মানুষ ব্যষ্টি ও সমষ্টি হিসেবে তার বোধ ও বিশ্বাসের বিশ্বেই বসবাস করতে চায়। তার সব পদক্ষেপকে নিজের নিরিখেই যৌক্তিক ভাবতে ভালোবাসে। দেশ ও সমাজ-সংসারসংক্রান্ত উপলব্ধি ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো যার যার চিন্তাধারা অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। মানসচক্রবালের চৌহদ্দিভেদে দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য হয়ে থাকে।
নৃতত্ত্ববিদ আর সমাজতত্ত্ববিদ যথাক্রমে পৌরুষ ও পরিবেশকে মানুষের বোধ, বিশ্বাস ও সৃষ্টির নিয়ামক ভেবে থাকেন। উভয়ের মতবাদের মধ্যে বৈরিতা নেই, বরং পরিপূরকের সম্পর্ক আছে। অস্থিমজ্জার সঙ্গে মিশে থাকা জাত্যাভিমানে ও পরিবেশ-প্রভাবের মেলবন্ধনে যে প্রতীতি গড়ে ওঠে, তা ব্যষ্টি ও সমষ্টির সমাজকে গতিদান করে। সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে না পিছিয়ে পড়ছে; ভাঙছে না গড়ছে, তা শনাক্তকরণের কাজে নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিকের সমীক্ষার বিকল্প নেই।
সবার ওপর মানুষ সত্য—এ উপলব্ধিরও কোনো বিকল্প নেই। মানুষই নিজেকে ও সকলকে, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের অবয়বে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণকে নিয়ন্ত্রণ করে। অবকাঠামো গড়ে যে সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়, তার ধ্বংসের কারণও আবার সেই সৃষ্টি করে। মুক্তবুদ্ধির মাধ্যমে মানুষ যেমন দৃষ্টির প্রসারে আলোকিত হয়, অবরুদ্ধ চিত্ততায় বন্দিত্ব বরণের ফলে অন্ধকারে ডুবে যাওয়াও তার ভাগ্যে ঘটতে পারে। ভালো পথ যাচাই ও গ্রহণ-বর্জনের প্রশ্নটিও আদিকাল থেকে অব্যাহতভাবে অমীমাংসিত আছে বলেই জীবন ও সমাজ গতিশীল। বৈধ-অবৈধের প্রতি আসক্তি ও আকর্ষণের তারতম্যের মধ্যে সমাজের পরিবেশ-পরিচয় প্রকাশ পায়।
সৃজনশীলতা মানুষের অন্যতম ধর্ম। প্রকৃতির অপার সম্পদ ও সৌন্দর্যকে রূপান্তর ও বহুমাত্রিক ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে মানুষ তার মেধা ও মননকে কাজে লাগায়। মানুষের মধ্যে যে সুকুমার বৃত্তিগুলো সৃজনসম্ভাবনায় উন্মুখ হয়ে আছে, উপযুক্ত পরিবেশের সমর্থনে ফল্গুধারার মতো তা বেরিয়ে আসতে পারে। এখানেও সৃজনশীলতা গঠন ও ধ্বংসের উভয় পর্যায়েই হতে পারে। সৃজনশীলতা গঠন না ধ্বংসের, তা নির্ভর করে পরিবেশের প্রযত্ন, প্রয়াস ও চাহিদার ওপর।
ঘটনার প্রকৃত কারণ নিহিত থাকে নেপথ্যে। যার দ্বারা ঘটনা ঘটে সে উপলক্ষ মাত্র, যে কারণে ঘটনা ঘটে কিংবা যে ঘটনা ঘটায়, সেটিই মুখ্য। ভাড়াটে খুনিকে দোষী সাব্যস্ত করার পাশাপাশি কার দ্বারা এবং কেন খুনি ভাড়া করা হলো, তার যথাযথ হদিস হওয়া বাঞ্ছনীয় সমস্যার প্রকৃত নিষ্পত্তির লক্ষ্যেই। নইলে সমাজের নৈতিক ভারসাম্য আর মূল্যবোধের প্রতি আস্থার ভিত্তিতে ধরতে পারে ভাঙন।
এটা প্রকৃতির অমোঘ বিধান যে অন্যায়-অনিয়মের পরিবেশ সৃষ্টিকারী ও ইন্ধনদাতা অন্যায়কারীর চেয়ে বেশি দায়ী। একে সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই। কেননা, প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘনকারীর অনিবার্য পরিণতিও অলঙ্ঘনীয়। কার্যকারণ ছাড়া কোনো কিছু যেমন ঘটে না, তেমনি কোনো ক্রিয়াই প্রতিক্রিয়াহীন থাকে না।
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ী জাতি বিগত ৫৪ বছরে গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যে পটপরিবর্তনসমূহ প্রত্যক্ষ করেছে, তা বাড়াবাড়ির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হিসেবেই এসেছে।
সমাজে বিভিন্ন উপলক্ষে এমন সব ঘটনার উদ্ভব হয়, যা সমাজের গতিপ্রকৃতির দিকনির্দেশ করে। গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে সমাজ সমৃদ্ধ হয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের দ্বারা বিজ্ঞান ও সভ্যতার অনেক সুযোগ সহজে হাতের কাছে এসে যায়। ধ্যানধারণায় তা যেমন নতুন মাত্রা যোগ করে, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও সূচিত হয় বিভিন্ন সুযোগ।
শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসান ঘটাতে মানুষ সংগ্রাম করে, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায় বুক বাঁধে। প্রত্যাশা পূরণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে দেখলে সে সংগ্রামের সার্থকতা খুঁজে পায়, উদ্দীপ্ত চেতনায় দীপান্বিত হয়ে ওঠে। তার এবং সকলের ঐকান্তিক প্রয়াসে উন্নয়ন ও সংহতি সুদৃঢ় হয়ে ওঠে। আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণের পরিতৃপ্তিতে তুষ্ট জনগোষ্ঠীকে কোনো বাদ-বিসংবাদ বিভ্রান্ত করতে পারে না। আগে যেমন বলা হয়েছে—মানুষ তার কর্মকাণ্ডের যৌক্তিকতা খুঁজে ফেরে নিয়ত নিজের নিরিখে। যদি দেখা যায় ক্ষুদ্র ও খণ্ডিত স্বার্থবাদিতায় বিভ্রান্তি ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে তার আত্মত্যাগের মহৎ উদ্দেশ্যগুলো, তাহলে তার সক্রিয় অংশগ্রহণের যৌক্তিকতার ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। তার উদ্দেশ্য-অভিপ্রায়ের, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ানের আঙিনায় অপব্যাখ্যার আগাছা জন্মায়। সে আগাছা একসময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের গতিশীলতার জন্য সেটা এক দারুণ দুঃসংবাদ।
অথচ ব্যষ্টি ও সমষ্টির মধ্যে প্রতিযোগিতাময় বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তুলনামূলক সমৃদ্ধি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়। এটা অত্যন্ত জরুরি ও প্রয়োজন যে প্রতিনিয়ত সফলতা-ব্যর্থতার খতিয়ান পর্যালোচনা, ভুল পদক্ষেপকে শনাক্ত করে শ্রেয়তর পদক্ষেপ গ্রহণের ঐকান্তিকতার পরিপোষণ। বিভ্রান্তি ও বিভক্তি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র প্রশ্রয় পেয়ে যাতে উন্নয়নের ধারায় বাধা সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার।
ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র একসূত্রে গাঁথা। তার বর্তমান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যমণ্ডিত অতীতকে সফল বর্তমানে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে পারলেই তা সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের ধাপ হিসেবে স্বীকৃত হবে। আজকের বর্তমানও একদিন ইতিহাসের বিবেচ্য বিষয় হবে। সবসময় অতীত বন্দনা ও প্রতিষ্ঠায় দৃষ্টি ও মনোযোগ নিবদ্ধ থাকলে বর্তমানের কী হবে? কোন পরিচয়ে বর্তমান ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে, সে বিবেচনাও অত্যন্ত জরুরি। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে বিনির্মাণ করার প্রয়াস সোনালি ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে।
বিদ্যমান ব্যবস্থাপনার সংস্কার কিংবা উন্নয়নকামী যেকোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দরকার বাস্তবায়নযোগ্যতা ও বাস্তবায়ন করার দৃঢ়চিত্ততা বিষয়ক বিবেচনা। তা না হলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আন্তরিক প্রয়াস নিশ্চিত হয় না। সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা ঠুনকো কার্যকারণকে উপলক্ষ করে নেওয়া পদক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী ফল বয়ে আনে না।
শুধু নিজেদের মেয়াদকালে বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ ও কার্যক্রম গ্রহণ করলে এবং পরবর্তীজন কর্তৃক পূর্ববর্তীজনের কার্যক্রমকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার রেওয়াজ শুরু হলে টেকসই উন্নতির সম্ভাবনা সীমিত হয়ে পড়তে বাধ্য। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য রূপকল্প প্রণয়নকারীর প্রগাঢ় প্রতিশ্রুতি ও দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রয়োজন হয়।
সমস্যা চোখে পড়লে ব্যবস্থা নিতে নিতে সব সামর্থ্য ও সীমিত সম্পদ নিঃশেষ হতে দিলে প্রকৃত উন্নয়নের জন্য পুঁজি ও প্রত্যয়ে ঘাটতি তো হবেই। তেল আনতে নুন ফুরায় যে সংসারে, সেখানে সমৃদ্ধির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। সমস্যারা পরস্পরের মিত্র, একটির সঙ্গে অন্যটির যেন নাড়ির যোগাযোগ।
আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে ব্যক্তি-নিরাপত্তার, ব্যক্তি-নিরাপত্তার সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার, সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে আয়-উপার্জনের সব কার্যক্রমের কার্যকারণগত সম্পর্ক রয়েছে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চাই আয়-উপার্জনের সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ। শিক্ষা কর্মদক্ষতাকে, স্বাস্থ্যসেবা কর্মক্ষমতাকে, কর্মদক্ষতা ও কর্মক্ষমতা উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটাবে—এটাই প্রত্যাশা। সর্বত্র সেই পরিবেশের সহায়তা একান্ত অপরিহার্য, যেখানে সীমিত সম্পদের ও সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব। একটিকে উপেক্ষা করা মানে একই সঙ্গে অন্যান্য সমস্যাকে ছাড় দেওয়া। সমস্যার উৎসে গিয়ে সমস্যার সমাধানে ব্রতী হতে হবে। এ কাজ কারো একার নয়, এ কাজ সকলের।
সমস্যার মোকাবিলায় প্রয়োজন সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা পরিপোষণের জন্য নয়। যেকোনো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। সংস্কার বাস্তবায়ন কোনোমতেই সহজসাধ্য নয় বলে সর্বত্র দৃঢ়চিত্ততা আবশ্যক। এখানে দ্বিধান্বিত হওয়া, দ্বিমত পোষণ করা কিংবা প্রথাসিদ্ধ মানসিকতার সঙ্গে আপস করার সুযোগ থাকতে নেই।
অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্র নির্বাচন ও পন্থা নির্ধারণেও সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। অতীতের উদাহরণ এনে বর্তমানের ভুলভ্রান্তিকে যৌক্তিক করার চেষ্টার চেয়ে আত্মঘাতী প্রতারণা আর নেই। ‘গুড প্রিসিডেন্স’ বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে সমৃদ্ধ হতে যতখানি সহায়তা করে, ‘ব্যাড প্রিসিডেন্স’ তার চেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অতীতেও এমনটি করা হয়েছে—এই বলে যদি বর্তমানের অপকর্মের যৌক্তিকতা দাঁড় করানো ও সাফাই বন্দনা শুরু হয়, তাহলে গঠনমূলক মূল্যবোধের বিকাশকে অসম্ভবই শুধু করে তোলা হবে না, চক্রবৃদ্ধি হারে তার মাশুল গুনতে হয়; আর তা করতে হয় অতীতের মতো করে ভবিষ্যৎকেও।
অথচ কথা ছিল ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’ চুয়ান্ন বছরের জয়ের আনন্দ-বেদনা, সমৃদ্ধি-সর্বনাশ আর প্রত্যাশা-প্রাপ্তির খতিয়ান ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎ জানালায় তাকিয়ে দেখি, বাইরে অসংখ্য মানুষের মুখ। একবিংশ শতাব্দীর এই সূচনাপ্রহরে গণপ্রজাতন্ত্রী আমাদের এই সময় ও সমাজে বয়স, বর্ণ, পর্যায় ও প্রকারভেদে নানান কিসিমের মানুষ এখনো রীতি-পদ্ধতি, নীতি ও নিয়মে উপনিবেশিত।
শ্রমজীবী কর্মক্লান্ত মানুষের পাশাপাশি অতিচালাক ফিটফাট ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও কর্মী, শিক্ষাবিহীন শিক্ষিতের সমারোহের পাশে প্রযুক্তিপ্রখর মেধাবী মুখ, মুক্তবুদ্ধি শান্ত সমাহিত চিন্তাচেতনার সারিতে সহসা মৌলবাদী চেহারার মানুষ, উন্নয়নকর্মীর পাশাপাশি নিজের আখের গোছাতে তৎপর এনজিও কর্ণধার, সন্ত্রাসীর ভয়ে আতঙ্কিত মানুষ, চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী আত্মোৎসর্গীকৃত সেই পুলিশ সার্জেন্ট, ষড়যন্ত্রের শিকার গৃহহীন মানুষ, আশ্রয়ণ প্রকল্পে হাসিমুখের মানুষ, বানভাসি মানুষ, নিঃস্বার্থ ত্রাণকর্মীর পাশে সুযোগসন্ধানী অসৎ উদ্দেশ্য-অভিলাষী চোখের মানুষ, কোণঠাসা সৎ ও নিষ্ঠাবান চাকুরে, ধান্দাবাজ আর স্বার্থের শর্করাসমৃদ্ধ জনস্বার্থসেবী আমলা, অবিবেচক বাসের হেলপার, ট্রাকের মাতাল ড্রাইভার, নীল-সাদা অধ্যাপক, একচোখা আঁতেল, রাজনৈতিক শিল্পী, ঋণখেলাপি, ব্রিফকেসবাহী নতুন শিল্পপতি, নকল সরবরাহকারী, উদ্ধত ছাত্রনেতার সামনে অসহায় অধ্যক্ষ, জামিনপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী, কুকুরের মাংস বিক্রেতা আর এসিডে দগ্ধ তরুণীর দেশে সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটার।
লেখক: বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব