leadT1ad

ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে কী ভাবছে মুসলিম বিশ্ব

কাতারের মাটিতে ইসরায়েলের প্রথম সরাসরি আক্রমণে ৮টি এফ-১৫ রাআম এবং এফ-৩৫ আদির যুদ্ধবিমানসহ মোট ১২টি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হয়েছিল। বিমানে থাকা ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সৌদি আরবের আকাশসীমার ওপর দিয়ে উড়ে আঘাত হানে। তবে এজন্য সৌদি আরবের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

সুমন সুবাহান
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩: ৪১
ইসরায়েল লোহিত সাগর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, যা কাতারের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার রাডার থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। স্ট্রিম গ্রাফিক

গত ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টা ৫৪ মিনিটে কাতারের রাজধানী দোহাতে ইসরায়েল হামলা করে। ইসরায়েলি হামলায় ব্যবহৃত যুদ্ধবিমানগুলো সরাসরি কোনো প্রতিবেশী আরব দেশের আকাশসীমা ব্যবহার করেনি। লোহিত সাগর থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে হামলা চালায় বলে জানা যায়। হামলার জন্য হামাস নেতাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের সংকেত ব্যবহার করা হয়েছিল। হামলাটি ছিল খুবই সুনির্দিষ্ট ও লক্ষ্যভেদী।

কাতারের মাটিতে ইসরায়েলের প্রথম সরাসরি আক্রমণে ৮টি এফ-১৫ রাআম এবং এফ-৩৫ আদির যুদ্ধবিমানসহ মোট ১২টি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হয়েছিল। বিমানে থাকা ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সৌদি আরবের আকাশসীমার ওপর দিয়ে উড়ে আঘাত হানে। তবে এজন্য সৌদি আরবের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশটির অনুমতি এড়িয়ে হামলা সফল করা এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এড়ানো। সৌদি আরব পরে অবশ্য ইসরায়েলের এই হামলার নিন্দা জানায়।

ইসরায়েল হামলার মাত্র কয়েক মিনিট আগে মার্কিন সামরিক বাহিনীকে এই আক্রমণের বিষয়ে সতর্ক করেছিল। কিন্তু আক্রমণের এত কম সময় আগে তথ্য দেওয়ায় বা স্বল্প সময়ের নোটিশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা কাতারের পক্ষে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল না।

ইসরায়েলের হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল কাতারে অবস্থানরত হামাসের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা খলিল আল-হায়া-কে হত্যা করা। এজন্য ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল দোহাতে অবস্থিত সেই ভবন, যেখানে হামাসের রাজনৈতিক নেতারা গাজার যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার জন্য মিলিত হয়েছিলেন।

ইসরায়েল এই হামলার মাধ্যমে হামাসকে একটি কঠোর বার্তা দিতে চেয়েছিল, তা হলো তাদের সদস্যরা বিশ্বের কোথাও নিরাপদ নয়। কিন্তু হামাসের শীর্ষ নেতারা ইসরায়েলের হামলা থেকে বেঁচে যান। কারণ আক্রমণের কিছুক্ষণ আগে তাঁরা লক্ষ্যবস্তু ভবনটি ত্যাগ করেছিলেন।

জানা যায় যে, আক্রমণের কিছুক্ষণ আগে তাদের ব্যবহৃত মোবাইলফোন আলোচনা স্থানে রেখে তারা পাশের মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। তবে পাঁচজন নিম্নপদস্থ হামাস সদস্য ও একজন কাতারি নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হন।

কাতারে ইসরায়েলের এই আক্রমণের পর মুসলিম দেশগুলো ন্যাটোর আদলে একটি সামরিক জোট গঠনের পরিকল্পনা করছে। এই উদ্যোগের পেছনে প্রধানত ইরান ও মিশর নেতৃত্ব দিচ্ছে।

এই হামলার ফলে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানায় এবং মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়।

ইসরায়েলের এই হামলা থেকে প্রশ্ন আসতে পারে, কাতারের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কাজ করেনি কেন? এর উত্তরে বলা যায়, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলের হামলা থেকে কাতারের পক্ষে নিজেদের রক্ষা করতে না পারার সম্ভাব্য কিছু কারণ আছে।

ক্ষেপণাস্ত্রের ধরন

ইসরায়েল সম্ভবত দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল, যা যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষেপ করা যায় এবং সরাসরি আকাশসীমায় প্রবেশ না করে মহাকাশপথ দিয়ে যেতে পারে।

আর কাতারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যেমন প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র, সাধারণত এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধের জন্য ডিজাইন করা নয়।

আক্রমণের কৌশল

ইসরায়েল লোহিত সাগর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, যা কাতারের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার রাডার থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। এই কৌশল ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানকে সরাসরি কাতারি বা প্রতিবেশী দেশের আকাশসীমায় প্রবেশ না করে হামলা চালানোর সুযোগ করে দেয়, যা রাডার শনাক্তকরণ এড়াতে সাহায্য করে।

অবস্থানের দূরত্ব

ইসরায়েলের সামরিক বিমানগুলো লোহিত সাগরে প্রায় ১,৫০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করেছিল। এত দূর থেকে আক্রমণ করার ফলে কাতারের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার পক্ষে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো শনাক্ত করা এবং সেগুলোকে বাধা দেওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছিল।

প্রশ্ন আসতে পারে, ইসরায়েলের হামলায় কাতারে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটির ভূমিকা কী ছিল কিংবা তারা কাতারকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসেনি কেন?

কাতারে অবস্থিত আল উদেইদ বিমান ঘাঁটি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। তারা কাতারের নিরাপত্তার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও এই হামলার ঘটনায় ঘাঁটিটির কোনো সক্রিয় ভূমিকা ছিল না।

মিশর কায়রোতে একটি যৌথ সামরিক কমান্ড সেন্টার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, আরব লীগের ২২টি সদস্য দেশ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করা হবে এবং প্রথম দফায় মিশরীয় সেনাবাহিনী এর নেতৃত্ব দেবে।

এই বিষয়ে কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ইসরায়েল হামলার মাত্র কয়েক মিনিট আগে মার্কিন সামরিক বাহিনীকে এই আক্রমণের বিষয়ে সতর্ক করেছিল। কিন্তু আক্রমণের এত কম সময় আগে তথ্য দেওয়ায় বা স্বল্প সময়ের নোটিশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা কাতারের পক্ষে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল না। এছাড়াও ইসরায়েল যে ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল (দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র) তা সাধারণ আকাশসীমার বাইরে থেকে আঘাত হেনেছিল, যা ঘাঁটির নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (যেমন প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র) দ্বারা ঠেকানো কঠিন ছিল।

কাতারে ইসরায়েলের এই আক্রমণের পর মুসলিম দেশগুলো ন্যাটোর আদলে একটি সামরিক জোট গঠনের পরিকল্পনা করছে। এই উদ্যোগের পেছনে প্রধানত ইরান ও মিশর নেতৃত্ব দিচ্ছে। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সামরিক কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে দোহাতে হামাস কর্মকর্তাদের ওপর হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম বিশ্ব ইসরায়েলকে একটি অস্থিতিশীল সামরিক শক্তি হিসেবে দেখছে। একই সঙ্গে এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। এ বিষয়ে মুসলিম দেশগুলোর ভাবনার রূপরেখাগুলো হলো—

মিশরের প্রস্তাব

মিশর কায়রোতে একটি যৌথ সামরিক কমান্ড সেন্টার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, আরব লীগের ২২টি সদস্য দেশ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করা হবে এবং প্রথম দফায় মিশরীয় সেনাবাহিনী এর নেতৃত্ব দেবে। এই বাহিনীতে নৌ, বিমান, স্থল ও কমান্ডো ইউনিট অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

ইরানের অবস্থান

ইরান আরও ব্যাপক জোট গঠনের পক্ষে। ইরানের সাবেক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস-এর কমান্ডার মোহসেন রেজায়ে বলেছেন, যদি মুসলিম দেশগুলো দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে সৌদি আরব, তুরস্ক ও ইরাকের মতো দেশগুলো ভবিষ্যতে ইসরায়েলের আক্রমণের শিকার হতে পারে।

পাকিস্তানের ভূমিকা

পাকিস্তান, যা একটি পারমাণবিক শক্তিধর মুসলিম দেশ, ইসরায়েলের হামলার পর 'ইসলামিক ন্যাটো' গঠনের আহ্বান জানিয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, মুসলিম দেশগুলোকে তাদের অভিন্ন চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং একটি ইসলামিক সামরিক জোট গঠন করতে হবে।

তবে ন্যাটোর মতো একটি মুসলিম সামরিক জোট গঠনের ধারণাটি নতুন নয়। অতীতেও এমন জোট গঠনের চেষ্টা করা হয়েছে, যেমন ২০১৫ সালে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ এবং ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থানের প্রেক্ষাপটে এরকম একটা প্রস্তাব এসেছিল। তবে সেই প্রচেষ্টাগুলো বিভিন্ন দেশের মধ্যে অবিশ্বাস, ভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থ এবং কমান্ড কাঠামোর মতো বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে সফল হয়নি।

সম্প্রতি কাতারে ইসরায়েলের হামলার পর অবশ্য পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে। অনেক মুসলিম দেশ, এমনকি যারা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, তারাও তাদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবছে। তারা যুক্তিসঙ্গত কারণেই মনে করছে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা গ্যারান্টি যথেষ্ট নয়।

এর ফলে এই জোট গঠনের আলোচনা আরও জোরালো হয়েছে। তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন—

শিয়া-সুন্নি বিভাজন

সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিনের শিয়া-সুন্নি বিভাজন এই জোটের জন্য একটি বড় বাধা হতে পারে।

পাকিস্তান, যা একটি পারমাণবিক শক্তিধর মুসলিম দেশ, ইসরায়েলের হামলার পর 'ইসলামিক ন্যাটো' গঠনের আহ্বান জানিয়েছে।

জাতীয় স্বার্থের সংঘাত

বিভিন্ন মুসলিম দেশের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে, যা তাদের ঐক্যবদ্ধ সামরিক পদক্ষেপকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ

একটি যৌথ সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব কে দেবে এবং কীভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তা নিয়ে অতীতের মতো ভবিষ্যতেও মতপার্থক্য দেখা দিতে পারে।

নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ইসরায়েলের আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সামরিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নতুন করে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নতুন রূপ দিতে পারে।

বিষয়:

Ad 300x250

সম্পর্কিত