leadT1ad

নেপালের জেন-জি বিক্ষোভ

ভারত কি তার ‘বাংলাদেশ-ব্যর্থতা’ থেকে শিক্ষা নেবে

বাংলাদেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ভারতের ‘ভুল হিসাব’ যেভাবে বিদ্বেষে রূপ নিয়েছিল, নেপালের জেন-জি বিক্ষোভ সেই স্মৃতি আবার জাগিয়ে তুলছে। প্রশ্ন হলো—ভারত এবার কি বিনয় ও আস্থার পথে হাঁটবে, নাকি আবারও প্রতিক্রিয়ার ফাঁদে পড়বে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক অমিতাভ মাত্তো

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭: ১১
স্ট্রিম গ্রাফিক

নেপাল এখনও উত্তাল। একদিকে তরুণ প্রজন্ম দেশের ভেতরে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে, অন্যদিকে একই সময় হাজার হাজার মানুষ নেপাল ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। রাস্তায় উত্তাল বিক্ষোভ ও নীরব দেশত্যাগ শুধু নেপালের শাসনব্যবস্থারই সংকট নয়, বরং তাদের অস্তিত্বের সংকটও ভারতের জন্য এর প্রভাব প্রত্যক্ষ ও গভীর। নেপালে যা ঘটে, তা নেপালেই সীমাবদ্ধ থাকে না; তা প্রতিধ্বনিত হয় খোলা সীমান্তে, অভিন্ন নদীতে, ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক আত্মীয়তায়। প্রশ্ন হলো, নয়াদিল্লি কি তার চিরাচরিত প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে প্রজ্ঞার সঙ্গে সাড়া দিতে পারবে? ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সহমর্মিতাকে তিক্ততায় রূপান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে পারবে?

নেপাল সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ২৬টি প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করার পর যে জেন-জি বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে দেশটির তরুণ সমাজ। এমন আন্দোলনের কোনো অতীত নজির নেই। ৭৭টি জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়া এ আন্দোলনে অন্তত ৫০ জন প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু এটি কোনো প্রাসাদ ষড়যন্ত্র কিংবা সরকার পরিবর্তনের চক্র নয়। বরং পদ্ধতিগত পরিবর্তনের জন্য, জবাবদিহিমূলক শাসনের জন্য এবং বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থাশীল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে–এমন সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য একটি প্রজন্মের আর্তনাদ।

তরুণ নেপালিদের কাছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ আর এক্স বন্ধ হওয়া কেবল কয়েকটি অ্যাপ নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ছিল না। নেপালের দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্থবির শাসনব্যবস্থা যে জনগণের কথা ভাবে না, তা অনেকদিন ধরেই স্পষ্ট ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো নিষেধের ঘটনা যেন তারই শেষ প্রমাণ হিসেবে সামনে এসেছে। রাস্তার বিক্ষোভ যদি হয় সোচ্চার বিদ্রোহ, তবে অভিবাসন হলো নীরব প্রত্যাখ্যান। নেপাল থেকে প্রতি বছর ৪ লাখের বেশি মানুষের দেশত্যাগ, অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন এক হাজারেরও বেশি মানুষ বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছেন। অথচ এই জনশক্তির হাত ধরেই নেপালের ভবিষ্যৎ নির্মিত হওয়ার কথা ছিল।

যেকোনো রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখে রেমিট্যান্স; এটি রাষ্ট্রের প্রাণভোমরা। অথচ এই রেমিট্যান্সই এক চরম বিপরীত চিত্রও দেখায়। যাঁরা এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পরোক্ষভাবে অর্থায়ন করছে, তাঁরাই সেই রাষ্ট্রে বাস করতে চায় না। আর যারা রাষ্ট্রে বসবাস করে তারা এই রাষ্ট্রব্যবস্থা চায় না। দুটোই একই আস্থাহীনতার ফল।

কিন্তু সংকটের শেকড় আরও গভীরে। নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিজেই অস্থিতিশীলতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির পদত্যাগ কাঠমান্ডুর জোটব্যবস্থার ভঙ্গুরতা ও ফাঁকা বুলি এবং জাতীয়তাবাদী আস্ফালনের ওপর নির্মিত নেতৃত্বের ব্যর্থতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। অলির পদত্যাগ নেপালের অস্থিতিশীলতার অবসান করেনি, বরং উত্তরাধিকার, জোট ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নেপালি কংগ্রেস, নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (একীভূত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) এবং নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির (মাওবাদী) মতো প্রধান দলগুলো কাঠামোগত সংস্কারের পরিবর্তে কৌশলগত লড়াই ও নেতৃত্বের লড়াইয়েই মগ্ন। একদিকে নেপালের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দাহাল প্রচন্ড তাঁর ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে নেপালি কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ও দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা নিজের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজছেন। নেপালের ২০১৫ সালের যে সংবিধান মাইলফলক হিসেবে প্রশংসিত হয়েছিল, তা আজও স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, শাসন আর তদবিরের সীমারেখা মিলেমিশে যাওয়া, দুর্নীতি—সব মিলিয়ে জনগণের আস্থা শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। নেপালের তরুণ প্রজন্মের কাছে এই রাজনৈতিক নাটকের কোনো বৈধতা আর অবশিষ্ট নেই। নেপালের তরুণ প্রজন্ম দেশটির যেদিকেই তাকায়, দেখে এমন এক ব্যবস্থা–যেখানে চাকরি, ন্যায় কিংবা মর্যাদা দেওয়ার বদলে ক্ষমতার খেলায় ব্যস্ত সবাই। এ বিশ্বাসহীনতাই ব্যাখ্যা করে কেন জেন-জিদের বিক্ষোভ ও দেশত্যাগের হার অঞ্চল এবং শ্রেণি নির্বিশেষে ছড়িয়ে পড়েছে।

বিক্ষোভে শহীদ হয়ে, কিংবা বিদেশে পাড়ি জমিয়ে একটা দেশ যেভাবেই তার তরুণদের হারাক না কেন, তা জাতীয় নিরাপত্তার ভিত্তিকেই ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থমকে দাঁড়ায়, রাজনৈতিক বৈধতা কমতে শুরু করে, সামাজিক সংহতি ভেঙে পড়ে। নেপালের জন্য এই জেন-জি বিক্ষোভ ও দেশত্যাগের ঘটনার সমন্বিত পরিস্থিতি আসলেই অস্তিত্বসংকট। অন্যদিকে ভারতের জন্য এটি কৌশলগত সংকট।

নেপালের এই অস্থিরতা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতেও ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। নেপালের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার যেকোনো ধরনের বদলের উত্তাপ ভারতের বিহার, উত্তরপ্রদেশ, সিকিম ও উত্তরাখণ্ডে অনুভূত হবে। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা, আইডিয়া ও ক্ষোভের এই প্রবাহ এতটাই নিবিড় যে তাকে সীমানায় আটকে রাখা সম্ভব নয়। ভারতের তাই আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো অবকাশ নেই।

ইতিহাস ভারতকে এক কঠোর সত্য স্মরণ করিয়ে দেয়। গত বছর বাংলাদেশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান প্রাথমিকভাবে স্থানীয় বিভিন্ন ইস্যুর ক্ষোভ থেকে শুরু হলেও দ্রুত তা ভারতবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। নয়াদিল্লির মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপের ধারণা সহানুভূতিকে শত্রুতায় পরিণত করেছিল। জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয় ‘বিদেশি দাদাগিরি’ বন্ধের বাসনা থেকেই, তা বিদেশিদের ইচ্ছা যতই কল্যাণমুখী হোক না কেন।

নেপালে এই ভুলের পুনরাবৃত্তি করা যাবে না ভারতের। একচোখা কূটনীতি, প্রকাশ্য রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বা শিক্ষক বা বড় ভাইয়ের মতো উপদেশ দেওয়ার প্রবণতা হিতে বিপরীত হবে। সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান রেখে নীরবে কিন্তু দৃঢ়ভাবে আলোচনার পথে যাওয়াই হবে প্রজ্ঞার পরিচয়। নেপাল-ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় কিছু সমস্যা এখনও বিদ্যমান। মানচিত্রসংক্রান্ত দাবি, শক্তি সহযোগিতা ও আন্তসীমান্ত পরিকাঠামো নিয়ে বিতর্কগুলোর বিচক্ষণ সমাধান প্রয়োজন। নয়াদিল্লির চ্যালেঞ্জ হলো—হস্তক্ষেপকারী না হয়ে সম্পৃক্ত হওয়া, তাচ্ছিল্য ছাড়া আশ্বস্ত করা।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক অমিতাভ মাত্তো। ছবি: সংগৃহীত
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক অমিতাভ মাত্তো। ছবি: সংগৃহীত

প্রথমত, ভারতকে অবশ্যই নেপালের তরুণদের কথা বুঝতে হবে। শিক্ষা বিনিময়, সাংস্কৃতিক যোগসূত্র এবং ডিজিটাল উদ্যোগের মাধ্যমে ভারতকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা নেপালের তরুণদের কণ্ঠস্বর শুনছে এবং তাদের গুরুত্ব দিচ্ছে। বৃত্তি ও ইন্টার্নশিপের প্রতীকী মান হয়তো জলবিদ্যুৎ চুক্তির মতোই গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত, শাসনব্যবস্থার সংস্কারকে সূক্ষ্মভাবে সহায়তা করা উচিত। ডিজিটাল অবকাঠামো, সাইবার স্পেস নিয়ন্ত্রণ ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিবৃদ্ধিতে সাহায্য আসা উচিত অংশীদার বা বন্ধু হিসেবে, প্রেসক্রিপশনদাতা বা বড়দাদা হিসেবে নয়।

তৃতীয়ত, যেকোনো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। অলির পদত্যাগ যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছে, তা হয়তো জোটে পূর্ণ হবে। সব দলের সঙ্গে, নাগরিক সমাজের সঙ্গে ও বিশেষত তরুণদের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ খোলা রাখতে হবে। সর্বশেষে, কৌশলগত ধৈর্য প্রদর্শন করতে হবে; বিশ্বাস রাখতে হবে নেপাল নিজেই তার সমস্যার সমাধান করবে। কিন্তু একইসঙ্গে নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী হয়েই তার পাশেও থাকতে হবে।

নেপালের জেন-জি বিক্ষোভ ও তরুণদের দেশত্যাগ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। দুটোই জানাচ্ছে, এই প্রজন্ম স্থবির অবস্থাকে মানতে নারাজ। তারা নেপালে থাকুক বা না থাকুক, তাদের বার্তা সুস্পষ্ট: উত্তরাধিকার সূত্রে নয় বরং যোগ্যতার ভিত্তিতে ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। নেপালের নেতারা যদি তা না বুঝেন, তবে রাষ্ট্রকাঠামো নিজেই ধসে পড়বে।

ভারতের জন্য শিক্ষাও সমানভাবে স্পষ্ট। কূটনৈতিক চালের মাধ্যমে নয়, বরং আস্থা তৈরির মাধ্যমেই দুই দেশের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষিত হয়। নেতাদের মধ্যে আস্থা যেমন জরুরি, তার চেয়েও বেশি জরুরি জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি। নেপাল-ভারত সীমান্ত এতটাই অবারিত যে এখানে সন্দেহের বিষবাষ্প ছড়াতে দেওয়া যাবে না।

নেপাল বর্তমানে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আন্দোলন ও সবচেয়ে বড় দেশত্যাগ একইসঙ্গে চলছে। দুটোই রাষ্ট্রের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। দুটোই দেশের ভবিষ্যৎকে ভেতর থেকে ফাঁপা করে দেওয়ার হুমকি।

ভারত নেপালের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারবে না, কিন্তু কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা বেছে নিতে পারবে। ভারত যদি প্রজ্ঞা, বিনয় ও দূরদৃষ্টিতে কাজ করে, তবে নেপালের রূপান্তর হতে পারে শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও দীর্ঘস্থায়ী। আর যদি ভুল হিসাব করে এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ভুলে যায়, তবে সদিচ্ছাকে শত্রুতায় পরিণত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।

(ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ)

Ad 300x250

সম্পর্কিত