সম্প্রতি সংগীত জগতকে বাই বাই বলে দিয়েছেন তাহসান। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। সেইসব অনলাইন তর্ক-যুদ্ধ এড়িয়ে, বাংলা মিউজিকে তাহসানে গানের অবস্থান ও মেজাজকে গভীরভাবে দেখার প্রয়াস এই লেখা।
ওয়াহিদ সুজন
সম্প্রতি সংগীত জগত থেকে বিদায়ের ঘোষণা দিয়েছেন তাহসান। এ নিয়ে বাজারে নানান ধরনের মতামত দেখা যাচ্ছে। অনেকে ধর্মাশ্রয়ী বিষয় হিসেবেও দেখছেন। এ ধরনের দেখার চল বাংলাদেশে বিরল নয়, বরং না থাকলেই অবাক হতাম। আমি এ লেখার শিরোনাম ও আলোচনায় ‘অনুশোচনা’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। তার সঙ্গে সেই আলোচনার সম্পর্ক নাই। এটা হয়তো না বললেও চলে; তারপরও বলা ফেলা গেল! এখানে ‘অনুশোচনা’ শব্দটি তাহসানের সাংগীতিক জার্নিকে কেন্দ্র করে। উনার নিজেকে প্রকাশের মাধ্যম হলো কথা, সুর ও কণ্ঠ; যেখানে তিনি গড়পড়তাভাবে আমাদের বোঝাপড়ায় সীমিত হয়ে পড়েন। তাহসানের কথার সূত্রেরই বিষয়টি আমি বোঝার চেষ্টা করেছি। সেই চেষ্টা খুবই আত্মগত এবং ব্যক্তিভেদে তফাৎযোগ্য।
তাহসানের প্রথম সলো অ্যালবাম ‘কথোপকথন’। জি সিরিজের ব্যানারে রিলিজ হয় ২০০৪ সালে। অর্থাৎ একুশ বছর আগে। হালচালে এসে যখন তিনি গান ছাড়ার ঘোষণা দেন; তখন জানান, এ বয়সে এসে ‘দূরে তুমি দাঁড়িয়ে’ আর গাইতে চান না। এটা সেই প্রথম একক অ্যালবামের ‘ঈর্ষা’ শিরোনামের গান। এ রেফারেন্স থেকে বোঝা যায়, মঞ্চে তিনি কী গান করেন এবং দর্শক কী পছন্দ করেন।
দুই দশক মোটামুটি একটা প্রজন্মের সমান সময়; এ হিসেবে অনুমান করা যায় তাহসানের কনসার্টের ভোক্তা এখন আর ২০০৪ সালে যারা উচ্চমাধ্যমিক বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে যারা ছিলেন তারা নন। অন্তত এ গানের কথা যে ধরনের বয়স বিবেচনা করতে বলে সেই হিসেবে।
তাহসানের জনপ্রিয় গানের জন্য লিস্ট করলে দেখা যাবে ‘ঈষা’ থেকে সাম্প্রতিক ‘যত ভুল’ বা ‘প্রেম তুমি’ তাতে সহজাত একটা মিল আছে—অনুশোচনাবোধ। আমার অনুমান হলো; তাহসানের এই যে জনপ্রিয়তা তা মূলত শ্রোতার কানে প্রজন্ম পার হয়ে অনুশোচনার বোধ জাগ্রত রাখার মেকানিজম। এ অনুশোচনার পেছনে আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনা তো থাকার কথা। সেদিকে অবশ্যই যাবো না। কিন্তু যেকোনো সময়ে যেকোনো ঘটনার আবহে এসব থাকে বৈকি।
সংগীত নিয়ে আমার যে প্রাথমিক ধারণা তাতে গানের লিরিকসকে মাঝে মাঝে বাহুল্যই মনে হয়। বরং এটা হতে পারে অনুভূতিকে আরো প্রকাশযোগ্য করা বা কোনো কথা ছড়িয়ে দেয়ার উপায়। এমনকি গানের কথা হয়তো সুরকে সমর্থন নাও করতে পারে। এটা যে সবসময় এমন, তা তো নয়। গানের কথার যে বিতর্ক; তাতে আধুনিক মানুষকে আমরা কীভাবে পাই? আমরা যদি তাহসানের ‘দূরে তুমি দাঁড়িয়ে’ অনুসরণ করি, যেটা সম্ভবত তাহসানের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর একটি, তিনি নিজেও গান ছাড়ার প্রসঙ্গে এর উল্লেখ করেছেন। সেই গানে কী আছে, যেটা দিয়ে তাহসানের সাংগীতিক ভ্রমণকে ব্র্যাকেটবন্দী করা যায়? এখানে ব্যক্তির এক ধরনের সার্বভৌম অস্তিত্ব নিয়ে হাজির। নিজেকে সমাজের অপরাপর বিষয় থেকে ভীষণভাবে আলাদা করেন। সেখানে এমন কেউ নেই যে মথুরা কৃষ্ণের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, বরং নিজেকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে শাসন করছে। আয়নায় নিজেকে দেখা বা অনুধাবন করার মতো। যেন ব্যথা আছে, তাই আমি আছি। এবং ব্যক্তি মানুষ নিজের সার্বভৌমত্ব এভাবে প্রকাশ করছে।
সুফি চর্চার জায়গা থেকে দেখলে সংগীত হলো অধরার প্রকাশ। অধরাকে ধরতে যাওয়ার বাসনা। মানুষ যেখান থেকে আসে সেই জায়গায় ফিরে যাওয়ার আরাধনা। বাংলার ভাব জগতে এর কমন রূপ হলো বিরহ ও কাতরতা। কিন্তু একজন আধুনিক মানুষের কাছে অধরা আসলে কী? সে কি ব্যক্তির মাধ্যমে অধরাকে ধরতে চায়? তা তো হয় না, বরং তার স্বাধীনতার মধ্যে নিজের চেহারা পরিষ্কার হয়। ফলে তাকে অনুশোচনার মধ্য দিয়ে নিজের কাছে ফিরতে হয়। তাহসানের এসব গান নিঃসন্দেহে প্রেমের গান; তাতে প্রেমময়তা আছে এবং এ প্রেম যার প্রতি নিবেদিত সে নিশ্চিত নারী। তবে এই নারী ঠিক প্রেমিকা নয়, বরং তার গানের মিউজ।
কিন্তু তার সঙ্গে লিরিকের যে লেনদেন সেটা মোটামুটি সম্মানজনক দূরত্ব। যেখানে ফানা-ফিল্লাহ নাই। ইগো আছে—আধুনিক মানুষের ইগো। আমার অনুমান এ ইগো তাহসানকে তার জনপ্রিয়তার একটা স্তরে আটকে রাখে। তিনিও বোধহয় সেই ‘আরামদায়ক স্তরে’ আটকে থাকেন। কিন্তু তাহসান কি আগা-গোড়াই এমন? আমার তা মনে হয় না।
তাহসান যখন ব্ল্যাক ব্যান্ডের ভোকাল হিসেবে আবির্ভূত হন, তাঁর ধারা ছিল অল্টারনেটিভ রক। ২০০১ সালে ব্ল্যাকের ‘আমার পৃথিবী’ অ্যালবামের ট্র্যাক ‘প্রার্থনাদ’। এটি নিঃসন্দেহে তাহসানের গাওয়া সেরা তিন গানের একটি হবে। তাহসানের লেখা লিরিকস হলো—
‘আমার এ জীবনটাকে আমি বুঝতে পেরেও বুঝে উঠিনি
আমি কি তোমার তুলির আঁচড়, শুধু তোমার রঙের খোরাক শুধু?’
অথবা ২০০৩ সালের ‘উৎসবের পর’ অ্যালবামের গান ‘অপমিত’। ইমন জুবায়েরের লেখায় তাহসান গাইছেন,
‘আমার দু'চোখে গাঢ় কুয়াশার ঘোর,
তবুও তোমার কাব্য দু'হাতে ধরা।
জলের স্রোতের পাশে ঘুমিয়ে পড়েছি আমি,
পাতা ঝরে ঢেকে দিয়ে গেল আমায়।’
এসব গানের মধ্যে যে আকুলতা আছে তাতে প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হওয়ার ও সামগ্রিক এক বোধের। এসব গানে অধরায় সমর্পণের যে সম্ভাবনা তা আর সামনে যেতে পারে না। বরং একটা চক্রের মধ্যে ঘুরপাক খায়, তাহসান নিজেকে ভেঙে বেশিদূর যেতে পারেন না।
আমাদের বড় হওয়ার কালে তাহসানকে যতটুকু দেখেছি তাকে শুধু পারফরমার হিসেবে দেখার সুযোগ নাই। গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে একটা মিউজিক্যাল জার্নি বলা যায়। যেখানে তার জীবনদর্শন ও ভাবনার পরিবর্তন বা সময়-শ্রোতার মাধ্যমে কীভাবে পরাভূত হন বা একে নিজের সৃজনশীল শক্তিমত্তা হিসেবে বজায় রাখেন তাও দেখা যাবে।
উইকিপিডিয়া থেকে উদ্ধৃত করি। ব্ল্যাক ছেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তাহসান বলেছিলেন, ‘ব্ল্যাক ব্যান্ডের সবাই এখনো আমার ভালো বন্ধু। আসলে ওরা অল্টারনেটিভ রক ধাঁচের গান করতে চেয়েছে। আর আমি স্লো-ব্যালাড ধাঁচের গান করি। তাই আমি ওদের ইচ্ছাকেই সম্মান জানিয়েছি। নিজের ইচ্ছাকে জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইনি।’ মানে তাহসান নিজের পথটা পরিষ্কার বুঝেছেন।
২০০৪ সালের প্রথম সলো কথোপকথন-এর পর একে একে প্রকাশ হয় কৃত্যদাসের নির্বাণ (২০০৫), ইচ্ছে (২০০৬) ও নেই (২০০৭)। শিরোনামের মধ্যে সুফিটিক জার্নির গন্ধ পাবেন। একদম শেষে বিলয় ঘটছে সসীম সত্তার। এরপর বিরতি দিয়ে আসে প্রত্যাবর্তন (২০১১), উদ্দেশ্য নেই (২০১৪) ও অভিমান আমার (২০১৭)। এবারের জার্নি কিছুটা বিশৃঙ্খল। আবার উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো অডিও টেপ ও সিডির যুগের রূপান্তরের সময়কাল। কথোপকথন থেকে নেই মোটামুটি এ রূপান্তরের একটা ধারাবাহিকতা বলা যায়। কিন্তু পরবর্তীতে অডিও ইন্ডাস্ট্রি যখন পুরোপুরি সিডি নির্ভর হতে থাকে; তখন ডিজিটাল পাইরেসি পুরো মুনাফা খেয়ে ফেলে। সংগীতচর্চার পুরোনো ধারাটা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে, যা আর কখনো উদ্ধার হয়নি। তাহসানের সর্বশেষ অ্যালবাম অভিমান আমার শুধু ডিজিটাল আকারে প্রকাশ হয়েছিল; যতদূর মনে পড়ে। যার ব্যানার ছিল জিপি মিউজিক। তাহসান কোনো এক সাক্ষাৎকারে প্রথম অ্যালবামের জন্য লাখ লাখ টাকা সম্মানির কথা বলেছিলেন; সেই যুগ কিছু নাই আর।
এরপর তাহসানের নতুন গান হয়ে যায় নাটক কিংবা মিউজিক ভিডিও কেন্দ্রিক। এসব গানের ফরম্যাট গল্পনির্ভর। প্রেম, বিরহ এসব। পর্দায় দর্শক-ভক্তরা তাকে এভাবেই দেখতে চাইতেন। কিন্তু কথোপকথনের ‘অপেক্ষার উপেক্ষা’, কৃত্যদাসের নির্বাণের টাইটেল গান বা অভিমান আমারের ‘কষ্ট’ এমন অনেক গান আছে যা এসব ফরম্যাটের বাইরে দিকে মানবিক বোধের অন্বেষণ আছে। এমনকি সুফি ধাঁচের জার্নির কথা মনে করিয়ে দেয়।
এখানে ভাষার প্রশ্নও আসে। আমাদের আরবান সংস্কৃতিতে মিথিক্যাল ও স্পিরিচুয়াল যাতনাগুলো কিছুটা বিদ্ঘুটেভাবে আসে। যেন ঠিকঠাক ভাষায় তুলে ধরা যাচ্ছে না। এগুলোর সঙ্গে একাত্ম হওয়া অনেক ক্ষেত্রে কঠিন। আমরা যতই বলি শিল্পের জন্য শিল্প, এর কিছু আলাদা উপযোগিতা তো থাকে। এখানে যেন তাহসান খেই হারান।
কৃত্যদাসের নির্বাণের কথা বললে এক ‘প্রেমাতাল’ই তরুণ শ্রোতাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। আর বাকি গানের চাপা পড়ে গেছে এর আড়ালে। এমনকি পরবর্তী অ্যালবামগুলোরও একই অবস্থা। যেখানে শুধু নিরীক্ষাপ্রবণ গানই বাধাগ্রস্ত হয়নি, তাহসানের ফিলোসফিকাল জার্নিও বোধহয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে! এখানে আমার একটা অনুমান বলি; যেটা গড়পড়তা অনুমান বাংলাদেশের বেশিরভাগ সংগীতশিল্পী যারা জীবনকে মিউজিক্যাল জার্নি হিসেবে নেন তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
অডিও টেপ, সিডি ধরে ডিজিটাল মাধ্যমে এ রূপান্তরে কোনোভাবে আমাদের অডিও ইন্ডাস্ট্রি সারভাইব করতে পারেনি। মানে ইন্ডাস্ট্রি আকারে এখানে নতুন কোনো ভাবনাই কাজ করেনি। অ্যালবামের কথা এজন্য বলছি যে, বারো বা দশ বা আটটি গান যখন একসঙ্গে প্রকাশ হচ্ছে—তখন একজন গায়ক বা কম্পোজারের অনেক ধরনের কাজ করার সুযোগ থাকে। গড়পড়তা, জনপ্রিয় ধারার গান; সঙ্গে জুড়ে এক্সপেরিমেন্টাল বা হৃদয়ের কাছাকাছি যে গানটা তিনি করতে চান সেটা। তাহসানের ওই অ্যালবামগুলোয় এ ধারা বরাবরই দেখা গেছে। যেখানে লিরিক থেকে সুর-সংগীত তিনি একাই সামলেছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। যেখানে হয়তো দুটি গান ‘দূরে তুমি দাঁড়িয়ে’; বাকি গানে অন্য ধরনের টেস্ট পাওয়া যায়। সচরাচর তার লিরিক যতটা কাব্যময় ও নিরীক্ষাপ্রবণ হয়; পরে সেটা আর মেলেনি।
অবশ্য তার নিজের ব্যান্ড তাহসান অ্যান্ড দ্য সুফিজ এর গান ততটা শোনা হয়নি। তবে নাম থেকেও কিছুটা অনুভব করা যায়। কিন্তু দুই-একটা শুনে, এগুলোর লিরিক এতটা চিহ্নহীন যে সুফি নামটার প্রতি বিসদৃশই মনে হয়। ইগো ঝেড়ে ফেলে সমর্পণে যেতে পারেননি তিনি। সুফিজ নামটি যে ধরনের মিথিক্যাল দ্যোতনা ধারণ করে; তা নেই। এ ধরনের গানের সহজিয়া একটা ধারা আছে। তাহসানের মনে সে বিষয়টা আছে বিস্ময় ও প্রশ্ন আকারে; হয়তো এমন প্রকাশই স্বাভাবিক। কিন্তু ভাষাভঙ্গি নিরেট কাটাখোট্ট গোছের। এবং বেশি দূরে যেতেও চাননি হয়তো। ফলে ‘প্রার্থনাদ’-এর ‘পুরোনো চাদর পশ্চিমে, বিছিয়ে আমি একা বসে। তোমার তরে আমার প্রার্থনাদ, তোমার তরে আমার আর্তনাদ’ এমন সমর্পণ সহজে মেলে না বা এর থেকে আর সামনে আগায় না। কিন্তু এ এমন এক বিষয়, জীবনযাপনের ধারা, ভাব-ভাষা প্রকাশের যে সম্পর্ক সেদিকের প্রচলিত স্বরকে উপেক্ষা; সে জায়গা থেকে এ গানগুলোর চর্চা ভীষণ উপভোগ্য। এমনকি পাঁচ বছর আগে তাহসান অ্যান্ড দ্য ব্যান্ড যখন ‘প্রতিবাদী গান’ সিঙ্গেল প্রকাশ করে একে এক প্রকার ফিরে আসার চেষ্টা বলা যায়।
তাহসানের গান নিয়ে আমার এ অনুমানগুলোকে সত্য বা মিথ্যার জায়গা থেকে দেখি না। বরং তার সাংগীতিক জার্নি কী ধরনের অনুমান তৈরি করে সেটাই এ লেখা। যা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে অন্য কোনো মানেও দাঁড় করানো যায়। আমি মনে করি, এমন ক্ষমতা তাহসানের গানে রয়েছে।
সম্প্রতি সংগীত জগত থেকে বিদায়ের ঘোষণা দিয়েছেন তাহসান। এ নিয়ে বাজারে নানান ধরনের মতামত দেখা যাচ্ছে। অনেকে ধর্মাশ্রয়ী বিষয় হিসেবেও দেখছেন। এ ধরনের দেখার চল বাংলাদেশে বিরল নয়, বরং না থাকলেই অবাক হতাম। আমি এ লেখার শিরোনাম ও আলোচনায় ‘অনুশোচনা’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। তার সঙ্গে সেই আলোচনার সম্পর্ক নাই। এটা হয়তো না বললেও চলে; তারপরও বলা ফেলা গেল! এখানে ‘অনুশোচনা’ শব্দটি তাহসানের সাংগীতিক জার্নিকে কেন্দ্র করে। উনার নিজেকে প্রকাশের মাধ্যম হলো কথা, সুর ও কণ্ঠ; যেখানে তিনি গড়পড়তাভাবে আমাদের বোঝাপড়ায় সীমিত হয়ে পড়েন। তাহসানের কথার সূত্রেরই বিষয়টি আমি বোঝার চেষ্টা করেছি। সেই চেষ্টা খুবই আত্মগত এবং ব্যক্তিভেদে তফাৎযোগ্য।
তাহসানের প্রথম সলো অ্যালবাম ‘কথোপকথন’। জি সিরিজের ব্যানারে রিলিজ হয় ২০০৪ সালে। অর্থাৎ একুশ বছর আগে। হালচালে এসে যখন তিনি গান ছাড়ার ঘোষণা দেন; তখন জানান, এ বয়সে এসে ‘দূরে তুমি দাঁড়িয়ে’ আর গাইতে চান না। এটা সেই প্রথম একক অ্যালবামের ‘ঈর্ষা’ শিরোনামের গান। এ রেফারেন্স থেকে বোঝা যায়, মঞ্চে তিনি কী গান করেন এবং দর্শক কী পছন্দ করেন।
দুই দশক মোটামুটি একটা প্রজন্মের সমান সময়; এ হিসেবে অনুমান করা যায় তাহসানের কনসার্টের ভোক্তা এখন আর ২০০৪ সালে যারা উচ্চমাধ্যমিক বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে যারা ছিলেন তারা নন। অন্তত এ গানের কথা যে ধরনের বয়স বিবেচনা করতে বলে সেই হিসেবে।
তাহসানের জনপ্রিয় গানের জন্য লিস্ট করলে দেখা যাবে ‘ঈষা’ থেকে সাম্প্রতিক ‘যত ভুল’ বা ‘প্রেম তুমি’ তাতে সহজাত একটা মিল আছে—অনুশোচনাবোধ। আমার অনুমান হলো; তাহসানের এই যে জনপ্রিয়তা তা মূলত শ্রোতার কানে প্রজন্ম পার হয়ে অনুশোচনার বোধ জাগ্রত রাখার মেকানিজম। এ অনুশোচনার পেছনে আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনা তো থাকার কথা। সেদিকে অবশ্যই যাবো না। কিন্তু যেকোনো সময়ে যেকোনো ঘটনার আবহে এসব থাকে বৈকি।
সংগীত নিয়ে আমার যে প্রাথমিক ধারণা তাতে গানের লিরিকসকে মাঝে মাঝে বাহুল্যই মনে হয়। বরং এটা হতে পারে অনুভূতিকে আরো প্রকাশযোগ্য করা বা কোনো কথা ছড়িয়ে দেয়ার উপায়। এমনকি গানের কথা হয়তো সুরকে সমর্থন নাও করতে পারে। এটা যে সবসময় এমন, তা তো নয়। গানের কথার যে বিতর্ক; তাতে আধুনিক মানুষকে আমরা কীভাবে পাই? আমরা যদি তাহসানের ‘দূরে তুমি দাঁড়িয়ে’ অনুসরণ করি, যেটা সম্ভবত তাহসানের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর একটি, তিনি নিজেও গান ছাড়ার প্রসঙ্গে এর উল্লেখ করেছেন। সেই গানে কী আছে, যেটা দিয়ে তাহসানের সাংগীতিক ভ্রমণকে ব্র্যাকেটবন্দী করা যায়? এখানে ব্যক্তির এক ধরনের সার্বভৌম অস্তিত্ব নিয়ে হাজির। নিজেকে সমাজের অপরাপর বিষয় থেকে ভীষণভাবে আলাদা করেন। সেখানে এমন কেউ নেই যে মথুরা কৃষ্ণের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, বরং নিজেকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে শাসন করছে। আয়নায় নিজেকে দেখা বা অনুধাবন করার মতো। যেন ব্যথা আছে, তাই আমি আছি। এবং ব্যক্তি মানুষ নিজের সার্বভৌমত্ব এভাবে প্রকাশ করছে।
সুফি চর্চার জায়গা থেকে দেখলে সংগীত হলো অধরার প্রকাশ। অধরাকে ধরতে যাওয়ার বাসনা। মানুষ যেখান থেকে আসে সেই জায়গায় ফিরে যাওয়ার আরাধনা। বাংলার ভাব জগতে এর কমন রূপ হলো বিরহ ও কাতরতা। কিন্তু একজন আধুনিক মানুষের কাছে অধরা আসলে কী? সে কি ব্যক্তির মাধ্যমে অধরাকে ধরতে চায়? তা তো হয় না, বরং তার স্বাধীনতার মধ্যে নিজের চেহারা পরিষ্কার হয়। ফলে তাকে অনুশোচনার মধ্য দিয়ে নিজের কাছে ফিরতে হয়। তাহসানের এসব গান নিঃসন্দেহে প্রেমের গান; তাতে প্রেমময়তা আছে এবং এ প্রেম যার প্রতি নিবেদিত সে নিশ্চিত নারী। তবে এই নারী ঠিক প্রেমিকা নয়, বরং তার গানের মিউজ।
কিন্তু তার সঙ্গে লিরিকের যে লেনদেন সেটা মোটামুটি সম্মানজনক দূরত্ব। যেখানে ফানা-ফিল্লাহ নাই। ইগো আছে—আধুনিক মানুষের ইগো। আমার অনুমান এ ইগো তাহসানকে তার জনপ্রিয়তার একটা স্তরে আটকে রাখে। তিনিও বোধহয় সেই ‘আরামদায়ক স্তরে’ আটকে থাকেন। কিন্তু তাহসান কি আগা-গোড়াই এমন? আমার তা মনে হয় না।
তাহসান যখন ব্ল্যাক ব্যান্ডের ভোকাল হিসেবে আবির্ভূত হন, তাঁর ধারা ছিল অল্টারনেটিভ রক। ২০০১ সালে ব্ল্যাকের ‘আমার পৃথিবী’ অ্যালবামের ট্র্যাক ‘প্রার্থনাদ’। এটি নিঃসন্দেহে তাহসানের গাওয়া সেরা তিন গানের একটি হবে। তাহসানের লেখা লিরিকস হলো—
‘আমার এ জীবনটাকে আমি বুঝতে পেরেও বুঝে উঠিনি
আমি কি তোমার তুলির আঁচড়, শুধু তোমার রঙের খোরাক শুধু?’
অথবা ২০০৩ সালের ‘উৎসবের পর’ অ্যালবামের গান ‘অপমিত’। ইমন জুবায়েরের লেখায় তাহসান গাইছেন,
‘আমার দু'চোখে গাঢ় কুয়াশার ঘোর,
তবুও তোমার কাব্য দু'হাতে ধরা।
জলের স্রোতের পাশে ঘুমিয়ে পড়েছি আমি,
পাতা ঝরে ঢেকে দিয়ে গেল আমায়।’
এসব গানের মধ্যে যে আকুলতা আছে তাতে প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হওয়ার ও সামগ্রিক এক বোধের। এসব গানে অধরায় সমর্পণের যে সম্ভাবনা তা আর সামনে যেতে পারে না। বরং একটা চক্রের মধ্যে ঘুরপাক খায়, তাহসান নিজেকে ভেঙে বেশিদূর যেতে পারেন না।
আমাদের বড় হওয়ার কালে তাহসানকে যতটুকু দেখেছি তাকে শুধু পারফরমার হিসেবে দেখার সুযোগ নাই। গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে একটা মিউজিক্যাল জার্নি বলা যায়। যেখানে তার জীবনদর্শন ও ভাবনার পরিবর্তন বা সময়-শ্রোতার মাধ্যমে কীভাবে পরাভূত হন বা একে নিজের সৃজনশীল শক্তিমত্তা হিসেবে বজায় রাখেন তাও দেখা যাবে।
উইকিপিডিয়া থেকে উদ্ধৃত করি। ব্ল্যাক ছেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তাহসান বলেছিলেন, ‘ব্ল্যাক ব্যান্ডের সবাই এখনো আমার ভালো বন্ধু। আসলে ওরা অল্টারনেটিভ রক ধাঁচের গান করতে চেয়েছে। আর আমি স্লো-ব্যালাড ধাঁচের গান করি। তাই আমি ওদের ইচ্ছাকেই সম্মান জানিয়েছি। নিজের ইচ্ছাকে জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইনি।’ মানে তাহসান নিজের পথটা পরিষ্কার বুঝেছেন।
২০০৪ সালের প্রথম সলো কথোপকথন-এর পর একে একে প্রকাশ হয় কৃত্যদাসের নির্বাণ (২০০৫), ইচ্ছে (২০০৬) ও নেই (২০০৭)। শিরোনামের মধ্যে সুফিটিক জার্নির গন্ধ পাবেন। একদম শেষে বিলয় ঘটছে সসীম সত্তার। এরপর বিরতি দিয়ে আসে প্রত্যাবর্তন (২০১১), উদ্দেশ্য নেই (২০১৪) ও অভিমান আমার (২০১৭)। এবারের জার্নি কিছুটা বিশৃঙ্খল। আবার উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো অডিও টেপ ও সিডির যুগের রূপান্তরের সময়কাল। কথোপকথন থেকে নেই মোটামুটি এ রূপান্তরের একটা ধারাবাহিকতা বলা যায়। কিন্তু পরবর্তীতে অডিও ইন্ডাস্ট্রি যখন পুরোপুরি সিডি নির্ভর হতে থাকে; তখন ডিজিটাল পাইরেসি পুরো মুনাফা খেয়ে ফেলে। সংগীতচর্চার পুরোনো ধারাটা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে, যা আর কখনো উদ্ধার হয়নি। তাহসানের সর্বশেষ অ্যালবাম অভিমান আমার শুধু ডিজিটাল আকারে প্রকাশ হয়েছিল; যতদূর মনে পড়ে। যার ব্যানার ছিল জিপি মিউজিক। তাহসান কোনো এক সাক্ষাৎকারে প্রথম অ্যালবামের জন্য লাখ লাখ টাকা সম্মানির কথা বলেছিলেন; সেই যুগ কিছু নাই আর।
এরপর তাহসানের নতুন গান হয়ে যায় নাটক কিংবা মিউজিক ভিডিও কেন্দ্রিক। এসব গানের ফরম্যাট গল্পনির্ভর। প্রেম, বিরহ এসব। পর্দায় দর্শক-ভক্তরা তাকে এভাবেই দেখতে চাইতেন। কিন্তু কথোপকথনের ‘অপেক্ষার উপেক্ষা’, কৃত্যদাসের নির্বাণের টাইটেল গান বা অভিমান আমারের ‘কষ্ট’ এমন অনেক গান আছে যা এসব ফরম্যাটের বাইরে দিকে মানবিক বোধের অন্বেষণ আছে। এমনকি সুফি ধাঁচের জার্নির কথা মনে করিয়ে দেয়।
এখানে ভাষার প্রশ্নও আসে। আমাদের আরবান সংস্কৃতিতে মিথিক্যাল ও স্পিরিচুয়াল যাতনাগুলো কিছুটা বিদ্ঘুটেভাবে আসে। যেন ঠিকঠাক ভাষায় তুলে ধরা যাচ্ছে না। এগুলোর সঙ্গে একাত্ম হওয়া অনেক ক্ষেত্রে কঠিন। আমরা যতই বলি শিল্পের জন্য শিল্প, এর কিছু আলাদা উপযোগিতা তো থাকে। এখানে যেন তাহসান খেই হারান।
কৃত্যদাসের নির্বাণের কথা বললে এক ‘প্রেমাতাল’ই তরুণ শ্রোতাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। আর বাকি গানের চাপা পড়ে গেছে এর আড়ালে। এমনকি পরবর্তী অ্যালবামগুলোরও একই অবস্থা। যেখানে শুধু নিরীক্ষাপ্রবণ গানই বাধাগ্রস্ত হয়নি, তাহসানের ফিলোসফিকাল জার্নিও বোধহয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে! এখানে আমার একটা অনুমান বলি; যেটা গড়পড়তা অনুমান বাংলাদেশের বেশিরভাগ সংগীতশিল্পী যারা জীবনকে মিউজিক্যাল জার্নি হিসেবে নেন তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
অডিও টেপ, সিডি ধরে ডিজিটাল মাধ্যমে এ রূপান্তরে কোনোভাবে আমাদের অডিও ইন্ডাস্ট্রি সারভাইব করতে পারেনি। মানে ইন্ডাস্ট্রি আকারে এখানে নতুন কোনো ভাবনাই কাজ করেনি। অ্যালবামের কথা এজন্য বলছি যে, বারো বা দশ বা আটটি গান যখন একসঙ্গে প্রকাশ হচ্ছে—তখন একজন গায়ক বা কম্পোজারের অনেক ধরনের কাজ করার সুযোগ থাকে। গড়পড়তা, জনপ্রিয় ধারার গান; সঙ্গে জুড়ে এক্সপেরিমেন্টাল বা হৃদয়ের কাছাকাছি যে গানটা তিনি করতে চান সেটা। তাহসানের ওই অ্যালবামগুলোয় এ ধারা বরাবরই দেখা গেছে। যেখানে লিরিক থেকে সুর-সংগীত তিনি একাই সামলেছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। যেখানে হয়তো দুটি গান ‘দূরে তুমি দাঁড়িয়ে’; বাকি গানে অন্য ধরনের টেস্ট পাওয়া যায়। সচরাচর তার লিরিক যতটা কাব্যময় ও নিরীক্ষাপ্রবণ হয়; পরে সেটা আর মেলেনি।
অবশ্য তার নিজের ব্যান্ড তাহসান অ্যান্ড দ্য সুফিজ এর গান ততটা শোনা হয়নি। তবে নাম থেকেও কিছুটা অনুভব করা যায়। কিন্তু দুই-একটা শুনে, এগুলোর লিরিক এতটা চিহ্নহীন যে সুফি নামটার প্রতি বিসদৃশই মনে হয়। ইগো ঝেড়ে ফেলে সমর্পণে যেতে পারেননি তিনি। সুফিজ নামটি যে ধরনের মিথিক্যাল দ্যোতনা ধারণ করে; তা নেই। এ ধরনের গানের সহজিয়া একটা ধারা আছে। তাহসানের মনে সে বিষয়টা আছে বিস্ময় ও প্রশ্ন আকারে; হয়তো এমন প্রকাশই স্বাভাবিক। কিন্তু ভাষাভঙ্গি নিরেট কাটাখোট্ট গোছের। এবং বেশি দূরে যেতেও চাননি হয়তো। ফলে ‘প্রার্থনাদ’-এর ‘পুরোনো চাদর পশ্চিমে, বিছিয়ে আমি একা বসে। তোমার তরে আমার প্রার্থনাদ, তোমার তরে আমার আর্তনাদ’ এমন সমর্পণ সহজে মেলে না বা এর থেকে আর সামনে আগায় না। কিন্তু এ এমন এক বিষয়, জীবনযাপনের ধারা, ভাব-ভাষা প্রকাশের যে সম্পর্ক সেদিকের প্রচলিত স্বরকে উপেক্ষা; সে জায়গা থেকে এ গানগুলোর চর্চা ভীষণ উপভোগ্য। এমনকি পাঁচ বছর আগে তাহসান অ্যান্ড দ্য ব্যান্ড যখন ‘প্রতিবাদী গান’ সিঙ্গেল প্রকাশ করে একে এক প্রকার ফিরে আসার চেষ্টা বলা যায়।
তাহসানের গান নিয়ে আমার এ অনুমানগুলোকে সত্য বা মিথ্যার জায়গা থেকে দেখি না। বরং তার সাংগীতিক জার্নি কী ধরনের অনুমান তৈরি করে সেটাই এ লেখা। যা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে অন্য কোনো মানেও দাঁড় করানো যায়। আমি মনে করি, এমন ক্ষমতা তাহসানের গানে রয়েছে।
গতকাল থেকে ফেসবুকে দেখতেছি, সবাই বন্ধু হইতে চায়। আমার বন্ধু হইতে চায় না। ডিয়ার রিডার, আপনারও বন্ধু হইতে চায় না, স্যরি; সবাই বন্ধু হইতে চায় স্বপ্নীলের।
১ দিন আগেজেন-জি’রা কর্মী হিসেবে অলস। এই অভিযোগ কর্পোরেট বস মহলে কমন। আসলেই কি তাই? জেন-জি’রা কর্মক্ষেত্রে ঢুকেছে অল্প কিছুদিন হল। কিন্তু এরই মধ্যে চাকরি ছাড়ার রেটে তারা এগিয়ে আছে, চাকরিতে তারা পুরো মনোযোগ দেয় না –এসব নালিশ তাদের বিরুদ্ধে প্রবল। আরেকদিকে জেন-জি টিকটকার, রিলমেকার, লেখকরা বলছে এই প্রবণতাগুলো সত
৩ দিন আগেআপনি হয়তো ভাবছেন দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি বা ডেঙ্গুই সমাজের প্রধান শত্রু। কিন্তু না, এই দেশে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিস কিন্তু আপনার সিনেমার রুচি। ভুল সিনেমা দেখে ফেললে আপনি শুধু আজিব চিড়িয়াই নন, বরং চলমান সামাজিক কলঙ্ক।
৬ দিন আগেএকসাথে গাদাখানেক ছবি, ক্যাপশনে লেখা হ্যাশট্যাগ ফটোডাম্প–এমন পোস্ট কি আপনার নিউজফিডেও ঘোরাফেরা করছে? আপনিও কি একই পোস্টে পরপর পোস্টদাতার সেলফি, ঘাস-লতাপাতা, খাবারের জুম করা ছবি দেখে কনফিউজড? ভেবে পাচ্ছেন না কী রিঅ্যাকশন দিবেন? তাহলে আপনার মত বুমারের জন্যই এই লেখা।
১০ দিন আগে