জাভেদ হুসেন
এই বছর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের সময় প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে ছয় প্রভাবশালী রাজনীতিক নিউ ইয়র্কে উপস্থিত রয়েছেন। অধিবেশনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে একটি বিশেষ বৈঠকেও অংশ নেবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বাংলাদেশে এই ধরনের সম্মিলিত সফর নজিরবিহীন। এমন সম্ভাবনার কথাও উঠেছে যে সফরের আড়ালে দেশ থেকে দূরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বিন্যাস তৈরির চেষ্টা চলছে। সরকারের লক্ষ্য—প্রতিটি পক্ষকে কিছু দিয়ে কোনো সমীকরণ দাঁড় করানো। যদি এমন কোনো বোঝাপড়া হয়, তাহলে প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথে কি বাধা সৃষ্টি হবে?
আর ঘোষিত বা অঘোষিতভাবে বিভিন্ন সময়ে দেশগুলো এরকম বোঝাপড়া তৈরিতে আগ্রহী ভূমিকা রেখেছে। কেনই বা তারা এমন ভূমিকা রাখে? তা কি শুধু সদিচ্ছা থেকে?
ইতিহাসজুড়ে কিছু শহর কেবল আকাশছোঁয়া দালান বা বিমানবন্দরের জন্যই বিখ্যাত নয়। প্রায়ই এগুলো হয়ে উঠেছে নিঃশব্দ মঞ্চ, যেখানে দেশগুলোর ভাগ্য লেখা হয়েছে। লন্ডন, জেনেভা, রোম, কায়রো, দোহা—নেতারা এইসব শহরে গিয়েছেন গোপন বৈঠকে, জোট গড়েছেন, এমনকি নতুন রাষ্ট্রের জন্মের সিদ্ধান্তও নিয়েছেন।
লন্ডনে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশী সংগঠকেরা লন্ডনে বৈঠক করে আন্তর্জাতিক সমর্থনের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। দিল্লি, নাইরোবি বা আক্রার ধুলোভরা রাস্তাগুলো থেকে অনেক দূরে, লন্ডনের ফ্ল্যাট, ক্লাব ও দূতাবাসে অনেক নতুন রাষ্ট্রের পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে।
জেনেভা শান্তি আলোচনার শহর। শীতল যুদ্ধের সময় ওয়াশিংটন ও মস্কো একে অপরের দিকে যুদ্ধংদেহী হয়ে থাকলেও জেনেভা নীরবে আলোচনা, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও মানবিক সমঝোতার মঞ্চ তৈরি করত। এটি শুধু সুইজারল্যান্ডের নিরপেক্ষতার কারণে নয়, এখানে নিশ্চয়তা ছিল গোপনীয়তা, স্থিতিশীলতা ও নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমের।
এমনি করেই রোমের ভ্যাটিকান এবং প্যারিসের যুদ্ধোত্তর আলোচনা বহু দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে।
৫০-৬০ এর দশকে মিশরের কায়রো ছিল আরব জাতীয়তাবাদের কেন্দ্র। মিশরের আরব জাতীয়তাবাদী নেতা নাসেরের মতো নেতারা মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা করেছিলেন।
আর কাতারের দোহা সাম্প্রতিক উদাহরণ। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান দোহায় বসে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পথ খুলে দেয়।
এই শহরগুলো শুধু নিরপেক্ষ মঞ্চ নয়। এগুলো রাজনৈতিক স্বার্থেরও কেন্দ্র। এমনও সব আলোচনার স্থান হয়ে লন্ডন প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে তার প্রভাব ধরে রাখে। জেনেভা প্রতিষ্ঠা করে তার আন্তর্জাতিক মর্যাদা। দোহা কূটনৈতিক প্রভাব বাড়ায়। আর ওয়াশিংটন বিশ্ব রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে।
ইতিহাস দেখায়, এসব শহর সাধারণত স্থিতিশীল, আন্তর্জাতিক সংযোগ সমৃদ্ধ, গণমাধ্যম ও কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দু এবং প্রাক্তন ঔপনিবেশিক বা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে অভিজ্ঞ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ও এই ধারা দেখা যায়।
এইসব পুরনো শহরগুলো আজও গুরুত্বপূর্ণ। তবে দোহা, ইস্তানবুল, আবুধাবি নতুন শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। নিউ ইয়র্ক শুধু জাতিসংঘের সদর দপ্তর নয়। এটি বিশ্ব অর্থনীতি, মিডিয়া এবং কূটনৈতিক নেটওয়ার্কের কেন্দ্র। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের জন্য এখানে বৈঠক মানে আন্তর্জাতিক মহলে বার্তা পাঠানো।
শহরগুলো কেবল স্থান নয়, তারা রাজনীতির আসর। লন্ডনের গোপন কক্ষে তৈরি চুক্তি, দোহার আলোচনায় স্বাক্ষরিত চুক্তি, জেনেভার শান্তি আলোচনা—সবই প্রমাণ যে এই শহরগুলো ভাগ্য রচনার মঞ্চ। নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বৈঠকও এই ধারার অংশ? প্রশ্ন হলো, দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কি এবার ঢাকায় নয়, বরং নিঃশব্দে নিউ ইয়র্কে লেখা হবে?
কী বৈশিষ্ট্য থাকলে কোনো দেশ বা শহর হয়ে ওঠে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চ? এর কিছু স্পষ্ট নির্দেশক আছে।
প্রথমত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। যে শহরে আলোচনার জন্য নেতারা আসে, সেখানে শান্তি থাকা অত্যন্ত জরুরি। আলোচনার অংশগ্রহণকারীদের নিরাপদ বোধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সংযোগ। বিমানপথে সহজে পৌঁছনো যায়, দূতাবাস আছে, এবং বিশ্বের মিডিয়ার কাছে সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব।
তৃতীয়ত, গোপনীয়তা ও মর্যাদা। অনেক সময় চুক্তি বা সমঝোতার জন্য প্রাইভেসি দরকার হয়। কিন্তু শুধু প্রাইভেসি নয়—শহরটিকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দেওয়া যায়। যেমন, জেনেভা অ্যাকর্ড, দোহা চুক্তি, বা প্যারিস শান্তি সম্মেলন—প্রতিটি নামেই আছে শক্তির প্রতীকী গুরুত্ব।
চতুর্থত, ঐতিহাসিক সম্পর্ক। দেখা গেছে যে প্রায়শই এরকম বৈঠক আয়োজক দেশের ঔপনিবেশিক ইতিহাস বা আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে। সে কারণে তারা আন্তর্জাতিক আলোচনায় নিজেকে সক্রিয় রাখে, নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়ও এমন দেখা গেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে সঙ্গে লন্ডন, নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক আলোচনা চলছিল। যুদ্ধের মঞ্চের সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল আন্তর্জাতিক মঞ্চ। এখানেই বিদেশি কূটনীতিক, রাজনৈতিক নেতা এবং সাংবাদিকরা অংশ নিয়েছিলেন, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে বড় ভূমিকা রেখেছে।
ইতিহাস বলছে—এই শহরগুলো কেবল স্থান নয়, তারা শক্তি, সংযোগ এবং প্রভাবের প্রতীক। যা ঘটে সেখানে, তার প্রতিক্রিয়া দেশের সীমা ছাড়িয়ে যায়।
আজকের দিনে নিউইয়র্ক এই তালিকায় স্বাভাবিকভাবে যুক্ত হয়েছে। এটি কেবল জাতিসংঘের সদর দপ্তর নয়—এটি হয়ে উঠেছে বিশ্ব কূটনীতির অঘোষিত রাজধানী। ওয়াল স্ট্রিটকে কেন্দ্র করে শহরটি বিশ্ব অর্থনীতির নার্ভ সেন্টার। এখানে প্রতিটি বড় মিডিয়া নেটওয়ার্ক, চিন্তক ট্যাঙ্ক এবং লবিং গ্রুপের উপস্থিতি নিশ্চিত। আর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রায় প্রতিটি বিশ্বনেতা বছরে অন্তত একবার নিউইয়র্কে আসেন।
এখানে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলো দেশীয় সংবাদমাধ্যমের কাছে কম দৃশ্যমান হলেও বিদেশি কূটনীতিক ও দাতা দেশের কাছে অত্যন্ত দৃশ্যমান। চুক্তি বা সমঝোতা শান্তিপূর্ণভাবে করা যায়। পাশে থাকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক বা সমর্থক—যারা তা প্রত্যক্ষ করতে পারে বা সমর্থন জানাতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য মূল প্রশ্ন হলো—এটি কি সক্রিয় ও স্বাস্থ্যকর বৈশ্বিক সংযোগের প্রতীক? নাকি দেশের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিজেদের নাগরিকদের চোখের বাইরে নেওয়ার লক্ষণ? এক সময় যেমন লন্ডন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মে সহায়ক ছিল, নিউ ইয়র্ক হয়তো দেশের পরবর্তী রাজনৈতিক অধ্যাযয়ের আকার দিতে পারে। তবে সেই নতুন অধ্যায় কেমন হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
প্রথমে মনে হতে পারে, এই শহরগুলো কেবল নিরপেক্ষ মঞ্চ, যেখানে শান্তি আলোচনা বা কূটনৈতিক বৈঠক নিরাপদে হয়। কিন্তু ইতিহাস বলছে—কোনো শহরই কেবল সদিচ্ছার কারণে এমন বৈঠকের আয়োজন করে না।
লন্ডন উদাহরণ। স্বাধীনতার পরও প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে প্রভাব বজায় রাখতে চেয়েছিল ব্রিটেন। ১৯৭১ সালের গ্রীষ্মে, যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, লন্ডন হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের কূটনৈতিক সদর দপ্তর। তাজউদ্দিন আহমদ এবং নির্বাসিত অন্যান্য নেতারা ব্রিটিশ সংসদ সদস্য, সাংবাদিক ও কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাতে চেষ্টা করেছিলেন। লন্ডনের বিভিন্ন বৈঠকখানা ও কমনওয়েলথ অফিসগুলোতে যুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক সহানুভূতি তৈরি হয় এবং প্রথম স্বীকৃতির অঙ্গীকারও নীরবে আলোচনা হয়।
জেনেভার নিরপেক্ষতাও ছিল তার প্রভাব বিস্তারের একটি উপায়। শীতল যুদ্ধের সময় জেনেভা বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনার মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আলোচনা থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের ফ্রান্সের ইন্দোচীনের উপনিবেশিক শাসন সমাপ্তকারী জেনেভা সম্মেলন। এসব সম্মেলন সুইজারল্যান্ডের আন্তর্জাতিকভাবে নিরপেক্ষ হিসেবে ইমেজ তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। আর তা শেষ পর্যন্ত সারা দুনিয়ার সব অবৈধ টাকা জমা রাখার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দেশ হিসেবেও তাদের প্রতিষ্ঠা কায়েম করেছে।
ওয়াশিংটন অবশ্য কখনো গোপন রাখেনি যে এরকম সব বৈঠক আয়োজনে তার স্বার্থ ছিল স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই চেয়েছে যেন এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার সরকারগুলো যেন আমেরিকান প্রভাবের মধ্যে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র কেবল মধ্যস্থতাকারী নয়। সে নিজেই একটি পক্ষ। চিলি থেকে গুয়াতেমালার মতো দেশগুলোর সরকারের অভ্যুত্থান বা পরিবর্তনে সিআইএ-এর ভূমিকা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে।
আজকের উদীয়মান কেন্দ্রগুলোও একই যুক্তি অনুসরণ করে। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, আফগানিস্তান বা সুদান নিয়ে কাতারের মধ্যস্থতা ছোট দেশটিকে বড় আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিয়েছে। দোহায় মার্কিন-তালেবান আলোচনার উদাহরণ লক্ষ্যণীয়। কয়েক মাস ধরে দোহার বিলাসবহুল হোটেলে চলা বৈঠক কেবল নিরপেক্ষ মঞ্চ ছিল না। কাতার বিশ্বকে দেখিয়েছে, যেখানে অন্যরা ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে তারা ফলাফল দিতে পারবে। ২০২০ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে, দোহার নাম ইতিহাসের পাতায় উঠেছে জেনেভা ও প্যারিসের সঙ্গে সমান মর্যাদায়।
বিশ্ব রাজনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেশের বাইরে তৈরি হয়েছে। কখনো প্রকাশ্য কখনো ঘোষণা না দিয়ে। বাংলাদেশের নেতাদের সাম্প্রতিক নিউইয়র্ক সফরও কি তেমন কোনো ধারার অংশ? বৈঠকগুলো জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ছায়ায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো কি আন্তর্জাতিক মঞ্চে নতুন কোন রাজনৈতিক সমীকরণ গড়ার চেষ্টার সূচনা?
এই সফরে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সফরসঙ্গী হওয়া কি শুধুই প্রতীকী? দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কি এবার ঢাকার নয়, বরং নিঃশব্দে নিউ ইয়র্কের বৈঠকখানায় লেখা হবে? প্রশ্নগুলো সহজ। কিন্তু উত্তর এখনো অজানা।
জাভেদ হুসেন: লেখক ও অনুবাদক
এই বছর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের সময় প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে ছয় প্রভাবশালী রাজনীতিক নিউ ইয়র্কে উপস্থিত রয়েছেন। অধিবেশনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে একটি বিশেষ বৈঠকেও অংশ নেবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বাংলাদেশে এই ধরনের সম্মিলিত সফর নজিরবিহীন। এমন সম্ভাবনার কথাও উঠেছে যে সফরের আড়ালে দেশ থেকে দূরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বিন্যাস তৈরির চেষ্টা চলছে। সরকারের লক্ষ্য—প্রতিটি পক্ষকে কিছু দিয়ে কোনো সমীকরণ দাঁড় করানো। যদি এমন কোনো বোঝাপড়া হয়, তাহলে প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথে কি বাধা সৃষ্টি হবে?
আর ঘোষিত বা অঘোষিতভাবে বিভিন্ন সময়ে দেশগুলো এরকম বোঝাপড়া তৈরিতে আগ্রহী ভূমিকা রেখেছে। কেনই বা তারা এমন ভূমিকা রাখে? তা কি শুধু সদিচ্ছা থেকে?
ইতিহাসজুড়ে কিছু শহর কেবল আকাশছোঁয়া দালান বা বিমানবন্দরের জন্যই বিখ্যাত নয়। প্রায়ই এগুলো হয়ে উঠেছে নিঃশব্দ মঞ্চ, যেখানে দেশগুলোর ভাগ্য লেখা হয়েছে। লন্ডন, জেনেভা, রোম, কায়রো, দোহা—নেতারা এইসব শহরে গিয়েছেন গোপন বৈঠকে, জোট গড়েছেন, এমনকি নতুন রাষ্ট্রের জন্মের সিদ্ধান্তও নিয়েছেন।
লন্ডনে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশী সংগঠকেরা লন্ডনে বৈঠক করে আন্তর্জাতিক সমর্থনের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। দিল্লি, নাইরোবি বা আক্রার ধুলোভরা রাস্তাগুলো থেকে অনেক দূরে, লন্ডনের ফ্ল্যাট, ক্লাব ও দূতাবাসে অনেক নতুন রাষ্ট্রের পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে।
জেনেভা শান্তি আলোচনার শহর। শীতল যুদ্ধের সময় ওয়াশিংটন ও মস্কো একে অপরের দিকে যুদ্ধংদেহী হয়ে থাকলেও জেনেভা নীরবে আলোচনা, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও মানবিক সমঝোতার মঞ্চ তৈরি করত। এটি শুধু সুইজারল্যান্ডের নিরপেক্ষতার কারণে নয়, এখানে নিশ্চয়তা ছিল গোপনীয়তা, স্থিতিশীলতা ও নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমের।
এমনি করেই রোমের ভ্যাটিকান এবং প্যারিসের যুদ্ধোত্তর আলোচনা বহু দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে।
৫০-৬০ এর দশকে মিশরের কায়রো ছিল আরব জাতীয়তাবাদের কেন্দ্র। মিশরের আরব জাতীয়তাবাদী নেতা নাসেরের মতো নেতারা মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা করেছিলেন।
আর কাতারের দোহা সাম্প্রতিক উদাহরণ। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান দোহায় বসে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পথ খুলে দেয়।
এই শহরগুলো শুধু নিরপেক্ষ মঞ্চ নয়। এগুলো রাজনৈতিক স্বার্থেরও কেন্দ্র। এমনও সব আলোচনার স্থান হয়ে লন্ডন প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে তার প্রভাব ধরে রাখে। জেনেভা প্রতিষ্ঠা করে তার আন্তর্জাতিক মর্যাদা। দোহা কূটনৈতিক প্রভাব বাড়ায়। আর ওয়াশিংটন বিশ্ব রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে।
ইতিহাস দেখায়, এসব শহর সাধারণত স্থিতিশীল, আন্তর্জাতিক সংযোগ সমৃদ্ধ, গণমাধ্যম ও কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দু এবং প্রাক্তন ঔপনিবেশিক বা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে অভিজ্ঞ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ও এই ধারা দেখা যায়।
এইসব পুরনো শহরগুলো আজও গুরুত্বপূর্ণ। তবে দোহা, ইস্তানবুল, আবুধাবি নতুন শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। নিউ ইয়র্ক শুধু জাতিসংঘের সদর দপ্তর নয়। এটি বিশ্ব অর্থনীতি, মিডিয়া এবং কূটনৈতিক নেটওয়ার্কের কেন্দ্র। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের জন্য এখানে বৈঠক মানে আন্তর্জাতিক মহলে বার্তা পাঠানো।
শহরগুলো কেবল স্থান নয়, তারা রাজনীতির আসর। লন্ডনের গোপন কক্ষে তৈরি চুক্তি, দোহার আলোচনায় স্বাক্ষরিত চুক্তি, জেনেভার শান্তি আলোচনা—সবই প্রমাণ যে এই শহরগুলো ভাগ্য রচনার মঞ্চ। নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বৈঠকও এই ধারার অংশ? প্রশ্ন হলো, দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কি এবার ঢাকায় নয়, বরং নিঃশব্দে নিউ ইয়র্কে লেখা হবে?
কী বৈশিষ্ট্য থাকলে কোনো দেশ বা শহর হয়ে ওঠে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চ? এর কিছু স্পষ্ট নির্দেশক আছে।
প্রথমত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। যে শহরে আলোচনার জন্য নেতারা আসে, সেখানে শান্তি থাকা অত্যন্ত জরুরি। আলোচনার অংশগ্রহণকারীদের নিরাপদ বোধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সংযোগ। বিমানপথে সহজে পৌঁছনো যায়, দূতাবাস আছে, এবং বিশ্বের মিডিয়ার কাছে সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব।
তৃতীয়ত, গোপনীয়তা ও মর্যাদা। অনেক সময় চুক্তি বা সমঝোতার জন্য প্রাইভেসি দরকার হয়। কিন্তু শুধু প্রাইভেসি নয়—শহরটিকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দেওয়া যায়। যেমন, জেনেভা অ্যাকর্ড, দোহা চুক্তি, বা প্যারিস শান্তি সম্মেলন—প্রতিটি নামেই আছে শক্তির প্রতীকী গুরুত্ব।
চতুর্থত, ঐতিহাসিক সম্পর্ক। দেখা গেছে যে প্রায়শই এরকম বৈঠক আয়োজক দেশের ঔপনিবেশিক ইতিহাস বা আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে। সে কারণে তারা আন্তর্জাতিক আলোচনায় নিজেকে সক্রিয় রাখে, নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়ও এমন দেখা গেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে সঙ্গে লন্ডন, নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক আলোচনা চলছিল। যুদ্ধের মঞ্চের সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল আন্তর্জাতিক মঞ্চ। এখানেই বিদেশি কূটনীতিক, রাজনৈতিক নেতা এবং সাংবাদিকরা অংশ নিয়েছিলেন, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে বড় ভূমিকা রেখেছে।
ইতিহাস বলছে—এই শহরগুলো কেবল স্থান নয়, তারা শক্তি, সংযোগ এবং প্রভাবের প্রতীক। যা ঘটে সেখানে, তার প্রতিক্রিয়া দেশের সীমা ছাড়িয়ে যায়।
আজকের দিনে নিউইয়র্ক এই তালিকায় স্বাভাবিকভাবে যুক্ত হয়েছে। এটি কেবল জাতিসংঘের সদর দপ্তর নয়—এটি হয়ে উঠেছে বিশ্ব কূটনীতির অঘোষিত রাজধানী। ওয়াল স্ট্রিটকে কেন্দ্র করে শহরটি বিশ্ব অর্থনীতির নার্ভ সেন্টার। এখানে প্রতিটি বড় মিডিয়া নেটওয়ার্ক, চিন্তক ট্যাঙ্ক এবং লবিং গ্রুপের উপস্থিতি নিশ্চিত। আর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রায় প্রতিটি বিশ্বনেতা বছরে অন্তত একবার নিউইয়র্কে আসেন।
এখানে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলো দেশীয় সংবাদমাধ্যমের কাছে কম দৃশ্যমান হলেও বিদেশি কূটনীতিক ও দাতা দেশের কাছে অত্যন্ত দৃশ্যমান। চুক্তি বা সমঝোতা শান্তিপূর্ণভাবে করা যায়। পাশে থাকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক বা সমর্থক—যারা তা প্রত্যক্ষ করতে পারে বা সমর্থন জানাতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য মূল প্রশ্ন হলো—এটি কি সক্রিয় ও স্বাস্থ্যকর বৈশ্বিক সংযোগের প্রতীক? নাকি দেশের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিজেদের নাগরিকদের চোখের বাইরে নেওয়ার লক্ষণ? এক সময় যেমন লন্ডন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মে সহায়ক ছিল, নিউ ইয়র্ক হয়তো দেশের পরবর্তী রাজনৈতিক অধ্যাযয়ের আকার দিতে পারে। তবে সেই নতুন অধ্যায় কেমন হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
প্রথমে মনে হতে পারে, এই শহরগুলো কেবল নিরপেক্ষ মঞ্চ, যেখানে শান্তি আলোচনা বা কূটনৈতিক বৈঠক নিরাপদে হয়। কিন্তু ইতিহাস বলছে—কোনো শহরই কেবল সদিচ্ছার কারণে এমন বৈঠকের আয়োজন করে না।
লন্ডন উদাহরণ। স্বাধীনতার পরও প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে প্রভাব বজায় রাখতে চেয়েছিল ব্রিটেন। ১৯৭১ সালের গ্রীষ্মে, যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, লন্ডন হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের কূটনৈতিক সদর দপ্তর। তাজউদ্দিন আহমদ এবং নির্বাসিত অন্যান্য নেতারা ব্রিটিশ সংসদ সদস্য, সাংবাদিক ও কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাতে চেষ্টা করেছিলেন। লন্ডনের বিভিন্ন বৈঠকখানা ও কমনওয়েলথ অফিসগুলোতে যুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক সহানুভূতি তৈরি হয় এবং প্রথম স্বীকৃতির অঙ্গীকারও নীরবে আলোচনা হয়।
জেনেভার নিরপেক্ষতাও ছিল তার প্রভাব বিস্তারের একটি উপায়। শীতল যুদ্ধের সময় জেনেভা বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনার মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আলোচনা থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের ফ্রান্সের ইন্দোচীনের উপনিবেশিক শাসন সমাপ্তকারী জেনেভা সম্মেলন। এসব সম্মেলন সুইজারল্যান্ডের আন্তর্জাতিকভাবে নিরপেক্ষ হিসেবে ইমেজ তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। আর তা শেষ পর্যন্ত সারা দুনিয়ার সব অবৈধ টাকা জমা রাখার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দেশ হিসেবেও তাদের প্রতিষ্ঠা কায়েম করেছে।
ওয়াশিংটন অবশ্য কখনো গোপন রাখেনি যে এরকম সব বৈঠক আয়োজনে তার স্বার্থ ছিল স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই চেয়েছে যেন এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার সরকারগুলো যেন আমেরিকান প্রভাবের মধ্যে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র কেবল মধ্যস্থতাকারী নয়। সে নিজেই একটি পক্ষ। চিলি থেকে গুয়াতেমালার মতো দেশগুলোর সরকারের অভ্যুত্থান বা পরিবর্তনে সিআইএ-এর ভূমিকা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে।
আজকের উদীয়মান কেন্দ্রগুলোও একই যুক্তি অনুসরণ করে। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, আফগানিস্তান বা সুদান নিয়ে কাতারের মধ্যস্থতা ছোট দেশটিকে বড় আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিয়েছে। দোহায় মার্কিন-তালেবান আলোচনার উদাহরণ লক্ষ্যণীয়। কয়েক মাস ধরে দোহার বিলাসবহুল হোটেলে চলা বৈঠক কেবল নিরপেক্ষ মঞ্চ ছিল না। কাতার বিশ্বকে দেখিয়েছে, যেখানে অন্যরা ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে তারা ফলাফল দিতে পারবে। ২০২০ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে, দোহার নাম ইতিহাসের পাতায় উঠেছে জেনেভা ও প্যারিসের সঙ্গে সমান মর্যাদায়।
বিশ্ব রাজনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেশের বাইরে তৈরি হয়েছে। কখনো প্রকাশ্য কখনো ঘোষণা না দিয়ে। বাংলাদেশের নেতাদের সাম্প্রতিক নিউইয়র্ক সফরও কি তেমন কোনো ধারার অংশ? বৈঠকগুলো জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ছায়ায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো কি আন্তর্জাতিক মঞ্চে নতুন কোন রাজনৈতিক সমীকরণ গড়ার চেষ্টার সূচনা?
এই সফরে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সফরসঙ্গী হওয়া কি শুধুই প্রতীকী? দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কি এবার ঢাকার নয়, বরং নিঃশব্দে নিউ ইয়র্কের বৈঠকখানায় লেখা হবে? প্রশ্নগুলো সহজ। কিন্তু উত্তর এখনো অজানা।
জাভেদ হুসেন: লেখক ও অনুবাদক
ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে দুটিতে ছবিতে চোখ আটকে গেল। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, মার্কিন প্রেসিডেন্টে ডোনাল্ড ট্রাম্প, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেফ তাইয়্যেপ এরদোয়ান, কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল থানি এবং সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান এক সঙ্গে এক টেবি
৪ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের রাজনীতির রঙ যেন সীমান্তে আটকে থাকে না। কিছুদিন আগেও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে দলটির নেতারা বিদেশে গেলে সেখানে জড়ো হতেন বিএনপিসহ বিরোধীদলের নেতাকর্মীরা। বিক্ষোভ করতেন, প্ল্যাকার্ড দেখিয়ে প্রতিবাদ জানাতেন। এখন একই চিত্রে দেখা যায় আওয়ামী লীগের প্রবাসী শাখাগুলোকেও। সরকারের পালাবদলের স
৮ ঘণ্টা আগেআওয়ামী লীগের রুদ্ধ শাসনামলে দেশের ভেতর কথা বলা যেত না, রাজনীতি করা যেত না বলেই বিদেশে বসে বা বিদেশে গিয়ে অ্যাক্টিভিজম হয়েছে, রাজনীতি হয়েছে, কূটনীতি হয়েছে, এমনকি সাংবাদিকতা হয়েছে। শেখ হাসিনা বিদেশে সফরে গেলে বিশেষত লন্ডন ও নিউইয়র্কে বিএনপিপন্থী প্রবাসীরা প্রতিবাদ জানাতেন।
১ দিন আগেবাংলাদেশে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও ভেঙে পড়েছিল। কোনো কোনো শিক্ষক চেয়েছিলেন এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে প্রশ্ন করা যাবে না। একদম হীরক রাজার দেশের আদর্শ শিক্ষক।
১ দিন আগে