(সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত কয়েক দিন ধরে আমাদের সামনে ঘুরছে ২০১৯ সালে বেনারনিউজে প্রকাশিত কয়েকটি ইলাস্ট্রেশন বা অলঙ্করণ। সেখানে ২০১৮ সালে কারাবন্দী অবস্থায় কেমন ছিল খালেদা জিয়ার জীবন এবং কেমন ছিল সেই কারাগার, সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এই ইলাস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন সাংবাদিক কামরান রেজা চৌধুরী। তাঁর বর্ণনা ও আলোকচিত্রের ওপর ভিত্তি করে ইলাস্ট্রেশনগুলো করেছিলেন রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট রেবেল পেপার। ঢাকা স্ট্রিমে আজ আমরা জানব সেই ইলাস্ট্রেশনের পেছনের গল্প।)
খালেদা জিয়ার এই স্কেচটি ২০১৯ সালে বেনারনিউজে প্রকাশিত হয়। এর ধারণা (আইডিয়া) মূলত সংবাদমাধ্যমটির ওয়াশিংটন ডিসি কার্যালয় থেকে এসেছিল। ধারণাটি আসার পর আমি এখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করি। সেখানে ‘রেবেল পেপার’ নামে একজন পলিটিক্যাল কার্টুনিস্ট ছিলেন। তিনি খুব আকর্ষণীয় একজন মানুষ। তাঁকে আমার খুব ভালো লেগেছে। তাঁর কাজও আমি দেখেছি। এর আগে আমি তাঁকে চিনতামও না। আমি তথ্য পাঠানোর পর ভদ্রলোক বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করতেন—বিষয়টা কী? রুমটা কেমন? এখানে কী থাকতে পারে? রুমের ধরন কেমন? আমি তখন সেই বর্ণনাগুলো তাঁকে দিতাম।
আমি গিয়ে গিয়ে দেখতাম। আগেও আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়েছি। ফলে তাঁর রুম বা আশপাশ সম্পর্কে আমার ভেতরে মোটামুটি একটা ধারণা ছিল। আমি বর্ণনা করতাম আর রেবেল তখন নোট নিতেন। এ ছাড়া আমি লিখিতভাবেও বর্ণনা পাঠিয়েছিলাম। খেয়াল করার বিষয় হলো, তথ্য পাঠানোর পর তিনি আমার পাঠানো ছবিগুলো নিয়েছিলেন। সেই ছবির ওপর ভিত্তি করে, সরাসরি না দেখেও একজন মানুষ কত সুন্দর করে এই কার্টুনটা তৈরি করলেন, তা আমাকে বেশ অবাক করেছে।
খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হচ্ছে। আঁকা: রেবেল পেপার
মজার বিষয় হচ্ছে, এই কার্টুনটা যখন ছাপা হলো, তারপর আমি একদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গেলাম। তিনি আমার ওপর বেশ মনঃক্ষুণ্ন ছিলেন। বললেন, ‘আমি আপনাকে বলে দিলাম...আর আপনি সব লিখে দিলেন!’ এর মধ্যে আমি একটা কাজ করেছিলাম; মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পর একজন ডেপুটি জেলারের সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। মন্ত্রী যে কথাটি বললেন, তা কতটুকু ঠিক, তা যাচাই করার জন্য। ওই ডেপুটি জেলার বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি খালেদা জিয়ার দেখভাল করি, নিজে গিয়ে দেখাশোনা করি। তিনি ভালো ব্যবহার করেন। অল্প কথা বলেন। যখন প্রয়োজন হয়, তখন আমরা গিয়ে জিজ্ঞেস করি।’
এরপর মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমাকে বললেন, ‘সব লিখে দিলেন?’ আমি বললাম, ‘কামাল ভাই, আপনার কথার ওপরে আমি শুধু নির্ভর (ডিপেন্ড) করি নাই, আমি একটু যাচাই (ভেরিফাই) করেছি।’ তখন তিনি বললেন, ‘এত বড় কাভারেজ দিলেন?’ আমি বললাম, ‘ভাই, আমি ভুল করছি কি না, সেটা বলেন।’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘না, আপনি ভুল কিছু বলেন নাই।’ সত্য কথা বলতে, তিনি পরে আর ওটা মনে রাখেননি। এমন নয় যে পরেরবার গেলে আমার সঙ্গে কথা বলেননি। তিনি সুন্দর করেই কথা বলতেন।
কারাগারে যে কক্ষে খালেদা জিয়াকে রাখা হয়েছিল। আঁকা: রেবেল পেপার
আমার বিরুদ্ধে একটাই অভিযোগ ছিল, আমরা খালেদা জিয়াকে কেন এত বড় কাভারেজ দিলাম। আমি বললাম, ‘এই জায়গায় যদি আপনি হন, আপনাকেও আমি কাভারেজ দেব। আপনার যদি এই অবস্থা হয় কিংবা শেখ হাসিনার যদি এই অবস্থা হয়, তাঁকেও আমরা কাভারেজ দেব। সাংবাদিক হিসেবে আমার কাজ হচ্ছে—যার অধিকার লঙ্ঘিত (ভায়োলেট) হবে বা হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তাকেই আমরা ডিফেন্ড করব। আমরা শক্তিশালী বা পাওয়ারফুল মানুষের পক্ষে যাব না।’
বিষয়টি বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রচুর সাড়া ফেলল। আমি ফেসবুকে খুবই নিষ্ক্রিয় (ইন-অ্যাক্টিভ)। কিন্তু ফেসবুকে শত শত অনুরোধ (রিকোয়েস্ট) আসা শুরু হলো। বাংলাদেশের প্রায় সব মূলধারার (মেইনস্ট্রিম) কাগজে এটা ছাপা হলো। কেউ কেউ বলল যে এটা ইন্দোনেশিয়ান মিডিয়া। যা–ই হোক, ভুল লিখেছিল হয়তো। কিন্তু ভালো কাভারেজ পেয়েছিল। তিনি আবার আমাকে বিএনপি বলারও চেষ্টা করেছেন। আমি বললাম, ‘ভাই, আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপি বলবে, বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগ বলেছে। সুতরাং আমি লাইনে ঠিক আছি।’
কারাগারে যেমন ছিলেন খালেদা জিয়া। আঁকা: রেবেল পেপার
কারাগারে খালেদা জিয়ার কম্পার্টমেন্টে তো আর সরাসরি যাওয়া যাবে না। তবে ২০১৩ সালের এপ্রিলে আমার একজন আত্মীয় যখন কারাবন্দী ছিলেন, তখন সেই আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমি ডেপুটি জেলারের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। জেলখানায় কথা বলতে চাইলে মাঝখানে বার বা শিক থাকে। বারের এপার-ওপার থেকে কথা বলতে হয়। ওই ডেপুটি জেলার তখন বলেছিলেন, ‘কামরান ভাই, আপনি যেহেতু সাংবাদিক মানুষ, আমি আপনাকে একটা সুযোগ (ফেভার) দিই। বরং আপনার আত্মীয়কে আমার রুমে নিয়ে আসি। আপনি আমার রুমে আসেন, আপনারা যতক্ষণ খুশি কথা বলেন, কথা বলে চলে যান।’ সেই কারণে আমি জানতাম জেলের ভেতরের বিন্যাসটা। জেলের পথটা কী রকম গোল, এরপর সামান্য রাস্তা, এরপর ডান দিকে-বাম দিকে কী—এসব আমার জানা ছিল।
জেলে কারও সঙ্গে দেখা করতে গেলে একটা মজার অভিজ্ঞতা হয়, যা দেখে আমি প্রথমবার অবাক হয়েছিলাম। আমি যখন ভেতরে যাচ্ছিলাম, আমাকে থামিয়ে হাতে একটা সিল মেরে দিল। আমি বুঝতে পারিনি সিল কিসের জন্য। বলল, ‘আপনি যে “ইনমেট” বা কারাবন্দী নন এবং আপনি যে পালিয়ে যাচ্ছেন না—তার প্রমাণ হচ্ছে এটা।’ বিষয়টা আমার কাছে খুব মজার লেগেছিল। ওই অভিজ্ঞতার কারণেই আমি বললাম যে হ্যাঁ, বর্ণনা মোটামুটি ঠিক আছে। আমি স্বীকার করলাম যে ওই রুমে আমার ভেতরে যাওয়া সম্ভব নয়, আমাকে অনুমতি দেওয়া হবে না। কিন্তু আমি তো তাঁর খুব কাছাকাছি গিয়েছিলাম। সব আমার জানা ছিল। এই হলো প্রেক্ষাপট।
কারাগারে খালেদা জিয়া। আঁকা: রেবেল পেপার
আমার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই যে আঁকা হলো, সেখানে যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে আমাদের পুরো দল (ফুল টিম) ছিল। পুরো দল থাকার পরও আমার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ থাকত। এডিটররা থাকতেন, ওরা পাঠাতেন—‘এটা কি এ রকম? ওটা কি এ রকম?’ এমন প্রচুর যোগাযোগ হয়েছে। স্কেচগুলো ছাপা হওয়ার বেশ কয়েক দিন আগে থেকে কয়েক দফা মিটিং, সিটিং, ই-মেইল চালাচালি, ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ—সবকিছু তারা করেছেন। মূল বিষয় হচ্ছে, আমার কাছে তাদের চাওয়া ছিল একটি সঠিক বর্ণনা এবং তথ্য। কারণ, আমি তো আর আঁকতে পারি না। আমি বলেছি, কার্টুনিস্ট শুনেছেন, এরপর অন্যান্য ছবি দেখেছেন। কারণ, ওয়্যার সার্ভিসে ছবি থাকে। এ ছাড়া ঢাকা সিটির স্যাটেলাইট ইমেজও পাওয়া যায়। আপনি চাইলে যেকোনো জায়গার ছবি পেতে পারেন। এভাবেই উনি কাজটা করেছেন।
কারাগারে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। আঁকা: রেবেল পেপার
আমার কাছে একটা জিনিস খুব চমৎকার লেগেছে যে কার্টুনিস্ট যে কাজগুলো করেছেন, এটা একটা বিশেষ যোগ্যতা। জেলের মধ্যে তো আমি ছবি তুলতে পারিনি। আমাকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। আর ছবি তোলার আগেই ফোন-টোন সব নিয়ে নেওয়া হয়। তাই চোখে যতটুকু দেখবেন, ওইটুকু স্মৃতিতে ধারণ করেই আপনাকে নিতে হবে। এটাই একজন সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা যে তিনি বিষয়টিকে ‘কনসিভ’ বা কল্পনা করতে পারবেন। তথ্য এবং পারিপার্শ্বিক আবহ দিয়ে তিনি বুঝে নেবেন যে বিষয়টা কেমন হতে পারে। একদম হুবহু খালেদা জিয়ার রুম যেমন ছিল, তেমনটা করা হয়তো সম্ভব না, কারণ তার জন্য ছবি থাকতে হবে বা দেখতে হবে। কিন্তু মোটামুটি একটা আবহ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে যে খালেদা জিয়ার রুমটা কেমন ছিল বা তাঁর জীবনটা কেমন। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটি বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় একটু ভিন্ন মাত্রার কাজ হয়েছে। ডিসি টিমের ওখানে কয়েকজন ছিলেন, বেশ ভালো এবং খুব নিবেদিতভাবে আমরা কাজ করেছিলাম। আমি একটা কারণেই খুশি যে আমি এখান থেকে সঠিক তথ্যগুলো দিতে পেরেছিলাম, যার কারণে এই কাজটি করা সম্ভব হয়েছে।
কামরান রেজা চৌধুরী:সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত কয়েক দিন ধরে আমাদের সামনে ঘুরছে ২০১৯ সালে বেনারনিউজে প্রকাশিত কয়েকটি ইলাস্ট্রেশন বা অলঙ্করণ। সেখানে ২০১৮ সালে কারাবন্দী অবস্থায় কেমন ছিল খালেদা জিয়ার জীবন এবং কেমন ছিল সেই কারাগার, সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এই ইলাস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন সাংবাদিক কামরান রেজা চৌধুরী। তাঁর বর্ণনা ও আলোকচিত্রের ওপর ভিত্তি করে ইলাস্ট্রেশনগুলো করেছিলেন রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট রেবেল পেপার। ঢাকা স্ট্রিমে আজ আমরা জানব সেই ইলাস্ট্রেশনের পেছনের গল্প।)
খালেদা জিয়ার এই স্কেচটি ২০১৯ সালে বেনারনিউজে প্রকাশিত হয়। এর ধারণা (আইডিয়া) মূলত সংবাদমাধ্যমটির ওয়াশিংটন ডিসি কার্যালয় থেকে এসেছিল। ধারণাটি আসার পর আমি এখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করি। সেখানে ‘রেবেল পেপার’ নামে একজন পলিটিক্যাল কার্টুনিস্ট ছিলেন। তিনি খুব আকর্ষণীয় একজন মানুষ। তাঁকে আমার খুব ভালো লেগেছে। তাঁর কাজও আমি দেখেছি। এর আগে আমি তাঁকে চিনতামও না। আমি তথ্য পাঠানোর পর ভদ্রলোক বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করতেন—বিষয়টা কী? রুমটা কেমন? এখানে কী থাকতে পারে? রুমের ধরন কেমন? আমি তখন সেই বর্ণনাগুলো তাঁকে দিতাম।
আমি গিয়ে গিয়ে দেখতাম। আগেও আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়েছি। ফলে তাঁর রুম বা আশপাশ সম্পর্কে আমার ভেতরে মোটামুটি একটা ধারণা ছিল। আমি বর্ণনা করতাম আর রেবেল তখন নোট নিতেন। এ ছাড়া আমি লিখিতভাবেও বর্ণনা পাঠিয়েছিলাম। খেয়াল করার বিষয় হলো, তথ্য পাঠানোর পর তিনি আমার পাঠানো ছবিগুলো নিয়েছিলেন। সেই ছবির ওপর ভিত্তি করে, সরাসরি না দেখেও একজন মানুষ কত সুন্দর করে এই কার্টুনটা তৈরি করলেন, তা আমাকে বেশ অবাক করেছে।
খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হচ্ছে। আঁকা: রেবেল পেপার
মজার বিষয় হচ্ছে, এই কার্টুনটা যখন ছাপা হলো, তারপর আমি একদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গেলাম। তিনি আমার ওপর বেশ মনঃক্ষুণ্ন ছিলেন। বললেন, ‘আমি আপনাকে বলে দিলাম...আর আপনি সব লিখে দিলেন!’ এর মধ্যে আমি একটা কাজ করেছিলাম; মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পর একজন ডেপুটি জেলারের সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। মন্ত্রী যে কথাটি বললেন, তা কতটুকু ঠিক, তা যাচাই করার জন্য। ওই ডেপুটি জেলার বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি খালেদা জিয়ার দেখভাল করি, নিজে গিয়ে দেখাশোনা করি। তিনি ভালো ব্যবহার করেন। অল্প কথা বলেন। যখন প্রয়োজন হয়, তখন আমরা গিয়ে জিজ্ঞেস করি।’
এরপর মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমাকে বললেন, ‘সব লিখে দিলেন?’ আমি বললাম, ‘কামাল ভাই, আপনার কথার ওপরে আমি শুধু নির্ভর (ডিপেন্ড) করি নাই, আমি একটু যাচাই (ভেরিফাই) করেছি।’ তখন তিনি বললেন, ‘এত বড় কাভারেজ দিলেন?’ আমি বললাম, ‘ভাই, আমি ভুল করছি কি না, সেটা বলেন।’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘না, আপনি ভুল কিছু বলেন নাই।’ সত্য কথা বলতে, তিনি পরে আর ওটা মনে রাখেননি। এমন নয় যে পরেরবার গেলে আমার সঙ্গে কথা বলেননি। তিনি সুন্দর করেই কথা বলতেন।
কারাগারে যে কক্ষে খালেদা জিয়াকে রাখা হয়েছিল। আঁকা: রেবেল পেপার
আমার বিরুদ্ধে একটাই অভিযোগ ছিল, আমরা খালেদা জিয়াকে কেন এত বড় কাভারেজ দিলাম। আমি বললাম, ‘এই জায়গায় যদি আপনি হন, আপনাকেও আমি কাভারেজ দেব। আপনার যদি এই অবস্থা হয় কিংবা শেখ হাসিনার যদি এই অবস্থা হয়, তাঁকেও আমরা কাভারেজ দেব। সাংবাদিক হিসেবে আমার কাজ হচ্ছে—যার অধিকার লঙ্ঘিত (ভায়োলেট) হবে বা হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তাকেই আমরা ডিফেন্ড করব। আমরা শক্তিশালী বা পাওয়ারফুল মানুষের পক্ষে যাব না।’
বিষয়টি বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রচুর সাড়া ফেলল। আমি ফেসবুকে খুবই নিষ্ক্রিয় (ইন-অ্যাক্টিভ)। কিন্তু ফেসবুকে শত শত অনুরোধ (রিকোয়েস্ট) আসা শুরু হলো। বাংলাদেশের প্রায় সব মূলধারার (মেইনস্ট্রিম) কাগজে এটা ছাপা হলো। কেউ কেউ বলল যে এটা ইন্দোনেশিয়ান মিডিয়া। যা–ই হোক, ভুল লিখেছিল হয়তো। কিন্তু ভালো কাভারেজ পেয়েছিল। তিনি আবার আমাকে বিএনপি বলারও চেষ্টা করেছেন। আমি বললাম, ‘ভাই, আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপি বলবে, বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগ বলেছে। সুতরাং আমি লাইনে ঠিক আছি।’
কারাগারে যেমন ছিলেন খালেদা জিয়া। আঁকা: রেবেল পেপার
কারাগারে খালেদা জিয়ার কম্পার্টমেন্টে তো আর সরাসরি যাওয়া যাবে না। তবে ২০১৩ সালের এপ্রিলে আমার একজন আত্মীয় যখন কারাবন্দী ছিলেন, তখন সেই আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমি ডেপুটি জেলারের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। জেলখানায় কথা বলতে চাইলে মাঝখানে বার বা শিক থাকে। বারের এপার-ওপার থেকে কথা বলতে হয়। ওই ডেপুটি জেলার তখন বলেছিলেন, ‘কামরান ভাই, আপনি যেহেতু সাংবাদিক মানুষ, আমি আপনাকে একটা সুযোগ (ফেভার) দিই। বরং আপনার আত্মীয়কে আমার রুমে নিয়ে আসি। আপনি আমার রুমে আসেন, আপনারা যতক্ষণ খুশি কথা বলেন, কথা বলে চলে যান।’ সেই কারণে আমি জানতাম জেলের ভেতরের বিন্যাসটা। জেলের পথটা কী রকম গোল, এরপর সামান্য রাস্তা, এরপর ডান দিকে-বাম দিকে কী—এসব আমার জানা ছিল।
জেলে কারও সঙ্গে দেখা করতে গেলে একটা মজার অভিজ্ঞতা হয়, যা দেখে আমি প্রথমবার অবাক হয়েছিলাম। আমি যখন ভেতরে যাচ্ছিলাম, আমাকে থামিয়ে হাতে একটা সিল মেরে দিল। আমি বুঝতে পারিনি সিল কিসের জন্য। বলল, ‘আপনি যে “ইনমেট” বা কারাবন্দী নন এবং আপনি যে পালিয়ে যাচ্ছেন না—তার প্রমাণ হচ্ছে এটা।’ বিষয়টা আমার কাছে খুব মজার লেগেছিল। ওই অভিজ্ঞতার কারণেই আমি বললাম যে হ্যাঁ, বর্ণনা মোটামুটি ঠিক আছে। আমি স্বীকার করলাম যে ওই রুমে আমার ভেতরে যাওয়া সম্ভব নয়, আমাকে অনুমতি দেওয়া হবে না। কিন্তু আমি তো তাঁর খুব কাছাকাছি গিয়েছিলাম। সব আমার জানা ছিল। এই হলো প্রেক্ষাপট।
কারাগারে খালেদা জিয়া। আঁকা: রেবেল পেপার
আমার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই যে আঁকা হলো, সেখানে যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে আমাদের পুরো দল (ফুল টিম) ছিল। পুরো দল থাকার পরও আমার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ থাকত। এডিটররা থাকতেন, ওরা পাঠাতেন—‘এটা কি এ রকম? ওটা কি এ রকম?’ এমন প্রচুর যোগাযোগ হয়েছে। স্কেচগুলো ছাপা হওয়ার বেশ কয়েক দিন আগে থেকে কয়েক দফা মিটিং, সিটিং, ই-মেইল চালাচালি, ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ—সবকিছু তারা করেছেন। মূল বিষয় হচ্ছে, আমার কাছে তাদের চাওয়া ছিল একটি সঠিক বর্ণনা এবং তথ্য। কারণ, আমি তো আর আঁকতে পারি না। আমি বলেছি, কার্টুনিস্ট শুনেছেন, এরপর অন্যান্য ছবি দেখেছেন। কারণ, ওয়্যার সার্ভিসে ছবি থাকে। এ ছাড়া ঢাকা সিটির স্যাটেলাইট ইমেজও পাওয়া যায়। আপনি চাইলে যেকোনো জায়গার ছবি পেতে পারেন। এভাবেই উনি কাজটা করেছেন।
কারাগারে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। আঁকা: রেবেল পেপার
আমার কাছে একটা জিনিস খুব চমৎকার লেগেছে যে কার্টুনিস্ট যে কাজগুলো করেছেন, এটা একটা বিশেষ যোগ্যতা। জেলের মধ্যে তো আমি ছবি তুলতে পারিনি। আমাকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। আর ছবি তোলার আগেই ফোন-টোন সব নিয়ে নেওয়া হয়। তাই চোখে যতটুকু দেখবেন, ওইটুকু স্মৃতিতে ধারণ করেই আপনাকে নিতে হবে। এটাই একজন সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা যে তিনি বিষয়টিকে ‘কনসিভ’ বা কল্পনা করতে পারবেন। তথ্য এবং পারিপার্শ্বিক আবহ দিয়ে তিনি বুঝে নেবেন যে বিষয়টা কেমন হতে পারে। একদম হুবহু খালেদা জিয়ার রুম যেমন ছিল, তেমনটা করা হয়তো সম্ভব না, কারণ তার জন্য ছবি থাকতে হবে বা দেখতে হবে। কিন্তু মোটামুটি একটা আবহ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে যে খালেদা জিয়ার রুমটা কেমন ছিল বা তাঁর জীবনটা কেমন। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটি বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় একটু ভিন্ন মাত্রার কাজ হয়েছে। ডিসি টিমের ওখানে কয়েকজন ছিলেন, বেশ ভালো এবং খুব নিবেদিতভাবে আমরা কাজ করেছিলাম। আমি একটা কারণেই খুশি যে আমি এখান থেকে সঠিক তথ্যগুলো দিতে পেরেছিলাম, যার কারণে এই কাজটি করা সম্ভব হয়েছে।
কামরান রেজা চৌধুরী:সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক