আইন ও নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে অংশীজনদের অংশগ্রহণ সীমিত। খসড়া আইন প্রণয়ন প্রায়শই মন্ত্রণালয়ের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে নানা সময়ে আইন প্রণয়ন হলেও এটি জন-অংশীমূলক না হওয়ায় তার বাস্তবায়নে তৈরি হয় নানান জটিলতা।
মো. নেয়ামুল ইসলাম
আইন ও নীতি প্রণয়ন একটি জটিল ও বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। এটি শুধু মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক কাজ নয়, বরং রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নের অংশ। নাগরিকের জীবনযাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, প্রযুক্তি—প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আইন ও নীতি প্রণয়নের প্রভাব রয়েছে। তাই আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, একাডেমিয়া, সুশীল সমাজ এবং স্থানীয় পর্যায়ের মানুষের মতামত অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য।
কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াটি প্রধানত মন্ত্রণালয়নির্ভর এবং তা সংসদীয় কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সংসদীয় কমিটিগুলো সচরাচর নাগরিক বা বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করে না। বড় ব্যবসায়ী সংগঠন ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা প্রভাব বিস্তার করলেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, সাধারণ নাগরিক, নারী বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতামত প্রায় অনুপস্থিত থাকে। ফলে আইনগুলো অনেক সময় বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না এবং টেকসই বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়।
অংশগ্রহণমূলক আইন প্রণয়নে অরগানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত সদস্য দেশগুলোর ৯৭ শতাংশ সরকার আইন প্রণয়নে স্টেকহোল্ডার বা অংশীজনদের মতামত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে। ৮২ শতাংশ দেশ নিয়মিতভাবে পাবলিক কনসালটেশন বা জনগণের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে। ৪৭ শতাংশ দেশে জনমত আহরণের জন্য অন্তত ৩০ দিন /৪ সপ্তাহ সময়সীমা নির্ধারিত। ৮৫ শতাংশ দেশ অনলাইন কনসালটেশন বা অনলাইনে আলোচনা চালু করেছে। আর প্রায় ৫০ শতাংশ দেশের অন্তত একটি মন্ত্রণালয় খসড়া আইন জনসমক্ষে প্রকাশ করে এবং ৬৬ শতাংশ দেশের মন্ত্রণালয় অংশগ্রহণমূলক কাঠামো তৈরি করেছে।
আইন ও নীতি প্রণয়নে উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা লক্ষ করার মতো। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রসিডিউর অ্যাক্ট, ১৯৪৬ আইন, নতুন নীতি বা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলোকে ‘নোটিশ অ্যান্ড কমেন্ট রুলমেকিং’ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এ লক্ষ্যে খসড়া আইন বা নীতি সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। নাগরিক, ব্যবসায়ী, এনজিও, একাডেমিক প্রতিষ্ঠানসহ সব অংশীজনকে মতামত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। সাধারণত ৬০ দিনের মধ্যে লিখিত মন্তব্য জমা দেওয়া যায়। কংগ্রেসীয় কমিটি গণ-শুনানি আয়োজন করে, যেখানে সরাসরি বক্তব্য বা সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ থাকে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পায়। প্রতিফলিত হয় জনস্বার্থ।
জাপানে নীতি প্রণয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো ‘শিনগিকাই’ বা পরামর্শক পর্ষদ, যা প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকে। এতে শিল্পপ্রতিনিধি, একাডেমিক, সিভিল সোসাইটি ও সাধারণ নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৯৯ সালে পাবলিক কমেন্ট প্রসিডিউর চালু হয়। এর মাধ্যমে সব খসড়া নীতি অনলাইনে প্রকাশিত হয় এবং আবশ্যিকভাবে নাগরিক মতামত সংগ্রহ করা হয়। জাপান ‘কনসেন্সাসবেজড পলিসিমেকিং’ বা সম্মতিভিত্তিক নীতি অনুসরণ করে, যেখানে দ্রুত আইন পাশের চেয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমঝোতা গড়ে তোলাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে আইনগুলো বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর থাকে।
নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ায় একটি কাঠামোগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। প্রথমে উন্মুক্ত আলোচনার জন্য গ্রিন পেপার প্রকাশিত হয়। এরপর চূড়ান্ত নীতি প্রস্তাব হোয়াইট পেপার আকারে সংসদে পেশ করা হয়। নতুন আইন প্রণয়নের আগে এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক। সংসদীয় কমিটি খসড়া আইন পর্যালোচনা করে এবং জনমত গ্রহণ করে। এর ধারাবাহিকতায় একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সব খসড়া প্রকাশিত হয়, যেখানে নাগরিকেরা মতামত দিতে পারে। এভাবে অস্ট্রেলিয়ায় নীতি প্রণয়নের প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়।
বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। আইন ও নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে অংশীজনদের অংশগ্রহণ সীমিত। খসড়া আইন প্রণয়ন প্রায়শই মন্ত্রণালয়ের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। সংসদীয় কমিটি থাকলেও তারা সচরাচর গণ-শুনানি আয়োজন করে না।
সংসদীয় অংশগ্রহণ ও সময় ব্যবহারের বাংলাদেশের বাস্তবতা ও পরিসংখ্যান লক্ষ করা যাক। যেমন—ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ‘পার্লামেন্টারি ওয়াচ’ প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, ১১তম সংসদে আইন প্রণয়ের উদ্দেশ্যে মোট সময়ের মাত্র ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ আইন প্রণয়নে বিলম্বহীনভাবে ব্যয় হয়। ২০১৯ সালের ১১তম সংসদের ৫টি অধিবেশন থেকে ১৬টি (বাজেট ব্যতীত) বিল পাস হয়েছে। প্রতিটি বিল পাসে গড় সময় ছিল মাত্র ৩২ মিনিট, যেখানে সংসদ সদস্যদের ৪ শতাংশের কম সদস্য বিল আলোচনায় অংশ নিয়েছিল ।
অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রথম চার অধিবেশনে ১৪ জন সংসদ সদস্য (৩৫০-এর মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ) বিল-সম্পর্কিত আলোচনায় অংশ নিয়েছিল।
এ ছাড়া, কিছু বিষয় আমরা লক্ষ করি, বড় বড় ব্যবসায়ী সংগঠন (যেমন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ) ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের মতামত প্রায়শই গুরুত্ব পায়। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষক, নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও সাধারণ নাগরিকরা প্রক্রিয়ায় অনুপস্থিত। একাডেমিয়া, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও থিংক-ট্যাঙ্কের মতামত নেওয়া হয় খুবই সীমিত আকারে। জাতীয় পর্যায়ের কোনো ডিজিটাল কনসালটেশন পোর্টাল নেই। আইন প্রণয়নের আগে রেগুলেটরি ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করা হয় না। স্থানীয় পর্যায়ে নীতি পরামর্শ সভা আয়োজনও খুবই সীমিত। ফলে অনেক আইন বাস্তবায়নের সময় মাঠপর্যায়ের চাহিদা ও বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। যেমন কিছু কর আইন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে, আবার স্থানীয় প্রশাসন আইন বাস্তবায়নে জটিলতার সম্মুখীন হয়। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের করণীয় কী? এই বাস্তবতা মাথায় রেখে আমরা কিছু প্রস্তাব পেশ করতে পরি :
১. পাবলিক কনসালটেশন অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে খসড়া আইন বা নীতি প্রকাশ ও মতামত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা। ২. বহুমাত্রিক প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তি—প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা নীতিনির্ধারণী বোর্ড/পরিষদে ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ, সুনির্দিষ্ট করে যাঁদের জন্য আইন তাঁদের প্রতিনিধি, সুশীল সমাজ ও সাধারণ নাগরিকদের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তি। ৩. জাতীয় অনলাইন কনসালটেশন পোর্টাল চালু করা, অর্থাৎ খসড়া আইন প্রকাশ ও নাগরিক মতামত সংগ্রহের জন্য একটি আধুনিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করা। ৪. সংসদীয় কমিটিকে গণ-শুনানি আয়োজন এবং বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা। ৫. প্রতিটি আইন প্রণয়নের আগে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন কর। ৬. স্থানীয় পর্যায়ের পরামর্শসভা, অর্থাৎ ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ে নীতি বিষয়ক পরামর্শসভা আয়োজন করে স্থানীয় বাস্তবতা সংগ্রহ। ৭. বিশ্ববিদ্যালয়, থিংক-ট্যাঙ্ক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা। একাডেমিক গবেষণা ও প্রমাণভিত্তিক নীতিপ্রণয়নকে গুরুত্ব দেওয়া। ৮. স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রাপ্ত মতামতের সারসংক্ষেপ ও সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ (কোন মতামত কেন গৃহীত/অগ্রহণযোগ্য)।
গণতন্ত্র শুধু ভোট দেওয়া নয়, বরং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণেই তা শক্তিশালী হয়। অংশগ্রহণমূলক আইন প্রণয়ন জনগণের আস্থা বাড়ায়, আইনের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে টেকসই করে। অরগানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, যেখানে ৯৭ শতাংশের বেশি দেশ জনমত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে, সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ৪ শতাংশ সংসদ সদস্য বিল আলোচনায় অংশ নেন; আইন প্রণয়নে তাঁদের অংশগ্রহণ ন্যূনতম। বাংলাদেশে ২০২৩ সালে ৬৬টি আইন পাস করা হলেও জনমতপ্রক্রিয়া এড়িয়ে যাওয়ার ফলে আইনগুলো প্রায়ই গ্রহণযোগ্যতা হারায়। আইন প্রণয়নকে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক করতে প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো সময়োপযোগী ও অপরিহার্য বলে মনে করি।
বাংলাদেশে আইন ও নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের মতামত গ্রহণ এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। ফলে অনেক আইন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না এবং বাস্তবায়নে জটিলতা তৈরি হয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক ও গবেষণানির্ভর।
বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক আইন প্রণয়ন নিশ্চিত করতে অরগানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের মতো জনমত আহরণের ন্যূনতম সময়সীমা, অনলাইন কনসালটেশন প্ল্যাটফর্ম এবং অংশীজনদের অংশগ্রহণমূলক মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। ফলে বাংলাদেশের আইন জনগণের কাছে হবে স্বচ্ছ, অধিক গ্রহণযোগ্য, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি হবে সুদৃঢ়, উন্নয়ন প্রক্রিয়া হবে টেকসই।
লেখক : আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ।
আইন ও নীতি প্রণয়ন একটি জটিল ও বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। এটি শুধু মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক কাজ নয়, বরং রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নের অংশ। নাগরিকের জীবনযাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, প্রযুক্তি—প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আইন ও নীতি প্রণয়নের প্রভাব রয়েছে। তাই আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, একাডেমিয়া, সুশীল সমাজ এবং স্থানীয় পর্যায়ের মানুষের মতামত অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য।
কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াটি প্রধানত মন্ত্রণালয়নির্ভর এবং তা সংসদীয় কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সংসদীয় কমিটিগুলো সচরাচর নাগরিক বা বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করে না। বড় ব্যবসায়ী সংগঠন ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা প্রভাব বিস্তার করলেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, সাধারণ নাগরিক, নারী বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতামত প্রায় অনুপস্থিত থাকে। ফলে আইনগুলো অনেক সময় বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না এবং টেকসই বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়।
অংশগ্রহণমূলক আইন প্রণয়নে অরগানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত সদস্য দেশগুলোর ৯৭ শতাংশ সরকার আইন প্রণয়নে স্টেকহোল্ডার বা অংশীজনদের মতামত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে। ৮২ শতাংশ দেশ নিয়মিতভাবে পাবলিক কনসালটেশন বা জনগণের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে। ৪৭ শতাংশ দেশে জনমত আহরণের জন্য অন্তত ৩০ দিন /৪ সপ্তাহ সময়সীমা নির্ধারিত। ৮৫ শতাংশ দেশ অনলাইন কনসালটেশন বা অনলাইনে আলোচনা চালু করেছে। আর প্রায় ৫০ শতাংশ দেশের অন্তত একটি মন্ত্রণালয় খসড়া আইন জনসমক্ষে প্রকাশ করে এবং ৬৬ শতাংশ দেশের মন্ত্রণালয় অংশগ্রহণমূলক কাঠামো তৈরি করেছে।
আইন ও নীতি প্রণয়নে উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা লক্ষ করার মতো। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রসিডিউর অ্যাক্ট, ১৯৪৬ আইন, নতুন নীতি বা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলোকে ‘নোটিশ অ্যান্ড কমেন্ট রুলমেকিং’ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এ লক্ষ্যে খসড়া আইন বা নীতি সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। নাগরিক, ব্যবসায়ী, এনজিও, একাডেমিক প্রতিষ্ঠানসহ সব অংশীজনকে মতামত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। সাধারণত ৬০ দিনের মধ্যে লিখিত মন্তব্য জমা দেওয়া যায়। কংগ্রেসীয় কমিটি গণ-শুনানি আয়োজন করে, যেখানে সরাসরি বক্তব্য বা সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ থাকে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পায়। প্রতিফলিত হয় জনস্বার্থ।
জাপানে নীতি প্রণয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো ‘শিনগিকাই’ বা পরামর্শক পর্ষদ, যা প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকে। এতে শিল্পপ্রতিনিধি, একাডেমিক, সিভিল সোসাইটি ও সাধারণ নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৯৯ সালে পাবলিক কমেন্ট প্রসিডিউর চালু হয়। এর মাধ্যমে সব খসড়া নীতি অনলাইনে প্রকাশিত হয় এবং আবশ্যিকভাবে নাগরিক মতামত সংগ্রহ করা হয়। জাপান ‘কনসেন্সাসবেজড পলিসিমেকিং’ বা সম্মতিভিত্তিক নীতি অনুসরণ করে, যেখানে দ্রুত আইন পাশের চেয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমঝোতা গড়ে তোলাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে আইনগুলো বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর থাকে।
নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ায় একটি কাঠামোগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। প্রথমে উন্মুক্ত আলোচনার জন্য গ্রিন পেপার প্রকাশিত হয়। এরপর চূড়ান্ত নীতি প্রস্তাব হোয়াইট পেপার আকারে সংসদে পেশ করা হয়। নতুন আইন প্রণয়নের আগে এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক। সংসদীয় কমিটি খসড়া আইন পর্যালোচনা করে এবং জনমত গ্রহণ করে। এর ধারাবাহিকতায় একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সব খসড়া প্রকাশিত হয়, যেখানে নাগরিকেরা মতামত দিতে পারে। এভাবে অস্ট্রেলিয়ায় নীতি প্রণয়নের প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়।
বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। আইন ও নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে অংশীজনদের অংশগ্রহণ সীমিত। খসড়া আইন প্রণয়ন প্রায়শই মন্ত্রণালয়ের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। সংসদীয় কমিটি থাকলেও তারা সচরাচর গণ-শুনানি আয়োজন করে না।
সংসদীয় অংশগ্রহণ ও সময় ব্যবহারের বাংলাদেশের বাস্তবতা ও পরিসংখ্যান লক্ষ করা যাক। যেমন—ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ‘পার্লামেন্টারি ওয়াচ’ প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, ১১তম সংসদে আইন প্রণয়ের উদ্দেশ্যে মোট সময়ের মাত্র ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ আইন প্রণয়নে বিলম্বহীনভাবে ব্যয় হয়। ২০১৯ সালের ১১তম সংসদের ৫টি অধিবেশন থেকে ১৬টি (বাজেট ব্যতীত) বিল পাস হয়েছে। প্রতিটি বিল পাসে গড় সময় ছিল মাত্র ৩২ মিনিট, যেখানে সংসদ সদস্যদের ৪ শতাংশের কম সদস্য বিল আলোচনায় অংশ নিয়েছিল ।
অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রথম চার অধিবেশনে ১৪ জন সংসদ সদস্য (৩৫০-এর মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ) বিল-সম্পর্কিত আলোচনায় অংশ নিয়েছিল।
এ ছাড়া, কিছু বিষয় আমরা লক্ষ করি, বড় বড় ব্যবসায়ী সংগঠন (যেমন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ) ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের মতামত প্রায়শই গুরুত্ব পায়। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষক, নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও সাধারণ নাগরিকরা প্রক্রিয়ায় অনুপস্থিত। একাডেমিয়া, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও থিংক-ট্যাঙ্কের মতামত নেওয়া হয় খুবই সীমিত আকারে। জাতীয় পর্যায়ের কোনো ডিজিটাল কনসালটেশন পোর্টাল নেই। আইন প্রণয়নের আগে রেগুলেটরি ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করা হয় না। স্থানীয় পর্যায়ে নীতি পরামর্শ সভা আয়োজনও খুবই সীমিত। ফলে অনেক আইন বাস্তবায়নের সময় মাঠপর্যায়ের চাহিদা ও বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। যেমন কিছু কর আইন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে, আবার স্থানীয় প্রশাসন আইন বাস্তবায়নে জটিলতার সম্মুখীন হয়। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের করণীয় কী? এই বাস্তবতা মাথায় রেখে আমরা কিছু প্রস্তাব পেশ করতে পরি :
১. পাবলিক কনসালটেশন অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে খসড়া আইন বা নীতি প্রকাশ ও মতামত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা। ২. বহুমাত্রিক প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তি—প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা নীতিনির্ধারণী বোর্ড/পরিষদে ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ, সুনির্দিষ্ট করে যাঁদের জন্য আইন তাঁদের প্রতিনিধি, সুশীল সমাজ ও সাধারণ নাগরিকদের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তি। ৩. জাতীয় অনলাইন কনসালটেশন পোর্টাল চালু করা, অর্থাৎ খসড়া আইন প্রকাশ ও নাগরিক মতামত সংগ্রহের জন্য একটি আধুনিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করা। ৪. সংসদীয় কমিটিকে গণ-শুনানি আয়োজন এবং বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা। ৫. প্রতিটি আইন প্রণয়নের আগে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন কর। ৬. স্থানীয় পর্যায়ের পরামর্শসভা, অর্থাৎ ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ে নীতি বিষয়ক পরামর্শসভা আয়োজন করে স্থানীয় বাস্তবতা সংগ্রহ। ৭. বিশ্ববিদ্যালয়, থিংক-ট্যাঙ্ক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা। একাডেমিক গবেষণা ও প্রমাণভিত্তিক নীতিপ্রণয়নকে গুরুত্ব দেওয়া। ৮. স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রাপ্ত মতামতের সারসংক্ষেপ ও সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ (কোন মতামত কেন গৃহীত/অগ্রহণযোগ্য)।
গণতন্ত্র শুধু ভোট দেওয়া নয়, বরং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণেই তা শক্তিশালী হয়। অংশগ্রহণমূলক আইন প্রণয়ন জনগণের আস্থা বাড়ায়, আইনের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে টেকসই করে। অরগানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, যেখানে ৯৭ শতাংশের বেশি দেশ জনমত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে, সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ৪ শতাংশ সংসদ সদস্য বিল আলোচনায় অংশ নেন; আইন প্রণয়নে তাঁদের অংশগ্রহণ ন্যূনতম। বাংলাদেশে ২০২৩ সালে ৬৬টি আইন পাস করা হলেও জনমতপ্রক্রিয়া এড়িয়ে যাওয়ার ফলে আইনগুলো প্রায়ই গ্রহণযোগ্যতা হারায়। আইন প্রণয়নকে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক করতে প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো সময়োপযোগী ও অপরিহার্য বলে মনে করি।
বাংলাদেশে আইন ও নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের মতামত গ্রহণ এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। ফলে অনেক আইন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না এবং বাস্তবায়নে জটিলতা তৈরি হয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক ও গবেষণানির্ভর।
বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক আইন প্রণয়ন নিশ্চিত করতে অরগানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের মতো জনমত আহরণের ন্যূনতম সময়সীমা, অনলাইন কনসালটেশন প্ল্যাটফর্ম এবং অংশীজনদের অংশগ্রহণমূলক মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। ফলে বাংলাদেশের আইন জনগণের কাছে হবে স্বচ্ছ, অধিক গ্রহণযোগ্য, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি হবে সুদৃঢ়, উন্নয়ন প্রক্রিয়া হবে টেকসই।
লেখক : আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ।
রাহুলের অভিযোগ, ভিন্ন রাজ্যে বসে কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত উপায়ে কংগ্রেসপন্থী, দলিত-আদিবাসী ও সংখ্যালঘু ভোটারদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। কর্ণাটকের আলন্দ কেন্দ্রে ছয় হাজারেরও বেশি নাম বাদ দেওয়ার আবেদন জমা পড়েছিল বলে অভিযোগ। রাহুল গান্ধীর মতে, ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া আসলে নিতান্তই এ
৫ ঘণ্টা আগেজাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) থেকে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে এলডিসি গ্রাজুয়েশনের প্রস্তুতি বিষয়ে অগ্রগতি জানানোর জন্য। এলডিসি উত্তরণ ঘটিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়ে পাঠানো হয়নি চিঠিটা। চিঠি পাবার পর দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে ফাঁসির রায় হয়ে গেছে।
২ দিন আগেহাসিনাশাহির পতনের পর আমাদের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্র-যাত্রা। জুলাই সনদ ইত্যাদির পর এমন রাষ্ট্রের দিকে বাংলাদেশ যাত্রা করবে, যেখানে স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে না। কিন্তু সেই জায়গা থেকে আমরা মনে হয় অনেক দূরে সরে এসেছি।
২ দিন আগেআসামে বছর ঘুরলেই নির্বাচন এবং পশ্চিমবঙ্গেও ভোট প্রায় একইসময়ে। এবার নির্বাচনে বিরোধীরা যখন বিশেষ নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধনী বা এসআইআর-কে নির্বাচনী ইস্যু হিসেবে সবার উপরে রাখছেন, তখন গেরুয়া শিবিরের প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার হলো ‘অনুপ্রবেশ’।
৩ দিন আগে