স্ট্রিম প্রতিবেদক
সকাল সাড়ে ৯ টা থেকেই শহীদ মিনার এলাকার আকাশজুড়ে জমে ছিল ঘন মেঘ। সেই মেঘের ছায়ায় শহিদ মিনারের পাদদেশে বানানো একটা মঞ্চ অপেক্ষা করছিল একজনের। মঞ্চের ঠিক সামনে শহীদ মিনার। মঞ্চের আশেপাশে রয়েছে পুরোনো কিছু গাছ। এই পুরোনো সবকিছু ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিত সবচেয়ে পুরোনো মানুষ বদরুদ্দীন উমরের মরদেহের অপেক্ষায়। গতকাল তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। আজ (৮ সেপ্টেম্বর) জাতি এই কমিউনিস্ট নেতা, গবেষক ও তাত্ত্বিককে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর প্রতি ঋণ প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল।
বেলা সাড়ে ১০ টায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত্র অ্যাম্বুলেন্সে ব ওমরের মরদেহ এলো শহীদ মিনারে। আশেপাশে তখন শ পাঁচেক মানুষ। কেউ স্বজন, কেউ ছাত্র, কেউ রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, কেউ পাঠক, কেউ লেখক। আর কেউ কেউ কোনো পরম্পরার সম্পর্ক ছাড়াই এখানে উপস্থিত হয়েছেন প্রান্তজনের এই ইতিহাসবক্তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
মঞ্চে তোলার পর উমরের কফিন ঢেকে দেওয়া হলো কাস্তে ও হাতুড়ি খোচিত লাল কমিউনিস্ট পতাকায়। এই পতাকা আগলে রেখেই সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন বদরুদ্দীন উমর। তাকে লাল পতাকায় ঢেকে দিয়ে মঞ্চে গাওয়া হলো ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’। ‘…শেষ যুদ্ধ শুরু আজ কমরেড/ এসো মোরা মিলি একসাথ’। এসময় মঞ্চে উপস্থিত তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাঁদতে দেখা গেল। পরিবারের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল উমরের দল জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের নেতাকর্মীরা। তাঁদের চেহারা শক্ত হয়ে আছে। চোখে আটকে আছে অনেক স্মৃতি। সেগুলো সম্ভবত বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। কে জানে, হয়তো বিপ্লবীদের কাঁদতে নেই।
কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল গানটা শেষ হতে হতেই দু-এক ফোটা বৃষ্টি ঝড়তে শুরু করেছে আকাশ থেকে। তাতে অবশ্য বদরুদ্দীন উমরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে লোকের আসা থেমে নেই। শহীদ মিনারে উপস্থিত লোকের সংখ্যা তখন হাজার ছাড়িয়েছে।
এসময় বদরুদ্দীন উমরের রাজনৈতিক সতীর্থদের কারো কারো মধ্যে হতাশা দেখা গেল। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন, মৃত্যুর পর উমরকে মিডিয়া ও সুধিজনেরা সবজায়গায় পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে বুদ্ধিজীবী হিসেবে। অথচ তিনি যে একজন আমরণ কমিউনিস্ট নেতা- একটি বামপন্থি দলের সভাপতি, এই আলাপটাই যেন ঢেকে যাচ্ছে।
এই আলাপ যখন শুনছিলাম, তখন উমরকে শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে আসেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তাঁর কাছেই জানতে চাইলাম, উমরকে কেবল বুদ্ধিজীবী হিসেবে আলাপের মহলে হাজির করাকে তিনি কীভাবে দেখছেন।
ফরহাদ মাজহার বললেন, এটাকে (বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিতি) আমি খারাপভাবে দেখি না। উমর ভাইকে যদি সত্যিকার অর্থে আপনি ধারণ করতে চান, তাহলে আপনাকে ভাবতে হবে যে গণরাজনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ততটা সক্রিয় ছিলেন না। যতটা ছিলেন বুদ্ধিজীবিতায়। স্বভাবতই জনসাধারণের দৈনন্দিন লড়াই-সংগ্রামের ক্ষেত্রে তিনি একটা দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। এটা ঠিকই আছে। একজন সক্রিয় বুদ্ধিজীবী হিসেবে এটাতে আমি কোনো দোষ দেখি না। সেদিক থেকে আমি মনে করি, এই মূল্যায়নটা এভাবে করি যে এটাই (বুদ্ধিজীবী) তাঁর শেষ পরিচয়, তাহলে ভুল হবে। কিন্তু আমরা যদি মূল্যায়নটা এভাবে করি, এই পরিচয়ই তিনি গ্রহণ করেছেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় হয়তো এরচেয়ে বেশি তিনি অবদান রাখতে পারতেন না।
ফরহাদ মজহার আরও বলেন, ৫ আগস্টের পরে আমি মনে করি বাংলাদেশে অনেক বদলে গেছে। এই বদলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে হবে ক্রিটিক্যালি। তাঁর স্বপ্ন হয়তো সরলভাবে কমিউনিস্ট নীতি হতে পারে। কিন্তু তাঁকে ঐতিহাসিকভাবে দেখতে হবে। কারণ তিনি তো ইতিহাসের সন্তান। সেই জায়গা থেকে তাকে আমাদের স্যালুট জানাতে হবে। আমাদের বলতে হবে, কমরেড বিদায়, কিন্তু আপনি আছেন আমাদের সাথেই।
অবশ্য ফরহাদ মজহারের সঙ্গে একমত নন একই জায়গায় উপস্থিত সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ) সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স।
নাসির উদ্দিন প্রিন্স বলেন, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে যেই স্বপ্নের কথা উমর ভাই ভাবতেন, তাঁর কমিউনিস্ট পরিচয়টা সামনে আনলে সেই স্বপ্নটাও অনেক বেশি সামনে চলে আসে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অংশ হিসেবে তিনি সমাজের অসঙ্গতি দেখিয়েছেন, ফলে কেবল তাঁর বুদ্ধিজীবী পরিচয়টা সামনে রাখা সেই মানুষগুলোর জন্য আরামদায়ক যারা সমাজের এই স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তিনি নিজের সারাটা জীবন কোনো আপস করেন নাই, যেটাকে তিনি ঠিক মনে করতেন, সেটার জন্যই তিনি সবসময় লড়াই করে গেছেন। কমিউনিস্ট মতাদর্শের জন্য তাঁর যে আজীবন সংগ্রাম, বিভিন্ন সময় যে রাজনৈতিক ভূমিকা তিনি রেখেছেন সেটাকে আড়াল করা হয় তাঁর কমিউনিস্ট পরিচয় আড়াল করার মধ্য দিয়ে।
এসময় পাশ দিয়েই ওমরের মরদেহে শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ ও ফরিদা আখতার।
শারমিন মুরশিদ স্ট্রিমকে বলেন, বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক একটা পর্ব শেষ হলে গেল। তিনি যে আদর্শ এবং দর্শনের ধারক ছিলেন, সেই দর্শনের ভিত্তিতে তিনি যে ইতিহাসের বিশ্লেষণ করে গেছেন, সেটা সবচেয়ে বড় সম্পদ হিসেবে আমরা দেখব। তিনি কখনোই কোনো জায়গায় আপস করেন নাই। তিনি চলে যাওয়ায় আমাদের চিন্তার জগতে শূন্যতা তৈরি হলো।
মঞ্চের একপাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল কবি ফারুক ওয়াসিফকে। তিনি বর্তমানে প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছেন বদরুদ্দীন উমরের সান্নিধ্যে। ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের নেতা।
একজন কবিকে কীভাবে বদরুদ্দীন উমরের রাজনীতি আকৃষ্ট করল? স্মৃতি কাতর হয়ে ওয়াসিফ বললেন, ছোটবেলায় বামপন্থার সঙ্গে কিছুটা পরিচয় ছিল। কিন্তু সেসব বামপন্থাকে এতো ম্রিয়মাণ লাগতো! এরমধ্যে বগুড়া শহরের ফুটপাতে একদিন বদরুদ্দীন উমরের একটা বই পাই, বইটার নাম ছিল সাম্প্রদায়িকতা। ৯০ পরবর্তি সময়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী রাজনীতি একটা বড় বিষয় ছিল। কিন্তু সেই রাজনীতি যে কোথায় ব্যর্থ আর সেই রাজনীতির গাফিলতিই বা কোথায়, তা ওই বইটা পড়ে বুঝতে পারি। তখন থেকে একের পর এক উমরের বইপত্রের সাথে পরিচয়।
স্মৃতির পাতা হাতড়ে ফারুক ওয়াসিফ আরও বলেন, বিপ্লবী চিন্তাভাবনা ছাড়া বামপন্থী রাজনীতি তো আসলে বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তি। উমরের লেখায় ওই তীব্র সাহসটা ছিল। আমার সমাজকে ব্যখ্যা করার মতো, একজন তরুণের মনে সমাজে যেই প্রবলেমগুলো আমাদের সামনে হাজির হয়, সেগুলোর অনেক সমাধানই উমর ভাইয়ের লেখার ভেতরে পেতাম।
তাঁর চিন্তার যে অবকাঠামো ছিল, যে সাহিত্যবোধ ছিল, তাঁর ছাপ হিসেবে লেখার ভেতরে সাহিত্য আসতো, ইতিহাসবোধ আসতো। ব্যাপারটা আমার কাছে ছিল, একটা মানুষ ইতিহাসের নিঃসঙ্গ সাওয়ারির মতো ঘোড়া চালিয়ে যাচ্ছেন ইতিহাসের ভেতরেই। আমাদের গত দেড়শ-দুইশ বছরের যে ইতিহাস, তা সঠিক বিশ্লেষণ করা ছাড়া আমরা বর্তমানে রাজনীতি করতে পারব না। উমর এই বিশ্লেষণ করাটা আমাকে শিখিয়েছিলেন।
২০১৯ সাল থেকে ৫ বছর আয়না ঘরে আটক থেকে মুক্তি পাওয়া মাইকেল চাকমার দেখা পেলাম শোক মঞ্চের ঠিক পাশেই। কথা হয় তাঁর সাথে। মাইকেল চাকমা বলেন, উমর ভাই শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, দেশে যারা সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ, নিপীড়িত মানুষ, তাঁদের পক্ষে তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন। তাঁদের নিয়ে তিনি কাজ করেছেন, রাজনীতি করেছেন।’
সবার সাথে কথা বলতে বলতে বেলা গড়িয়ে তখন প্রায় ১২ টা বাজতে চলেছে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি বাড়ছে। দেখলাম, ঝুম বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ফতুয়া পরা একজন কান্না করছেন। তিনি অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। বদরুদ্দীন উমরের রাজনৈতিক স্বপ্নের আরেক সারথি। গণ-মানুষের আরেক বুদ্ধিজীবী। তাঁর কান্নার মাঝে ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছে হলো না। তবে লেখার শুরুতে যে বলেছিলাম, ‘কে জানে, হয়তো বিপ্লবীদের কাঁদতে নেই’, সেই ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। আনু মুহাম্মদ কাঁদছিলেন। সহযোদ্ধাদের হারানোর শোকে বিপ্লবরাও কাঁদেন। কাঁদেন বুদ্ধিজীবীরাও।
সকাল সাড়ে ৯ টা থেকেই শহীদ মিনার এলাকার আকাশজুড়ে জমে ছিল ঘন মেঘ। সেই মেঘের ছায়ায় শহিদ মিনারের পাদদেশে বানানো একটা মঞ্চ অপেক্ষা করছিল একজনের। মঞ্চের ঠিক সামনে শহীদ মিনার। মঞ্চের আশেপাশে রয়েছে পুরোনো কিছু গাছ। এই পুরোনো সবকিছু ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিত সবচেয়ে পুরোনো মানুষ বদরুদ্দীন উমরের মরদেহের অপেক্ষায়। গতকাল তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। আজ (৮ সেপ্টেম্বর) জাতি এই কমিউনিস্ট নেতা, গবেষক ও তাত্ত্বিককে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর প্রতি ঋণ প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল।
বেলা সাড়ে ১০ টায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত্র অ্যাম্বুলেন্সে ব ওমরের মরদেহ এলো শহীদ মিনারে। আশেপাশে তখন শ পাঁচেক মানুষ। কেউ স্বজন, কেউ ছাত্র, কেউ রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, কেউ পাঠক, কেউ লেখক। আর কেউ কেউ কোনো পরম্পরার সম্পর্ক ছাড়াই এখানে উপস্থিত হয়েছেন প্রান্তজনের এই ইতিহাসবক্তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
মঞ্চে তোলার পর উমরের কফিন ঢেকে দেওয়া হলো কাস্তে ও হাতুড়ি খোচিত লাল কমিউনিস্ট পতাকায়। এই পতাকা আগলে রেখেই সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন বদরুদ্দীন উমর। তাকে লাল পতাকায় ঢেকে দিয়ে মঞ্চে গাওয়া হলো ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’। ‘…শেষ যুদ্ধ শুরু আজ কমরেড/ এসো মোরা মিলি একসাথ’। এসময় মঞ্চে উপস্থিত তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাঁদতে দেখা গেল। পরিবারের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল উমরের দল জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের নেতাকর্মীরা। তাঁদের চেহারা শক্ত হয়ে আছে। চোখে আটকে আছে অনেক স্মৃতি। সেগুলো সম্ভবত বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। কে জানে, হয়তো বিপ্লবীদের কাঁদতে নেই।
কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল গানটা শেষ হতে হতেই দু-এক ফোটা বৃষ্টি ঝড়তে শুরু করেছে আকাশ থেকে। তাতে অবশ্য বদরুদ্দীন উমরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে লোকের আসা থেমে নেই। শহীদ মিনারে উপস্থিত লোকের সংখ্যা তখন হাজার ছাড়িয়েছে।
এসময় বদরুদ্দীন উমরের রাজনৈতিক সতীর্থদের কারো কারো মধ্যে হতাশা দেখা গেল। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন, মৃত্যুর পর উমরকে মিডিয়া ও সুধিজনেরা সবজায়গায় পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে বুদ্ধিজীবী হিসেবে। অথচ তিনি যে একজন আমরণ কমিউনিস্ট নেতা- একটি বামপন্থি দলের সভাপতি, এই আলাপটাই যেন ঢেকে যাচ্ছে।
এই আলাপ যখন শুনছিলাম, তখন উমরকে শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে আসেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তাঁর কাছেই জানতে চাইলাম, উমরকে কেবল বুদ্ধিজীবী হিসেবে আলাপের মহলে হাজির করাকে তিনি কীভাবে দেখছেন।
ফরহাদ মাজহার বললেন, এটাকে (বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিতি) আমি খারাপভাবে দেখি না। উমর ভাইকে যদি সত্যিকার অর্থে আপনি ধারণ করতে চান, তাহলে আপনাকে ভাবতে হবে যে গণরাজনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ততটা সক্রিয় ছিলেন না। যতটা ছিলেন বুদ্ধিজীবিতায়। স্বভাবতই জনসাধারণের দৈনন্দিন লড়াই-সংগ্রামের ক্ষেত্রে তিনি একটা দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। এটা ঠিকই আছে। একজন সক্রিয় বুদ্ধিজীবী হিসেবে এটাতে আমি কোনো দোষ দেখি না। সেদিক থেকে আমি মনে করি, এই মূল্যায়নটা এভাবে করি যে এটাই (বুদ্ধিজীবী) তাঁর শেষ পরিচয়, তাহলে ভুল হবে। কিন্তু আমরা যদি মূল্যায়নটা এভাবে করি, এই পরিচয়ই তিনি গ্রহণ করেছেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় হয়তো এরচেয়ে বেশি তিনি অবদান রাখতে পারতেন না।
ফরহাদ মজহার আরও বলেন, ৫ আগস্টের পরে আমি মনে করি বাংলাদেশে অনেক বদলে গেছে। এই বদলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে হবে ক্রিটিক্যালি। তাঁর স্বপ্ন হয়তো সরলভাবে কমিউনিস্ট নীতি হতে পারে। কিন্তু তাঁকে ঐতিহাসিকভাবে দেখতে হবে। কারণ তিনি তো ইতিহাসের সন্তান। সেই জায়গা থেকে তাকে আমাদের স্যালুট জানাতে হবে। আমাদের বলতে হবে, কমরেড বিদায়, কিন্তু আপনি আছেন আমাদের সাথেই।
অবশ্য ফরহাদ মজহারের সঙ্গে একমত নন একই জায়গায় উপস্থিত সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ) সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স।
নাসির উদ্দিন প্রিন্স বলেন, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে যেই স্বপ্নের কথা উমর ভাই ভাবতেন, তাঁর কমিউনিস্ট পরিচয়টা সামনে আনলে সেই স্বপ্নটাও অনেক বেশি সামনে চলে আসে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অংশ হিসেবে তিনি সমাজের অসঙ্গতি দেখিয়েছেন, ফলে কেবল তাঁর বুদ্ধিজীবী পরিচয়টা সামনে রাখা সেই মানুষগুলোর জন্য আরামদায়ক যারা সমাজের এই স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তিনি নিজের সারাটা জীবন কোনো আপস করেন নাই, যেটাকে তিনি ঠিক মনে করতেন, সেটার জন্যই তিনি সবসময় লড়াই করে গেছেন। কমিউনিস্ট মতাদর্শের জন্য তাঁর যে আজীবন সংগ্রাম, বিভিন্ন সময় যে রাজনৈতিক ভূমিকা তিনি রেখেছেন সেটাকে আড়াল করা হয় তাঁর কমিউনিস্ট পরিচয় আড়াল করার মধ্য দিয়ে।
এসময় পাশ দিয়েই ওমরের মরদেহে শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ ও ফরিদা আখতার।
শারমিন মুরশিদ স্ট্রিমকে বলেন, বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক একটা পর্ব শেষ হলে গেল। তিনি যে আদর্শ এবং দর্শনের ধারক ছিলেন, সেই দর্শনের ভিত্তিতে তিনি যে ইতিহাসের বিশ্লেষণ করে গেছেন, সেটা সবচেয়ে বড় সম্পদ হিসেবে আমরা দেখব। তিনি কখনোই কোনো জায়গায় আপস করেন নাই। তিনি চলে যাওয়ায় আমাদের চিন্তার জগতে শূন্যতা তৈরি হলো।
মঞ্চের একপাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল কবি ফারুক ওয়াসিফকে। তিনি বর্তমানে প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছেন বদরুদ্দীন উমরের সান্নিধ্যে। ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের নেতা।
একজন কবিকে কীভাবে বদরুদ্দীন উমরের রাজনীতি আকৃষ্ট করল? স্মৃতি কাতর হয়ে ওয়াসিফ বললেন, ছোটবেলায় বামপন্থার সঙ্গে কিছুটা পরিচয় ছিল। কিন্তু সেসব বামপন্থাকে এতো ম্রিয়মাণ লাগতো! এরমধ্যে বগুড়া শহরের ফুটপাতে একদিন বদরুদ্দীন উমরের একটা বই পাই, বইটার নাম ছিল সাম্প্রদায়িকতা। ৯০ পরবর্তি সময়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী রাজনীতি একটা বড় বিষয় ছিল। কিন্তু সেই রাজনীতি যে কোথায় ব্যর্থ আর সেই রাজনীতির গাফিলতিই বা কোথায়, তা ওই বইটা পড়ে বুঝতে পারি। তখন থেকে একের পর এক উমরের বইপত্রের সাথে পরিচয়।
স্মৃতির পাতা হাতড়ে ফারুক ওয়াসিফ আরও বলেন, বিপ্লবী চিন্তাভাবনা ছাড়া বামপন্থী রাজনীতি তো আসলে বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তি। উমরের লেখায় ওই তীব্র সাহসটা ছিল। আমার সমাজকে ব্যখ্যা করার মতো, একজন তরুণের মনে সমাজে যেই প্রবলেমগুলো আমাদের সামনে হাজির হয়, সেগুলোর অনেক সমাধানই উমর ভাইয়ের লেখার ভেতরে পেতাম।
তাঁর চিন্তার যে অবকাঠামো ছিল, যে সাহিত্যবোধ ছিল, তাঁর ছাপ হিসেবে লেখার ভেতরে সাহিত্য আসতো, ইতিহাসবোধ আসতো। ব্যাপারটা আমার কাছে ছিল, একটা মানুষ ইতিহাসের নিঃসঙ্গ সাওয়ারির মতো ঘোড়া চালিয়ে যাচ্ছেন ইতিহাসের ভেতরেই। আমাদের গত দেড়শ-দুইশ বছরের যে ইতিহাস, তা সঠিক বিশ্লেষণ করা ছাড়া আমরা বর্তমানে রাজনীতি করতে পারব না। উমর এই বিশ্লেষণ করাটা আমাকে শিখিয়েছিলেন।
২০১৯ সাল থেকে ৫ বছর আয়না ঘরে আটক থেকে মুক্তি পাওয়া মাইকেল চাকমার দেখা পেলাম শোক মঞ্চের ঠিক পাশেই। কথা হয় তাঁর সাথে। মাইকেল চাকমা বলেন, উমর ভাই শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, দেশে যারা সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ, নিপীড়িত মানুষ, তাঁদের পক্ষে তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন। তাঁদের নিয়ে তিনি কাজ করেছেন, রাজনীতি করেছেন।’
সবার সাথে কথা বলতে বলতে বেলা গড়িয়ে তখন প্রায় ১২ টা বাজতে চলেছে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি বাড়ছে। দেখলাম, ঝুম বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ফতুয়া পরা একজন কান্না করছেন। তিনি অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। বদরুদ্দীন উমরের রাজনৈতিক স্বপ্নের আরেক সারথি। গণ-মানুষের আরেক বুদ্ধিজীবী। তাঁর কান্নার মাঝে ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছে হলো না। তবে লেখার শুরুতে যে বলেছিলাম, ‘কে জানে, হয়তো বিপ্লবীদের কাঁদতে নেই’, সেই ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। আনু মুহাম্মদ কাঁদছিলেন। সহযোদ্ধাদের হারানোর শোকে বিপ্লবরাও কাঁদেন। কাঁদেন বুদ্ধিজীবীরাও।
বহু প্রত্যাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছেন, ভোট দিচ্ছেন, হাস্যজ্জ্বোল ছবি দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেসব ছবি দেখছি আর কত কিছু যে মনে পড়ছে!
১ ঘণ্টা আগেতাঁর প্রতিটি নতুন গ্রন্থ আগের চিন্তাগুলোকে আরও বিকশিত করে, ধরে রাখে চিন্তার সংগতি। বাংলাদেশের বিগত দেড় শ বছরের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাকরণ বুঝতে উমরকে লাগবেই।
১ দিন আগেউজ্জ্বল নক্ষত্র বদরুদ্দীন উমর (১৯৩১) আর নেই। তিনি কেবল উপনিবেশ-পরবর্তী বাংলাদেশের একজন মার্কসবাদী ইতিহাসবিদই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী তাত্ত্বিক এবং রাজনীতিবিদও। লেখালেখি ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্য দিয়ে শ্রেণিসংগ্রাম, জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রগঠনের প্রচলিত ধারণাকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। নিজের
২ দিন আগেঅধ্যাপক উমরের সাথে আমার দীর্ঘদিনের সখ্যতা। তাঁর শেষ দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আজও মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তিনি ছিলেন অসম্ভব রসবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ। বাইরে থেকে তাঁকে কিছুটা কাঠখোট্টা মনে হলেও, তাঁর ভেতরের সূক্ষ্ম রসবোধ ছিল অসাধারণ। প্রায়ই তিনি মজা করে বলতেন, ‘আমি তো ইয়ের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি, আজরাইল আমার
২ দিন আগে