বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের অন্যতম ‘গণবুদ্ধিজীবী’। লেখক-গবেষক ও বামপন্থী এই রাজনীতিক ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। এরপর ১৯৬৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতি এবং লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। আজ রোববার ৯৪ বছর বয়সে মহাপ্রয়াণ হলো তাঁর। বদরুদ্দীন উমর তাঁর জীবনের শেষ লেখাটি লিখেছেন সংস্কৃতি পত্রিকার মে সংখ্যায় ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাঙলাদেশের পরিস্থিতি’ শিরোনামে।
স্ট্রিম ডেস্ক
জুলাই অভ্যুত্থানের পর নয় মাস গত হয়েছে। এই সময়ে বাঙলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির মধ্যে অনেক ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনের সব থেকে উল্লেখযোগ্য দিক হলো বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের একটানা পনেরো বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট চরিত্রের যে পরিচয় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত শেখ মুজিবের শাসন আমলে পাওয়া গিয়েছিল তারই পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল শেখ হাসিনার শাসনকালে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ২০০৯ সালের প্রথম দিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা হলো, এরপর ক্ষমতা তাঁর হাতছাড়া হতে না দেওয়া, যেমন করেই হোক একটানা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা। এই উদ্দেশ্যে প্রথমেই তিনি তাঁদের জোর আন্দোলনের মাধ্যমে প্রণীত ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন বাতিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের নৈতিক বিবেচনার ধারে কাছে না গিয়ে তিনি পরবর্তী সব নির্বাচন নিজেদের সরকারের অধীনে করার জন্য বদ্ধপরিকর হন। ২০০৯ সাল থেকেই শেখ হাসিনা এবং তাঁদের ফ্যাসিস্ট সংগঠন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশে আইন কানুনের কোনো তোয়াক্কা না করে বেপরোয়াভাবে চুরি দুর্নীতি ও নির্যাতনের মাধ্যমে পুরো শাসন ব্যবস্থায় এক অদৃষ্টপূর্ব লুটপাটের প্রক্রিয়া জারী করেন।
এই দুঃশাসন ও লুটপাটের বিরুদ্ধে সামান্য প্রতিরোধ পর্যন্ত যাতে গড়ে উঠতে না পারে এ জন্য তিনি এমন দমন পীড়নের আশ্রয় গ্রহণ করেন যা ১৯৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিবের নির্যাতনের মাত্রাকেও ছাড়িয়ে যায়। কোনো আইন কানুনের ধারে কাছে না থেকে বেপরোয়া গ্রেফতার, অপহরণ ও গুম খুন হয়ে দাঁড়ায় এক নিয়মিত ব্যাপার। এ জন্য তিনি গোয়েন্দা বিভাগের অধীনে ‘আয়না ঘর’ নামে পরিচিত এমন এক নির্যাতন সেল-এর ব্যবস্থা করেন, যার চিন্তা পর্যন্ত বাঙলাদেশে কোনো সরকার ইতিপূর্বে করেনি। শেখ হাসিনা বিনা কারণে এই অপকর্ম করেননি। যে আকারে তাঁর শাসন আমলে দেশে শোষণ ও লুটপাট জারি ছিল, তার বিরুদ্ধে যে কোনো প্রতিরোধ বা সম্ভাব্য প্রতিরোধ দমন করার উদ্দেশ্যে এটাই ছিল তাঁর ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের অর্থনীতিও এর ফলে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবার এবং তাঁদের দল আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা পর্যন্ত শুধু বেপরোয়াভাবে চুরি, দুর্নীতি, লুটপাট করেনি। সেই লুটপাটের টাকা দেশে না রেখে তারা ব্যাপকভাবে বিদেশে পাচার করতে থাকে। এটা ছিল দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে দেশীয় অর্থনীতিকে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার এক প্রক্রিয়া। আওয়ামী লীগের হাজার হাজার লোক লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। এর ফলে বাঙলাদেশের অর্থনীতি ও প্রশাসন ক্ষেত্রে দেখা দেয় এক লণ্ডভণ্ড অবস্থা। এসবের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার অবকাশ এখানে নেই। এর পরিণতিতে সমগ্র রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভাঙনের শর্ত তৈরী হয়। এভাবে এই শর্ত পূরণ না হলে ২০২৪ সালে সরকারের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলন এবং তার শীর্ষে ৫ই অগাস্টের গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হতো না। এই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনই ঘটেনি, একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ সমূলে উৎখাত হয়েছিল। শেখ হাসিনাসহ হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী ৫ই অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের মুখে পড়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। কোনো সরকারের পতনের পর এভাবে সরকার প্রধান থেকে নিয়ে অন্যান্য মন্ত্রী, দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, এমনকি গ্রামাঞ্চলের নেতারা পর্যন্ত ব্যাপক আকারে আত্মগোপন করা কিংবা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আর কোনো দৃষ্টান্ত ইতিহাসে নেই। শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার পনেরো বছর ক্ষমতায় থেকে কত ভয়াবহভাবে দেশের সমগ্র জনগণের ওপর শোষণ নির্যাতন চালিয়েছিল এর মধ্যে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়।
নির্যাতনের কারণে দেশে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ ১৫ বছরে রাজনৈতিকভাবে গড়ে উঠতে না পারলেও অবশেষে বিগত জুলাই মাসে দেশে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ছাত্রদের কোটা আন্দোলন তাদের সাথে সরকারের এক সংঘর্ষের অবস্থা তৈরী করে। পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং সেই তাপ জনগণকে স্পর্শ করে, যে জনগণ ১৫ বছর আওয়ামী শাসনে অতিষ্ঠ অবস্থায় থেকে প্রতিরোধের জন্য উন্মুখ ছিলেন, কিন্তু নির্যাতনের কারণে প্রতিরোধের কোনো ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। বিএনপিসহ সকল বিরোধী দলকে শেখ হাসিনা সরকার নির্যাতনের জালে আটক রেখে পঙ্গু করে রেখেছিল। জুলাই মাসে ছাত্রদের কোটা আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। সেই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ জনগণের প্রতিরোধ শক্তিকে জাগরিত করে এক দাবানল সৃষ্টি করে। সেই দাবানল আওয়ামী লীগের শাসনই শুধু নয়, সমগ্র আওয়ামী লীগ সংগঠনকেই ছারখার করে দেয়। আওয়ামী শাসনমুক্ত বাঙলাদেশে এক নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে ভারতে পলায়ন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শাসন ক্ষেত্রে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের শূন্যতা এক বিপজ্জনক ব্যাপার, কারণ সে অবস্থায় দেশে এক অনিয়ন্ত্রিত অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির শর্ত তৈরী হয়। বাঙলাদেশেও এ সময় তাই হয়েছিল। সে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রেরা এবং জনগণের একাংশ ৮ই অগাস্ট ডক্টর মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এক সরকার গঠন করে। এ কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এভাবে জরুরী ভিত্তিতে এই সরকার গঠিত না হলে এর একমাত্র বিকল্প ছিল সামরিক সরকার। ৮ই অগাস্ট একটি বেসামরিক সরকার গঠন করায় সে সম্ভাবনা দূর হয়েছিল। এদিক দিয়ে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ এই সরকারকে অনির্বাচিত বলে সমালোচনা করে থাকেন। কিন্তু ৫ই অগাস্টের পর দেশে নৈরাজ্য ঠেকানোর জন্য কোন নির্বাচিত সরকার তো সম্ভব ছিল না। সেক্ষেত্রে অনির্বাচিত সরকারের কোন বিকল্প চিন্তা করার মত অবাস্তব চিন্তা আর কি আছে? তাছাড়া এই সরকার তো উড়ে এসে জুড়ে বসে নাই। তাদেরকে ডেকে এনে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল।
জুলাই-অগাস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থানের উথাল পাথাল পরিস্থিতিতে কোটা আন্দোলনকারী ছাত্রেরা বাঙলাদেশে এক নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। এ ধরনের ঘটনা ইতিহাসে বিরল। গণঅভ্যুত্থানের আগে তাদের কোন শক্তিই ছিল না। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর তারা নিজেরা ক্ষমতাসীন না হলেও সরকার গঠন করার মত শক্তিতে পরিণত হয়। তাদের কয়েকজন উপদেষ্টা হিসাবে সরকারে যোগদান করেন। এ সরকারের চরিত্র যাই হোক, এর একটা বড় কৃতিত্ব হলো ৫ই অগাস্টের পর দেশে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে না দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা তৈরী করা। ছাত্ররাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনগণের জীবনে যে শ্বাসরোধকারী অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার অবসান ঘটে। জনগণ কর্তৃক নির্ভয়ে ও স্বাধীনভাবে নিজেদের কথা বলার মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এটাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ের প্রথম উল্লেখযোগ্য দিক। পনেরো বছর দেশে রাজনৈতিক স্থবিরতার পর প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা দেয়। বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম ইত্যাদি রাজনৈতিক দলগুলি দীর্ঘদিন পর বাঙলাদেশের রাজনীতির মাঠে নামে। ছাত্রদের কোনো সংগঠিত দল না থাকলেও একভাবে সংগঠিত হয়ে তারাও রাজনৈতিকভাবে তৎপর হয়। তাদের তৎপরতা থেকে বোঝা যায় যে, তারা দল হিসাবে এখনো পর্যন্ত সংগঠিত না হলেও অদূর ভবিষ্যতে তারা নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এক পর্যায়ে তাদের বড় অংশটি জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে (National Citizen Party, NCP) একটি পার্টি গঠন করে।
জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউ চত্বরে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে মহা ধুমধামের সাথে এই রাজনৈতিক দলের উদ্বোধন হয়। এর ঠিক পরই দলটির প্রথম কর্মসূচী হয় সুহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ইফতার পার্টি। তাদের দ্বিতীয় কর্মসূচী হয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক বিশাল ইফতার পার্টি যাতে ব্যয় হয় লক্ষ লক্ষ টাকা। কোন জনসভার আয়োজন না করে এই ধরনের ইফতার পার্টির কর্মসূচী পালন করা ছিল এক বিস্ময়ের ব্যাপার। কারণ এই কর্মসূচীর কোনো গণতান্ত্রিক চরিত্র ছিল না। উপরন্তু তার মধ্যে দেখা গিয়েছিল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীর বড় সংগঠনের সাথে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা। এটা ছিল এক হতাশাব্যঞ্জক ব্যাপার। কারণ জুলাই গণঅভ্যুত্থান এক দৃষ্টান্তকারী ঘটনা হলেও এসব কর্মসূচীর মধ্যে কোন গণতান্ত্রিক উপাদান ছিল না। তাছাড়া অভ্যুত্থানের আগে যে ছাত্রদের হাতে কানাকড়িও ছিল না, তাদের হাতে লক্ষ লক্ষ টাকা কিভাবে এলো এটাও ছিল এক লক্ষ্যণীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ টাকার উৎস কী ছিল সেটাও এক বড় প্রশ্ন। শুধু এ ধরনের সাংগঠনিক ব্যয় ছাড়াও তাদের এক নেতাকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে একশত গাড়ী নিয়ে তাদের গ্রামে প্রবেশ করতে দেখা যায়। এটা বোঝার আর কোন অসুবিধা ছিল না যে, দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী সংস্থার আনুকূল্য ছিল এসব কর্মকাণ্ডের আর্থিক যোগানদার।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের থেকে আশা করা গিয়েছিল যে, তারা দেশে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দল ও শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হবে। তার পরিবর্তে তাদের এই অবস্থা দাঁড়ানো খুব হতাশাব্যঞ্জক। তাছাড়া তাদের রাজনৈতিক দলের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তাদের বক্তব্য ও কার্যক্রমে দেশের শ্রমজীবী জনগণ, বিশেষ করে শ্রমিক কৃষকের বিষয়ে কোন কথাই আজ পর্যন্ত শোনা যায় নি। তাদের সমস্ত কর্মসূচীর মূল লক্ষ্য দাঁড়ায় দেশে ক্ষমতার মসনদ দখল করা। এদিক দিয়ে ছাত্রদের নোতুন দলের ভূমিকার মধ্যে দেখা যায় দেশে একটি নোতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সরকার গঠনে সহায়তার পরিবর্তে নিজেরা সরকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার এক উদগ্র আকাংখা। এই আকাংখার দ্বারা তাড়িত হয়েই তারা এখন বাঙলাদেশের রাজনীতি ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে।
ছাত্রদের এই রাজনৈতিক দলটির অন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর শ্রেণী চরিত্র। গঠিত হওয়ার পরই তারা ঘোষণা করে যে, তারা বামপন্থী অথবা দক্ষিণপন্থী নয়। তারা হলো মধ্যপন্থী। কিন্তু বাস্তবত: মধ্যপন্থী বলে কোন কিছু তো রাজনীতিতে নেই। প্রকৃতপক্ষে দেখা যাচ্ছে এদের কর্মসূচী ও কথাবার্তা দেশের বুর্জোয়া দক্ষিণপন্থী দলগুলির মতই। শ্রমজীবী কৃষক শ্রমিকের কোন বিষয় এদের কর্মসূচীতে না থাকা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা, ধর্মীয় দলগুলি, বিশেষতঃ জামায়াতে ইসলামীর সাথে এদের অপেক্ষাকৃত নিকট সম্পর্ক এদের দক্ষিণপন্থী চরিত্রকেই নির্দেশ করে। বস্তুতঃপক্ষে বাংলাদেশে অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে দক্ষিণপন্থীদের তৎপরতা এখন প্রাধান্যে। বামপন্থীদের কোন উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ও তৎপরতা নেই।
৫ই অগাস্ট পরবর্তী সম্ভাব্য নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে না দেওয়াই বর্তমান সরকারের সব থেকে বড় অর্জন। এদের অন্য উল্লেখযোগ্য কাজ হলো, বিশৃংখল ও বিধ্বস্ত ব্যাংকিং খাতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনা, আওয়ামী লীগ আমলের লণ্ডভণ্ড অবস্থা সামাল দেওয়ার উদ্দেশ্যে কতকগুলি কমিশন গঠন করা। এই কমিশনগুলি ইতিমধ্যে তাদের রিপোর্ট প্রদান করেছে। এদের রিপোর্টের ভিত্তিতে দেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলেও তা কতখানি সম্ভব এটাও দেখার বিষয়। বর্তমান সরকার তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করলেও এদিক দিয়ে তারা কতখানি সাফল্য নিশ্চিত করবে সেটাও অনিশ্চিত। এর কারণ বর্তমান সরকার আকাশ থেকে পড়া কোন শক্তি না। যে শাসক শ্রেণী প্রকৃতপক্ষে এই দেশ শাসন করছে তার আয়ত্তের বাইরে থেকে এদের দ্বারা উল্লেখযোগ্য কোন কিছু করা সম্ভব নয়। এই শ্রেণী কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করা ছাড়া এদের কোন উপায় নেই। এ কারণে এদের শাসনে দেশ একটা স্থিতাবস্থায় থাকলেও শ্রমিক কৃষক শ্রমজীবীদের এদের থেকে কিছু পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। অন্য যে কোন সরকারের মত এই সরকারও দেশের শ্রমিক ও শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থে কিছু করছে না। উপরন্তু শ্রমিকদের মজুরী এবং অন্যান্য স্বার্থের ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা আগের যে কোন সরকারের মতই, এমনকি পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের মতই।
১৯৭২ সালে বাঙলাদেশে যে ব্যবসায়ী শ্রেণী শাসক শ্রেণী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল তারাই শেখ হাসিনার পনেরো বছরের শাসন আমলে দেশ শাসন করেছে। ৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া এবং আওয়ামী লীগের পতন
সত্ত্বেও এই শাসক শ্রেণী দেশ ছেড়ে যায় নি। তারা আছে। তারাই পর্দার অন্তরালে থেকে দেশের যাবতীয় ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। বর্তমান সরকারও এই শাসক শ্রেণীর কাঠামোর মধ্যে থেকে শাসন কাজ পরিচালনা করছে। শেখ হাসিনা সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসন উচ্ছেদ হলেও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শ্রেণীগতভাবে তারা উচ্ছেদ হয়নি। কাজেই ৫ই অগাস্টের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ফ্যাসিবাদ মুক্ত হলেও ফ্যাসিবাদের ভিত্তি এই ব্যবসায়ী শাসক শ্রেণী তার কাঠামোর মধ্যে এদেশের রাজনীতি এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে।
৫ই অগাস্টের পর এদেশের জনগণের মানসিকতার (mindset) মধ্যে যা শক্তিশালীভাবে দেখা দিয়েছে তা হলো নির্যাতন সহ্য না করা। এ কারণে এখন জনগণের ওপর সাধারণভাবে কোন নির্যাতন নেই, যদিও শ্রমজীবী জনগণের দাবী দাওয়ার ক্ষেত্রে এরা উদাসীন এবং বিরোধীও বটে। শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এদের বিরোধিতা আছে। এদিক দিয়ে দেশের ধনিক শ্রেণীর পক্ষেই এরা কাজ করছে। এর মূল কারণ জুলাই গণঅভ্যুত্থান এক গণতান্ত্রিক ব্যাপার হলেও সেটা কোন সামাজিক বিপ্লব ছিল না। এ কারণে দেশের শাসন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রেণী বৈষম্য দূর করার কোন প্রক্রিয়া অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে নেই। ছাত্রদের পক্ষ থেকেও এক্ষেত্রে কোন ভূমিকা নেই। তারা উল্লেখযোগ্যভাবে নীরব আছে। কারণ কোটা ক্ষেত্রে বৈষম্যের কথা থাকলেও কোটা বৈষম্য ও সামাজিক বৈষম্য এক জিনিষ নয়। তাদের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য। কোটা বৈষম্য হলো শাসক শ্রেণীর একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যে বৈষম্য। সামাজিক বৈষম্য বিষয়ে ছাত্রদের কোন ধারণা নেই। তাদের কোন বক্তব্যও কোথাও নেই।
এসব কারণে দেখা যায় যে, অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সামাজিক বৈষম্য দূর করা, প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কারও কোন চিন্তাভাবনা এবং উদ্যোগ নেই। উপরন্তু দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রভাব এখন সর্বত্র। এদিক দিয়ে বলা চলে অভ্যুত্থান পরবর্তী পর্যায়ে বাঙলাদেশের রাজনীতিতে সামগ্রিকভাবে এখন দক্ষিণপন্থীদের প্রাধান্য। এই প্রাধান্যের একটি দিক হলো বর্তমান পরিস্থিতিতে ধর্মীয় দলগুলির তৎপরতা। বামপন্থী দলগুলির কোন উল্লেখযোগ্য তৎপরতা এখন না থাকলেও ধর্মীয় দলগুলি, বিশেষতঃ জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের মত চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের তৎপরতা বর্তমান পরিস্থিতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক। ছাত্রদের নোতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির সম্পর্কও এই ধরনের ধর্মীয় দলগুলির সাথে তুলনামূলকভাবে ঘনিষ্ঠ।
জামায়াতে ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম ইত্যাদি ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলি এখন কোরান হাদিসের সাথে সংগতিপূর্ণ শাসনতন্ত্র এবং আইন কানুনের কথা জোরে শোরে বলছে। তারা এমনভাবে এসব কথা বলছে ও দাবী দাওয়া তুলছে যাতে মনে হবে বাঙলাদেশ একটি ইসলামী রাষ্ট্র। অভ্যুত্থান পরবর্তী বাঙলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। এর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু জামায়াতসহ অন্য ধর্মীয় সংগঠনগুলি এমনভাবে দাবী দাওয়া তুলছে যাতে মনে হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আসল লক্ষ্য এদেশে একটি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এর থেকে বিপজ্জনক ব্যাপার আর কী হতে পারে?
সামগ্রিকভাবে বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে বর্তমান সরকার এবং এদের কার্যকলাপ সম্পর্কে এখানে সাধারণভাবে কিছু বলা দরকার। এদের শ্রেণী চরিত্রের কথা আগেই বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আলোচনার সময় এদের শ্রেণী চরিত্রের কথা বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। একটি সরকার কিছু ভালো কাজ করতে পারে, কিছু ভালো কাজ না করতে পারে এবং কিছু খারাপ কাজ করতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে এদের কিছু ভালো গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা বলা হলেও পরের দিকে কিছু ভালো কাজ করার ক্ষমতা থাকলেও তারা তা করেনি। এক্ষেত্রে সব কাজের বিষয় আলোচনা সম্ভব নয়। তবে একটি বহুল আলোচিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে এ ধরনের কাজে সরকারের ব্যর্থতার পরিচয় ভালোভাবেই পাওয়া যায়।
২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী নিহত হন। তারপর ১৩ বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত এই হত্যা মামলার কোন সুরাহা হয়নি। শেখ হাসিনার আমলে এই মামলার তদন্তের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ, র্যাব ১২ বছর ধরে 'তদন্তে' আদালতে তার প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করতে ১১২ বার ব্যর্থ হয়। ইতিহাসে কোন তদন্তকারী সংস্থার এই ধরনের ব্যর্থতার কোন দৃষ্টান্ত নেই। এর থেকেই স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল যে, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে উচ্চতম সরকারী মহলের সম্পর্ক আছে। সরকারের নির্দেশেই যে র্যাব ১২ বছর ধরে ১১২ বার আদালতে তার প্রাথমিক রিপোর্ট দাখিল করতে 'ব্যর্থ' হয় এতে কারও কোন সন্দেহ ছিল না।
সাগর-রুনী হত্যার পরই বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে এবং এর জন্য শেখ হাসিনাকেই হত্যাকারী বলে জনগণ ও সাধারণভাবে সাংবাদিক মহল মনে করে। এর কারণ শেখ হাসিনার পুত্র জয় এর চরম ও বড় আকারের চুরি দুর্নীতির কিছু প্রামাণ্য দলিল সাগর-রুনীর হস্তগত থাকা। ইতিপূর্বে সাগর জার্মানীতে জার্মান রেডিওতে কর্মরত থাকা অবস্থায় এগুলি সংগ্রহ করেন। দেশে ফিরে এসে সাগর মাছরাঙা টেলিভিশনে বার্তা সম্পাদক এবং তাঁর স্ত্রী 'এটিএন বাংলার' সিনিয়র রিপোর্টার হিসাবে যোগদান করেন। এ সময় রুনী এটিএন বাংলার ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে জানান যে, জয় এর দুর্নীতি বিষয়ক প্রামাণ্য কাগজপত্র তাঁদের কাছে আছে এবং সেগুলি টেলিভিশনে প্রকাশ করার অনুরোধ করেন। ম্যানেজিং ডিরেক্টর ঐ দিনই শেখ হাসিনার কাছে গিয়ে এ বিষয়ে তাঁকে অবহিত করেন। পরদিন ভোর বেলাতেই সাগর-রুনী দম্পতি তাঁদের বাসায় ঘাতকের হাতে নিহত হন। এ সময় তাঁদের ল্যাপটপসহ অন্যান্য সব কাগজপত্রও লুট করে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা। উল্লেখ করা দরকার যে, এই হত্যাকাণ্ডের ঠিক পরই তৎকালীন আওয়ামী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দ্রুত খুনীদেরকে গ্রেফতার ও তাদেরকে বিচারের মুখোমুখী করার কথা বলেন। কিন্তু এর পরেই দেখা যায় এ বিষয়ে সাহারা খাতুন কোন পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা একটি বাক্যও আর উচ্চারণ করেন নি! উপরন্তু দেখা যায় যে, মামলা শুরু হওয়ার পর থেকে তার কোন অগ্রগতি না হয়ে ১২ বছর ধরে তদন্তের ভারপ্রাপ্ত র্যাব ১১২ বার আদালতে তার প্রাথমিক রিপোর্ট দাখিল করতে ব্যর্থ হয়। আপাতঃদৃষ্টিতে এটা এক অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর ব্যাপার। কিন্তু এক্ষেত্রে আসলে বিস্ময়ের কোন ব্যাপার ছিল না। কারণ র্যাব হাসিনার নির্দেশেই এ কাজ করেছিল। এছাড়া র্যাবের এই কাণ্ডের অন্য কোন যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা নেই।
সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ড ছিল এবং এখনো আছে এদেশে টার্গেট কিলিং (Target Killing) এর সব থেকে গুরুতর এবং বহুল আলোচিত এক বিষয়। এর গুরুত্বের কারণেই বর্তমান সরকার এ হত্যাকাণ্ড বিষয়ে নোতুন করে তদন্ত শুরু করেছে। কিন্তু সেটা করলেও দেখা যাচ্ছে যে, এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সঠিক পথে এগুচ্ছে না। তদন্ত এমনভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে যাতে আসল অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। প্রথমতঃ, ১২ বছর ধরে তদন্তের কোন অগ্রগতি না হয়ে র্যাব ১১২ বার প্রাথমিক রিপোর্ট দাখিল করতে কেন ব্যর্থ হয় তার কোন কথা নেই। দ্বিতীয়তঃ, এমনভাবে এই তদন্ত হচ্ছে যাতে এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে যে, এটা এক মামুলী বা সাধারণ হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ড যে সাগর-রুনী কর্তৃক এটিএন বাংলার ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে হাসিনার পুত্র জয় এর চুরি দুর্নীতির বিষয় অবগত করার প্রায় সাথে সাথেই ঘটেছিল সেদিকে তদন্তকারীদের কোন দৃষ্টি নেই। তাছাড়া তারা এমনভাবে তাদের তদন্তের কথা বলছে যা বিস্ময়কর তো বটেই, উপরম্ভ হাস্যকর। খুনের জন্য হত্যাকারীরা রান্নাঘরের বঁটি ছুরি ব্যবহার করেছিল কিনা এ বিষয়েও তারা 'তদন্ত' করছে। এর থেকে মনে হয় হত্যাকারীরা হত্যার জন্য গেলেও তাদের কাছে কোন অস্ত্র ছিল না, তারা খালি হাতে সাগর-রুনীর বাসায় ঢুকেছিল। তদন্তকারীদের এ ধরনের আরও অনেক উদ্ভট কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে যা থেকে মনে হয় তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে আসল হত্যাকারীদের থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। হয়তো দেখা যাবে যে, শেষ পর্যন্ত এরা এক ভুয়া তদন্তের নামে আসল অপরাধীদেরকে চিহ্নিত করার পরিবর্তে কয়েকজন নিরাপরাধী ব্যক্তিকে অপরাধী সাজিয়ে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছে। সরকার চাপের মুখে এবং বহু আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডটির গুরুত্বের কারণে গোপনভাবে তদন্তের ব্যবস্থা করলেও এ ব্যাপারে তাদের আর কোন করণীয় আছে বলে মনে হয় না। তারা হাত পা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে অবলোকনকারী হিসাবে। বর্তমান তদন্তকারীরা যে হাসিনার আমলের তদন্তকারীদের মতই একই পালকের পক্ষী এতে কোন সন্দেহ নেই।
শেখ হাসিনার পুলিশ প্রশাসনের সাথে বর্তমান পুলিশ প্রশাসনের যে কোন পাথক্য নেই, আগের লোকরাই যে প্রশাসনে বহাল তবিয়তে থেকে আগের মত এ কাজ করছে এর থেকে এটাই প্রমাণিত হয়। এখানে সাগর-রুনীর হত্যাকাণ্ডের ওপর এত বিস্তারিত আলোচনা করা হলো এটা দেখানোর জন্য যে অনেক বাগারম্বর সত্ত্বেও পুলিশ প্রশাসন এবং সাধারণভাবে সমগ্র প্রশাসনের চরিত্র আগের মতই রয়ে গেছে। বাঙলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কার্যকরভাবে জারী করার ক্ষেত্রে যে বিশাল ও শক্তিশালী প্রতিবন্ধকতা অভ্যুত্থান পরবর্তী পর্যায়ে সমগ্র শাসন ব্যবস্থার মধ্যে রয়ে গেছে এটা সেই পরিস্থিতির এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।
বর্তমান সরকার প্রসঙ্গে ফিরে এসে এটা বলা দরকার যে, এই সরকার কোন নির্বাচিত সরকার নয়। এর মেয়াদও খুব সীমিত। এদিক দিয়ে দেশের শাসন ব্যবস্থার কোন বড় ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা এদের দ্বারা সম্ভব নয়। এদের কাজও সেটা নয়। এদের কাজ হলো যত তাড়াতাড়ি কিছু সংস্কার, বিশেষতঃ নির্বাচন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন দিয়ে দেশের শাসনভার নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা। কিন্তু এদের অবস্থা দেখে মনে হয় এরা এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে না থেকে আরও বৃহত্তর ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী। এ জন্য এরা নিজেদের শাসনকালের মেয়াদ সম্পর্কেও সুনির্দিষ্টভাবে কিছু না বলে, নির্বাচনের কোন তারিখ ঘোষণা না করে অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করছে। এদের নানা ধরনের গড়িমসি দেখে এটা ভাবাই স্বাভাবিক। তবে বাঙলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি এমন যে, তাদেরকে অল্প দিনের মধ্যেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে। নির্বাচন দিয়ে আগামী বছরের মাঝামাঝির মধ্যেই নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে তারা বাধ্য।
বদরুদ্দীন উমর
সম্পাদক, সংস্কৃতি
৬.৫.২০২৫
জুলাই অভ্যুত্থানের পর নয় মাস গত হয়েছে। এই সময়ে বাঙলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির মধ্যে অনেক ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনের সব থেকে উল্লেখযোগ্য দিক হলো বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের একটানা পনেরো বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট চরিত্রের যে পরিচয় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত শেখ মুজিবের শাসন আমলে পাওয়া গিয়েছিল তারই পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল শেখ হাসিনার শাসনকালে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ২০০৯ সালের প্রথম দিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা হলো, এরপর ক্ষমতা তাঁর হাতছাড়া হতে না দেওয়া, যেমন করেই হোক একটানা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা। এই উদ্দেশ্যে প্রথমেই তিনি তাঁদের জোর আন্দোলনের মাধ্যমে প্রণীত ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন বাতিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের নৈতিক বিবেচনার ধারে কাছে না গিয়ে তিনি পরবর্তী সব নির্বাচন নিজেদের সরকারের অধীনে করার জন্য বদ্ধপরিকর হন। ২০০৯ সাল থেকেই শেখ হাসিনা এবং তাঁদের ফ্যাসিস্ট সংগঠন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশে আইন কানুনের কোনো তোয়াক্কা না করে বেপরোয়াভাবে চুরি দুর্নীতি ও নির্যাতনের মাধ্যমে পুরো শাসন ব্যবস্থায় এক অদৃষ্টপূর্ব লুটপাটের প্রক্রিয়া জারী করেন।
এই দুঃশাসন ও লুটপাটের বিরুদ্ধে সামান্য প্রতিরোধ পর্যন্ত যাতে গড়ে উঠতে না পারে এ জন্য তিনি এমন দমন পীড়নের আশ্রয় গ্রহণ করেন যা ১৯৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিবের নির্যাতনের মাত্রাকেও ছাড়িয়ে যায়। কোনো আইন কানুনের ধারে কাছে না থেকে বেপরোয়া গ্রেফতার, অপহরণ ও গুম খুন হয়ে দাঁড়ায় এক নিয়মিত ব্যাপার। এ জন্য তিনি গোয়েন্দা বিভাগের অধীনে ‘আয়না ঘর’ নামে পরিচিত এমন এক নির্যাতন সেল-এর ব্যবস্থা করেন, যার চিন্তা পর্যন্ত বাঙলাদেশে কোনো সরকার ইতিপূর্বে করেনি। শেখ হাসিনা বিনা কারণে এই অপকর্ম করেননি। যে আকারে তাঁর শাসন আমলে দেশে শোষণ ও লুটপাট জারি ছিল, তার বিরুদ্ধে যে কোনো প্রতিরোধ বা সম্ভাব্য প্রতিরোধ দমন করার উদ্দেশ্যে এটাই ছিল তাঁর ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের অর্থনীতিও এর ফলে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবার এবং তাঁদের দল আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা পর্যন্ত শুধু বেপরোয়াভাবে চুরি, দুর্নীতি, লুটপাট করেনি। সেই লুটপাটের টাকা দেশে না রেখে তারা ব্যাপকভাবে বিদেশে পাচার করতে থাকে। এটা ছিল দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে দেশীয় অর্থনীতিকে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার এক প্রক্রিয়া। আওয়ামী লীগের হাজার হাজার লোক লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। এর ফলে বাঙলাদেশের অর্থনীতি ও প্রশাসন ক্ষেত্রে দেখা দেয় এক লণ্ডভণ্ড অবস্থা। এসবের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার অবকাশ এখানে নেই। এর পরিণতিতে সমগ্র রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভাঙনের শর্ত তৈরী হয়। এভাবে এই শর্ত পূরণ না হলে ২০২৪ সালে সরকারের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলন এবং তার শীর্ষে ৫ই অগাস্টের গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হতো না। এই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনই ঘটেনি, একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ সমূলে উৎখাত হয়েছিল। শেখ হাসিনাসহ হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী ৫ই অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের মুখে পড়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। কোনো সরকারের পতনের পর এভাবে সরকার প্রধান থেকে নিয়ে অন্যান্য মন্ত্রী, দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, এমনকি গ্রামাঞ্চলের নেতারা পর্যন্ত ব্যাপক আকারে আত্মগোপন করা কিংবা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আর কোনো দৃষ্টান্ত ইতিহাসে নেই। শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার পনেরো বছর ক্ষমতায় থেকে কত ভয়াবহভাবে দেশের সমগ্র জনগণের ওপর শোষণ নির্যাতন চালিয়েছিল এর মধ্যে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়।
নির্যাতনের কারণে দেশে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ ১৫ বছরে রাজনৈতিকভাবে গড়ে উঠতে না পারলেও অবশেষে বিগত জুলাই মাসে দেশে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ছাত্রদের কোটা আন্দোলন তাদের সাথে সরকারের এক সংঘর্ষের অবস্থা তৈরী করে। পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং সেই তাপ জনগণকে স্পর্শ করে, যে জনগণ ১৫ বছর আওয়ামী শাসনে অতিষ্ঠ অবস্থায় থেকে প্রতিরোধের জন্য উন্মুখ ছিলেন, কিন্তু নির্যাতনের কারণে প্রতিরোধের কোনো ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। বিএনপিসহ সকল বিরোধী দলকে শেখ হাসিনা সরকার নির্যাতনের জালে আটক রেখে পঙ্গু করে রেখেছিল। জুলাই মাসে ছাত্রদের কোটা আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। সেই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ জনগণের প্রতিরোধ শক্তিকে জাগরিত করে এক দাবানল সৃষ্টি করে। সেই দাবানল আওয়ামী লীগের শাসনই শুধু নয়, সমগ্র আওয়ামী লীগ সংগঠনকেই ছারখার করে দেয়। আওয়ামী শাসনমুক্ত বাঙলাদেশে এক নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে ভারতে পলায়ন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শাসন ক্ষেত্রে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের শূন্যতা এক বিপজ্জনক ব্যাপার, কারণ সে অবস্থায় দেশে এক অনিয়ন্ত্রিত অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির শর্ত তৈরী হয়। বাঙলাদেশেও এ সময় তাই হয়েছিল। সে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রেরা এবং জনগণের একাংশ ৮ই অগাস্ট ডক্টর মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এক সরকার গঠন করে। এ কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এভাবে জরুরী ভিত্তিতে এই সরকার গঠিত না হলে এর একমাত্র বিকল্প ছিল সামরিক সরকার। ৮ই অগাস্ট একটি বেসামরিক সরকার গঠন করায় সে সম্ভাবনা দূর হয়েছিল। এদিক দিয়ে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ এই সরকারকে অনির্বাচিত বলে সমালোচনা করে থাকেন। কিন্তু ৫ই অগাস্টের পর দেশে নৈরাজ্য ঠেকানোর জন্য কোন নির্বাচিত সরকার তো সম্ভব ছিল না। সেক্ষেত্রে অনির্বাচিত সরকারের কোন বিকল্প চিন্তা করার মত অবাস্তব চিন্তা আর কি আছে? তাছাড়া এই সরকার তো উড়ে এসে জুড়ে বসে নাই। তাদেরকে ডেকে এনে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল।
জুলাই-অগাস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থানের উথাল পাথাল পরিস্থিতিতে কোটা আন্দোলনকারী ছাত্রেরা বাঙলাদেশে এক নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। এ ধরনের ঘটনা ইতিহাসে বিরল। গণঅভ্যুত্থানের আগে তাদের কোন শক্তিই ছিল না। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর তারা নিজেরা ক্ষমতাসীন না হলেও সরকার গঠন করার মত শক্তিতে পরিণত হয়। তাদের কয়েকজন উপদেষ্টা হিসাবে সরকারে যোগদান করেন। এ সরকারের চরিত্র যাই হোক, এর একটা বড় কৃতিত্ব হলো ৫ই অগাস্টের পর দেশে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে না দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা তৈরী করা। ছাত্ররাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনগণের জীবনে যে শ্বাসরোধকারী অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার অবসান ঘটে। জনগণ কর্তৃক নির্ভয়ে ও স্বাধীনভাবে নিজেদের কথা বলার মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এটাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ের প্রথম উল্লেখযোগ্য দিক। পনেরো বছর দেশে রাজনৈতিক স্থবিরতার পর প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা দেয়। বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম ইত্যাদি রাজনৈতিক দলগুলি দীর্ঘদিন পর বাঙলাদেশের রাজনীতির মাঠে নামে। ছাত্রদের কোনো সংগঠিত দল না থাকলেও একভাবে সংগঠিত হয়ে তারাও রাজনৈতিকভাবে তৎপর হয়। তাদের তৎপরতা থেকে বোঝা যায় যে, তারা দল হিসাবে এখনো পর্যন্ত সংগঠিত না হলেও অদূর ভবিষ্যতে তারা নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এক পর্যায়ে তাদের বড় অংশটি জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে (National Citizen Party, NCP) একটি পার্টি গঠন করে।
জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউ চত্বরে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে মহা ধুমধামের সাথে এই রাজনৈতিক দলের উদ্বোধন হয়। এর ঠিক পরই দলটির প্রথম কর্মসূচী হয় সুহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ইফতার পার্টি। তাদের দ্বিতীয় কর্মসূচী হয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক বিশাল ইফতার পার্টি যাতে ব্যয় হয় লক্ষ লক্ষ টাকা। কোন জনসভার আয়োজন না করে এই ধরনের ইফতার পার্টির কর্মসূচী পালন করা ছিল এক বিস্ময়ের ব্যাপার। কারণ এই কর্মসূচীর কোনো গণতান্ত্রিক চরিত্র ছিল না। উপরন্তু তার মধ্যে দেখা গিয়েছিল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীর বড় সংগঠনের সাথে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা। এটা ছিল এক হতাশাব্যঞ্জক ব্যাপার। কারণ জুলাই গণঅভ্যুত্থান এক দৃষ্টান্তকারী ঘটনা হলেও এসব কর্মসূচীর মধ্যে কোন গণতান্ত্রিক উপাদান ছিল না। তাছাড়া অভ্যুত্থানের আগে যে ছাত্রদের হাতে কানাকড়িও ছিল না, তাদের হাতে লক্ষ লক্ষ টাকা কিভাবে এলো এটাও ছিল এক লক্ষ্যণীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ টাকার উৎস কী ছিল সেটাও এক বড় প্রশ্ন। শুধু এ ধরনের সাংগঠনিক ব্যয় ছাড়াও তাদের এক নেতাকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে একশত গাড়ী নিয়ে তাদের গ্রামে প্রবেশ করতে দেখা যায়। এটা বোঝার আর কোন অসুবিধা ছিল না যে, দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী সংস্থার আনুকূল্য ছিল এসব কর্মকাণ্ডের আর্থিক যোগানদার।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের থেকে আশা করা গিয়েছিল যে, তারা দেশে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দল ও শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হবে। তার পরিবর্তে তাদের এই অবস্থা দাঁড়ানো খুব হতাশাব্যঞ্জক। তাছাড়া তাদের রাজনৈতিক দলের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তাদের বক্তব্য ও কার্যক্রমে দেশের শ্রমজীবী জনগণ, বিশেষ করে শ্রমিক কৃষকের বিষয়ে কোন কথাই আজ পর্যন্ত শোনা যায় নি। তাদের সমস্ত কর্মসূচীর মূল লক্ষ্য দাঁড়ায় দেশে ক্ষমতার মসনদ দখল করা। এদিক দিয়ে ছাত্রদের নোতুন দলের ভূমিকার মধ্যে দেখা যায় দেশে একটি নোতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সরকার গঠনে সহায়তার পরিবর্তে নিজেরা সরকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার এক উদগ্র আকাংখা। এই আকাংখার দ্বারা তাড়িত হয়েই তারা এখন বাঙলাদেশের রাজনীতি ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে।
ছাত্রদের এই রাজনৈতিক দলটির অন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর শ্রেণী চরিত্র। গঠিত হওয়ার পরই তারা ঘোষণা করে যে, তারা বামপন্থী অথবা দক্ষিণপন্থী নয়। তারা হলো মধ্যপন্থী। কিন্তু বাস্তবত: মধ্যপন্থী বলে কোন কিছু তো রাজনীতিতে নেই। প্রকৃতপক্ষে দেখা যাচ্ছে এদের কর্মসূচী ও কথাবার্তা দেশের বুর্জোয়া দক্ষিণপন্থী দলগুলির মতই। শ্রমজীবী কৃষক শ্রমিকের কোন বিষয় এদের কর্মসূচীতে না থাকা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা, ধর্মীয় দলগুলি, বিশেষতঃ জামায়াতে ইসলামীর সাথে এদের অপেক্ষাকৃত নিকট সম্পর্ক এদের দক্ষিণপন্থী চরিত্রকেই নির্দেশ করে। বস্তুতঃপক্ষে বাংলাদেশে অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে দক্ষিণপন্থীদের তৎপরতা এখন প্রাধান্যে। বামপন্থীদের কোন উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ও তৎপরতা নেই।
৫ই অগাস্ট পরবর্তী সম্ভাব্য নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে না দেওয়াই বর্তমান সরকারের সব থেকে বড় অর্জন। এদের অন্য উল্লেখযোগ্য কাজ হলো, বিশৃংখল ও বিধ্বস্ত ব্যাংকিং খাতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনা, আওয়ামী লীগ আমলের লণ্ডভণ্ড অবস্থা সামাল দেওয়ার উদ্দেশ্যে কতকগুলি কমিশন গঠন করা। এই কমিশনগুলি ইতিমধ্যে তাদের রিপোর্ট প্রদান করেছে। এদের রিপোর্টের ভিত্তিতে দেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলেও তা কতখানি সম্ভব এটাও দেখার বিষয়। বর্তমান সরকার তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করলেও এদিক দিয়ে তারা কতখানি সাফল্য নিশ্চিত করবে সেটাও অনিশ্চিত। এর কারণ বর্তমান সরকার আকাশ থেকে পড়া কোন শক্তি না। যে শাসক শ্রেণী প্রকৃতপক্ষে এই দেশ শাসন করছে তার আয়ত্তের বাইরে থেকে এদের দ্বারা উল্লেখযোগ্য কোন কিছু করা সম্ভব নয়। এই শ্রেণী কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করা ছাড়া এদের কোন উপায় নেই। এ কারণে এদের শাসনে দেশ একটা স্থিতাবস্থায় থাকলেও শ্রমিক কৃষক শ্রমজীবীদের এদের থেকে কিছু পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। অন্য যে কোন সরকারের মত এই সরকারও দেশের শ্রমিক ও শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থে কিছু করছে না। উপরন্তু শ্রমিকদের মজুরী এবং অন্যান্য স্বার্থের ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা আগের যে কোন সরকারের মতই, এমনকি পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের মতই।
১৯৭২ সালে বাঙলাদেশে যে ব্যবসায়ী শ্রেণী শাসক শ্রেণী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল তারাই শেখ হাসিনার পনেরো বছরের শাসন আমলে দেশ শাসন করেছে। ৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া এবং আওয়ামী লীগের পতন
সত্ত্বেও এই শাসক শ্রেণী দেশ ছেড়ে যায় নি। তারা আছে। তারাই পর্দার অন্তরালে থেকে দেশের যাবতীয় ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। বর্তমান সরকারও এই শাসক শ্রেণীর কাঠামোর মধ্যে থেকে শাসন কাজ পরিচালনা করছে। শেখ হাসিনা সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসন উচ্ছেদ হলেও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শ্রেণীগতভাবে তারা উচ্ছেদ হয়নি। কাজেই ৫ই অগাস্টের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ফ্যাসিবাদ মুক্ত হলেও ফ্যাসিবাদের ভিত্তি এই ব্যবসায়ী শাসক শ্রেণী তার কাঠামোর মধ্যে এদেশের রাজনীতি এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে।
৫ই অগাস্টের পর এদেশের জনগণের মানসিকতার (mindset) মধ্যে যা শক্তিশালীভাবে দেখা দিয়েছে তা হলো নির্যাতন সহ্য না করা। এ কারণে এখন জনগণের ওপর সাধারণভাবে কোন নির্যাতন নেই, যদিও শ্রমজীবী জনগণের দাবী দাওয়ার ক্ষেত্রে এরা উদাসীন এবং বিরোধীও বটে। শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এদের বিরোধিতা আছে। এদিক দিয়ে দেশের ধনিক শ্রেণীর পক্ষেই এরা কাজ করছে। এর মূল কারণ জুলাই গণঅভ্যুত্থান এক গণতান্ত্রিক ব্যাপার হলেও সেটা কোন সামাজিক বিপ্লব ছিল না। এ কারণে দেশের শাসন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রেণী বৈষম্য দূর করার কোন প্রক্রিয়া অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে নেই। ছাত্রদের পক্ষ থেকেও এক্ষেত্রে কোন ভূমিকা নেই। তারা উল্লেখযোগ্যভাবে নীরব আছে। কারণ কোটা ক্ষেত্রে বৈষম্যের কথা থাকলেও কোটা বৈষম্য ও সামাজিক বৈষম্য এক জিনিষ নয়। তাদের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য। কোটা বৈষম্য হলো শাসক শ্রেণীর একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যে বৈষম্য। সামাজিক বৈষম্য বিষয়ে ছাত্রদের কোন ধারণা নেই। তাদের কোন বক্তব্যও কোথাও নেই।
এসব কারণে দেখা যায় যে, অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সামাজিক বৈষম্য দূর করা, প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কারও কোন চিন্তাভাবনা এবং উদ্যোগ নেই। উপরন্তু দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রভাব এখন সর্বত্র। এদিক দিয়ে বলা চলে অভ্যুত্থান পরবর্তী পর্যায়ে বাঙলাদেশের রাজনীতিতে সামগ্রিকভাবে এখন দক্ষিণপন্থীদের প্রাধান্য। এই প্রাধান্যের একটি দিক হলো বর্তমান পরিস্থিতিতে ধর্মীয় দলগুলির তৎপরতা। বামপন্থী দলগুলির কোন উল্লেখযোগ্য তৎপরতা এখন না থাকলেও ধর্মীয় দলগুলি, বিশেষতঃ জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের মত চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের তৎপরতা বর্তমান পরিস্থিতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক। ছাত্রদের নোতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির সম্পর্কও এই ধরনের ধর্মীয় দলগুলির সাথে তুলনামূলকভাবে ঘনিষ্ঠ।
জামায়াতে ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম ইত্যাদি ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলি এখন কোরান হাদিসের সাথে সংগতিপূর্ণ শাসনতন্ত্র এবং আইন কানুনের কথা জোরে শোরে বলছে। তারা এমনভাবে এসব কথা বলছে ও দাবী দাওয়া তুলছে যাতে মনে হবে বাঙলাদেশ একটি ইসলামী রাষ্ট্র। অভ্যুত্থান পরবর্তী বাঙলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। এর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু জামায়াতসহ অন্য ধর্মীয় সংগঠনগুলি এমনভাবে দাবী দাওয়া তুলছে যাতে মনে হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আসল লক্ষ্য এদেশে একটি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এর থেকে বিপজ্জনক ব্যাপার আর কী হতে পারে?
সামগ্রিকভাবে বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে বর্তমান সরকার এবং এদের কার্যকলাপ সম্পর্কে এখানে সাধারণভাবে কিছু বলা দরকার। এদের শ্রেণী চরিত্রের কথা আগেই বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আলোচনার সময় এদের শ্রেণী চরিত্রের কথা বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। একটি সরকার কিছু ভালো কাজ করতে পারে, কিছু ভালো কাজ না করতে পারে এবং কিছু খারাপ কাজ করতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে এদের কিছু ভালো গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা বলা হলেও পরের দিকে কিছু ভালো কাজ করার ক্ষমতা থাকলেও তারা তা করেনি। এক্ষেত্রে সব কাজের বিষয় আলোচনা সম্ভব নয়। তবে একটি বহুল আলোচিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে এ ধরনের কাজে সরকারের ব্যর্থতার পরিচয় ভালোভাবেই পাওয়া যায়।
২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী নিহত হন। তারপর ১৩ বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত এই হত্যা মামলার কোন সুরাহা হয়নি। শেখ হাসিনার আমলে এই মামলার তদন্তের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ, র্যাব ১২ বছর ধরে 'তদন্তে' আদালতে তার প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করতে ১১২ বার ব্যর্থ হয়। ইতিহাসে কোন তদন্তকারী সংস্থার এই ধরনের ব্যর্থতার কোন দৃষ্টান্ত নেই। এর থেকেই স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল যে, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে উচ্চতম সরকারী মহলের সম্পর্ক আছে। সরকারের নির্দেশেই যে র্যাব ১২ বছর ধরে ১১২ বার আদালতে তার প্রাথমিক রিপোর্ট দাখিল করতে 'ব্যর্থ' হয় এতে কারও কোন সন্দেহ ছিল না।
সাগর-রুনী হত্যার পরই বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে এবং এর জন্য শেখ হাসিনাকেই হত্যাকারী বলে জনগণ ও সাধারণভাবে সাংবাদিক মহল মনে করে। এর কারণ শেখ হাসিনার পুত্র জয় এর চরম ও বড় আকারের চুরি দুর্নীতির কিছু প্রামাণ্য দলিল সাগর-রুনীর হস্তগত থাকা। ইতিপূর্বে সাগর জার্মানীতে জার্মান রেডিওতে কর্মরত থাকা অবস্থায় এগুলি সংগ্রহ করেন। দেশে ফিরে এসে সাগর মাছরাঙা টেলিভিশনে বার্তা সম্পাদক এবং তাঁর স্ত্রী 'এটিএন বাংলার' সিনিয়র রিপোর্টার হিসাবে যোগদান করেন। এ সময় রুনী এটিএন বাংলার ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে জানান যে, জয় এর দুর্নীতি বিষয়ক প্রামাণ্য কাগজপত্র তাঁদের কাছে আছে এবং সেগুলি টেলিভিশনে প্রকাশ করার অনুরোধ করেন। ম্যানেজিং ডিরেক্টর ঐ দিনই শেখ হাসিনার কাছে গিয়ে এ বিষয়ে তাঁকে অবহিত করেন। পরদিন ভোর বেলাতেই সাগর-রুনী দম্পতি তাঁদের বাসায় ঘাতকের হাতে নিহত হন। এ সময় তাঁদের ল্যাপটপসহ অন্যান্য সব কাগজপত্রও লুট করে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা। উল্লেখ করা দরকার যে, এই হত্যাকাণ্ডের ঠিক পরই তৎকালীন আওয়ামী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দ্রুত খুনীদেরকে গ্রেফতার ও তাদেরকে বিচারের মুখোমুখী করার কথা বলেন। কিন্তু এর পরেই দেখা যায় এ বিষয়ে সাহারা খাতুন কোন পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা একটি বাক্যও আর উচ্চারণ করেন নি! উপরন্তু দেখা যায় যে, মামলা শুরু হওয়ার পর থেকে তার কোন অগ্রগতি না হয়ে ১২ বছর ধরে তদন্তের ভারপ্রাপ্ত র্যাব ১১২ বার আদালতে তার প্রাথমিক রিপোর্ট দাখিল করতে ব্যর্থ হয়। আপাতঃদৃষ্টিতে এটা এক অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর ব্যাপার। কিন্তু এক্ষেত্রে আসলে বিস্ময়ের কোন ব্যাপার ছিল না। কারণ র্যাব হাসিনার নির্দেশেই এ কাজ করেছিল। এছাড়া র্যাবের এই কাণ্ডের অন্য কোন যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা নেই।
সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ড ছিল এবং এখনো আছে এদেশে টার্গেট কিলিং (Target Killing) এর সব থেকে গুরুতর এবং বহুল আলোচিত এক বিষয়। এর গুরুত্বের কারণেই বর্তমান সরকার এ হত্যাকাণ্ড বিষয়ে নোতুন করে তদন্ত শুরু করেছে। কিন্তু সেটা করলেও দেখা যাচ্ছে যে, এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সঠিক পথে এগুচ্ছে না। তদন্ত এমনভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে যাতে আসল অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। প্রথমতঃ, ১২ বছর ধরে তদন্তের কোন অগ্রগতি না হয়ে র্যাব ১১২ বার প্রাথমিক রিপোর্ট দাখিল করতে কেন ব্যর্থ হয় তার কোন কথা নেই। দ্বিতীয়তঃ, এমনভাবে এই তদন্ত হচ্ছে যাতে এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে যে, এটা এক মামুলী বা সাধারণ হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ড যে সাগর-রুনী কর্তৃক এটিএন বাংলার ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে হাসিনার পুত্র জয় এর চুরি দুর্নীতির বিষয় অবগত করার প্রায় সাথে সাথেই ঘটেছিল সেদিকে তদন্তকারীদের কোন দৃষ্টি নেই। তাছাড়া তারা এমনভাবে তাদের তদন্তের কথা বলছে যা বিস্ময়কর তো বটেই, উপরম্ভ হাস্যকর। খুনের জন্য হত্যাকারীরা রান্নাঘরের বঁটি ছুরি ব্যবহার করেছিল কিনা এ বিষয়েও তারা 'তদন্ত' করছে। এর থেকে মনে হয় হত্যাকারীরা হত্যার জন্য গেলেও তাদের কাছে কোন অস্ত্র ছিল না, তারা খালি হাতে সাগর-রুনীর বাসায় ঢুকেছিল। তদন্তকারীদের এ ধরনের আরও অনেক উদ্ভট কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে যা থেকে মনে হয় তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে আসল হত্যাকারীদের থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। হয়তো দেখা যাবে যে, শেষ পর্যন্ত এরা এক ভুয়া তদন্তের নামে আসল অপরাধীদেরকে চিহ্নিত করার পরিবর্তে কয়েকজন নিরাপরাধী ব্যক্তিকে অপরাধী সাজিয়ে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছে। সরকার চাপের মুখে এবং বহু আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডটির গুরুত্বের কারণে গোপনভাবে তদন্তের ব্যবস্থা করলেও এ ব্যাপারে তাদের আর কোন করণীয় আছে বলে মনে হয় না। তারা হাত পা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে অবলোকনকারী হিসাবে। বর্তমান তদন্তকারীরা যে হাসিনার আমলের তদন্তকারীদের মতই একই পালকের পক্ষী এতে কোন সন্দেহ নেই।
শেখ হাসিনার পুলিশ প্রশাসনের সাথে বর্তমান পুলিশ প্রশাসনের যে কোন পাথক্য নেই, আগের লোকরাই যে প্রশাসনে বহাল তবিয়তে থেকে আগের মত এ কাজ করছে এর থেকে এটাই প্রমাণিত হয়। এখানে সাগর-রুনীর হত্যাকাণ্ডের ওপর এত বিস্তারিত আলোচনা করা হলো এটা দেখানোর জন্য যে অনেক বাগারম্বর সত্ত্বেও পুলিশ প্রশাসন এবং সাধারণভাবে সমগ্র প্রশাসনের চরিত্র আগের মতই রয়ে গেছে। বাঙলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কার্যকরভাবে জারী করার ক্ষেত্রে যে বিশাল ও শক্তিশালী প্রতিবন্ধকতা অভ্যুত্থান পরবর্তী পর্যায়ে সমগ্র শাসন ব্যবস্থার মধ্যে রয়ে গেছে এটা সেই পরিস্থিতির এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।
বর্তমান সরকার প্রসঙ্গে ফিরে এসে এটা বলা দরকার যে, এই সরকার কোন নির্বাচিত সরকার নয়। এর মেয়াদও খুব সীমিত। এদিক দিয়ে দেশের শাসন ব্যবস্থার কোন বড় ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা এদের দ্বারা সম্ভব নয়। এদের কাজও সেটা নয়। এদের কাজ হলো যত তাড়াতাড়ি কিছু সংস্কার, বিশেষতঃ নির্বাচন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন দিয়ে দেশের শাসনভার নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা। কিন্তু এদের অবস্থা দেখে মনে হয় এরা এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে না থেকে আরও বৃহত্তর ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী। এ জন্য এরা নিজেদের শাসনকালের মেয়াদ সম্পর্কেও সুনির্দিষ্টভাবে কিছু না বলে, নির্বাচনের কোন তারিখ ঘোষণা না করে অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করছে। এদের নানা ধরনের গড়িমসি দেখে এটা ভাবাই স্বাভাবিক। তবে বাঙলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি এমন যে, তাদেরকে অল্প দিনের মধ্যেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে। নির্বাচন দিয়ে আগামী বছরের মাঝামাঝির মধ্যেই নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে তারা বাধ্য।
বদরুদ্দীন উমর
সম্পাদক, সংস্কৃতি
৬.৫.২০২৫
উজ্জ্বল নক্ষত্র বদরুদ্দীন উমর (১৯৩১) আর নেই। তিনি কেবল উপনিবেশ-পরবর্তী বাংলাদেশের একজন মার্কসবাদী ইতিহাসবিদই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী তাত্ত্বিক এবং রাজনীতিবিদও। লেখালেখি ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্য দিয়ে শ্রেণিসংগ্রাম, জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রগঠনের প্রচলিত ধারণাকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। নিজের
১৫ ঘণ্টা আগেঅধ্যাপক উমরের সাথে আমার দীর্ঘদিনের সখ্যতা। তাঁর শেষ দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আজও মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তিনি ছিলেন অসম্ভব রসবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ। বাইরে থেকে তাঁকে কিছুটা কাঠখোট্টা মনে হলেও, তাঁর ভেতরের সূক্ষ্ম রসবোধ ছিল অসাধারণ। প্রায়ই তিনি মজা করে বলতেন, ‘আমি তো ইয়ের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি, আজরাইল আমার
১৭ ঘণ্টা আগেবদরুদ্দীন উমরের কাজগুলো কেউ মুছে দিতে পারবে না। তিনি ১১৫টি বই লিখেছেন। বেশির ভাগ মানুষ তাঁর এতগুলো বই পড়েননি। কিছু কিছু সাক্ষাৎকার হয়তো পড়েছে। কিন্তু তারা সমালোচনা করার ব্যাপারে খুব তৎপর। যাইহোক, আমি তাঁর প্রধান প্রধান বইগুলো পড়ার চেষ্টা করেছি। ফলে আমি তার সমগ্র কাজকে বিবেচনায় নিয়ে বলতে পারি, বাংলা
১৭ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রগতিশীল চিন্তার ‘বাতিঘর’ হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ সেখানেই সম্প্রতি এক ছাত্রীকে দলবদ্ধধ র্ষণের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ এক তিক্ত সত্যকে সামনে এনেছে।
৩ দিন আগে