leadT1ad

ফটো ডাম্পিং: জেনজি যেভাবে সোশাল মিডিয়ার নতুন ওবায়দুল কাদের হয়ে উঠছে

একসাথে গাদাখানেক ছবি, ক্যাপশনে লেখা হ্যাশট্যাগ ফটোডাম্প–এমন পোস্ট কি আপনার নিউজফিডেও ঘোরাফেরা করছে? আপনিও কি একই পোস্টে পরপর পোস্টদাতার সেলফি, ঘাস-লতাপাতা, খাবারের জুম করা ছবি দেখে কনফিউজড? ভেবে পাচ্ছেন না কী রিঅ্যাকশন দিবেন? তাহলে আপনার মত বুমারের জন্যই এই লেখা।

প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ০০
কেন জেনজি ছবি আপ্লোডের ক্ষেত্রে ওবায়দুল কাদেরকে ফলো করছে। স্ট্রিম গ্রাফিক

‘চ্যালেঞ্জিং টাইমস’ ক্যাপশনে গাদাখানেক ছবি। একই কাপড়ে, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে, বসে, ঝুঁকে বিভিন্ন পোজে ছবি। বিখ্যাত পোস্ট; পোস্টদাতাও বিখ্যাত: আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ফেসবুকে কয়েকশো ছবি একসাথে একই পোস্টে আপলোড করা যায় সেটার হাতেখড়ি অনেকেরই এই ওকা-র হাতে। তখন এই নিয়ে অনেক ট্রল হলেও বর্তমানে জেন জি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফটো ডাম্প নামে যে ট্রেন্ডের চর্চা করছে তা অনেকটা অরিজিনাল ওকা আপলোডিং এর মতই।

ফটো ডাম্প ট্রেন্ডের সাথে পরিচিত না হওয়ার চান্স কম। ইন্সটাগ্রামে ফটোডাম্প হ্যাশট্যাগটি ৫.৮ মিলিয়ন বার ব্যবহার হয়েছে। তাও তর্জমার খাতিরে বলি, ফটো ডাম্প হল একটা পোস্ট বা অ্যালবামে একসাথে অনেক সুন্দর-অসুন্দর, প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক ছবি আপলোড করা। দেখে যাতে ছবিগুলোকে কিউরেটেড না মনে হয়। অর্থাৎ অনেক ক্ষেত্রেই একটা ছবির সাথে আরেক ছবির ভেতরের মালমশলা বা অ্যাস্থেটিকে মিল থাকে না। বেশ কয়টা ‘আগ্লি সেলফি’ থাকে যা জেনজির কাছে তুমুল জনপ্রিয়। এই ধরনের ছবিতে কেউ খুব কাছে থেকে ‘আনফ্ল্যাটারিং অ্যাঙ্গেলে’সেলফি তুলে যেখানে তার ডাবল চিন বা কপাল বড় দেখা যাচ্ছে। অনেক ছবি হয় ইচ্ছাকৃত ব্লার এবং ফিশআই লেন্সে অদ্ভুত অ্যাঙ্গেলে তোলা। ডাম্পে শুধু মানুষের ছবি থাকে এমনও নয়। থাকে সমুদ্র, গাছপালা, পাহাড় টাইপ ল্যান্ডস্কেপ ছবি। এমনকি আধখাওয়া বার্গার, কেক এসব ছবিও থাকে।

পুঁজিবাদের কলিযুগে কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ট্রেন্ডই বিক্রিবাট্টামুক্ত থাকতে পারে বা। ফটোডাম্প ট্রেন্ডের মূল আকর্ষণ ইনফরমালিটি হলেও ধীরে ধীরে এটাকে বড় কোম্পানি ও বিজ্ঞাপনী সংস্থারা ব্যবহার করা শুরু করে। এমা চেম্বারলেইনরাও ডাম্পের মাঝে তাদের বিভিন্ন মার্চেন্ডাইজের ছবি আপলোড করা শুরু করলেন। অনেকে আবার প্রশ্ন তোলা শুরু করলেন যে এই অথেনন্টিসিটির ট্রেন্ড আনঅথেন্টিক হয়ে যাচ্ছে/গেছে।

বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারদের একজন এমা চেম্বারলেইন এই ট্রেন্ডের চর্চা করেন অনেক। এমার ইন্সটাগ্রাম ফলোয়ার ১৪.৬ মিলিয়ন এবং ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে তার মূল আকর্ষণ ‘রিলেটিবিলিটি’। অর্থাৎ তাঁর জীবন কত সাধারণ, উইয়ার্ড, গ্ল্যামারমুক্ত এবং ‘জনতার কাতারের’ তিনি তা তুলে ধরেন ইন্সটাগ্রামে। তাঁর অনলাইন ব্যক্তিত্ব কোয়ার্কি, ফানি, উচ্ছল ও সংবেদনশীল। তাঁর এই পার্সোনার সাথে ফটো ডাম্প ট্রেন্ড খুবই ভালোভাবে খাপ খায়। তাই তার এই ট্রেন্ডের প্রতি ভালোবাসা খুব সারপ্রাইজিং কিছু না।

ইন্টারনেট-পূর্ব তারকাদের সাথে ইনফ্লুয়েন্সারদের একটা বড় অমিল আছে। ট্রেডিশনাল তারকারা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’, আনরিলেটেবল জীবন কাটান এবং তা-ই সেলিব্রিটি ম্যাগাজিন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরেন/ধরতেন। কিন্তু ইনফ্লুয়েন্সাররা দেখাতে চান তাঁরা সাধারণ মানুষ। সেলফ ক্যামেরা অন করে মেকাপ করতে করতে বা র‍্যান্ট ভিডিও বানাতে বানাতে ‘ন্যাচারালি’ খ্যাতির দেখা পেয়েছেন। তাঁরা আপনার মাঝে স্বপ্ন জিইয়ে রাখতে চান যে একদিন আপনিও ইনফ্লুয়েন্সার হয়ে উঠতে পারেন।

এমা চেম্বারলেইনের একটি ইন্সটাগ্রাম পোস্ট, ফটোডাম্প ট্রেন্ডের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
এমা চেম্বারলেইনের একটি ইন্সটাগ্রাম পোস্ট, ফটোডাম্প ট্রেন্ডের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

এই কারণে ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং এত জনপ্রিয়। অজয় দেভগান যে পান মশলার বিজ্ঞাপন করেন তা নিজে ভক্ষণ করেন এটা মানা কষ্ট। কিন্তু গার্ল নেক্সট ডোর ইনফ্লুয়েন্সার যাকে আপনি চোখের সামনে আস্তে আস্তে বিখ্যাত হয়ে উঠতে দেখেছেন, যার বিশাল কোনো ‘প্রতিভা’ নেই, তিনি যদি বলেন, আমি অমুক সানস্ত্রিন ব্যবহার করি, তবে সেটা আপনার বিশ্বাস হতেই পারে।

অথচ এক সময়, ইন্সটাগ্রাম-ফেসবুকের সূচনাকালে, ইনফ্লুয়েন্সাররা তাদের ‘পারফেক্ট’ জীবনের ছবি প্ল্যাটফর্মগুলোতে তুলে ধরতেন। তাদের গোছানো রান্নাঘরের ক্যাবিনেট, রেইনবো থিমে সাজানো বুকশেলফ, নিখুঁত ত্বক (ফিল্টার মারা) –এসব ছবি ছিল তাদের ইন্সটাগ্রাম ফিডের মূল চালিকাশক্তি। একসময় ভক্তকূল তাঁদের এই কিউরেশনের সমালোচনা করতে লাগল। এগুলো অবাস্তব স্ট্যান্ডার্ড সাধারণ মানুষের জন্য —এই অভিযোগ বারবার উঠে আসতে থাকল। শুরু হল ডাউন টু আর্থ ইনফ্লুয়েন্সিং, মূল টার্গেট জেন জি।

জেন জি—মানে যেই প্রজন্মের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ এর মধ্যে তাদের বড় হয়ে ওঠাই ইন্টারনেটের ল্যান্ডস্কেপে। জেন জি-রা প্রথম ইন্টারনেট নেটিভ। তারা এই রিলেটেবল ইনফ্লুয়েন্সিং এর ভক্ত এবং চর্চাকারী। লকডাউনের সময় তাদের হাত ধরেই ফটো ডাম্প কালচারের যাত্রা। প্রাত্যাহিক জীবনের পুরাটাই ছবিতে ধারণ করে নিউজফিডে ডাম্প করা তখন ছিল নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার একটা উপায়। ২০২৩ এর পর এই ট্রেন্ড জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছায়।

অজয় দেভগান যে পান মশলার বিজ্ঞাপন করেন তা নিজে ভক্ষণ করেন এটা মানা কষ্ট। কিন্তু গার্ল নেক্সট ডোর ইনফ্লুয়েন্সার যাকে আপনি চোখের সামনে আস্তে আস্তে বিখ্যাত হয়ে উঠতে দেখেছেন, যার বিশাল কোনো ‘প্রতিভা’ নেই, তিনি যদি বলেন, আমি অমুক সানস্ত্রিন ব্যবহার করি, তবে সেটা আপনার বিশ্বাস হতেই পারে।

কিন্তু এই পুঁজিবাদের কলিযুগে কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ট্রেন্ডই বিক্রিবাট্টামুক্ত থাকতে পারে বা। ফটোডাম্প ট্রেন্ডের মূল আকর্ষণ ইনফরমালিটি হলেও ধীরে ধীরে এটাকে বড় কোম্পানি ও বিজ্ঞাপনী সংস্থারা ব্যবহার করা শুরু করে। এমা চেম্বারলেইনরাও ডাম্পের মাঝে তাদের বিভিন্ন মার্চেন্ডাইজের ছবি আপলোড করা শুরু করলেন। অনেকে আবার প্রশ্ন তোলা শুরু করলেন যে এই অথেনন্টিসিটির ট্রেন্ড আনঅথেন্টিক হয়ে যাচ্ছে/গেছে। ‘কেয়ারফুলি কেয়ারলেস’-ভাবে এই ফটোডাম্প কিউরেট করা হচ্ছে। বেশ ক’বছর আগে ইন্সটাগ্রামে ‘নো মেকাপ মেকাপ লুক’ ট্রেন্ডের মত, যেখানে ইনফ্লুয়েন্সাররা এমনভাবে মেকাপ করতেন যাতে বোঝা না যায় যে তিনি মেকাপ করেছেন।

ফটোডাম্প এই অভিযোগে বিলীন হয়ে যাবে নাকি আরো বহু ইন্টারনেট ট্রেন্ডের মত তা বলা মুশকিল। তবে বর্তমানে এত সমালোচনার পরও এই ট্রেন্ড জনপ্রিয়। কারণ ফটোডাম্পের ‘নস্টালজিয়া’ ফ্যাক্টর। জেন জির কাছে এডিট ছাড়া ছবির আইডিয়াটাই রেট্রো বা ভিন্টেজ। ক্যাসেট প্লেয়ার, ভাইনাল রেকর্ড আর চিঠির মতই তার নস্টালজিয়া ভ্যালু আছে। ডিজিটাল ক্যামেরা যুগে মানুষ প্রচুর ছবি তুলতো এবং এডিটিং এত বহুল প্রচলিত ছিল না, এটাই এখন ফটোডাম্পে রেট্রো হয়ে ফিরে এসেছে। এটাকে কেন্দ্র করেও হচ্ছে নস্টালজিয়া মার্কেটিং!

মূলত, ইন্সটাগ্রামে অথেনসিটির যেকোনো ট্রেন্ড আইরনিক। জো বাইডেন থেকে শুরু করে বড় কোলা ব্র্যান্ড সবাই-ই এই ট্রেন্ড ব্যবহার করে রিলেটেবল হয়ে উঠতে চাচ্ছেন। মানুষ স্ক্রল করতে করতে ব্রেইন ফ্রাই করে সেটা দেখছে, লাইক দিচ্ছে, সমালোচনা করছে। আমি বসে এই আর্টিকেল লিখছি। এটাও এক প্রকার ডাম্প, চিন্তার ডাম্প। কারণ ইন্টারনেট এক সুবিশাল ডাম্পিং গ্রাউন্ড। কিন্তু পরিবেশবান্ধব কারণ প্রায়ই এখানে ট্রেন্ড ও চিন্তা রিসাইকেল হয়!

Ad 300x250

সম্পর্কিত