২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে, যার মূলে রয়েছে রাষ্ট্র কাঠামোর আমূল সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা। এই সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন ৮৪ দফা সুপারিশ পেশ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম এবং যুগান্তকারী প্রস্তাব হলো জাতীয় সংসদে একটি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা। যেহেতু এই ধরনের পরিবর্তন সংবিধান সংশোধনের দাবি রাখে, তাই জনগণের সম্মতি আদায়ের জন্য গণভোটের পথে হাঁটছে সরকার। দীর্ঘদিনের এককক্ষীয় ব্যবস্থার পর এই পরিবর্তন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া এবং ক্ষমতার ভারসাম্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
উচ্চকক্ষের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্য ভূমিকা
বাংলাদেশে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করা এবং নির্বাহী বিভাগের একচ্ছত্র আধিপত্য হ্রাস করা। বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, এককক্ষীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সহজেই সংবিধান সংশোধনসহ যেকোনো আইন পাস করতে সক্ষম হয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হয়েছে। দ্বিকক্ষীয় ব্যবস্থা এই প্রবণতা রোধ করতে পারে। নিম্নকক্ষে কোনো বিল পাস হওয়ার পর তা উচ্চকক্ষে পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হবে। উচ্চকক্ষ বিলটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে তার অনুমোদন বা সংশোধনের সুপারিশ করতে পারবে। যদিও অর্থবিল ছাড়া অন্য কোনো বিল উচ্চকক্ষ স্থায়ীভাবে আটকে রাখতে পারবে না, তবে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিলম্বিত করতে পারবে, যা জনমত গঠন এবং আরও সূক্ষ পর্যালোচনার সুযোগ তৈরি করবে।
উচ্চকক্ষে বিভিন্ন পেশার বিশেষজ্ঞ, যেমন—আইনজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সমাজকর্মীদের উপস্থিতি আইনের মান উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আইনকে আরও জনবান্ধব এবং দেশের জন্য কল্যাণকর করে তুলতে পারে। এছাড়া নন-পার্টিজান বা নির্দলীয় সদস্যদের উপস্থিতি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে এবং জাতীয় সংকটে সমঝোতার পথ তৈরি করতে সহায়ক হবে।
উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাবিত পদ্ধতি ও কাঠামো
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ ১০০টি আসন নিয়ে গঠিত হবে। এর সদস্যরা নিম্নকক্ষের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন। অর্থাৎ, নির্বাচনে একটি দল যে পরিমাণ ভোট পাবে, সেই অনুপাতে তারা উচ্চকক্ষের আসন লাভ করবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো দল ২০ শতাংশ ভোট পায়, তবে তারা উচ্চকক্ষের ২০টি আসন লাভ করবে এবং তাদের পূর্বঘোষিত তালিকা থেকে প্রথম ২০ জন সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হবেন। এই ব্যবস্থায় ছোট দলগুলোরও সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারবে।
সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষের জন্য তাদের ১০০ জন প্রার্থীর একটি তালিকা প্রকাশ করতে হবে। এই পদ্ধতিকে ‘পার্টি লিস্ট’ ব্যবস্থা বলা হয়। ফলে ভোটাররা প্রার্থীদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং সততা বিবেচনা করে দলকে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন, যা রাজনৈতিক দলগুলোকে যোগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিতে উৎসাহিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের মনোনয়ন: উচ্চকক্ষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা ব্যক্তিদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। প্রস্তাব অনুযায়ী, ১০০টি আসনের মধ্যে অন্তত ১০টি আসন আইনজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, গবেষক, সমাজকর্মী এবং অন্যান্য পেশার বিশেষজ্ঞদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে, যাদের রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন দেবেন। যুক্তরাজ্য এবং ভারতের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে এই ব্যবস্থা সফলভাবে কার্যকর রয়েছে। ভারতে রাজ্যসভার ১২ জন সদস্যকে রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন দেন, যা আইন প্রণয়নে গভীরতা এবং পেশাদারত্ব যোগ করে। এই নন-পার্টিজান বা নির্দলীয় সদস্যরা রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থে ভূমিকা রাখতে পারবেন এবং দলীয় সংকটের সময় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে পারবেন।
স্থায়ী কক্ষ হিসেবে উচ্চকক্ষের ধারণা
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো উচ্চকক্ষকে একটি স্থায়ী কক্ষে পরিণত করা, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসের মতো কখনোই ভেঙে দেওয়া যাবে না। এর সদস্যরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাচিত বা মনোনীত হবেন এবং একটি অংশ পর্যায়ক্রমে অবসর গ্রহণ করবে। এই ব্যবস্থা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময়েও রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে। যদি রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হলেও, উচ্চকক্ষ ভাঙার ক্ষমতা না থাকে, তবে এটি রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় একটি স্থিতিশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পারবে।
বাস্তবায়ন ও কার্যাবলী
উচ্চকক্ষ কেবল একটি আলংকারিক প্রতিষ্ঠান হবে না, বরং রাষ্ট্র পরিচালনায় এর সুনির্দিষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।
১. বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া: ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, জাতীয় নির্বাচনের পর নিম্নকক্ষ গঠিত হওয়ার পরপরই ভোটের হারের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচন সম্পন্ন হবে। এর জন্য নির্বাচন কমিশনকে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। সফলভাবে গণভোটে উত্তীর্ণ হলে, এই প্রক্রিয়াটি হবে বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে একটি নতুন মাইলফলক।
২. ক্ষমতার ভারসাম্য ও জবাবদিহিতা: উচ্চকক্ষের প্রধান কাজ হবে নিম্নকক্ষ থেকে পাস হওয়া বিলগুলো পর্যালোচনা করা এবং ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা। অর্থবিল ব্যতীত অন্যান্য সব ক্ষেত্রে উভয় কক্ষের ক্ষমতা সমান থাকবে। নিম্নকক্ষে কোনো বিল পাস হওয়ার পর তা উচ্চকক্ষের অনুমোদন লাভের জন্য পাঠানো হবে। উচ্চকক্ষ বিলটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে তা অনুমোদন, সংশোধন বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে। এটি নির্বাহী বিভাগের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে একটি কার্যকর ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স’ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে।
৩. আইনের মানোন্নয়ন: বিশেষজ্ঞ সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির ফলে আইনের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। কারিগরি, আইনগত এবং সামাজিক দিকগুলো বিবেচনা করে আইন প্রণীত হবে, যা একে আরও জনবান্ধব ও টেকসই করে তুলবে।
৪. স্থায়ী কক্ষের ধারণা: একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো উচ্চকক্ষকে একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়া, যা কখনো ভেঙে দেওয়া হবে না। এর সদস্যরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হবেন এবং পর্যায়ক্রমে একটি অংশ অবসর গ্রহণ করবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময় যখন নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়া হতে পারে, তখনো উচ্চকক্ষ রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে এবং সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
চ্যালেঞ্জ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রভাব
উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে একটি মহৎ উদ্যোগ। তবে এর বাস্তবায়নের পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
১. রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন: বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে যে ‘পেশিশক্তি’ বা ‘মূর্খশাসনে’র অভিযোগ রয়েছে, উচ্চকক্ষ তা পরিবর্তনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। পার্টি লিস্ট পদ্ধতির কারণে রাজনৈতিক দলগুলো এখন আর অযোগ্য বা বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিতে পারবে না। শিক্ষিত, সৎ এবং অভিজ্ঞ প্রার্থীদের সামনে আনতে তারা বাধ্য হবে, যা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম দেবে। তবে এই পরিবর্তন রাজনৈতিক দলগুলো কতটা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করবে, তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
২. নতুন নেতৃত্বের আগমন: এই ব্যবস্থার ফলে রাজনীতিতে সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ এবং পেশাজীবীদের অংশগ্রহণ বাড়তে পারে, যারা এতদিন প্রচলিত রাজনীতির ধারা থেকে দূরে ছিলেন। এটি রাজনীতিতে নতুন মেধা ও চিন্তার বিকাশ ঘটাবে। তবে এই ব্যক্তিদের মধ্যে জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ বা ‘পিপলস স্পিরিট’ সবসময় নাও থাকতে পারে, যা একটি প্রায়োগিক চ্যালেঞ্জ।
৩. সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা: উচ্চকক্ষ গঠনের মূল ভিত্তি হবে গণভোট। জনগণকে এর প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বোঝানো এবং একটি জাতীয় ঐক্যমত্য তৈরি করা অপরিহার্য। যেকোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝি বা রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি এই মহৎ উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
বাংলাদেশে সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। এটি কেবল ক্ষমতার ভারসাম্য ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে না, বরং আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশেষজ্ঞ-নির্ভর করে তুলবে। যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে এটি দেশের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে এবং একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এখন দেখার বিষয়, গণভোটের মাধ্যমে জনগণ এই ঐতিহাসিক পরিবর্তনে সায় দেয় কিনা এবং রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় স্বার্থে ক্ষুদ্র মতপার্থক্য ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে কিনা। এর সাফল্যের ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক দিগন্তের ভবিষ্যৎ।
লেখক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও উপ-উপাচার্য, কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ