’
ইসির তথ্য অনুযায়ী, এখন দেশে মোট ভোটারের সংখ্যা ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯০৭, নারী ৬ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪২ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ১ হাজার ২৩৪।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চায় সরকার। যদিও গত ১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়নে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
ইতিমধ্যে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী ভোট আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সংস্থাটি। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তফসিল ঘোষণা করতে পারে কমিশন।