মারুফ ইসলাম
যে রাতে রকিব হাসানকে ফোন করেছিলাম, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল না। ঘন অন্ধকারই বলা যায়। তবু রাতটি স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
ফোন করেছিলাম তিন গোয়েন্দার কিংবদন্তী লেখক রকিব হাসানের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। বছর সাতেক আগের কথা। তখন দৈনিক প্রথম আলোতে কাজ করি। আমাকে বলা হলো, রকিব হাসানের একটি টেলিফোনিক সাক্ষাৎকার নিতে।
ফোন রিসিভ করে এত আন্তরিক কণ্ঠে কথা বললেন! মনেই হলো না প্রথমবার কথা বলছি আমরা। বুঝলাম, মুহূর্তে যাঁরা সবাইকে আপন করে নিতে পারেন, তাঁদের একজন রকিব হাসান।
রকিব হাসান সেই লেখক, যিনি আমাদের শৈশবকে সোনায় মুড়ে দিয়েছিলেন। আমাদের বালকবেলায় অ্যাডভেঞ্চারের গাঢ় ছাপ এঁকে দিয়েছিলেন। সেই তাঁর সঙ্গে আজ কথা বলছি। বিশ্বাস হয় না!
তিন গোয়েন্দার লেখক সম্মোহনী গলায় বললেন, ‘কেমন আছ?’
সঙ্গে সঙ্গে আমি যেন দেখতে পেলাম, তিনজন কিশোর নিঃসঙ্কোচে ছুটে যাচ্ছে রকি বিচের পথে…ঝড়ের মধ্যে…রহস্যের পেছনে।
রকিব হাসান বললেন, ‘তারপর বলো, কী জানতে চাও?’
আমি সম্বিৎ ফিরে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, তাঁর প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র সম্পর্কে। তিনি খুক খুক করে হেসে বললেন, ‘আমি গোয়েন্দা কাহিনী লিখি বলে যে শুধু গোয়েন্দা বই পড়ি তা নয়... তবে যেদিন থেকে তিন গোয়েন্দা লেখা শুরু করি সেদিন থেকে কিশোর, মুসা ও রবিন চরিত্রই প্রিয়।’
বলতে বলতে তাঁর গলা আরও গাঢ় হয়ে উঠল। মনে হোল তিনজন কিশোর এখনো তাঁর ভেতরে জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মতো ঘুমিয়ে আছে।
জানতে চাইলাম তাঁর প্রিয় বইয়ের কথা। উত্তরে বললেন, ‘পথের পাঁচালী’।
পথের পাঁচালী! এমন গলায় বললেন, যেন বই নয়, কোনো জীবন্ত স্মৃতির কথা বলছেন। বললেন, প্রথমবার পড়তে পারেননি। দুর্গার মৃত্যুর দৃশ্যে এসে থেমে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার দুর্গার পিসি ইন্দির ঠাকুরনের মৃত্যুর জায়গায় থেমেছিলেন। সবশেষে পঞ্চাশ বছর বয়সে গিয়ে বইটা পড়ে শেষ করতে পেরেছিলেন।
এক জীবনে চারবার পড়েও তাঁর মনে পথের পাঁচালীর দুঃখ জমে ছিল। এই কারণে হয়তো তিন গোয়েন্দার অভিযানে আমরা পাই এক ধরনের মানবিক কোমলতা। তাই কিশোরদের গল্প হয়েও বড়দের চোখে জল আনে কিশোর-মুসা-রবিন।
আমি ভাবছিলাম, যিনি কিশোর, মুসা, রবিনের প্রাণে শ্বাস ফুঁকে দিতে পারেন, তিনি কেমন সিনেমা পছন্দ করেন, জানা দরকার।
আবারও হাসলেন রকিব হাসান। বললেন, ‘প্রিয় সিনেমা নেই, তবে কিশোর বয়সে ‘‘হাজার দাস্তানো’’ ঊনিশবার দেখেছি!’
তারপর যোগ করলেন, বাস্তবতার ঘূর্ণিতে সিনেমার সময় পাননি। কিন্তু ‘টাইটানিক’ দেখে ভালো লেগেছিল। তবু সেটাকেও ‘প্রিয়’ বলতে অস্বীকার করলেন। যেন প্রিয় বলার মধ্যে তাঁর কাছে একধরনের দায় রয়েছে। সেই দায় তিনি শুধু নিজের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর প্রতিই রাখতে চান।
সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম যখন শুনলাম, এক মাসে তিনি ছয়টি বই লিখেছেন! তিন গোয়েন্দার এই লেখক বললেন, ‘দিনে ১৮ ঘণ্টা লিখেছি।’
তাঁর গলায় ক্লান্তির রেখা ছিল। অনুতাপ ছি না। ছিল একজন কারিগরের মৃদু গর্ব, যিনি জানেন তাঁর প্রতিটি রহস্যগল্প হাজার হাজার কিশোরের প্রাণে আলো জ্বেলেছে।
শেষে তাঁর শখের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললেন, ‘এক সময় পাখি শিকার করাই ছিল আমার একমাত্র শখ… কিন্তু এখন সে জন্য অনুশোচনা হয়।’
সেই কথাটা বলার সময় তাঁর কণ্ঠে সত্যিকারের অনুতাপ শুনেছিলাম। মনে হয়েছিল, এই মানুষটি হয়তো শিকারি থেকে লেখকে রূপান্তরিত হওয়ার মধ্যেই নিজের মুক্তি খুঁজে পেয়েছেন।
সাক্ষাৎকার শেষ হওয়ার পর অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমার চারপাশে বইয়ের গন্ধ, বাতাসে পুরোনো কাগজের পাতা উল্টানোর শব্দ। এসবের সঙ্গে কোথাও যেন তিন কিশোরের হাসি মিলেমিশে এক অদ্ভুত নীরবতা তৈরি করেছে।
আজ রকিব হাসান চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। কিন্তু আজ থেকে যখনই কোনো কিশোর ছেলেকে ‘তিন গোয়েন্দা’ হাতে নিয়ে পড়তে দেখব, মনে হবে তিনি এখনো আছেন, আমাদের কল্পনার ঠিক পাশেই।
তিনি ছিলেন লেখক, ছিলেন কিশোর বয়সের এক বন্ধু। আবার ছিলেন আমাদের স্বপ্নের মহানায়ক। আমি দিব্য চোখে দেখতে পেলাম, অনন্তলোকেও তাঁর টাইপরাইটারের কী–বোর্ডে খটখট শব্দ উঠছে। তিনি লিখছেন—‘রকি বিচে সূর্য ডুবছে… তিন গোয়েন্দা আবার পথে নামল…’।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
যে রাতে রকিব হাসানকে ফোন করেছিলাম, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল না। ঘন অন্ধকারই বলা যায়। তবু রাতটি স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
ফোন করেছিলাম তিন গোয়েন্দার কিংবদন্তী লেখক রকিব হাসানের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। বছর সাতেক আগের কথা। তখন দৈনিক প্রথম আলোতে কাজ করি। আমাকে বলা হলো, রকিব হাসানের একটি টেলিফোনিক সাক্ষাৎকার নিতে।
ফোন রিসিভ করে এত আন্তরিক কণ্ঠে কথা বললেন! মনেই হলো না প্রথমবার কথা বলছি আমরা। বুঝলাম, মুহূর্তে যাঁরা সবাইকে আপন করে নিতে পারেন, তাঁদের একজন রকিব হাসান।
রকিব হাসান সেই লেখক, যিনি আমাদের শৈশবকে সোনায় মুড়ে দিয়েছিলেন। আমাদের বালকবেলায় অ্যাডভেঞ্চারের গাঢ় ছাপ এঁকে দিয়েছিলেন। সেই তাঁর সঙ্গে আজ কথা বলছি। বিশ্বাস হয় না!
তিন গোয়েন্দার লেখক সম্মোহনী গলায় বললেন, ‘কেমন আছ?’
সঙ্গে সঙ্গে আমি যেন দেখতে পেলাম, তিনজন কিশোর নিঃসঙ্কোচে ছুটে যাচ্ছে রকি বিচের পথে…ঝড়ের মধ্যে…রহস্যের পেছনে।
রকিব হাসান বললেন, ‘তারপর বলো, কী জানতে চাও?’
আমি সম্বিৎ ফিরে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, তাঁর প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র সম্পর্কে। তিনি খুক খুক করে হেসে বললেন, ‘আমি গোয়েন্দা কাহিনী লিখি বলে যে শুধু গোয়েন্দা বই পড়ি তা নয়... তবে যেদিন থেকে তিন গোয়েন্দা লেখা শুরু করি সেদিন থেকে কিশোর, মুসা ও রবিন চরিত্রই প্রিয়।’
বলতে বলতে তাঁর গলা আরও গাঢ় হয়ে উঠল। মনে হোল তিনজন কিশোর এখনো তাঁর ভেতরে জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মতো ঘুমিয়ে আছে।
জানতে চাইলাম তাঁর প্রিয় বইয়ের কথা। উত্তরে বললেন, ‘পথের পাঁচালী’।
পথের পাঁচালী! এমন গলায় বললেন, যেন বই নয়, কোনো জীবন্ত স্মৃতির কথা বলছেন। বললেন, প্রথমবার পড়তে পারেননি। দুর্গার মৃত্যুর দৃশ্যে এসে থেমে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার দুর্গার পিসি ইন্দির ঠাকুরনের মৃত্যুর জায়গায় থেমেছিলেন। সবশেষে পঞ্চাশ বছর বয়সে গিয়ে বইটা পড়ে শেষ করতে পেরেছিলেন।
এক জীবনে চারবার পড়েও তাঁর মনে পথের পাঁচালীর দুঃখ জমে ছিল। এই কারণে হয়তো তিন গোয়েন্দার অভিযানে আমরা পাই এক ধরনের মানবিক কোমলতা। তাই কিশোরদের গল্প হয়েও বড়দের চোখে জল আনে কিশোর-মুসা-রবিন।
আমি ভাবছিলাম, যিনি কিশোর, মুসা, রবিনের প্রাণে শ্বাস ফুঁকে দিতে পারেন, তিনি কেমন সিনেমা পছন্দ করেন, জানা দরকার।
আবারও হাসলেন রকিব হাসান। বললেন, ‘প্রিয় সিনেমা নেই, তবে কিশোর বয়সে ‘‘হাজার দাস্তানো’’ ঊনিশবার দেখেছি!’
তারপর যোগ করলেন, বাস্তবতার ঘূর্ণিতে সিনেমার সময় পাননি। কিন্তু ‘টাইটানিক’ দেখে ভালো লেগেছিল। তবু সেটাকেও ‘প্রিয়’ বলতে অস্বীকার করলেন। যেন প্রিয় বলার মধ্যে তাঁর কাছে একধরনের দায় রয়েছে। সেই দায় তিনি শুধু নিজের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর প্রতিই রাখতে চান।
সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম যখন শুনলাম, এক মাসে তিনি ছয়টি বই লিখেছেন! তিন গোয়েন্দার এই লেখক বললেন, ‘দিনে ১৮ ঘণ্টা লিখেছি।’
তাঁর গলায় ক্লান্তির রেখা ছিল। অনুতাপ ছি না। ছিল একজন কারিগরের মৃদু গর্ব, যিনি জানেন তাঁর প্রতিটি রহস্যগল্প হাজার হাজার কিশোরের প্রাণে আলো জ্বেলেছে।
শেষে তাঁর শখের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললেন, ‘এক সময় পাখি শিকার করাই ছিল আমার একমাত্র শখ… কিন্তু এখন সে জন্য অনুশোচনা হয়।’
সেই কথাটা বলার সময় তাঁর কণ্ঠে সত্যিকারের অনুতাপ শুনেছিলাম। মনে হয়েছিল, এই মানুষটি হয়তো শিকারি থেকে লেখকে রূপান্তরিত হওয়ার মধ্যেই নিজের মুক্তি খুঁজে পেয়েছেন।
সাক্ষাৎকার শেষ হওয়ার পর অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমার চারপাশে বইয়ের গন্ধ, বাতাসে পুরোনো কাগজের পাতা উল্টানোর শব্দ। এসবের সঙ্গে কোথাও যেন তিন কিশোরের হাসি মিলেমিশে এক অদ্ভুত নীরবতা তৈরি করেছে।
আজ রকিব হাসান চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। কিন্তু আজ থেকে যখনই কোনো কিশোর ছেলেকে ‘তিন গোয়েন্দা’ হাতে নিয়ে পড়তে দেখব, মনে হবে তিনি এখনো আছেন, আমাদের কল্পনার ঠিক পাশেই।
তিনি ছিলেন লেখক, ছিলেন কিশোর বয়সের এক বন্ধু। আবার ছিলেন আমাদের স্বপ্নের মহানায়ক। আমি দিব্য চোখে দেখতে পেলাম, অনন্তলোকেও তাঁর টাইপরাইটারের কী–বোর্ডে খটখট শব্দ উঠছে। তিনি লিখছেন—‘রকি বিচে সূর্য ডুবছে… তিন গোয়েন্দা আবার পথে নামল…’।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
ঢাকা নগরীর বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা যেন এখন এক ভয়াবহ বাস্তবতা। মিরপুরের রাসায়নিক গুদামে আগুনে ১৬ জনের মৃত্যু, তার আগে বঙ্গবাজারে শতাধিক দোকান ছাই হয়ে যাওয়া কিংবা চকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে বহু প্রাণহানি—এসব ঘটনা যেন এক ভয়ংকর চক্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, কেন এই শহরে এত ঘন ঘন আগুন লাগে?
৩ ঘণ্টা আগেদিন কয়েক ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক সরগরম কন্টেন্ট ক্রিয়েটর রিপন মিয়াকে ঘিরে। প্রতিটি ভিডিওরে শেষে তাঁর হাসিমুখের বলা, ‘এটাই বাস্তব, কি কেমন দিলাম’—তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়। একজন খেটে খাওয়া মানুষের সহজ আবেগ দিয়ে মানুষকে ছুঁতে পেরেছেন তিনি। কিন্তু সেই বয়ানে এখন যেন ফাটল ধরতে শুরু করেছে।
৮ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেকটা জায়গাজুড়ে আছে দেশের ছাত্রসমাজ। ইতিহাস সাক্ষী, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান পেরিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, এরপর ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবই এসেছে এই ছাত্রসমাজের হাত ধরে। সাম্প্রতিক জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বও দিয়েছে ছাত্রছাত্রী
১১ ঘণ্টা আগেকবি নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’-এর অনেক বছর পরে কবি তুহিন খান যখন তাঁর কবিতায় বলেন, ‘এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ’, তখন সামগ্রিক পরিস্থিতি মিলিয়ে আমাদের তা মানতে বাধ্য হতে হয়।
১৩ ঘণ্টা আগে