ভারতে ফিরে সোনালি খাতুন
যারা আমার জন্য লড়াই করেছে, আমাকে বাড়ি ফিরতে সাহায্য করেছে, আমি তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু কেন আমাদের সঙ্গে এমন হলো? আমি তো কোনো জুলুম করি নাই। আমরা দিল্লিতে গেছিলাম শুধু পেটের দায়ে, বাঁচার জন্য। ওদের এটা বোঝা উচিত ছিল, খাবারের জন্য, জীবিকার জন্যই আমরা দিল্লি গেছিলাম।
অর্ক দেব

‘পুলিশ বলেছিল, তোমরা বাংলাদেশি।’—এই কথার পর থেকেই বদলে যায় সব। দিল্লিতে দীর্ঘ ২০ বছরের জীবন, কাজ করে খাওয়া, পরিবার গড়া—মুহূর্তেই যেন সবকিছু উধাও হয়ে যায়। তারপর অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় গ্রেপ্তার, থানায় আটকে রাখা, সীমান্তে পুশব্যাক করা—একের পর এক নির্মম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয় সোনালি খাতুনকে। কীভাবে একটি বাঙালি পরিবারকে ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে দেশছাড়া করা হলো, কীভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ফাঁকে হারিয়ে গেল মানবিকতা—সেই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতারই বিবরণ উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্ট্রিমের ভারতীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইনস্ক্রিপ্টের সম্পাদক অর্ক দেব।
সোনালি আপনাকে জুন মাসে দিল্লি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। ঠিক কী ঘটেছিল সেই সময়ে, যদি একটু সবিস্তারে বলেন।
সোনালি খাতুন: ১৮ জুন, আমরা তখন ঘরেই ছিলাম। প্রথমে পুলিশ আমার স্বামী দানিশকে ঘর থেকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। আমরা থানায় গিয়ে তাঁরা যা যা কাগজপত্র চাইছিল, সব দেখায়ছিলাম। তবুও তারা আমাদের বিশ্বাস করে নাই।
ওরা বলছিল, সকালে দানিশকে ছেড়ে দেবে। আমরা সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলে আমরা থানায় যাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকেও কি গ্রেপ্তার করবা?
ওরা বলল, ‘একদম না। তোমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। শুধু ডকুমেন্টস একটু যাচাই করতে হবে।’
তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কী কী ডকুমেন্ট আছে?’ আমি বললাম, আমার স্বামীর যা আছে, আমাদেরও তাই, সব তো আপনাদের আগেই দেখায়ছি।
তবুও তারা আমাদের থানায় দু’দিন আটকে রাখল, আঙুলের ছাপ নিল এবং তারপর আমাদের একটা হলঘরে নিয়ে গেল। ওরা ওটাকে ‘ভারত ঘর’ বলে। সেখানে গিয়ে দেখি, অনেক বাংলাদেশি ছেলে-পুরুষকে আটকে রাখছে। আমাদেরও জোর করে তাদের সঙ্গে ঢুকায় দেয়। আমি খুব কাঁদছি, অনেক অনুরোধ করছি, কিন্তু কেউ একদমই শুনে নাই। আমরা ওইখানে সাত দিন ছিলাম।
এরপর আমাদের বিমানে তোলা হলো এবং বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স)-এর গাড়িতে তুলে দেওয়া হলো। সেই বিএসএফের গাড়ি আমাদের সীমান্ত পার করে এক অচেনা জঙ্গলের মধ্যে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। তারপর আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিশেহারা হয়ে ঘুরতে থাকি। টানা ১০ দিন আমার নদীর পানি খেয়েই বেঁচে ছিলাম—খাওয়ার মতো কিছুই ছিল না। খাবার না পেয়ে বাচ্চা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করত।
শেষমেশ আমরা কুড়িগ্রাম নামের একটা গ্রামে পৌঁছাই। গ্রামের মানুষ আমাদের খেতে দেয় এবং একদিন থাকতে দেয়। ওরা আমাদের বলছিল, ‘এই পথ ধরে গেলে যেতে পারো—কেউ তোমাদের মারবে না, আর বেশি কষ্টও হবে না। নিজেদের দেশে ফিরে যাও।’
ওদের কথা শুনে আমরা আবার রওনা দিই এবং ভারতে ফেরার চেষ্টা করি। কিন্তু আবার বিএসএফের মুখোমুখি হয়ে যাই। বিএসএফ আমাদের ধরে প্রচণ্ড মারধর করে—এত মেরেছিল যে শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে গেছিল। তারপর আবার আমাদের বাংলাদেশের জঙ্গলে ঠেলে দেয়।
সেখান থেকে আমরা আরও দু’দিন এদিক-ওদিক ঘুরে কুড়িগ্রামের কাছের আরেকটি গ্রামে পৌঁছাই। সেখানকার লোকজন আমাদের বলে, ওখানে বেশি দিন থাকতে না। ওরা বলে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ জানতে পারলে তোমাদের গ্রেপ্তার করবে।’
তারা আমাদের ঢাকায় যেতে বলে। আমরা জানতাম না বাসে কীভাবে উঠতে হয়, কোন পথে যেতে হয়। তাই বাসের একজন যাত্রীর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঢাকা কত দূর?’ ওই যাত্রী বলে, ‘অনেক দূর।’ সন্ধ্যায় আমরা ঢাকায় নামি। ঢাকায় নামার পর পুরোপুরি দিশেহারা হয়ে যাই। এরপর ঢাকার এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকি। শেষ পর্যন্ত আমরা ভিক্ষা করতে শুরু করি।

ঢাকায় কয়েক দিন থাকার পর আমরা আলিনগরে (ঢাকা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে) গিয়ে লুকানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সেখানেই পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করে এবং জেলে পাঠিয়ে দেয়।
দিল্লিতে ঠিক কোন অভিযোগে এবং কার অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ আপনাদের গ্রেপ্তার করেছিল?
সোনালি খাতুন: এটা আমার সঙ্গে বিজেপিই করেছে। আমি শুধু জানি, এর পেছনে মোদি সরকার ছিল। আমরা ২০ বছর ধরে দিল্লিতে থাকতাম। সেখানেই আমার দানিশের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, ওইখানেই আমার দুই সন্তানের জন্ম। এর আগে কখনও এমন কিছু ঘটেনি। আমরা শান্তিতেই জীবন কাটাচ্ছিলাম। কাজের জন্যই ওইখানে গেছিলাম, রোজগারের জন্য। আমাদের গ্রামের দিকে তেমন কাজ নেই।
আমরা পুলিশকে বলেছিলাম, আমাদের কাছে ৫ টাকাও নাই। অতিরিক্ত কোনো কাপড় পর্যন্ত নিতে দেয় নাই—যে কাপড় পরে ছিলাম, সেই অবস্থাতেই আমাদের বের করে দিয়েছে। আমরা হাতজোড় করে বলেছিলাম, ‘বাচ্চাদের তো কিছু খেতে দিতে হবে, একটু ঘরে গিয়ে কিছু টাকা আনতে দিতে।’
কিন্তু তারা আমাদের কিছুই করতে দেয় নাই। আমরা দিল্লি পুলিশের কাছে কত অনুরোধ করছি, পা ধরে, হাত ধরে কাঁদেছি। কিন্তু তারা একেবারেই শোনে নাই। আমাদের সেই নরকের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
আপনাদের যখন বাংলাদেশে পাঠানো হয়, তখন বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছিল আপনাদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাঠানো হয়েছে। আসলে ঠিক কীভাবে এবং কোন জায়গা থেকে আপনাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল, একটু বিস্তারিত বলবেন?
সোনালি খাতুন: দিল্লি পুলিশ আমাদের আসাম সীমান্তে নামিয়ে দেয়। ঠিক কোন জায়গায় নামানো হয়েছিল, আমি জানি না। কারণ, পুরো সময়টাই আমাদের গাড়ির করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একবারও গাড়ি থেকে নামতে দেয় নাই। গাড়িটা দিল্লি পুলিশই ব্যবস্থা করেছিল। আমরা ওদের সব কাগজপত্র দেখায়ছিলাম, যেগুলোতে প্রমাণ ছিল আমরা বীরভূম জেলার পাইকর এলাকার বাসিন্দা। তবুও আমাদের বিশ্বাস করে নাই।

বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর প্রথম কাদের সঙ্গে আপনারা কথা বলতে পেরেছিলেন? সেই সময় কে আপনাদের সাহায্য করেছিল?
সোনালি খাতুন: বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর আমরা টানা ১০ দিন জঙ্গলের মধ্যেই ছিলাম। এরপর আমরা এক সপ্তাহ ঢাকায় ছিলাম। ঢাকায় পৌঁছানোর পরই প্রথমবারের মতো মা-র সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়। সেখানে আমরা মানুষের কাছে সাহায্য চাইতাম, না চাইলে বাচ্চাদের কী হত? ওরা তো না খেয়ে মরে যেত। কেউ কেউ আমাদের একটু খাবার দিত, কেউ কেউ কিছু টাকা দিত, আবার অনেকে কিছুই দিত না। কখনও একবেলা খেতাম, আবার পরের বেলা না খেয়েই থাকতে হত। রাস্তায় ঘুমাতাম। আমরা কাউকে বলতে পারতাম না আমরা ভারতীয়।
যদি জানত, পুলিশে ধরায় দিত। তাই খুব কমই মানুষের কাছ থেকে সাহায্য পাইছি। প্রায় না খায় ঘুরে বেড়ায়ছি। সবাই আমাদের ঘৃণার চোখে দেখত। নিজের সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য আমাদের ভিক্ষা করতে হয়েছে। লোকজন বলত, ‘তোমাদের তো কম বয়স, ভিক্ষা করছ কেন?’
কিন্তু আমাদের আর কী করার ছিল? সন্তানদের জন্যই তো ভিক্ষা করতে হয়েছে। মানুষ কত দিন আর না খায় থাকতে পারে? সেই সময়টা অনেক কষ্টের ছিল।
বাংলাদেশে আপনাদের প্রায় সাড়ে তিন মাস জেলে থাকতে হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সোনালি খাতুন: অভিশাপের মতো মনে হয়। শুধু একদিনের খারাপ সময় না, প্রতিদিনই একই রকম কষ্টের ছিল। ভাত কখনও আধা সেদ্ধ, কখনও ঠিকমতো সেদ্ধই হয় নাই। রুটিগুলা শক্ত। জেলে এইগুলা নাকি স্বাভাবিক।
ঘুমানোর ব্যবস্থাও খুব খারাপ ছিল। কম্বল দিলেও তা এত নোংরা ছিল ব্যবহার করা যেত না। সব কিছু আমাদের নিজেরাই ধুয়ে ব্যবহার করতে হত। আমরা শুধু এক সেট কাপড়েই দিন কাটায়ছি, যে কাপড় পরে আমাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ওটাই। আমি সেই দিনগুলার কথা ভাবতেও চাই না। আমরা বাচ্চাদের নিয়ে কাঁদতাম।
আপনার এক সন্তান তখন ভারতে ছিল। তার সঙ্গে কি যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন?
সোনালি খাতুন: না, আমি আমার সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি নাই। আমরা যখন ঢাকায় ছিলাম, তখন শুধু একবার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলাম। আমার বাবা যে হাইকোর্টে গেছিল, সেটাও আমি তখন জানতাম না। এখানে মফি দাদা (মফিজুল শেখ, পশ্চিমবঙ্গের খাতুনের গ্রামের একজন সমাজকর্মী), সোহেল দাদা আমাদের খুব সাহায্য করছে। মফি দাদা নিজে বাংলাদেশের জেলে গিয়েও আমাদের কাপড় দিয়ে আসছে। তখন খুব ঠান্ডা ছিল, আর জেল কর্তৃপক্ষ না, মফি দাদার কাছ থেকেই আমরা সোয়েটার পাইছিলাম। আমার বাবা ডকুমেন্টেশন সংক্রান্ত কাজে মুহাম্মদ আরিফ শেখের সাহায্য পাইছিল।

আরিফ দাদাও অনেক করছে আমাদের জন্য। হাইকোর্টে গেছে একটা পরীক্ষা ছেড়ে। সব ডকুমেন্টস ওর কাছে ছিল। বাবা তো অত পড়ালেখা জানে না, বুঝতে পারে না। সবার সহযোগিতার কারণেই আমরা ফিরতে পারছি। আমি বলতেই চাই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উদ্যোগ না থাকলে আমাদের ফেরা সম্ভব হত না। (তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ সমীরুল ইসলাম, ভদু শেখের হয়ে হেবিয়াস কর্পাস মামলা দায়ের করতে সাহায্য করেছিলেন।)
আপনি কি জানতেন যে আপনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন?
সোনালি খাতুন: হ্যাঁ, আমি জানতাম। আমরা যখন দিল্লি পুলিশের থানায় ছিলাম, তখনই পরীক্ষা করে জানতে পারি। ওরা আমার অবস্থার কথা খুব ভালোভাবেই জানত। তবুও ওরা একটুও দয়া দেখায় নাই।
বাংলাদেশে আপনি প্রথম কবে একজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলেন?
সোনালি খাতুন: বাংলাদেশে থাকাকালীন আমি একবারও কোনো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাই নাই। ওইখানে আমার কোনো চিকিৎসাই হয় নাই। জেল থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পরই প্রথমবার ফারুক দাদার স্ত্রী (ফারুক আলি, স্থানীয় জামিনদার) আমাকে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যায়। সেখানে আমার আলট্রাসাউন্ড করা হয়। ডাক্তার ওষুধ দেয় এবং জানায়, আমার সুগার হয়েছে। এখানে এসে দেখি আমার সুগার-মুগার কিছু নাই। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা, ঠিকমতো না খাওয়া, অতিরিক্ত কাপড় না থাকা— এই সবকিছুর কারণেই এই অসুখ হয়েছে। মানসিক চাপও ছিল অনেক। আমি আবারও বলছি, বাংলাদেশে আটক থাকার পুরো সময়টায় আমি কোনো ডাক্তারের পরামর্শ পাইনি। একবারও না, কিছুই না।
আপনি ফিরে আসতে পেরেছেন, কিন্তু সুইটি পারেননি। কীভাবে দেখছেন এই ঘটনাটাকে?
সোনালি খাতুন: আমি আশা করি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার দ্রুতই ওদের নিয়ে আসবে। শুনছি, ওদের আনার জন্য ব্যবস্থা করা হচ্ছে, সম্ভবত ৬ জানুয়ারি। ওরা সব কাগজপত্র জমা দিয়েছে। আমার স্বামীও এখনও ওখানেই আছে। আমার সন্তান কাঁদছে, আমার মেয়ে ওর বাবার জন্য কাঁদছে। সুইটির মা অসুস্থ। আমি আশা করছি, ৬ তারিখেই ওদের নিয়ে আসা হবে।
আপনি কি আপনার স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছেন? তাঁর সঙ্গে কী কথা হয়েছে?
সোনালি খাতুন: হ্যাঁ, পরশুদিন (১২ ডিসেম্বর, ২০২৫) আমি ওর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইছিলাম। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কবে আসবা?’ ও বলে, ‘এখানে তারিখের উপর তারিখ চাপাচ্ছে, কান্নাকাটি করছে সুইটিরা। কখন যে যাব, ভালো লাগে না। দিন কেটে যাচ্ছে, কিন্তু ভালো লাগে না। এখানে কিছু নাই, কেউ নাই। চারদিকে সব অন্ধকার মনে হয়।’
আমার এখানে স্বামী নাই। দিন-রাত খালি ভাবছি কী করব, কী করে খাবো? কী করে কী করব, ও কখন ফিরে আসবে? এটাই শুধু ভাবছি। কিছু সাহায্য পাই ঠিকই, কিন্তু মন শান্ত হয় না।
দিল্লি পুলিশকে আপনি কী বার্তা দিতে চান?
সোনালি খাতুন: আমি এখনই ওদের কিছু বলতে চাই না। আগে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে আনুক। আমি শুধু চাই, সবাই নিরাপদে ফিরে আসুক।

দিল্লি পুলিশকে এটুকুই বলব, আমার সাথে যা করেছে তা যেন আর কারও সাথে না করে।
ভবিষ্যতে সংসার চালানোর জন্য কী ধরনের কাজের কথা ভাবছেন?
সোনালি খাতুন: আমাদের গ্রামে বিড়ির কাজ আছে, কিন্তু আমি বিড়ি বাঁধতে পারি না। তাই আমার স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করবে। দিনে প্রায় ৩০০ টাকা পাওয়া যায়।
কিন্তু ৩০০ টাকায় তিনটি সন্তানকে কীভাবে খাওয়াবেন?
সোনালি খাতুন: এই কথাই আমিও ভাবছি। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, আমি আর দিল্লি যাব না। দিল্লি গিয়ে তো এত বড় জুলুম সহ্য করতে হলো।
আপনার লড়াই অনেকের অনুপ্রেরণা। সারা দেশে যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছেন, তাঁদের উদ্দেশে আপনি কী বলবেন?
সোনালি খাতুন: যারা আমার জন্য লড়াই করেছে, আমাকে বাড়ি ফিরতে সাহায্য করেছে, আমি তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু কেন আমাদের সঙ্গে এমন হলো? আমি তো কোনো জুলুম করি নাই। আমরা দিল্লিতে গেছিলাম শুধু পেটের দায়ে, বাঁচার জন্য। ওদের এটা বোঝা উচিত ছিল, খাবারের জন্য, জীবিকার জন্যই আমরা দিল্লি গেছিলাম।
আমার সঙ্গে যা করা হয়েছে, তা যেন আর কারও সঙ্গে না করা হয়। আমাদের গ্রেপ্তারের আগেই, ১৭ জুন দিল্লিতে আমার মা আর বোনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আমার বোনকে গ্রেপ্তার করার দিন বাড়িতে কেউ ছিল না, আমার মেয়ে আর ভাগ্নি একা হয়ে যায়। আমার বোন একজন আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজের আর মা-র জামিন করায়। সব নথি দেখানোর পরও পুলিশ বলেছিল, ‘তোমরা বাংলাদেশি।’ আমার মা গ্রামেই ফিরে আসেছে, সে আর দিল্লিতে যায় না।
উল্লেখ্য, গত জুনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলা থেকে কাজের সন্ধানে দিল্লি গিয়েছিল অন্তঃসত্ত্বা সোনালি খাতুন ও তাঁর পরিবার। কিন্তু বাংলাদেশি সন্দেহে তাঁদের আটক করে দিল্লি পুলিশ। তারপর সীমান্ত দিয়ে জোর করে ঠেলে পাঠায় (পুশ ইন) বাংলাদেশে। গত ২০ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের আলীনগর থেকে সোনালি খাতুন, তাঁর স্বামী ও সন্তানসহ ভারতের ছয় নাগরিককে আটক করে বাংলাদেশ পুলিশ। সোনালি খাতুন ছাড়া অন্য আটক ব্যক্তিরা হলেন- তাঁর স্বামী বীরভূম জেলার ধিতোরা গ্রামের দানিশ শেখ (২৮), তাঁদের ছেলে সাব্বির (৮) এবং সুইটি (৩৩) ও তাঁর ১৬ ও ৬ বছর বয়সী ছেলে। পরে গত ৫ ডিসেম্বর সোনালি খাতুন ও তাঁর শিশুসন্তানকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়। যদিও সোনালি খাতুনের স্বামীকে ফেরত নেয়নি বিএসএফ।

‘পুলিশ বলেছিল, তোমরা বাংলাদেশি।’—এই কথার পর থেকেই বদলে যায় সব। দিল্লিতে দীর্ঘ ২০ বছরের জীবন, কাজ করে খাওয়া, পরিবার গড়া—মুহূর্তেই যেন সবকিছু উধাও হয়ে যায়। তারপর অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় গ্রেপ্তার, থানায় আটকে রাখা, সীমান্তে পুশব্যাক করা—একের পর এক নির্মম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয় সোনালি খাতুনকে। কীভাবে একটি বাঙালি পরিবারকে ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে দেশছাড়া করা হলো, কীভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ফাঁকে হারিয়ে গেল মানবিকতা—সেই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতারই বিবরণ উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্ট্রিমের ভারতীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইনস্ক্রিপ্টের সম্পাদক অর্ক দেব।
সোনালি আপনাকে জুন মাসে দিল্লি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। ঠিক কী ঘটেছিল সেই সময়ে, যদি একটু সবিস্তারে বলেন।
সোনালি খাতুন: ১৮ জুন, আমরা তখন ঘরেই ছিলাম। প্রথমে পুলিশ আমার স্বামী দানিশকে ঘর থেকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। আমরা থানায় গিয়ে তাঁরা যা যা কাগজপত্র চাইছিল, সব দেখায়ছিলাম। তবুও তারা আমাদের বিশ্বাস করে নাই।
ওরা বলছিল, সকালে দানিশকে ছেড়ে দেবে। আমরা সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলে আমরা থানায় যাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকেও কি গ্রেপ্তার করবা?
ওরা বলল, ‘একদম না। তোমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। শুধু ডকুমেন্টস একটু যাচাই করতে হবে।’
তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কী কী ডকুমেন্ট আছে?’ আমি বললাম, আমার স্বামীর যা আছে, আমাদেরও তাই, সব তো আপনাদের আগেই দেখায়ছি।
তবুও তারা আমাদের থানায় দু’দিন আটকে রাখল, আঙুলের ছাপ নিল এবং তারপর আমাদের একটা হলঘরে নিয়ে গেল। ওরা ওটাকে ‘ভারত ঘর’ বলে। সেখানে গিয়ে দেখি, অনেক বাংলাদেশি ছেলে-পুরুষকে আটকে রাখছে। আমাদেরও জোর করে তাদের সঙ্গে ঢুকায় দেয়। আমি খুব কাঁদছি, অনেক অনুরোধ করছি, কিন্তু কেউ একদমই শুনে নাই। আমরা ওইখানে সাত দিন ছিলাম।
এরপর আমাদের বিমানে তোলা হলো এবং বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স)-এর গাড়িতে তুলে দেওয়া হলো। সেই বিএসএফের গাড়ি আমাদের সীমান্ত পার করে এক অচেনা জঙ্গলের মধ্যে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। তারপর আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিশেহারা হয়ে ঘুরতে থাকি। টানা ১০ দিন আমার নদীর পানি খেয়েই বেঁচে ছিলাম—খাওয়ার মতো কিছুই ছিল না। খাবার না পেয়ে বাচ্চা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করত।
শেষমেশ আমরা কুড়িগ্রাম নামের একটা গ্রামে পৌঁছাই। গ্রামের মানুষ আমাদের খেতে দেয় এবং একদিন থাকতে দেয়। ওরা আমাদের বলছিল, ‘এই পথ ধরে গেলে যেতে পারো—কেউ তোমাদের মারবে না, আর বেশি কষ্টও হবে না। নিজেদের দেশে ফিরে যাও।’
ওদের কথা শুনে আমরা আবার রওনা দিই এবং ভারতে ফেরার চেষ্টা করি। কিন্তু আবার বিএসএফের মুখোমুখি হয়ে যাই। বিএসএফ আমাদের ধরে প্রচণ্ড মারধর করে—এত মেরেছিল যে শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে গেছিল। তারপর আবার আমাদের বাংলাদেশের জঙ্গলে ঠেলে দেয়।
সেখান থেকে আমরা আরও দু’দিন এদিক-ওদিক ঘুরে কুড়িগ্রামের কাছের আরেকটি গ্রামে পৌঁছাই। সেখানকার লোকজন আমাদের বলে, ওখানে বেশি দিন থাকতে না। ওরা বলে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ জানতে পারলে তোমাদের গ্রেপ্তার করবে।’
তারা আমাদের ঢাকায় যেতে বলে। আমরা জানতাম না বাসে কীভাবে উঠতে হয়, কোন পথে যেতে হয়। তাই বাসের একজন যাত্রীর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঢাকা কত দূর?’ ওই যাত্রী বলে, ‘অনেক দূর।’ সন্ধ্যায় আমরা ঢাকায় নামি। ঢাকায় নামার পর পুরোপুরি দিশেহারা হয়ে যাই। এরপর ঢাকার এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকি। শেষ পর্যন্ত আমরা ভিক্ষা করতে শুরু করি।

ঢাকায় কয়েক দিন থাকার পর আমরা আলিনগরে (ঢাকা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে) গিয়ে লুকানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সেখানেই পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করে এবং জেলে পাঠিয়ে দেয়।
দিল্লিতে ঠিক কোন অভিযোগে এবং কার অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ আপনাদের গ্রেপ্তার করেছিল?
সোনালি খাতুন: এটা আমার সঙ্গে বিজেপিই করেছে। আমি শুধু জানি, এর পেছনে মোদি সরকার ছিল। আমরা ২০ বছর ধরে দিল্লিতে থাকতাম। সেখানেই আমার দানিশের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, ওইখানেই আমার দুই সন্তানের জন্ম। এর আগে কখনও এমন কিছু ঘটেনি। আমরা শান্তিতেই জীবন কাটাচ্ছিলাম। কাজের জন্যই ওইখানে গেছিলাম, রোজগারের জন্য। আমাদের গ্রামের দিকে তেমন কাজ নেই।
আমরা পুলিশকে বলেছিলাম, আমাদের কাছে ৫ টাকাও নাই। অতিরিক্ত কোনো কাপড় পর্যন্ত নিতে দেয় নাই—যে কাপড় পরে ছিলাম, সেই অবস্থাতেই আমাদের বের করে দিয়েছে। আমরা হাতজোড় করে বলেছিলাম, ‘বাচ্চাদের তো কিছু খেতে দিতে হবে, একটু ঘরে গিয়ে কিছু টাকা আনতে দিতে।’
কিন্তু তারা আমাদের কিছুই করতে দেয় নাই। আমরা দিল্লি পুলিশের কাছে কত অনুরোধ করছি, পা ধরে, হাত ধরে কাঁদেছি। কিন্তু তারা একেবারেই শোনে নাই। আমাদের সেই নরকের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
আপনাদের যখন বাংলাদেশে পাঠানো হয়, তখন বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছিল আপনাদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাঠানো হয়েছে। আসলে ঠিক কীভাবে এবং কোন জায়গা থেকে আপনাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল, একটু বিস্তারিত বলবেন?
সোনালি খাতুন: দিল্লি পুলিশ আমাদের আসাম সীমান্তে নামিয়ে দেয়। ঠিক কোন জায়গায় নামানো হয়েছিল, আমি জানি না। কারণ, পুরো সময়টাই আমাদের গাড়ির করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একবারও গাড়ি থেকে নামতে দেয় নাই। গাড়িটা দিল্লি পুলিশই ব্যবস্থা করেছিল। আমরা ওদের সব কাগজপত্র দেখায়ছিলাম, যেগুলোতে প্রমাণ ছিল আমরা বীরভূম জেলার পাইকর এলাকার বাসিন্দা। তবুও আমাদের বিশ্বাস করে নাই।

বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর প্রথম কাদের সঙ্গে আপনারা কথা বলতে পেরেছিলেন? সেই সময় কে আপনাদের সাহায্য করেছিল?
সোনালি খাতুন: বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর আমরা টানা ১০ দিন জঙ্গলের মধ্যেই ছিলাম। এরপর আমরা এক সপ্তাহ ঢাকায় ছিলাম। ঢাকায় পৌঁছানোর পরই প্রথমবারের মতো মা-র সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়। সেখানে আমরা মানুষের কাছে সাহায্য চাইতাম, না চাইলে বাচ্চাদের কী হত? ওরা তো না খেয়ে মরে যেত। কেউ কেউ আমাদের একটু খাবার দিত, কেউ কেউ কিছু টাকা দিত, আবার অনেকে কিছুই দিত না। কখনও একবেলা খেতাম, আবার পরের বেলা না খেয়েই থাকতে হত। রাস্তায় ঘুমাতাম। আমরা কাউকে বলতে পারতাম না আমরা ভারতীয়।
যদি জানত, পুলিশে ধরায় দিত। তাই খুব কমই মানুষের কাছ থেকে সাহায্য পাইছি। প্রায় না খায় ঘুরে বেড়ায়ছি। সবাই আমাদের ঘৃণার চোখে দেখত। নিজের সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য আমাদের ভিক্ষা করতে হয়েছে। লোকজন বলত, ‘তোমাদের তো কম বয়স, ভিক্ষা করছ কেন?’
কিন্তু আমাদের আর কী করার ছিল? সন্তানদের জন্যই তো ভিক্ষা করতে হয়েছে। মানুষ কত দিন আর না খায় থাকতে পারে? সেই সময়টা অনেক কষ্টের ছিল।
বাংলাদেশে আপনাদের প্রায় সাড়ে তিন মাস জেলে থাকতে হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সোনালি খাতুন: অভিশাপের মতো মনে হয়। শুধু একদিনের খারাপ সময় না, প্রতিদিনই একই রকম কষ্টের ছিল। ভাত কখনও আধা সেদ্ধ, কখনও ঠিকমতো সেদ্ধই হয় নাই। রুটিগুলা শক্ত। জেলে এইগুলা নাকি স্বাভাবিক।
ঘুমানোর ব্যবস্থাও খুব খারাপ ছিল। কম্বল দিলেও তা এত নোংরা ছিল ব্যবহার করা যেত না। সব কিছু আমাদের নিজেরাই ধুয়ে ব্যবহার করতে হত। আমরা শুধু এক সেট কাপড়েই দিন কাটায়ছি, যে কাপড় পরে আমাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ওটাই। আমি সেই দিনগুলার কথা ভাবতেও চাই না। আমরা বাচ্চাদের নিয়ে কাঁদতাম।
আপনার এক সন্তান তখন ভারতে ছিল। তার সঙ্গে কি যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন?
সোনালি খাতুন: না, আমি আমার সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি নাই। আমরা যখন ঢাকায় ছিলাম, তখন শুধু একবার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলাম। আমার বাবা যে হাইকোর্টে গেছিল, সেটাও আমি তখন জানতাম না। এখানে মফি দাদা (মফিজুল শেখ, পশ্চিমবঙ্গের খাতুনের গ্রামের একজন সমাজকর্মী), সোহেল দাদা আমাদের খুব সাহায্য করছে। মফি দাদা নিজে বাংলাদেশের জেলে গিয়েও আমাদের কাপড় দিয়ে আসছে। তখন খুব ঠান্ডা ছিল, আর জেল কর্তৃপক্ষ না, মফি দাদার কাছ থেকেই আমরা সোয়েটার পাইছিলাম। আমার বাবা ডকুমেন্টেশন সংক্রান্ত কাজে মুহাম্মদ আরিফ শেখের সাহায্য পাইছিল।

আরিফ দাদাও অনেক করছে আমাদের জন্য। হাইকোর্টে গেছে একটা পরীক্ষা ছেড়ে। সব ডকুমেন্টস ওর কাছে ছিল। বাবা তো অত পড়ালেখা জানে না, বুঝতে পারে না। সবার সহযোগিতার কারণেই আমরা ফিরতে পারছি। আমি বলতেই চাই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উদ্যোগ না থাকলে আমাদের ফেরা সম্ভব হত না। (তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ সমীরুল ইসলাম, ভদু শেখের হয়ে হেবিয়াস কর্পাস মামলা দায়ের করতে সাহায্য করেছিলেন।)
আপনি কি জানতেন যে আপনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন?
সোনালি খাতুন: হ্যাঁ, আমি জানতাম। আমরা যখন দিল্লি পুলিশের থানায় ছিলাম, তখনই পরীক্ষা করে জানতে পারি। ওরা আমার অবস্থার কথা খুব ভালোভাবেই জানত। তবুও ওরা একটুও দয়া দেখায় নাই।
বাংলাদেশে আপনি প্রথম কবে একজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলেন?
সোনালি খাতুন: বাংলাদেশে থাকাকালীন আমি একবারও কোনো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাই নাই। ওইখানে আমার কোনো চিকিৎসাই হয় নাই। জেল থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পরই প্রথমবার ফারুক দাদার স্ত্রী (ফারুক আলি, স্থানীয় জামিনদার) আমাকে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যায়। সেখানে আমার আলট্রাসাউন্ড করা হয়। ডাক্তার ওষুধ দেয় এবং জানায়, আমার সুগার হয়েছে। এখানে এসে দেখি আমার সুগার-মুগার কিছু নাই। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা, ঠিকমতো না খাওয়া, অতিরিক্ত কাপড় না থাকা— এই সবকিছুর কারণেই এই অসুখ হয়েছে। মানসিক চাপও ছিল অনেক। আমি আবারও বলছি, বাংলাদেশে আটক থাকার পুরো সময়টায় আমি কোনো ডাক্তারের পরামর্শ পাইনি। একবারও না, কিছুই না।
আপনি ফিরে আসতে পেরেছেন, কিন্তু সুইটি পারেননি। কীভাবে দেখছেন এই ঘটনাটাকে?
সোনালি খাতুন: আমি আশা করি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার দ্রুতই ওদের নিয়ে আসবে। শুনছি, ওদের আনার জন্য ব্যবস্থা করা হচ্ছে, সম্ভবত ৬ জানুয়ারি। ওরা সব কাগজপত্র জমা দিয়েছে। আমার স্বামীও এখনও ওখানেই আছে। আমার সন্তান কাঁদছে, আমার মেয়ে ওর বাবার জন্য কাঁদছে। সুইটির মা অসুস্থ। আমি আশা করছি, ৬ তারিখেই ওদের নিয়ে আসা হবে।
আপনি কি আপনার স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছেন? তাঁর সঙ্গে কী কথা হয়েছে?
সোনালি খাতুন: হ্যাঁ, পরশুদিন (১২ ডিসেম্বর, ২০২৫) আমি ওর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইছিলাম। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কবে আসবা?’ ও বলে, ‘এখানে তারিখের উপর তারিখ চাপাচ্ছে, কান্নাকাটি করছে সুইটিরা। কখন যে যাব, ভালো লাগে না। দিন কেটে যাচ্ছে, কিন্তু ভালো লাগে না। এখানে কিছু নাই, কেউ নাই। চারদিকে সব অন্ধকার মনে হয়।’
আমার এখানে স্বামী নাই। দিন-রাত খালি ভাবছি কী করব, কী করে খাবো? কী করে কী করব, ও কখন ফিরে আসবে? এটাই শুধু ভাবছি। কিছু সাহায্য পাই ঠিকই, কিন্তু মন শান্ত হয় না।
দিল্লি পুলিশকে আপনি কী বার্তা দিতে চান?
সোনালি খাতুন: আমি এখনই ওদের কিছু বলতে চাই না। আগে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে আনুক। আমি শুধু চাই, সবাই নিরাপদে ফিরে আসুক।

দিল্লি পুলিশকে এটুকুই বলব, আমার সাথে যা করেছে তা যেন আর কারও সাথে না করে।
ভবিষ্যতে সংসার চালানোর জন্য কী ধরনের কাজের কথা ভাবছেন?
সোনালি খাতুন: আমাদের গ্রামে বিড়ির কাজ আছে, কিন্তু আমি বিড়ি বাঁধতে পারি না। তাই আমার স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করবে। দিনে প্রায় ৩০০ টাকা পাওয়া যায়।
কিন্তু ৩০০ টাকায় তিনটি সন্তানকে কীভাবে খাওয়াবেন?
সোনালি খাতুন: এই কথাই আমিও ভাবছি। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, আমি আর দিল্লি যাব না। দিল্লি গিয়ে তো এত বড় জুলুম সহ্য করতে হলো।
আপনার লড়াই অনেকের অনুপ্রেরণা। সারা দেশে যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছেন, তাঁদের উদ্দেশে আপনি কী বলবেন?
সোনালি খাতুন: যারা আমার জন্য লড়াই করেছে, আমাকে বাড়ি ফিরতে সাহায্য করেছে, আমি তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু কেন আমাদের সঙ্গে এমন হলো? আমি তো কোনো জুলুম করি নাই। আমরা দিল্লিতে গেছিলাম শুধু পেটের দায়ে, বাঁচার জন্য। ওদের এটা বোঝা উচিত ছিল, খাবারের জন্য, জীবিকার জন্যই আমরা দিল্লি গেছিলাম।
আমার সঙ্গে যা করা হয়েছে, তা যেন আর কারও সঙ্গে না করা হয়। আমাদের গ্রেপ্তারের আগেই, ১৭ জুন দিল্লিতে আমার মা আর বোনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আমার বোনকে গ্রেপ্তার করার দিন বাড়িতে কেউ ছিল না, আমার মেয়ে আর ভাগ্নি একা হয়ে যায়। আমার বোন একজন আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজের আর মা-র জামিন করায়। সব নথি দেখানোর পরও পুলিশ বলেছিল, ‘তোমরা বাংলাদেশি।’ আমার মা গ্রামেই ফিরে আসেছে, সে আর দিল্লিতে যায় না।
উল্লেখ্য, গত জুনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলা থেকে কাজের সন্ধানে দিল্লি গিয়েছিল অন্তঃসত্ত্বা সোনালি খাতুন ও তাঁর পরিবার। কিন্তু বাংলাদেশি সন্দেহে তাঁদের আটক করে দিল্লি পুলিশ। তারপর সীমান্ত দিয়ে জোর করে ঠেলে পাঠায় (পুশ ইন) বাংলাদেশে। গত ২০ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের আলীনগর থেকে সোনালি খাতুন, তাঁর স্বামী ও সন্তানসহ ভারতের ছয় নাগরিককে আটক করে বাংলাদেশ পুলিশ। সোনালি খাতুন ছাড়া অন্য আটক ব্যক্তিরা হলেন- তাঁর স্বামী বীরভূম জেলার ধিতোরা গ্রামের দানিশ শেখ (২৮), তাঁদের ছেলে সাব্বির (৮) এবং সুইটি (৩৩) ও তাঁর ১৬ ও ৬ বছর বয়সী ছেলে। পরে গত ৫ ডিসেম্বর সোনালি খাতুন ও তাঁর শিশুসন্তানকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়। যদিও সোনালি খাতুনের স্বামীকে ফেরত নেয়নি বিএসএফ।

ইতিহাস সম্পর্কে যেসব ভিন্নমত আমরা দেখতে পাই, তার মধ্যে দুটো বড় ঘটনা—প্রথমত, অপারেশন সার্চলাইটের ভয়াবহতা ও হিংস্রতা পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের পাকিস্তান সম্পর্কে সামান্যতম দুর্বলতাকেও পরিহার করতে প্রণোদিত করেছিল। দ্বিতীয়ত, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে জগজিৎ সিং অরোরার কাছে নিয়াজির আত্মসমর্পণ।
১২ ঘণ্টা আগে
তিন রকমের অন্তরায় বাংলাদেশের ভবিষ্যত যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে—রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক। বাংলাদেশ অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অন্তরায়গুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে চলবে না, বরং তারা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক চালচিত্রের সঙ্গে জড়িত।
১২ ঘণ্টা আগে
আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং রাষ্ট্র সংস্কারের ওপর গণভোটের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বাংলাদেশ। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা দেশটির রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নিঃসন্দেহে একটি মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। দেড় বছরের সংস্কার প্রক্রিয়া ও নানাবিধ ঘটনার পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচন।
২ দিন আগে
আজ ১৪ ডিসেম্বর। এই দিনটি বাংলাদেশে প্রতিবছর রাষ্ট্রীয়ভাবে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসাবে পালিত হয়। এ দিনটি গভীর বেদনার, শোকের অশ্রু ঝরানো এবং স্বজন হারানোর কষ্টে কাতর। আজকের এই দিনে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠ থেকে যখন শুনি-সব ক’টা জানালা খুলে দাও না/ওরা আসবে চুপি চুপি/যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রা
২ দিন আগে