leadT1ad

দক্ষিণ এশিয়ায় ছাত্রনেতা থেকে জাতীয় নেতা হয়েছিলেন যাঁরা

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম গ্রাফিক

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ছাত্র সংগঠনগুলোর গুরুত্ব অনেক প্রাচীন। ১৮৮৫ সালে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ শুরু হয়।

১৯০৬ সালে মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার জন্য মুসলিম লীগ গঠিত হলে, তারা জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্রদের সম্পৃক্ত করতে চায়। ১৯৩২ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ‘অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লিগ’ (নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ) গঠন হয়, যা উপমহাদেশের প্রথম জাতীয় রাজনীতিভিত্তিক ছাত্র সংগঠন।

এর প্রভাবেই ১৯৩৬ সালে কংগ্রেসপন্থী হিন্দু ছাত্ররা ‘স্টুডেন্ট ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া’ গঠন করে।

অন্যদিকে, নেপালে ১৯৪৭ সালে ‘অল নেপাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ ও শ্রীলঙ্কায় ১৯৪২ সালে ‘সিলন ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস’ ইউনিয়ন গড়ে ওঠে, যা ওই দেশের রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সূচনা করে।

এই সব ছাত্র সংগঠন রাজনীতির মূল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে, যার মাধ্যমে অনেক ছাত্র ভবিষ্যতে জাতীয় নেতার আসনে পৌঁছায় এবং দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখে।

উপমহাদেশের এরকম ব্যক্তিত্ত্বের কথা নিয়ে এই লেখা।

শ্রীলঙ্কা

শ্রীলঙ্কার ছাত্র রাজনীতি মূলত শক্তিশালী বামপন্থী ও মার্কসবাদী ধারায় বিকশিত হয়েছে। দেশটির রাজনীতিতে জাতিগত সমস্যা এবং সামাজিক বঞ্চনা কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখায় ছাত্ররা নানা সময়ে সশস্ত্র এবং সামাজিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলা হয়েছে।

মাহিন্দা রাজাপকসে: জন্ম ১৯৪৫। কলম্বোর ল’ কলেজে পড়াশোনার সময় থেকে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। গ্রামীণভিত্তিক জনপ্রিয়তা এবং দৃঢ় প্রশাসনিক দক্ষতা তাকে শ্রীলঙ্কার জাতীয় নেতৃত্বের মঞ্চে আলাদা পরিচয় দেয়। তামিল বিদ্রোহ দমনে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে জনতুষ্টিবাদি বলয়ে প্রবেশ করেন। দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

অনুরা কুমারা দিশানায়েকে। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া
অনুরা কুমারা দিশানায়েকে। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

অনুরা কুমারা দিশানায়েকে: জন্ম ১৯৬৮। ১৯৭১ সালের প্রথম জেভিপি বিদ্রোহের পর তিনি ১৯৮৮ সালে দ্বিতীয় মার্কসবাদী বিদ্রোহের সময় সশস্ত্র ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই কারণে তাদের সংগঠন নিষিদ্ধ হয় এবং দিশানায়েকে আত্মগোপনে চলে যান। তবে ২০১৪ সালে জেভিপির নেতা হিসেবে দলে পুনর্জাগরণ ঘটান এবং অতীতের ভুলগুলো মেনে নিয়ে জনগণের আস্থা ফিরে পান। ২০২৪ সালের নির্বাচনে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি। ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে সংগ্রামী জীবন তার রাজনৈতিক পরিচয়কে সমৃদ্ধ করেছে।

নেপালের ছাত্ররাজনীতি: সংগ্রাম থেকে নেতৃত্বের পথ

নেপালের ছাত্ররাজনীতি মূলত গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়ের জন্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। এখানে ছাত্ররা দেশের শাসনব্যবস্থার প্রতি সক্রিয় প্রতিবাদী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়েছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে নারীর ক্ষমতায়ন এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে ছাত্ররাজনীতি জাতীয় রাজনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে।

বিদ্যা দেবি ভান্ডারি। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া
বিদ্যা দেবি ভান্ডারি। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

বিদ্যা দেবি ভান্ডারি: ১৯৬১ সালে জন্ম। বিদ্যা দেবি ভান্ডারি ছাত্রজীবন থেকে বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে রাজনীতির শুরু করেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও নারীর অধিকার রক্ষায় তার অবদান অসাধারণ। তার নেতৃত্বগুণ, নারীর ক্ষমতায়ন ও জাতীয় রাজনীতিতে দৃঢ় অবস্থান তাকে নেপাল ও দক্ষিণ এশিয়ার একজন প্রভাবশালী নারী নেতা হিসেবে গড়ে তোলে। ২০১৫ সালে তিনি নেপালের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি হন।

রাম চন্দ্র পাউডেল: ১৯৪৪ সালে জন্ম নেওয়া পাউডেল ১৬ বছর বয়সে নেপালি কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনে যোগ দিয়ে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন এবং একাধিকবার কারাবরণ করেন। তার সাহসী নেতৃত্ব, মানবাধিকারের প্রতি দৃঢ় আস্থা ও শান্ত প্রকৃতি তাকে জাতীয় রাজনীতির স্থায়ী ও সম্মানিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রার পর ২০২৩ সাল থেকে তিনি নেপালের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

পাকিস্তানের ছাত্ররাজনীতি: ন্যায়বিচার ও অধিকার সংগ্রামের সুর

পাকিস্তানে ছাত্ররাজনীতি মূলত মানবাধিকার ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে বেলুচিস্তান অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় দমননীতি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্র এবং তরুণ প্রজন্মের প্রতিবাদী স্বর হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলের রাজনীতিতে মানবাধিকার রক্ষা, স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা মূল চ্যালেঞ্জ।

মাহরাঙ্গ বেলুচ। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া
মাহরাঙ্গ বেলুচ। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

মাহরাঙ্গ বেলুচ: ১৯৯৩ সালে বেলুচিস্তানে জন্ম নেওয়া মাহরাঙ্গ বেলুচ একজন সাহসী মানবাধিকারকর্মী ও বেলুচ জাতীয়তাবাদী নেতা। নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে কণ্ঠস্বর দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে দাবিসমূহ তুলে ধরাই তাঁর সংগ্রামের মূল শক্তি। তাঁর দৃঢ় মনোভাব, ত্যাগ ও সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা তাকে বেলুচ আন্দোলনের অন্যতম অনুপ্রেরণার প্রতীক বানিয়েছে। ২০২৪ সালে টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় তিনি স্থান পান। ২০২৫ সালে কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময় বেলুচ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। একই বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন।

ভারত

ভারতের ছাত্র রাজনীতি এক ঐতিহাসিক আন্দোলনধর্মী ধারা, যা উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম থেকে শুরু করে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ইস্যুতে ছাত্ররা আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় প্রভাব রেখেছে। জেএনইউ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এসব আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আজও ছাত্রনেতারা জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করছেন।

কানহাইয়া কুমার। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া
কানহাইয়া কুমার। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

কানহাইয়া কুমার: জন্ম ১৯৮৭। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) ছাত্র সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে তিনি আলোচনায় আসেন। ২০১৬ সালে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিনি জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত হন এবং ছাত্র-যুব আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হন। ২০১৯ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে বেগুসরাই থেকে নির্বাচন করেছিলেন। পরাজিত হন।

ঐশী ঘোষ: জন্ম ১৯৯৫। ২০১৯ সালে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ভারতীয় জনতা পার্টির তীব্র সমালোচনা করার পর পর ৫ জানুয়ারি ২০২০ সালে ঘোষকে ক্যাম্পাসে আক্রমণ করে এবং মাথায় আঘাত পান তিনি। ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে জামুরিয়া (বিধানসভা কেন্দ্র) থেকে সিপিআই (এম) প্রার্থী ছিলেন ঐশী ঘোষ।

মমতা ব্যানার্জি: জন্ম ১৯৫৫। ব্যানার্জি মাত্র ১৫ বছর বয়সেই রাজনীতিতে যোগ দেন। জগমায়া দেবি কলেজে পড়ার সময় ছাত্র পরিষদে যোগ দেন। এটি ছিল কংগ্রেসের স্টুডেন্ট উইং। পরে ১৯৭০-এ তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৯৭ সালে মমতা ব্যানার্জি ‍মুকুল রায়ের সঙ্গে মিলে অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করে। ২০১১ সাল থেকে তিনিই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

বাংলাদেশ

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি মূলত ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতীয় ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে উঠেছে। এখানকার ছাত্ররা প্রতিটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের আগুন জ্বালিয়েছে—১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ বা ২০২৪-এর গনভ্যুত্থান—সব ক্ষেত্রেই ছাত্র রাজনীতি ছিল নেতৃত্বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাস প্রগতিশীল, বিপ্লবী এবং কখনো কখনো দলীয় রাজনীতির ঘাঁটি হিসেবে কাজ করেছে। বর্তমানেও ছাত্র আন্দোলন থেকে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন ও নেতৃত্ব উঠে আসছে, যারা সামাজিক ন্যায়, গণতন্ত্র ও বৈষম্য বিরোধী রাজনীতিতে সক্রিয়।

শেখ মুজিবুর রহমান: জন্ম ১৯২০। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা। পাকিস্তানি শাসনের কঠোর প্রতিবাদে কারাবরণ। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার স্থপতি ও প্রথম রাষ্ট্রপতি।

তোফায়েল আহমেদ: জন্ম ১৯৪৩। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা, ৬৮-৬৯ সালের গণজাগরণে ডাকসুর ভিপি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক। ১৯৭০ নির্বাচনে জয়ী, পরবর্তীতে বাণিজ্যমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য।

মতিয়া চৌধুরী: জন্ম ১৯৪২। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি, আওয়ামী লীগের কৃষিমন্ত্রী ও প্রেসিডিয়াম সদস্য। দীর্ঘকাল সংসদ উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন।

রাশেদ খান মেনন: জন্ম ১৯৪৩। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ও মাওবাদী রাজনীতিক। ১৯৬২ শিক্ষা আন্দোলনের নেতা, মুক্তিযোদ্ধা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য।

হাসানুল হক ইনু: জন্ম ১৯৪৬। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা, মুক্তিযোদ্ধা। জাসদের সভাপতি, ২০০৮ থেকে সংসদ সদস্য ও বিভিন্ন সময় মন্ত্রী।

মাহমুদুর রহমান মান্না: জন্ম ১৯৫১। ছাত্রলীগের আহ্বায়ক, ডাকসু ভিপি, বাসদ প্রতিষ্ঠাতা ও এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অগ্রণী। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও বর্তমানে দলের সভাপতি।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর: জন্ম ১৯৪৮। ছাত্র রাজনীতির নেতা ও বিএনপি মহাসচিব। কারাভোগী, সামরিক শাসন বিরোধী, নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীক।

রুহুল কবির রিজভী: বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা। বহুবার কারাবরণ, স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামী। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব।

নুরুল হক নুর: জন্ম ১৯৯১। কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক, ডাকসু ভিপি। ছাত্রলীগের নির্যাতনের বিরুদ্ধে বারবার রাজপথে ফিরে আসা। গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি।

নাহিদ ইসলাম: জন্ম ১৯৯৮। সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সক্রিয় নেতা। গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি গঠনে অগ্রণী। নির্যাতনের পর আন্দোলনের প্রভাব বৃদ্ধি। বর্তমানে রাজনৈতিক দলের আহ্বায়ক।

Ad 300x250

সম্পর্কিত