মির্জা তাসলিমা সুলতানা
ভণিতা না করে, আসুন আমরা দেখি কোন পরিস্থিতিতে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে দরকষাকষি হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের করা সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নারী সংস্কার কমিশন সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব অর্থপূর্ণভাবে বাড়াতে দুই ধরনের সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিল।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল নারী আসন হবে ১০০টি এবং সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নারী নির্বাচিত হবেন। অন্যদিকে নারী সংস্কার কমিশন সংসদে মোট সিট সংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ করার প্রস্তাব দেয়। এর অর্ধেক মানে ৩০০ সিট হবে শুধু নারীর জন্য।
নারী সংস্কার কমিশনের পুরো প্রস্তাবকে আগে মাঠেই নাকচ করে দেওয়া হয়েছিল। সংসদের আগামী নির্বাচনে শতকরা ৩৩ শতাংশ নারী সংসদ সদস্যের লক্ষ্য নিয়ে পরে ঐকমত্য কমিশন কাজ শুরু করেছিল। সেখানে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবটি তারা টেবিলে রেখেছিলেন। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, তারা তাদের প্রস্তাব থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।
সিদ্ধান্ত হয়েছে যে প্রত্যেক দলের মনোনয়নের ৫ শতাংশ হবে নারী। নির্বাচনের পর দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে সংসদে সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসন বণ্টন হবে।
২০৪৩ সাল পর্যন্ত সংরক্ষিত নারী আসন থাকবে। ক্রমান্বয়ে দলগুলো নির্বাচনে নারী মনোনয়নে শতকরা হার বাড়াবে, যাতে ধীরে ধীরে সংসদে নারী প্রতিনিধির শতকরা হার ৩৩ শতাংশ পূরণ হয়।
বহুদিন ধরে নারী রাজনীতিক ও নারী অধিকারকর্মীদের মধ্যে কথা হচ্ছিল সংসদে নারীর অর্থবহ প্রতিনিধিত্ব নিয়ে। এজন্য সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছিলেন তাঁরা। যদিও রাজনীতি নারীর জন্য খুব একটা চেনা বা কাম্য পরিসর ছিল না। এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও না।
বিশ শতকের শুরুতে খুব কম ক্ষেত্রে নারী প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন আলোচনায় এসেছে। যদিও তখন যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে সামান্য কিছু আসনে নারীরা সরাসরি নির্বাচনে জিতেছিল। ১৯৫৬ সালেই পাকিস্তানের সংসদে ১০টি আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়, যা ছিল মোট আসনের ৩ শতাংশ। এর মানে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনীয়তা একটি পুরনো চিন্তা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে নারীর জন্য ১৫টি সংরক্ষিত আসন ছিল; যা মোট আসনের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে এই আসন সংখ্যা ৩০টি করা হয়। সেসময়ে সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকা ‘সংসদের শোভা ৩০ সেট অলংকার’ শিরোনামে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে সংরক্ষিত নারী আসনকে ব্যঙ্গ করে ‘অলংকার’ বলা হয়। কারণ, এই ৩০টি আসন সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় না, সংসদে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে সংরক্ষিত আসনে নারীরা মনোনয়ন পেয়ে থাকেন। তাঁদের থাকে না নির্দিষ্ট কোনো নির্বাচনী এলাকা। ফলে সংসদে নারীর সরাসরি জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকে না।
আইন সভার কার্যক্রম সম্পর্কে নারী যাতে অভিজ্ঞতা লাভ করে এবং নারীর উপস্থিতি রাজনীতিতে যেন সহনীয় হয়ে ওঠে, তাই এই সংরক্ষিত আসনের ধারণা। এই ব্যবস্থা প্রচলনের ৩০ বছর পরেও রাজনৈতিক দলের পুরুষদের প্রশ্রয়মূলক নীতিকে সাদা চোখে দেখা হয়নি।
১৯৭২ সালে এরকম আসনের ধারণাকে অলংকার বলা না হলেও ৮৬ সালে বলা হলো। ১৯৭২ সালে নতুন দেশ। আগের ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা তখনও শেষ হয়নি। তখন হয়তো কারো মনে এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। সেই সময়ের সমাজবাস্তবতায়ও এই নারীদের সংসদে থাকা জরুরি ছিল। তা না হলে জনগণের একটা বড় অংশ রাষ্ট্রব্যবস্থার বাইরে থেকে যাচ্ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ১৬ বছর পর নারীর এই পরোক্ষ অংশগ্রহণের সংখ্যা বৃদ্ধিটা প্রশ্নবোধক হয়ে ওঠে।
এই প্রচেষ্টাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়—বেশি ভোট পেয়ে যারা সরকার গঠন করল, তারা কেবল সংসদে তাদের ভোট বাড়ালো। কিন্তু প্রতিনিধিত্বের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ, বিতর্ক, আলোচনায় গুণগত পরিবর্তনের জন্য কিছুই করা হলো না।
আইন প্রণয়নে পুরুষ সহকর্মীদের মতো সংরক্ষিত আসনে নারীদের যে কার্যকরী অংশগ্রহণ থাকে না, বরং আনুগত্য হয় তাঁদের টিকে থাকার শর্ত— এটি তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই দেখা যায়, এই আসনের নারী সদস্যরা অন্যদের মতো সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও সরাসরি ভোটে নির্বাচিতদের মতো মর্যাদা ও গুরুত্ব পান না। আর ১৯৫৬ সালের সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনের ধারণা সত্তর বছর পর ২০২৫ সালেও একইভাবে রয়ে গেছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনের চল্লিশ বছর আগের সমালোচনা এখনও প্রাসঙ্গিক রাখার প্রচেষ্টাই আমরা দেখতে পাচ্ছি। অথচ রাষ্ট্রীয় জীবনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পুরুষের একার আয়ে এখন আর সংসার চলে না। নারী ঘরে-বাইরে, শিক্ষাদীক্ষায়, আইন-আদালতে সবখানে সমান অংশীদারি। নারীর কাজের অবদান জিডিপিতে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে এই বছর। ফলে দেশে যখন শতকরা ৫১ ভাগ নারী, তখন নারী সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইবে এইটাই স্বাভাবিক।
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে নারী সম্মুখভাগে লড়াই করেছে। সেই নারীকেই অভ্যুত্থান শেষে রাজনীতি করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নারীরাও বাইনারির বাইরের মানুষসহ অন্যান্য প্রান্তিকজন তখন মানবাধিকারের জন্য পথে নেমে এসেছিলেন। তাঁরা সবার বেঁচে থাকার অধিকার, মত ও পথের জন্য ঊনমানুষে পরিণত করার বিরুদ্ধে শক্ত বার্তা দিয়েছিলেন। অথচ এই আন্দোলন শেষে নারীসহ সকল প্রান্তকজনের বিরুদ্ধে নীতি পুলিশগিরি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
স্লাট শেমিং করে বেশ্যাকরণ করার আগের রেজিমের তরিকা নতুন মাত্রায় জারি রাখা হচ্ছে। ইসলামে নানান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যেখানে অনুমোদিত, কোরআন পাঠ ও তার মর্ম উদ্ধারে নারী বা পুরুষ কাউকে বিরত রাখা হয়নি—এমনকি সকল বিচারের দায়িত্ব আল্লাহ্ নিজে নিয়েছেন, সেখানে কতিপয় সহি 'ইসলামচর্চার দাবিদারেরা' তাঁদের ব্যাখ্যাকে একমাত্র ইসলাম বলে প্রতিষ্ঠায় উঠে পড়ে লেগেছেন। এছাড়া মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে নারীর রাজনীতিতে এবং সমরে সক্রিয় থাকার উদাহরণ থাকার পরেও তাঁরা আমাদের দেশে নারীর রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের বিরোধিতা করছে। কিংবা নারীর রাজনীতির ধরন-ধারণ কী হবে, তা তারা নির্ধারণ করতে চাইছে।
রাজনীতি থেকে নারীকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা, তাঁদের রাজনীতি করার ভিন্ন ভিন্ন আকাঙক্ষা ও তা প্রকাশের ওপর খবরদারি করাকে আমি নারীর বিরুদ্ধে জুলুম মনে করি। শুধু তাই না এটিকে ঔপনিবেশিক পিতৃতান্ত্রিকতা হিসেবেও দেখি। কারণ, এই বিশেষ ধরনের পিতৃতন্ত্র বিকশিত হয়েছে ব্রিটিশদের ইসলামি আইন কোডিফাই করার মধ্য দিয়ে, যেখানে ব্রিটিশ কমন ল-এর প্রভাবও আছে।
এদের চোখ রাঙানিতেই কি না জানি না, বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আমরা সংকীর্ণ ভূমিকায় দেখতে পাচ্ছি। নারী কমিশন ছাড়া আর কোনো কমিশনের প্রধান হিসেবে নারীকে আমরা দেখতে পাইনি। আবার এই অজুহাতে ঐকমত্য কমিশনে আমরা কোনো নারীকে পেলাম না।
অন্যদিকে ঐকমত্য কমিশনে সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে নীতিগত আলোচনার জন্য বিষয়টি পাঠানো হলেও নারী সদস্যদের অগ্রাধিকার দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যদের মধ্যে আগ্রহ দেখা যায়নি। নারীও পিতৃতান্ত্রিকতার বাইরে থাকে নয়। পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ যখন আধিপত্য তৈরি করে, তখন অল্পসংখ্যক নারী অধিক সংখ্যক পুরুষের পরিসরে কাজ করতে চাইলে, সফল হতে চাইলে, টিকে থাকতে তাঁদের বেশি পিতৃতান্ত্রিক হতে হয়। তখন নারীকে পুরুষের চেয়েও বেশি পুরুষ হতে হয়।
অন্যদিকে, অধিক হারে নারী ও অন্য প্রান্তিক মানুষজনের রাজনীতির পরিসরে আসা যদি নিশ্চিত করা যেত, তবে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হতো। এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, নারীদের উপস্থিতিতে রাজনীতির ধরন-ধারণের প্রকাশ বদলে যায়।
তার মানে দাঁড়ায়, আগের অবস্থা টিকিয়ে রাখতেই নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে এসব টালবাহানা জারি আছে। আর এভাবে অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের কথা তো টেবিলেই আনা বন্ধ রাখা হয়েছে।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক
ভণিতা না করে, আসুন আমরা দেখি কোন পরিস্থিতিতে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে দরকষাকষি হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের করা সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নারী সংস্কার কমিশন সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব অর্থপূর্ণভাবে বাড়াতে দুই ধরনের সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিল।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল নারী আসন হবে ১০০টি এবং সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নারী নির্বাচিত হবেন। অন্যদিকে নারী সংস্কার কমিশন সংসদে মোট সিট সংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ করার প্রস্তাব দেয়। এর অর্ধেক মানে ৩০০ সিট হবে শুধু নারীর জন্য।
নারী সংস্কার কমিশনের পুরো প্রস্তাবকে আগে মাঠেই নাকচ করে দেওয়া হয়েছিল। সংসদের আগামী নির্বাচনে শতকরা ৩৩ শতাংশ নারী সংসদ সদস্যের লক্ষ্য নিয়ে পরে ঐকমত্য কমিশন কাজ শুরু করেছিল। সেখানে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবটি তারা টেবিলে রেখেছিলেন। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, তারা তাদের প্রস্তাব থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।
সিদ্ধান্ত হয়েছে যে প্রত্যেক দলের মনোনয়নের ৫ শতাংশ হবে নারী। নির্বাচনের পর দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে সংসদে সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসন বণ্টন হবে।
২০৪৩ সাল পর্যন্ত সংরক্ষিত নারী আসন থাকবে। ক্রমান্বয়ে দলগুলো নির্বাচনে নারী মনোনয়নে শতকরা হার বাড়াবে, যাতে ধীরে ধীরে সংসদে নারী প্রতিনিধির শতকরা হার ৩৩ শতাংশ পূরণ হয়।
বহুদিন ধরে নারী রাজনীতিক ও নারী অধিকারকর্মীদের মধ্যে কথা হচ্ছিল সংসদে নারীর অর্থবহ প্রতিনিধিত্ব নিয়ে। এজন্য সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছিলেন তাঁরা। যদিও রাজনীতি নারীর জন্য খুব একটা চেনা বা কাম্য পরিসর ছিল না। এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও না।
বিশ শতকের শুরুতে খুব কম ক্ষেত্রে নারী প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন আলোচনায় এসেছে। যদিও তখন যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে সামান্য কিছু আসনে নারীরা সরাসরি নির্বাচনে জিতেছিল। ১৯৫৬ সালেই পাকিস্তানের সংসদে ১০টি আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়, যা ছিল মোট আসনের ৩ শতাংশ। এর মানে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনীয়তা একটি পুরনো চিন্তা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে নারীর জন্য ১৫টি সংরক্ষিত আসন ছিল; যা মোট আসনের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে এই আসন সংখ্যা ৩০টি করা হয়। সেসময়ে সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকা ‘সংসদের শোভা ৩০ সেট অলংকার’ শিরোনামে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে সংরক্ষিত নারী আসনকে ব্যঙ্গ করে ‘অলংকার’ বলা হয়। কারণ, এই ৩০টি আসন সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় না, সংসদে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে সংরক্ষিত আসনে নারীরা মনোনয়ন পেয়ে থাকেন। তাঁদের থাকে না নির্দিষ্ট কোনো নির্বাচনী এলাকা। ফলে সংসদে নারীর সরাসরি জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকে না।
আইন সভার কার্যক্রম সম্পর্কে নারী যাতে অভিজ্ঞতা লাভ করে এবং নারীর উপস্থিতি রাজনীতিতে যেন সহনীয় হয়ে ওঠে, তাই এই সংরক্ষিত আসনের ধারণা। এই ব্যবস্থা প্রচলনের ৩০ বছর পরেও রাজনৈতিক দলের পুরুষদের প্রশ্রয়মূলক নীতিকে সাদা চোখে দেখা হয়নি।
১৯৭২ সালে এরকম আসনের ধারণাকে অলংকার বলা না হলেও ৮৬ সালে বলা হলো। ১৯৭২ সালে নতুন দেশ। আগের ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা তখনও শেষ হয়নি। তখন হয়তো কারো মনে এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। সেই সময়ের সমাজবাস্তবতায়ও এই নারীদের সংসদে থাকা জরুরি ছিল। তা না হলে জনগণের একটা বড় অংশ রাষ্ট্রব্যবস্থার বাইরে থেকে যাচ্ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ১৬ বছর পর নারীর এই পরোক্ষ অংশগ্রহণের সংখ্যা বৃদ্ধিটা প্রশ্নবোধক হয়ে ওঠে।
এই প্রচেষ্টাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়—বেশি ভোট পেয়ে যারা সরকার গঠন করল, তারা কেবল সংসদে তাদের ভোট বাড়ালো। কিন্তু প্রতিনিধিত্বের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ, বিতর্ক, আলোচনায় গুণগত পরিবর্তনের জন্য কিছুই করা হলো না।
আইন প্রণয়নে পুরুষ সহকর্মীদের মতো সংরক্ষিত আসনে নারীদের যে কার্যকরী অংশগ্রহণ থাকে না, বরং আনুগত্য হয় তাঁদের টিকে থাকার শর্ত— এটি তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই দেখা যায়, এই আসনের নারী সদস্যরা অন্যদের মতো সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও সরাসরি ভোটে নির্বাচিতদের মতো মর্যাদা ও গুরুত্ব পান না। আর ১৯৫৬ সালের সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনের ধারণা সত্তর বছর পর ২০২৫ সালেও একইভাবে রয়ে গেছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনের চল্লিশ বছর আগের সমালোচনা এখনও প্রাসঙ্গিক রাখার প্রচেষ্টাই আমরা দেখতে পাচ্ছি। অথচ রাষ্ট্রীয় জীবনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পুরুষের একার আয়ে এখন আর সংসার চলে না। নারী ঘরে-বাইরে, শিক্ষাদীক্ষায়, আইন-আদালতে সবখানে সমান অংশীদারি। নারীর কাজের অবদান জিডিপিতে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে এই বছর। ফলে দেশে যখন শতকরা ৫১ ভাগ নারী, তখন নারী সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইবে এইটাই স্বাভাবিক।
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে নারী সম্মুখভাগে লড়াই করেছে। সেই নারীকেই অভ্যুত্থান শেষে রাজনীতি করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নারীরাও বাইনারির বাইরের মানুষসহ অন্যান্য প্রান্তিকজন তখন মানবাধিকারের জন্য পথে নেমে এসেছিলেন। তাঁরা সবার বেঁচে থাকার অধিকার, মত ও পথের জন্য ঊনমানুষে পরিণত করার বিরুদ্ধে শক্ত বার্তা দিয়েছিলেন। অথচ এই আন্দোলন শেষে নারীসহ সকল প্রান্তকজনের বিরুদ্ধে নীতি পুলিশগিরি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
স্লাট শেমিং করে বেশ্যাকরণ করার আগের রেজিমের তরিকা নতুন মাত্রায় জারি রাখা হচ্ছে। ইসলামে নানান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যেখানে অনুমোদিত, কোরআন পাঠ ও তার মর্ম উদ্ধারে নারী বা পুরুষ কাউকে বিরত রাখা হয়নি—এমনকি সকল বিচারের দায়িত্ব আল্লাহ্ নিজে নিয়েছেন, সেখানে কতিপয় সহি 'ইসলামচর্চার দাবিদারেরা' তাঁদের ব্যাখ্যাকে একমাত্র ইসলাম বলে প্রতিষ্ঠায় উঠে পড়ে লেগেছেন। এছাড়া মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে নারীর রাজনীতিতে এবং সমরে সক্রিয় থাকার উদাহরণ থাকার পরেও তাঁরা আমাদের দেশে নারীর রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের বিরোধিতা করছে। কিংবা নারীর রাজনীতির ধরন-ধারণ কী হবে, তা তারা নির্ধারণ করতে চাইছে।
রাজনীতি থেকে নারীকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা, তাঁদের রাজনীতি করার ভিন্ন ভিন্ন আকাঙক্ষা ও তা প্রকাশের ওপর খবরদারি করাকে আমি নারীর বিরুদ্ধে জুলুম মনে করি। শুধু তাই না এটিকে ঔপনিবেশিক পিতৃতান্ত্রিকতা হিসেবেও দেখি। কারণ, এই বিশেষ ধরনের পিতৃতন্ত্র বিকশিত হয়েছে ব্রিটিশদের ইসলামি আইন কোডিফাই করার মধ্য দিয়ে, যেখানে ব্রিটিশ কমন ল-এর প্রভাবও আছে।
এদের চোখ রাঙানিতেই কি না জানি না, বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আমরা সংকীর্ণ ভূমিকায় দেখতে পাচ্ছি। নারী কমিশন ছাড়া আর কোনো কমিশনের প্রধান হিসেবে নারীকে আমরা দেখতে পাইনি। আবার এই অজুহাতে ঐকমত্য কমিশনে আমরা কোনো নারীকে পেলাম না।
অন্যদিকে ঐকমত্য কমিশনে সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে নীতিগত আলোচনার জন্য বিষয়টি পাঠানো হলেও নারী সদস্যদের অগ্রাধিকার দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যদের মধ্যে আগ্রহ দেখা যায়নি। নারীও পিতৃতান্ত্রিকতার বাইরে থাকে নয়। পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ যখন আধিপত্য তৈরি করে, তখন অল্পসংখ্যক নারী অধিক সংখ্যক পুরুষের পরিসরে কাজ করতে চাইলে, সফল হতে চাইলে, টিকে থাকতে তাঁদের বেশি পিতৃতান্ত্রিক হতে হয়। তখন নারীকে পুরুষের চেয়েও বেশি পুরুষ হতে হয়।
অন্যদিকে, অধিক হারে নারী ও অন্য প্রান্তিক মানুষজনের রাজনীতির পরিসরে আসা যদি নিশ্চিত করা যেত, তবে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হতো। এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, নারীদের উপস্থিতিতে রাজনীতির ধরন-ধারণের প্রকাশ বদলে যায়।
তার মানে দাঁড়ায়, আগের অবস্থা টিকিয়ে রাখতেই নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে এসব টালবাহানা জারি আছে। আর এভাবে অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের কথা তো টেবিলেই আনা বন্ধ রাখা হয়েছে।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর হয়েছে। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান সরকার গত বছর আগস্ট মাসের ৮ তারিখে শপথ নিয়েছিল। গোটা দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। অধিকাংশ মানুষ ভেবেছিলেন এবার দেশে একটা স্থিতিশীল টেকসই জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
১ দিন আগেশেখ মুজিবের হত্যার ঘটনাকে নানাভাবে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। এভাবে তিনি দ্বিতীয়বার নিহত হতে থাকলেন।
১ দিন আগে২০১৯ সালের ৫ আগস্ট। ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে দেওয়া জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়। দুটি আলাদা ভাগ করে জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে নয়াদিল্লির সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়।
১ দিন আগে১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। উপমহাদেশের অনেক মানুষের চোখে ঘুম ছিল না সেই রাতে। এমন রাত তাঁদের জীবনে আগে কখনো আসেনি। তাঁরা জানত না রাতের আঁধারে কেমন সকাল তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। সাতচল্লিশের সেই দেশভাগ বা পার্টিশনের প্রভাব এখনো বহন করে চলেছি আমরা। একে কোনো একরৈখিক বয়ানে বেঁধে ফেলা দুষ্কর।
২ দিন আগে