leadT1ad

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা কারা করেছিলেন, পাকিস্তানি জেনারেলদের বই ঘেঁটে যা জানা গেল

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

স্ট্রিম গ্রাফিক

অপরাধবিজ্ঞানে একটি তত্ত্ব আছে—‘মিউচুয়াল রিক্রিমিনেশন’ বা পারস্পরিক দোষারোপ। যখন কোনো অপরাধী চক্রের সদস্যরা নিজেদের বাঁচানোর জন্য একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাতে শুরু করে, তখন তাদের জবানবন্দি থেকেই বেরিয়ে আসে আসল সত্য। একাত্তরে পরাজয়ের পর পাকিস্তানি জেনারেলরা ঠিক এই কাজটিই করেছেন।

১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে পাঁচ দশকে জল কম ঘোলা করা হয়নি। কখনো ভারতীয় ষড়যন্ত্র, কখনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে মূল অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ আসলে কারা ছিল? খোদ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শীর্ষ জেনারেলদের লেখা বই, তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন এবং একে অপরের দিকে ছুড়ে দেওয়া কাদা বিশ্লেষণ করলেই বেরিয়ে আসে ১৪ ডিসেম্বরের সেই ভয়ানক নীলনকশা।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি তার লেখা দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান বইয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় সরাসরি চাপিয়েছেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর কাঁধে। নিয়াজি পরিষ্কার ভাষায় লিখেছেন, রাও ফরমান আলী ছিলেন ঢাকার বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্বে এবং আলবদর বাহিনীকে ব্যবহারের মূল পরিকল্পনা ফরমানেরই ছিল। নিয়াজি দাবি করেন, বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি এবং তাদের নির্মূল করার প্রকল্পটি ফরমানের মস্তিষ্কপ্রসূত।

এখানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আচরণে একটি ভয়ানক ‘যৌক্তিক বিভ্রম’ বা লজিক্যাল ফ্যালাসি ধরা পড়ে। একাত্তরের যুদ্ধের পর ব্যর্থতার দায়ভার মাথায় নিয়ে জেনারেল নিয়াজিকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বাতিল করা হয় তার পেনশন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, যাকে নিয়াজি বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল হোতা বললেন, সেই রাও ফরমান আলীকে পাকিস্তান সরকার বরখাস্ত তো করেইনি, উল্টো পুরস্কৃত করেছে। রাও ফরমান আলীকে পাকিস্তানের অন্যতম বৃহৎ ও প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান ‘ফৌজি ফাউন্ডেশন’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) করা হয়। পাক্কা দশ বছর এই পদে বহাল ছিলেন তিনি।

প্রশ্ন হলো, কেন? জেনারেল নিয়াজির মতে, অন্য অফিসারদের ওপর খড়্গ নেমে এলেও ফরমানের ওপর পাকিস্তান সরকারের এই ‘অগাধ ভালোবাসা’র কারণ একটাই—‘বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড’। পাকিস্তান রাষ্ট্র মনে করেছিল, যুদ্ধে হারলেও ফরমান অন্তত বাঙালির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পেরেছেন। এই পুরস্কারই প্রমাণ করে, বুদ্ধিজীবী হত্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এটি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের নীতি বা পলিসি।

এবার মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখা যাক। রাও ফরমান আলী তার হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড বইয়ে নিজেকে একজন নিরীহ আমলা হিসেবে দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। লিখেছেন, খুনখারাবির মধ্যে ছিলেন না তিনি। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে এমন কিছু তথ্য ফাঁস করেছেন, যা তার গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফরমান স্বীকার করেছেন, জেনারেল নিয়াজির অফিসের সামনে আলবদরের কুখ্যাত ‘সাদা মাইক্রোবাস’ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। আরও স্বীকার করেছেন, জানতেন ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজনকে ধরে এনে একটি ‘স্পেশাল কারাগার’ বা বিশেষ স্থানে রাখা হচ্ছে।

একজন মেজর জেনারেল পদমর্যাদার অফিসার, যিনি বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্বে, চোখের সামনে দেখেছেন ডেথ স্কোয়াডের গাড়ি, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বা বন্দিশিবিরের খবর রাখছেন, অথচ তিনি বলছেন এর সঙ্গে জড়িত নন—এই দাবি হাস্যকর।

সবচেয়ে বড় প্রমাণটি আসে পাকিস্তানের আমলা আলতাফ গওহরের জবানবন্দি থেকে। আলতাফ গওহর তার বন্ধু বাঙালি কবি সানাউল হককে বাঁচানোর সুপারিশ নিয়ে ফরমানের কাছে গিয়েছিলেন। তখন তিনি নিজ চোখে দেখেছিলেন, রাও ফরমান আলী তার ব্যক্তিগত ডায়েরি খুলে সানাউল হকের নাম কেটে দেন। এই ঘটনাটি পরবর্তী সময়ে জেনারেল নিয়াজির সাক্ষাৎকারেও উঠে এসেছে।

জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযমও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে গিয়ে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ফরমানের কাছে গিয়ে ডায়েরি থেকে নাম কাটানোর সুপারিশ করতেন তিনি। অর্থাৎ ‘মৃত্যু তালিকা’ বা ‘হিটলিস্ট’ যে রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতেই ছিল এবং তিনি যে জীবনের মালিক-মোক্তার হয়ে বসেছিলেন, তা তাদের বয়ানেই প্রমাণিত।

অনেকে ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনায় ‘পাকিস্তান জড়িত নয়’—এমন আজগুবি তত্ত্ব প্রচার করেন। কিন্তু সময়রেখা (টাইমলাইন) এবং জেনারেল জ্যাকবের ‘ধাপ্পা’ বা ‘ব্লাফ’ তত্ত্ব এই দাবিকে নস্যাৎ করে দেয়। ভারতীয় জেনারেল জ্যাকব নিয়াজিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে মিথ্যে বলেছিলেন যে ভারতীয় বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে প্রস্তুত। বাস্তবে ১৬ ডিসেম্বর সকালের আগে ভারতীয় বা মিত্রবাহিনীর কোনো বড় অংশ ঢাকায় প্রবেশই করেনি। সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের বইতে উদ্ধৃত মার্কিন গোপন দলিলগুলো দেখলে বোঝা যায়, ১৫ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ছিল।

সুতরাং, ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর যখন বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে তুলে নেওয়া হচ্ছে, তখন ঢাকা শহর ছিল সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। একটি অবরুদ্ধ শহরে, যেখানে কারফিউ চলছে, সেখানে সেনাবাহিনীর নাকের ডগায় সাদা মাইক্রোবাস নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, তালিকা ধরে ধরে মানুষ তুলে নেওয়া এবং রায়েরবাজারের মতো জায়গায় নিয়ে হত্যা করা—এটি সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়া আলবদরের একার পক্ষেও সম্ভব ছিল না।

পাকিস্তানি জামায়াতে ইসলামীর তরুণ সদস্য সেলিম মনসুর খালেদের লেখা আল-বদর গ্রন্থ কিংবা ১৬ ডিসেম্বরের ঠিক আগে আলবদরপ্রধান মুজাহিদের শেষ ভাষণ এবং আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়েরি—এগুলো একেকটি জ্বলন্ত অঙ্গার। আশরাফুজ্জামানের ডায়েরিতে ২০ জন শিক্ষকের নাম ও তাদের কোয়ার্টার নম্বর লেখা ছিল, যাদের লাশ পরে বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়।

দিন শেষে পাকিস্তানি জেনারেলদের বইগুলো পড়লে বোঝা যায়, একে অপরকে ‘খুনি’ প্রমাণ করতে গিয়ে অজান্তেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে খুনটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীই করেছে। নিয়াজি বলেন ফরমান খুনি; ফরমান বলেন শুধু গাড়ি দেখেছেন, খুনি নিয়াজি। এই পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি প্রমাণ করে, বুদ্ধিজীবী হত্যা কোনো বিশৃঙ্খলা বা দুর্ঘটনার ফল নয়। এটি ছিল ঠান্ডা মাথার পরিকল্পিত গণহত্যা, যার নকশা হয়েছিল রাও ফরমান আলীর টেবিলে আর বাস্তবায়ন হয়েছিল আলবদরের হাতে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত