সোশাল মিডিয়া ও ডিজিটাল লাইফস্টাইলের নতুন কারেন্সি হয়ে উঠেছে ‘ভাইব’। এখন আমাদের সম্পর্ক নির্ভর করে ভাইব ম্যাচ করা না-করার উপরে। কিন্তু ভাইব জিনিসটা আসলে কী? আমরা ভাইব-ক্যাপিটালিজমের যুগে পৌছে গেছি?
স্ট্রিম ডেস্ক
সেদিনও বিকেলটা কেটে যাচ্ছিল টিকটকের অতল গহ্বরে। জানেন তো, ওই যে যখন স্ক্রল করতে করতে দুনিয়ার আর কোনো হুঁশ থাকে না, মগজটা যেন অন্য কারও কাছে বন্ধক রাখা। ঠিক তখনই চোখে পড়ল একটা ভিডিও। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরের কোনো এক বিল্ডিংয়ের ভেতরের দৃশ্য।
বিল্ডিংয়ের অনেক উঁচুতে, কাচের বিশাল জানালার বাইরেটা কুয়াশায় ঢাকা। আর ভেতরে ঝা চকচকে এক সুইমিং পুলে এক লোক চিৎ হয়ে ভাসছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে ফ্র্যাঙ্ক ওশানের গান ‘হোয়াইট ফেরারি’। দশ সেকেন্ডের ভিডিও। হ্যাশট্যাগ? #vibin
পরের ক্লিপে আরেক কাণ্ড। এক নারী তার সকাল বেলার রুটিন দেখাচ্ছেন। কী নেই সেখানে! লিনেনের এলোমেলো বিছানার চাদর, গাঢ় নীল রঙের সাটিন পাজামা, আর ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা। সাথে টুকিটাকি আরও জিনিস: একটা মনস্টেরা গাছ, এক টুকরো আধপোড়া সুগন্ধী কাঠ, আর জানালার বাইরে ব্যস্ত রাস্তা। সব মিলিয়ে কেমন একটা শান্ত, সাজানো-গোছানো কর্মব্যস্ততার ভাব। এটার হ্যাশট্যাগ ছিল #vibes।
আরেকটা মন্তাজের ক্যাপশন: ‘এখানকার রাতের ভাইবস আমার দারুণ লাগে’। ভেতরে কী? আবছা আলোয় একটা ফ্ল্যাট, যেখানে গোলাপি নিওন সাইনে লেখা ‘Where Love Lives’। একটা শিবা ইনু কুকুর উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পিকাসোর আর্টের বইয়ের ওপর রাখা একটা গোল ল্যাম্প, আর দেয়ালে ঝোলানো টিভিতে চলছে ইউটিউবের সেই বিখ্যাত চ্যানেল—‘lofi hip hop radio - beats to relax/study to’।
এই যে আপাতদৃষ্টিতে জীবনের ‘সাধারণ’ কিছু মুহূর্ত, সেগুলোকে ছোট ছোট ভিডিওর মধ্যে ঠেসে দেওয়া—এটাই এখন টিকটকের মূল কারবার। অ্যালগরিদমের কল্যাণে আমার ফিডটা তো এখন এসব জিনিসেই সয়লাব। অন্যদের কপালে হয়তো নাচের ভিডিও বা ফাজলামি জোটে, কিন্তু আমার জন্য বরাদ্দ শুধুই এই ‘চিল ভাইবস’।
মাঝসমুদ্রে দুলতে থাকা পালতোলা নৌকায় ক্যাজুয়ালি রান্না করা? সেটাও নাকি একটা ‘ভাইব’। আবার ধরুন, ন্যাথান অ্যাপোডাকার সেই বিখ্যাত টিকটক—ফ্লিটউড ম্যাক-এর ‘ড্রিমস’ গানটা শুনতে শুনতে স্কেটবোর্ডে চেপে রাস্তায় এঁকেবেঁকে যাওয়া, আর সাথে ক্র্যানবেরি জুসের বোতলে চুমুক দেওয়া... সেটাও একটা জব্বর ‘ভাইব’।
‘ভাইব’ শব্দটার মানে কী, তা আমরা মোটামুটি সবাই-ই জানি, তাই না? এটা আসলে একটা আবছা গুণের নাম। একটা পরিবেশ... ধরুন, ‘একটা আয়েশি মেজাজ’। এই কারণেই তো আমরা কাউকে বা কোনো কিছুকে পছন্দ বা অপছন্দ করি (গুড ভাইবস বনাম ব্যাড ভাইবস)। ভাইব হলো মন-থেকে-আসা সেই অনুভূতিটা, যার কোনো পোশাকি ব্যাখ্যা নেই (‘কী জানি কেন, একটা ভাইব পেলাম আরকি’)।
বেশিরভাগ ভাইবের কোনো কেতাবি নাম-ধাম নেই, তবে কয়েকটার আবার আছে। যেমন, পর্তুগিজ শব্দ ‘সওদাদে’ (Saudade), যার মানে হলো এক ধরনের মিষ্টি বেদনার অনুভূতি। এটাকে একটা ভাইব বলা যেতে পারে। কিংবা জাপানি শব্দ ‘ইকি’ (iki)—এক ধরনের উদাসীন কিন্তু অভিজাত ভঙ্গি। আবার ধরুন জার্মান ‘ফার্নভে’ (fernweh), মানে দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, যা হয়তো অচেনা জঙ্গল বা দূরের কোনো দৃশ্য দেখলে মনে জাগে।
তবে সোশ্যাল মিডিয়ার এই জমানায় ‘ভাইব’ শব্দটা আরও গভীর অর্থ নিয়ে হাজির হয়েছে। ইউএনসি, শার্লটের দর্শনের অধ্যাপক রবিন জেমস ব্যাপারটাকে বলেছেন, মানুষ আর তার পরিবেশের মধ্যে একটা ‘সহানুভূতিশীল অনুরণন’।
ভাষার জগতে হাইকু যা, আমাদের ইন্দ্রিয়ের জগতে ভাইব-ও ঠিক তাই: ছবি, শব্দ আর নড়াচড়ার এক ছোট্ট, জমাট প্যাকেজ। (মাঝে মাঝে #Aesthetic হ্যাশট্যাগ দিয়েও ভাইব বোঝানো হয়, কিন্তু ওটা মূলত চোখে দেখার বিষয়।) একটা ভাইব ভালো হতে পারে, খারাপ হতে পারে, সুন্দর, কুৎসিত, বা একেবারে খ্যাপাটে গোছের হতে পারে। এটা এমনকি নিজেই একটা গুণে পরিণত হতে পারে: কোনো জিনিস যদি ‘ভাইবি’ (vibey) হয়, তার মানে হলো সেটা থেকে মানুষ তীব্র ভাইব পাচ্ছে বা সেটা ভাইব লেনদেনের জন্য একেবারে আদর্শ জায়গা।
আসলে ভাইব হলো অনুভূতি প্রকাশের একটা মাধ্যম; কোনো অভিজ্ঞতার নাম দেওয়ার আগে যে আবছা অনুভূতিটা হয়, ঠিক সেটাই। আর ঠিক এ কারণেই এটি সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য একেবারে খাপে খাপ। কারণ এই দুনিয়ায় তো লেখার চেয়ে অডিও, ভিডিও আর ছবিকেই বেশি পাত্তা দেওয়া হয়। তাই কষ্ট করে আর কোনো কিছুর শব্দ (টেক্সট) খুঁজে বের করতে হয় না। আপনার কাজ ভাইবটাকে বলা নয়, বোঝানো।
এই ‘ভাইব’ শব্দটা এসেছে ‘ভাইব্রেশন’ (vibration) বা কম্পন থেকে—এমন কিছু যা অনুরণিত হয়, প্রতিধ্বনিত হয় আর একটা জায়গাকে ভরিয়ে তোলে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, শব্দটা ভাইব্রাফোন নামের এক বাদ্যযন্ত্রের সাথে জুড়ে গেল। এটা হলো ম্যারিম্বার এক জ্ঞাতি ভাই, যার বারের নিচে মোটরচালিত পাখা লাগানো থাকে আরও ‘ভাইবি’ আওয়াজ তৈরি করার জন্য। যখন এটা প্রথম বানানো হয়, মানে ওই ১৯২০-এর দশকে, শিল্পীরা ঠিক নিশ্চিত ছিলেন না যে এর ডাকনাম একবচন হবে নাকি বহুবচন—‘ভাইব’ নাকি ‘ভাইবস’। শেষমেশ দ্বিতীয়টাই টিকে গেল।
আজকাল এই বাজনার আওয়াজ শুনলেই একগাদা জিনিস মাথায় চলে আসে: ট্রপিকালিয়া মিউজিক, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে হাওয়াই নিয়ে মাতামাতি, একটা লোকদেখানো আধুনিকতা।
তবে স্ল্যাং হিসেবে ‘ভাইব’ শব্দটার চল শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে, ক্যালিফোর্নিয়ায়। তখন এর মানে ছিল কোনো কিছুর আবেশ বা অনুভূতি। তখন এই শব্দটি হিপি কালচারের সঙ্গে জুড়ে যায়। সে সময় বার্কলি বার্ব বলে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা ছিল। ১৯৬৫ সাল থেকে তারাই দেদারসে এই শব্দের ব্যবহার শুরু করে। তার ঠিক তার পরেই তো ‘বিচ বয়েজ’ তাদের বিখ্যাত গান ‘গুড ভাইব্রেশনস’ নিয়ে হাজির হলো। এই একটা গানেই শব্দটা আমজনতার কানে পৌঁছে গেল।
বিবি ভেইন নামে এক লেখিকা তার বইয়ে ভাইবসকে বলেছিলেন ‘আত্মার স্পর্শ’। বইটা ছিল আমেরিকার বিদ্রোহী তরুণদের নিয়ে, সালটা ১৯৭০।
কিন্তু যা হয় আরকি, কিছুদিন যেতে না যেতেই শব্দটাকে যে কোনো কিছুর সাথেই জুড়ে দেওয়া শুরু হলো। ১৯৭৩ সাল নাগাদ ‘কালচারর্স’ নামের এক জার্নাল তো লিখেই বসল যে, ‘এক ঘর মানুষ, একটা শহর, এমনকি একটা রাজনৈতিক প্রচারণারও নিজস্ব ভাইব্রেশন থাকে’।
সংস্কৃতির জগতে নতুন যা কিছুই আসে, সাধারণ মানুষ যখন সেটাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু করে, তখন তার ধার কমে যায়। (‘ভাইবস’ শব্দটা ‘আমার কাছে কোনো মানেই রাখে না’, ১৯৭৬ সালে পারফর্মিং আর্টস জার্নালে কোরিওগ্রাফার ত্রিশা ব্রাউন এভাবেই বলেছিলেন।)
আজকাল আমরা হয়তো প্রায়ই ‘এইটিজের ভাইব’-এর কথা বলি—ভাবলেই চোখে ভাসে চকচকে কাপড়, ফোলানো চুল আর ধোঁয়ার মেশিন। কিন্তু সত্যি বলতে, আশি বা নব্বইয়ের দশকে মানুষ ভাইব নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাত না। সম্ভবত ওই দশকগুলো ছিল বড্ড বেশি কঠিন, বড্ড বেশি টাকা-পয়সার পেছনে ছোটার দশক। তাই বোধহয় ভাইব-টাইব বোঝার মতো মন-মানসিকতা তখন ছিল না। (১৯৯৩ সালে ‘ভাইব’ নামের যে ম্যাগাজিনটা বের হলো, সেটাও হিপ-হপ সংস্কৃতিকে একটা পণ্য হিসেবেই তুলে ধরেছিল।)
কিন্তু ওই সময়েই আবার ভাইব হয়ে উঠল দার্শনিক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৯৩ সালে, ‘থিসিস ইলেভেন’ জার্নালের এক প্রবন্ধে, জার্মান দার্শনিক গেরনট বোমে ‘অ্যাটমোস্ফিয়ার’ বা আবহকে উপলব্ধির এক নতুন নান্দনিকতার ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই যে একটা সার্বিক অনুভূতি, এর সাথে ভাইবের কিন্তু বেশ মিল আছে।
এর আগে হাইডেগার পৃথিবীতে থাকার অনুভূতি বোঝাতে ‘মুড’ (mood) শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, আর ওয়াল্টার বেনইয়ামিন বলেছিলেন ‘অরা’ (aura)-র কথা, যা কোনো অনন্য শিল্পকর্মের (যেমন ধরুন, একটি পেইন্টিং) সান্নিধ্যে গেলে হয়। কিন্তু বোমে দেখলেন, এর চেয়েও অনেক সাধারণ জিনিস—যেমন কসমেটিকস, বিজ্ঞাপন, ঘরের সাজসজ্জা—এদেরও নিজস্ব এক ধরনের আবহ আছে, যা দিয়ে তৈরি হয় ‘দৈনন্দিন জীবনের নান্দনিকতা’।
একবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেন বেনেটের সাথেও ঘটেছিল প্রায় একই রকম কাণ্ড। রৌদ্রোজ্জ্বল এক সকালে নর্দমায় পড়ে থাকা একগাদা ময়লার দিকে তাকিয়ে নাকি তার দিব্যজ্ঞান লাভ হয়েছিল। তার ২০১০ সালের বই ভাইব্র্যান্ট ম্যাটার: আ পলিটিকাল ইকলজি অব থিংস -এ তিনি এই অভিজ্ঞতার কথা ফলাও করে লিখেছেন।
ফেলে দেওয়া জিনিসগুলোর মধ্যে হঠাৎ করেই যেন প্রাণের সঞ্চার হলো। তিনি লিখেছেন: ‘দস্তানাটা, ইঁদুরটা, ফুলের রেণু, বোতলের ছিপি, আর লাঠিটা, সব যেন ঝিকমিক করে উঠল, স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে লাগল। সেই রাস্তা, সেই সকালের আবহাওয়া আর আমি—সব মিলেমিশে যেন এক দৃশ্যের জন্ম হলো।’
বেনেটের মতে, পুঁজিবাদ আমাদের শেখায় এই ধরনের ভাইবকে পাত্তা না দিতে। কেননা একটা ভোগবাদী সমাজ, যেখানে জিনিসপত্র ক্রমাগত ফেলে দেওয়া হয় আর নতুন কেনা হয়, সেখানে বস্তুর প্রাণশক্তিকে সবসময় আড়াল করা হয়। বেনেটের ওই প্রাণবন্ত ময়লার গাদা না হয় পুঁজিবাদের ঘোর শত্রু, কিন্তু ইনস্টাগ্রামের এই সাজানো-গোছানো ভিডিওগুলো অন্তত কিছু-না-কিছু বিক্রি করার ধান্দায়ই করা হয়। হয়তো সরাসরি কোনো পণ্য নয়, কিন্তু যে ইনফ্লুয়েন্সার পোস্ট দিচ্ছে, তার নিজের ‘ব্র্যান্ড’ তো বটেই। রবিন জেমস এই ব্যাপারটার একটা যুতসই নামও দিয়েছেন: ‘ভাইব-ক্যাপিটালিজম’।
কোনো পণ্য বা কোম্পানির সাথে যদি একটা ভাইবকে শক্ত করে জুড়ে দেওয়া যায়, তাহলে সেটা হয়ে ওঠে একটা চলমান বিজ্ঞাপন, যা মানুষের রুচি অনুযায়ী কাউকে কাছে টানে, আবার কাউকে দূরে ঠেলে দেয়। টেসলা গাড়ির কথা একবার ভাবুন। এর সাথে জড়িয়ে থাকা উদ্দাম টেকনো-পৌরুষের ভাইবের কথা কি মাথায় আসছে না?
ইনস্টাগ্রামের মূল কারবার যেখানে একটা সাজানো-গোছানো ছবি, মানে একটামাত্র স্থির ছবি বা কোনো কাটাছেঁড়া-না-করা ভিডিও, টিকটকের কারবার হলো বাস্তব দুনিয়া থেকে তুলে আনা টুকরো-টাকরা মুহূর্ত, যেগুলোকে সিনেমার মতো মন্তাজ বানিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়। (যদিও ইনস্টাগ্রামও কম যায় না, তারাও কয়েক বছর আগে এর সাথে পাল্লা দেওয়ার ধান্দায় ‘রিলস’ নামের ফিচার এনেছে।)
টিকটকের প্রযুক্তিটা এমন যে ভিডিও ক্লিপ কেটেকুটে তার সাথে একটা জুতসই জনপ্রিয় গান জুড়ে দেওয়াটা কোনো ব্যাপারই না: ব্যস, হয়ে গেল ইনস্ট্যান্ট ভাইব। টিকটকের ‘ফর ইউ’ ফিডটা আবার প্রত্যেক ব্যবহারকারীর পছন্দসই কনটেন্ট এনে দেয়। ফলাফল? এমন একটা প্ল্যাটফর্মছোট ছোট মুহূর্তের ওপর, আলাদা আলাদা অনুভূতির অগভীর ঝলকানির ওপর যা চলে।
অ্যামস্টারডামের ডিজাইন সংস্থা, মেটাহেভেনের প্রতিষ্ঠাতা ভিনকা ক্রুক আর ড্যানিয়েল ভ্যান ডার ভেলডেন আমাকে বলছিলেন, ‘মানুষ আস্ত একটা গল্প চায়—টিকটক এসে এই কথাটার মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে।’ ম্যানচেস্টারের সেই আকাশছোঁয়া বিল্ডিংয়ের সুইমিং পুলে যে লোকটাকে আমি হাত-পা নাড়তে দেখেছিলাম, সে কিন্তু কিছু বোঝানোর বা বেচার চেষ্টা করছে না—সে স্রেফ ভাইবে মজেছে, আর আমরা বাকিরা শুধু দেখছি। বেশি কিছু আশা না করে সেই শান্তির ভাবটা শুধু গোগ্রাসে গিলছি।
কৌতূহল সামলাতে না পেরে, ভিডিওটা নিয়ে জিজ্ঞেস করার জন্য সেদিন আমি টিকটকে লোকটাকে একটা মেসেজ পাঠালাম (যেটা সে এখন প্রাইভেট করে দিয়েছে)। তার নাম নাইজেল কাবভিনা, পঁচিশ বছরের এক বারটেন্ডার। সে আমাকে বলল, ‘আমি আসলে রিল্যাক্স করার মধ্যে ছিলাম। সাথে যে গানটা চলছিল, সেটি আমাকে সেই সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যখন বড় হয়ে যাওয়ার চাপ আর দায়িত্ব ছিল না।’
ভাইব জিনিসটা ইন্টারনেটের জন্যই যেন তৈরি হয়েছিল। শুধু যে এটা দেখা যায় বা শোনা যায়, তাই নয়। আসল কারণ হলো, এতে যে কেউ অংশ নিতে পারে। যে কেউ নিজের মতো করে এর একটা সংস্করণ বানিয়ে ফেলতে পারে। এটা কোনো দুর্লভ বা লিমিটেড-এডিশন মাল নয়। এর যত নকল হবে, এর দাম তত কমবে—এমনটাও নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যবহারকারীরা শুধু ভাইব যাপনই করে না, তারা নতুন নতুন ভাইব বানায়ও। যেমন ধরুন, ‘কার্সড’ (Cursed) বা ‘অভিশপ্ত’—এটা হলো একটা ইন্টারনেট ভাইব, যা দিয়ে আমাদের ‘বাড়তে থাকা উদ্বেগ আর অস্বস্তির অনুভূতি’ বোঝানো হয়।
ইদানীংকার ‘ক্রিঞ্জ’ (Cringe) শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এটি হলো আরেকজনের বোকামি দেখে নিজের কাছেই লজ্জা লাগা। বাংলা ভাইবের ভাষা ধার করে যদি বলি, আরেকজনের কাজকে বিরক্তিকর মাত্রায় ‘খ্যাত’ মনে হওয়া।
একসময় টাম্বলার-এ যে ‘এস্থেটিক মুড বোর্ড’ দেখা যেত, টিকটকে এসে সেগুলোই এখন একেকটা গোষ্ঠীর ভাইব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন: ‘কটেজকোর’ (cottagecore)—প্রকৃতির কোলে ফিরে যাওয়ার এক ‘ফিল গুড’ ভঙ্গি; আবার আছে ‘ডার্ক অ্যাকাডেমিয়া’ (dark academia)—স্কটিশ বোর্ডিং স্কুলের আদলে বানানো গথ কালচারের এক নতুন সংস্করণ (ভয় ধরানো দুর্গ, মোটা টুইডের কাপড় ইত্যাদি)।
ব্যবহারকারীরা এই লেবেলগুলোর আদলে তাদের বাস্তব জীবনকে গড়ে তোলে। এই ভাইব তখন ইন্টারনেট থেকে লাফ দিয়ে বাস্তব দুনিয়ায় আসে, আবার সেখান থেকে ফিরেও যায়। পেলি গ্রিয়েটজার নামে গবেষক সেদিন আমাকে বলছিলেন, ‘ভাইবের এই কথাবার্তা আমাদের সবার জন্য এখন প্রায় নিজেদের ভাষার মতো হয়ে যাচ্ছে।’ তবে সাথে একটা লেজুড়ও জুড়ে দিলেন: ‘অবশ্য এই ‘আমরা’টা কারা, তা নিয়ে আমি ঠিক নিশ্চিত নই—হয়তো শুধু তারাই, যারা সারাক্ষণ অনলাইনে পড়ে থাকে।’
এই নতুন ভাষাটাকে আপন করে নেওয়ার মধ্যে নিজেকে কিছুটা আড়ালে রাখার একটা ব্যাপার আছে। টিকটকের ভাষায় বলতে গেলে, আপনি পরিস্থিতির ‘মূল চরিত্র’ নন, বরং একজন বদলিযোগ্য দর্শক মাত্র। অনলাইনের একটা চালু মন্ত্র হলো: ‘নো থটস, জাস্ট ভাইব্স’ (কোনো চিন্তা নয়, শুধু ভাইব)। আর লাগাতার টেনশনে ভরা সময় কাটানোর পর এই কথাটা শুনতে বেশ ভালোই লাগে।
মেরি রেটা নামে এক লেখক সম্প্রতি বলেছেন, কোয়ারেন্টাইনের পুরো সময়টা তিনি নাকি ‘ভাইব’ করেই কাটিয়েছেন: ‘কিছুই করছি না, আবার একেবারে কিছুই করছি না, তাও নয়; কোনো রুটিন মানছি না, ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি না, কিন্তু তবুও কোনো না কোনোভাবে দিনগুলোকে একটা উদ্দেশ্য দিয়ে ভরিয়ে তুলছি।’
ভাইব হতে পারে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার একটা উপায়, শান্তি খোঁজার একরকম আত্মরক্ষামূলক চেষ্টা। রেটা লিখেছেন, ‘ভাইব করা মানে হলো, সময়কে কেটেছেটে আনন্দের ছাঁচে ফেলা।’
এই যে ধরুন, আমি যখন ‘মন্টানার এক কেবিনে থাকা ভেষজবিদ ও রাঁধুনি’র সকালবেলার রুটিনের টিকটক দেখি, তখন আমি ডিসেম্বরের রোদ, সিরামিকের মগে কফি, লম্বা পাইন বন—এই সবকিছুর মেজাজ গোগ্রাসে গিলি। সাথে আবার চলছে সুফিযান স্টিভেন্সের একটা ঢিমেতালের গান। সব মিলিয়ে বেশ একটা ‘কেতাদুরস্ত বনবাসী’ ভাইব আরকি।
এই রকম গোটা দশেক ভিডিও একনাগাড়ে দেখার পর, আমি যখন ফোন থেকে মুখ তুলি, দেখি আমার নিজের ফ্ল্যাটটাও যেন ওই একই রকম মনোযোগের আলোয় ঝলমল করছে; যেন আমি ওটাকেও একটা মন্টাজের মধ্য দিয়েই দেখছি। আমার চারপাশের জিনিসগুলোও যেন এক অদ্ভুত আলোয় জ্বলজ্বল করতে থাকে, সবকিছুর মধ্যেই যেন এক একটা গভীর মানে লুকিয়ে আছে।
আমিও তখন আমার নিজের হোম অফিসের ভাইবটা উপভোগ করতে পারি: জবা ফুলের গাছ, কাঠের ডেস্ক, নয়েজ ক্যান্সেলিং হেডফোন, ষাটের দশকের জ্যাজ, আর কফির কাপ।
হঠাৎ করেই জায়গাটাকে আরও বেশি নিজের মনে হতে লাগল। যেন এই জায়গাটা নতুন করে আমার কাছে ধরা দিয়েছে। অথবা আমি ওই গোটা ভাইবেরই একটা অংশ হিসেবে এর মধ্যে নিজের জায়গা খুঁজে পেয়েছি, নিজের ভূমিকাটা পালন করছি।
ভাইব তো আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, শুধু তুলে নেওয়ার অপেক্ষা। এর জন্য আপনাকে কবি বা দার্শনিক হতে হবে না, এমনকি অনলাইনে কিছু পোস্ট করারও দরকার নেই।
আপনার শুধু দেখার চোখ থাকতে হবে।
* দ্য নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত কাইল চাইকার টিকটক এন্ড ভাইবস রিভাইভাল লেখাটির সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত তর্জমা। পপ স্ট্রিমের জন্য তর্জমা করেছেন কৌরিত্র পোদ্দার তীর্থ।
সেদিনও বিকেলটা কেটে যাচ্ছিল টিকটকের অতল গহ্বরে। জানেন তো, ওই যে যখন স্ক্রল করতে করতে দুনিয়ার আর কোনো হুঁশ থাকে না, মগজটা যেন অন্য কারও কাছে বন্ধক রাখা। ঠিক তখনই চোখে পড়ল একটা ভিডিও। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরের কোনো এক বিল্ডিংয়ের ভেতরের দৃশ্য।
বিল্ডিংয়ের অনেক উঁচুতে, কাচের বিশাল জানালার বাইরেটা কুয়াশায় ঢাকা। আর ভেতরে ঝা চকচকে এক সুইমিং পুলে এক লোক চিৎ হয়ে ভাসছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে ফ্র্যাঙ্ক ওশানের গান ‘হোয়াইট ফেরারি’। দশ সেকেন্ডের ভিডিও। হ্যাশট্যাগ? #vibin
পরের ক্লিপে আরেক কাণ্ড। এক নারী তার সকাল বেলার রুটিন দেখাচ্ছেন। কী নেই সেখানে! লিনেনের এলোমেলো বিছানার চাদর, গাঢ় নীল রঙের সাটিন পাজামা, আর ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা। সাথে টুকিটাকি আরও জিনিস: একটা মনস্টেরা গাছ, এক টুকরো আধপোড়া সুগন্ধী কাঠ, আর জানালার বাইরে ব্যস্ত রাস্তা। সব মিলিয়ে কেমন একটা শান্ত, সাজানো-গোছানো কর্মব্যস্ততার ভাব। এটার হ্যাশট্যাগ ছিল #vibes।
আরেকটা মন্তাজের ক্যাপশন: ‘এখানকার রাতের ভাইবস আমার দারুণ লাগে’। ভেতরে কী? আবছা আলোয় একটা ফ্ল্যাট, যেখানে গোলাপি নিওন সাইনে লেখা ‘Where Love Lives’। একটা শিবা ইনু কুকুর উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পিকাসোর আর্টের বইয়ের ওপর রাখা একটা গোল ল্যাম্প, আর দেয়ালে ঝোলানো টিভিতে চলছে ইউটিউবের সেই বিখ্যাত চ্যানেল—‘lofi hip hop radio - beats to relax/study to’।
এই যে আপাতদৃষ্টিতে জীবনের ‘সাধারণ’ কিছু মুহূর্ত, সেগুলোকে ছোট ছোট ভিডিওর মধ্যে ঠেসে দেওয়া—এটাই এখন টিকটকের মূল কারবার। অ্যালগরিদমের কল্যাণে আমার ফিডটা তো এখন এসব জিনিসেই সয়লাব। অন্যদের কপালে হয়তো নাচের ভিডিও বা ফাজলামি জোটে, কিন্তু আমার জন্য বরাদ্দ শুধুই এই ‘চিল ভাইবস’।
মাঝসমুদ্রে দুলতে থাকা পালতোলা নৌকায় ক্যাজুয়ালি রান্না করা? সেটাও নাকি একটা ‘ভাইব’। আবার ধরুন, ন্যাথান অ্যাপোডাকার সেই বিখ্যাত টিকটক—ফ্লিটউড ম্যাক-এর ‘ড্রিমস’ গানটা শুনতে শুনতে স্কেটবোর্ডে চেপে রাস্তায় এঁকেবেঁকে যাওয়া, আর সাথে ক্র্যানবেরি জুসের বোতলে চুমুক দেওয়া... সেটাও একটা জব্বর ‘ভাইব’।
‘ভাইব’ শব্দটার মানে কী, তা আমরা মোটামুটি সবাই-ই জানি, তাই না? এটা আসলে একটা আবছা গুণের নাম। একটা পরিবেশ... ধরুন, ‘একটা আয়েশি মেজাজ’। এই কারণেই তো আমরা কাউকে বা কোনো কিছুকে পছন্দ বা অপছন্দ করি (গুড ভাইবস বনাম ব্যাড ভাইবস)। ভাইব হলো মন-থেকে-আসা সেই অনুভূতিটা, যার কোনো পোশাকি ব্যাখ্যা নেই (‘কী জানি কেন, একটা ভাইব পেলাম আরকি’)।
বেশিরভাগ ভাইবের কোনো কেতাবি নাম-ধাম নেই, তবে কয়েকটার আবার আছে। যেমন, পর্তুগিজ শব্দ ‘সওদাদে’ (Saudade), যার মানে হলো এক ধরনের মিষ্টি বেদনার অনুভূতি। এটাকে একটা ভাইব বলা যেতে পারে। কিংবা জাপানি শব্দ ‘ইকি’ (iki)—এক ধরনের উদাসীন কিন্তু অভিজাত ভঙ্গি। আবার ধরুন জার্মান ‘ফার্নভে’ (fernweh), মানে দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, যা হয়তো অচেনা জঙ্গল বা দূরের কোনো দৃশ্য দেখলে মনে জাগে।
তবে সোশ্যাল মিডিয়ার এই জমানায় ‘ভাইব’ শব্দটা আরও গভীর অর্থ নিয়ে হাজির হয়েছে। ইউএনসি, শার্লটের দর্শনের অধ্যাপক রবিন জেমস ব্যাপারটাকে বলেছেন, মানুষ আর তার পরিবেশের মধ্যে একটা ‘সহানুভূতিশীল অনুরণন’।
ভাষার জগতে হাইকু যা, আমাদের ইন্দ্রিয়ের জগতে ভাইব-ও ঠিক তাই: ছবি, শব্দ আর নড়াচড়ার এক ছোট্ট, জমাট প্যাকেজ। (মাঝে মাঝে #Aesthetic হ্যাশট্যাগ দিয়েও ভাইব বোঝানো হয়, কিন্তু ওটা মূলত চোখে দেখার বিষয়।) একটা ভাইব ভালো হতে পারে, খারাপ হতে পারে, সুন্দর, কুৎসিত, বা একেবারে খ্যাপাটে গোছের হতে পারে। এটা এমনকি নিজেই একটা গুণে পরিণত হতে পারে: কোনো জিনিস যদি ‘ভাইবি’ (vibey) হয়, তার মানে হলো সেটা থেকে মানুষ তীব্র ভাইব পাচ্ছে বা সেটা ভাইব লেনদেনের জন্য একেবারে আদর্শ জায়গা।
আসলে ভাইব হলো অনুভূতি প্রকাশের একটা মাধ্যম; কোনো অভিজ্ঞতার নাম দেওয়ার আগে যে আবছা অনুভূতিটা হয়, ঠিক সেটাই। আর ঠিক এ কারণেই এটি সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য একেবারে খাপে খাপ। কারণ এই দুনিয়ায় তো লেখার চেয়ে অডিও, ভিডিও আর ছবিকেই বেশি পাত্তা দেওয়া হয়। তাই কষ্ট করে আর কোনো কিছুর শব্দ (টেক্সট) খুঁজে বের করতে হয় না। আপনার কাজ ভাইবটাকে বলা নয়, বোঝানো।
এই ‘ভাইব’ শব্দটা এসেছে ‘ভাইব্রেশন’ (vibration) বা কম্পন থেকে—এমন কিছু যা অনুরণিত হয়, প্রতিধ্বনিত হয় আর একটা জায়গাকে ভরিয়ে তোলে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, শব্দটা ভাইব্রাফোন নামের এক বাদ্যযন্ত্রের সাথে জুড়ে গেল। এটা হলো ম্যারিম্বার এক জ্ঞাতি ভাই, যার বারের নিচে মোটরচালিত পাখা লাগানো থাকে আরও ‘ভাইবি’ আওয়াজ তৈরি করার জন্য। যখন এটা প্রথম বানানো হয়, মানে ওই ১৯২০-এর দশকে, শিল্পীরা ঠিক নিশ্চিত ছিলেন না যে এর ডাকনাম একবচন হবে নাকি বহুবচন—‘ভাইব’ নাকি ‘ভাইবস’। শেষমেশ দ্বিতীয়টাই টিকে গেল।
আজকাল এই বাজনার আওয়াজ শুনলেই একগাদা জিনিস মাথায় চলে আসে: ট্রপিকালিয়া মিউজিক, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে হাওয়াই নিয়ে মাতামাতি, একটা লোকদেখানো আধুনিকতা।
তবে স্ল্যাং হিসেবে ‘ভাইব’ শব্দটার চল শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে, ক্যালিফোর্নিয়ায়। তখন এর মানে ছিল কোনো কিছুর আবেশ বা অনুভূতি। তখন এই শব্দটি হিপি কালচারের সঙ্গে জুড়ে যায়। সে সময় বার্কলি বার্ব বলে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা ছিল। ১৯৬৫ সাল থেকে তারাই দেদারসে এই শব্দের ব্যবহার শুরু করে। তার ঠিক তার পরেই তো ‘বিচ বয়েজ’ তাদের বিখ্যাত গান ‘গুড ভাইব্রেশনস’ নিয়ে হাজির হলো। এই একটা গানেই শব্দটা আমজনতার কানে পৌঁছে গেল।
বিবি ভেইন নামে এক লেখিকা তার বইয়ে ভাইবসকে বলেছিলেন ‘আত্মার স্পর্শ’। বইটা ছিল আমেরিকার বিদ্রোহী তরুণদের নিয়ে, সালটা ১৯৭০।
কিন্তু যা হয় আরকি, কিছুদিন যেতে না যেতেই শব্দটাকে যে কোনো কিছুর সাথেই জুড়ে দেওয়া শুরু হলো। ১৯৭৩ সাল নাগাদ ‘কালচারর্স’ নামের এক জার্নাল তো লিখেই বসল যে, ‘এক ঘর মানুষ, একটা শহর, এমনকি একটা রাজনৈতিক প্রচারণারও নিজস্ব ভাইব্রেশন থাকে’।
সংস্কৃতির জগতে নতুন যা কিছুই আসে, সাধারণ মানুষ যখন সেটাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু করে, তখন তার ধার কমে যায়। (‘ভাইবস’ শব্দটা ‘আমার কাছে কোনো মানেই রাখে না’, ১৯৭৬ সালে পারফর্মিং আর্টস জার্নালে কোরিওগ্রাফার ত্রিশা ব্রাউন এভাবেই বলেছিলেন।)
আজকাল আমরা হয়তো প্রায়ই ‘এইটিজের ভাইব’-এর কথা বলি—ভাবলেই চোখে ভাসে চকচকে কাপড়, ফোলানো চুল আর ধোঁয়ার মেশিন। কিন্তু সত্যি বলতে, আশি বা নব্বইয়ের দশকে মানুষ ভাইব নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাত না। সম্ভবত ওই দশকগুলো ছিল বড্ড বেশি কঠিন, বড্ড বেশি টাকা-পয়সার পেছনে ছোটার দশক। তাই বোধহয় ভাইব-টাইব বোঝার মতো মন-মানসিকতা তখন ছিল না। (১৯৯৩ সালে ‘ভাইব’ নামের যে ম্যাগাজিনটা বের হলো, সেটাও হিপ-হপ সংস্কৃতিকে একটা পণ্য হিসেবেই তুলে ধরেছিল।)
কিন্তু ওই সময়েই আবার ভাইব হয়ে উঠল দার্শনিক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৯৩ সালে, ‘থিসিস ইলেভেন’ জার্নালের এক প্রবন্ধে, জার্মান দার্শনিক গেরনট বোমে ‘অ্যাটমোস্ফিয়ার’ বা আবহকে উপলব্ধির এক নতুন নান্দনিকতার ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই যে একটা সার্বিক অনুভূতি, এর সাথে ভাইবের কিন্তু বেশ মিল আছে।
এর আগে হাইডেগার পৃথিবীতে থাকার অনুভূতি বোঝাতে ‘মুড’ (mood) শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, আর ওয়াল্টার বেনইয়ামিন বলেছিলেন ‘অরা’ (aura)-র কথা, যা কোনো অনন্য শিল্পকর্মের (যেমন ধরুন, একটি পেইন্টিং) সান্নিধ্যে গেলে হয়। কিন্তু বোমে দেখলেন, এর চেয়েও অনেক সাধারণ জিনিস—যেমন কসমেটিকস, বিজ্ঞাপন, ঘরের সাজসজ্জা—এদেরও নিজস্ব এক ধরনের আবহ আছে, যা দিয়ে তৈরি হয় ‘দৈনন্দিন জীবনের নান্দনিকতা’।
একবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেন বেনেটের সাথেও ঘটেছিল প্রায় একই রকম কাণ্ড। রৌদ্রোজ্জ্বল এক সকালে নর্দমায় পড়ে থাকা একগাদা ময়লার দিকে তাকিয়ে নাকি তার দিব্যজ্ঞান লাভ হয়েছিল। তার ২০১০ সালের বই ভাইব্র্যান্ট ম্যাটার: আ পলিটিকাল ইকলজি অব থিংস -এ তিনি এই অভিজ্ঞতার কথা ফলাও করে লিখেছেন।
ফেলে দেওয়া জিনিসগুলোর মধ্যে হঠাৎ করেই যেন প্রাণের সঞ্চার হলো। তিনি লিখেছেন: ‘দস্তানাটা, ইঁদুরটা, ফুলের রেণু, বোতলের ছিপি, আর লাঠিটা, সব যেন ঝিকমিক করে উঠল, স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে লাগল। সেই রাস্তা, সেই সকালের আবহাওয়া আর আমি—সব মিলেমিশে যেন এক দৃশ্যের জন্ম হলো।’
বেনেটের মতে, পুঁজিবাদ আমাদের শেখায় এই ধরনের ভাইবকে পাত্তা না দিতে। কেননা একটা ভোগবাদী সমাজ, যেখানে জিনিসপত্র ক্রমাগত ফেলে দেওয়া হয় আর নতুন কেনা হয়, সেখানে বস্তুর প্রাণশক্তিকে সবসময় আড়াল করা হয়। বেনেটের ওই প্রাণবন্ত ময়লার গাদা না হয় পুঁজিবাদের ঘোর শত্রু, কিন্তু ইনস্টাগ্রামের এই সাজানো-গোছানো ভিডিওগুলো অন্তত কিছু-না-কিছু বিক্রি করার ধান্দায়ই করা হয়। হয়তো সরাসরি কোনো পণ্য নয়, কিন্তু যে ইনফ্লুয়েন্সার পোস্ট দিচ্ছে, তার নিজের ‘ব্র্যান্ড’ তো বটেই। রবিন জেমস এই ব্যাপারটার একটা যুতসই নামও দিয়েছেন: ‘ভাইব-ক্যাপিটালিজম’।
কোনো পণ্য বা কোম্পানির সাথে যদি একটা ভাইবকে শক্ত করে জুড়ে দেওয়া যায়, তাহলে সেটা হয়ে ওঠে একটা চলমান বিজ্ঞাপন, যা মানুষের রুচি অনুযায়ী কাউকে কাছে টানে, আবার কাউকে দূরে ঠেলে দেয়। টেসলা গাড়ির কথা একবার ভাবুন। এর সাথে জড়িয়ে থাকা উদ্দাম টেকনো-পৌরুষের ভাইবের কথা কি মাথায় আসছে না?
ইনস্টাগ্রামের মূল কারবার যেখানে একটা সাজানো-গোছানো ছবি, মানে একটামাত্র স্থির ছবি বা কোনো কাটাছেঁড়া-না-করা ভিডিও, টিকটকের কারবার হলো বাস্তব দুনিয়া থেকে তুলে আনা টুকরো-টাকরা মুহূর্ত, যেগুলোকে সিনেমার মতো মন্তাজ বানিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়। (যদিও ইনস্টাগ্রামও কম যায় না, তারাও কয়েক বছর আগে এর সাথে পাল্লা দেওয়ার ধান্দায় ‘রিলস’ নামের ফিচার এনেছে।)
টিকটকের প্রযুক্তিটা এমন যে ভিডিও ক্লিপ কেটেকুটে তার সাথে একটা জুতসই জনপ্রিয় গান জুড়ে দেওয়াটা কোনো ব্যাপারই না: ব্যস, হয়ে গেল ইনস্ট্যান্ট ভাইব। টিকটকের ‘ফর ইউ’ ফিডটা আবার প্রত্যেক ব্যবহারকারীর পছন্দসই কনটেন্ট এনে দেয়। ফলাফল? এমন একটা প্ল্যাটফর্মছোট ছোট মুহূর্তের ওপর, আলাদা আলাদা অনুভূতির অগভীর ঝলকানির ওপর যা চলে।
অ্যামস্টারডামের ডিজাইন সংস্থা, মেটাহেভেনের প্রতিষ্ঠাতা ভিনকা ক্রুক আর ড্যানিয়েল ভ্যান ডার ভেলডেন আমাকে বলছিলেন, ‘মানুষ আস্ত একটা গল্প চায়—টিকটক এসে এই কথাটার মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে।’ ম্যানচেস্টারের সেই আকাশছোঁয়া বিল্ডিংয়ের সুইমিং পুলে যে লোকটাকে আমি হাত-পা নাড়তে দেখেছিলাম, সে কিন্তু কিছু বোঝানোর বা বেচার চেষ্টা করছে না—সে স্রেফ ভাইবে মজেছে, আর আমরা বাকিরা শুধু দেখছি। বেশি কিছু আশা না করে সেই শান্তির ভাবটা শুধু গোগ্রাসে গিলছি।
কৌতূহল সামলাতে না পেরে, ভিডিওটা নিয়ে জিজ্ঞেস করার জন্য সেদিন আমি টিকটকে লোকটাকে একটা মেসেজ পাঠালাম (যেটা সে এখন প্রাইভেট করে দিয়েছে)। তার নাম নাইজেল কাবভিনা, পঁচিশ বছরের এক বারটেন্ডার। সে আমাকে বলল, ‘আমি আসলে রিল্যাক্স করার মধ্যে ছিলাম। সাথে যে গানটা চলছিল, সেটি আমাকে সেই সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যখন বড় হয়ে যাওয়ার চাপ আর দায়িত্ব ছিল না।’
ভাইব জিনিসটা ইন্টারনেটের জন্যই যেন তৈরি হয়েছিল। শুধু যে এটা দেখা যায় বা শোনা যায়, তাই নয়। আসল কারণ হলো, এতে যে কেউ অংশ নিতে পারে। যে কেউ নিজের মতো করে এর একটা সংস্করণ বানিয়ে ফেলতে পারে। এটা কোনো দুর্লভ বা লিমিটেড-এডিশন মাল নয়। এর যত নকল হবে, এর দাম তত কমবে—এমনটাও নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যবহারকারীরা শুধু ভাইব যাপনই করে না, তারা নতুন নতুন ভাইব বানায়ও। যেমন ধরুন, ‘কার্সড’ (Cursed) বা ‘অভিশপ্ত’—এটা হলো একটা ইন্টারনেট ভাইব, যা দিয়ে আমাদের ‘বাড়তে থাকা উদ্বেগ আর অস্বস্তির অনুভূতি’ বোঝানো হয়।
ইদানীংকার ‘ক্রিঞ্জ’ (Cringe) শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এটি হলো আরেকজনের বোকামি দেখে নিজের কাছেই লজ্জা লাগা। বাংলা ভাইবের ভাষা ধার করে যদি বলি, আরেকজনের কাজকে বিরক্তিকর মাত্রায় ‘খ্যাত’ মনে হওয়া।
একসময় টাম্বলার-এ যে ‘এস্থেটিক মুড বোর্ড’ দেখা যেত, টিকটকে এসে সেগুলোই এখন একেকটা গোষ্ঠীর ভাইব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন: ‘কটেজকোর’ (cottagecore)—প্রকৃতির কোলে ফিরে যাওয়ার এক ‘ফিল গুড’ ভঙ্গি; আবার আছে ‘ডার্ক অ্যাকাডেমিয়া’ (dark academia)—স্কটিশ বোর্ডিং স্কুলের আদলে বানানো গথ কালচারের এক নতুন সংস্করণ (ভয় ধরানো দুর্গ, মোটা টুইডের কাপড় ইত্যাদি)।
ব্যবহারকারীরা এই লেবেলগুলোর আদলে তাদের বাস্তব জীবনকে গড়ে তোলে। এই ভাইব তখন ইন্টারনেট থেকে লাফ দিয়ে বাস্তব দুনিয়ায় আসে, আবার সেখান থেকে ফিরেও যায়। পেলি গ্রিয়েটজার নামে গবেষক সেদিন আমাকে বলছিলেন, ‘ভাইবের এই কথাবার্তা আমাদের সবার জন্য এখন প্রায় নিজেদের ভাষার মতো হয়ে যাচ্ছে।’ তবে সাথে একটা লেজুড়ও জুড়ে দিলেন: ‘অবশ্য এই ‘আমরা’টা কারা, তা নিয়ে আমি ঠিক নিশ্চিত নই—হয়তো শুধু তারাই, যারা সারাক্ষণ অনলাইনে পড়ে থাকে।’
এই নতুন ভাষাটাকে আপন করে নেওয়ার মধ্যে নিজেকে কিছুটা আড়ালে রাখার একটা ব্যাপার আছে। টিকটকের ভাষায় বলতে গেলে, আপনি পরিস্থিতির ‘মূল চরিত্র’ নন, বরং একজন বদলিযোগ্য দর্শক মাত্র। অনলাইনের একটা চালু মন্ত্র হলো: ‘নো থটস, জাস্ট ভাইব্স’ (কোনো চিন্তা নয়, শুধু ভাইব)। আর লাগাতার টেনশনে ভরা সময় কাটানোর পর এই কথাটা শুনতে বেশ ভালোই লাগে।
মেরি রেটা নামে এক লেখক সম্প্রতি বলেছেন, কোয়ারেন্টাইনের পুরো সময়টা তিনি নাকি ‘ভাইব’ করেই কাটিয়েছেন: ‘কিছুই করছি না, আবার একেবারে কিছুই করছি না, তাও নয়; কোনো রুটিন মানছি না, ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি না, কিন্তু তবুও কোনো না কোনোভাবে দিনগুলোকে একটা উদ্দেশ্য দিয়ে ভরিয়ে তুলছি।’
ভাইব হতে পারে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার একটা উপায়, শান্তি খোঁজার একরকম আত্মরক্ষামূলক চেষ্টা। রেটা লিখেছেন, ‘ভাইব করা মানে হলো, সময়কে কেটেছেটে আনন্দের ছাঁচে ফেলা।’
এই যে ধরুন, আমি যখন ‘মন্টানার এক কেবিনে থাকা ভেষজবিদ ও রাঁধুনি’র সকালবেলার রুটিনের টিকটক দেখি, তখন আমি ডিসেম্বরের রোদ, সিরামিকের মগে কফি, লম্বা পাইন বন—এই সবকিছুর মেজাজ গোগ্রাসে গিলি। সাথে আবার চলছে সুফিযান স্টিভেন্সের একটা ঢিমেতালের গান। সব মিলিয়ে বেশ একটা ‘কেতাদুরস্ত বনবাসী’ ভাইব আরকি।
এই রকম গোটা দশেক ভিডিও একনাগাড়ে দেখার পর, আমি যখন ফোন থেকে মুখ তুলি, দেখি আমার নিজের ফ্ল্যাটটাও যেন ওই একই রকম মনোযোগের আলোয় ঝলমল করছে; যেন আমি ওটাকেও একটা মন্টাজের মধ্য দিয়েই দেখছি। আমার চারপাশের জিনিসগুলোও যেন এক অদ্ভুত আলোয় জ্বলজ্বল করতে থাকে, সবকিছুর মধ্যেই যেন এক একটা গভীর মানে লুকিয়ে আছে।
আমিও তখন আমার নিজের হোম অফিসের ভাইবটা উপভোগ করতে পারি: জবা ফুলের গাছ, কাঠের ডেস্ক, নয়েজ ক্যান্সেলিং হেডফোন, ষাটের দশকের জ্যাজ, আর কফির কাপ।
হঠাৎ করেই জায়গাটাকে আরও বেশি নিজের মনে হতে লাগল। যেন এই জায়গাটা নতুন করে আমার কাছে ধরা দিয়েছে। অথবা আমি ওই গোটা ভাইবেরই একটা অংশ হিসেবে এর মধ্যে নিজের জায়গা খুঁজে পেয়েছি, নিজের ভূমিকাটা পালন করছি।
ভাইব তো আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, শুধু তুলে নেওয়ার অপেক্ষা। এর জন্য আপনাকে কবি বা দার্শনিক হতে হবে না, এমনকি অনলাইনে কিছু পোস্ট করারও দরকার নেই।
আপনার শুধু দেখার চোখ থাকতে হবে।
* দ্য নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত কাইল চাইকার টিকটক এন্ড ভাইবস রিভাইভাল লেখাটির সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত তর্জমা। পপ স্ট্রিমের জন্য তর্জমা করেছেন কৌরিত্র পোদ্দার তীর্থ।
ডায়ান কিটন কেবলই অভিনেত্রী ছিলেন না, ছিলেন এক সাংস্কৃতিক বিস্ময়; সারল্য ও অকৃত্রিমতার আইকন, হাতের ইশারা ও নিখুঁত তোতলামিতে গভীর, হাস্যকর ও হৃদয়বিদারক সত্যি তুলে ধরার এক অনন্য শিল্পী। লা-দি-দা-খ্যাত এই শিল্পীর প্রতি পপস্ট্রিমের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
২ দিন আগেএকটা ছবি বড়জোর কিই-বা করতে পারে? একটা ছবি হয়তো অনেক কিছুই করতে পারে। কিন্তু কেউই হয়তো বলবেন না, একটি ছবি পুঁজিবাদ বিরোধী শহীদকে বানিয়ে দিতে পারে পুঁজি বাজারের ফ্যাশন আইকন।
৫ দিন আগেঢালিউডের প্রথম মেগাস্টার, নায়ক জসিমের ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। এক সময়ের এ্যাকশন সুপারস্টার জসিমের লিগেসি কেমন? কিভাবে জসিমের সিনেমা দেখতেছে তরুণ প্রজন্ম? জসিম কিভাবে হয়ে উঠছে মিম ম্যাটেরিয়ালের উৎস?
৬ দিন আগেএতকাল জানতাম জগতের তিনভাগ জল আর একভাগ স্থল। কমোডে বসে ফেসবুক স্ক্রোল করে নতুন জ্ঞানপ্রাপ্তি ঘটল। জানলাম এর মধ্যে জল-স্থলের বাইরে আছে শাহবাগী, জামাতি, এমনকি শাপলাবাগীও। খুঁজেপেতে দেখলাম কোথাও দেওয়ানবাগী কেউ আছেন কি না!
৮ দিন আগে