ইটভাটার আগুনের তাপে শুধু ইটই পোড়ে না—পুড়ে যায় শিশুদের শৈশবও। রাজধানীর অদূরে ধামরাই উপজেলায় প্রায় দেড় শতাধিক ইটভাটায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নানা শ্রমে জড়িত অসংখ্য শিশু। শ্রম আইন থাকলেও বাস্তবে তদারকির অভাবে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছে নগণ্য মজুরিতে।
ধামরাইয়ের রোয়াইল ইউনিয়নের খড়ারচর এলাকার এবিসি ব্রিকসে দেখা যায় ১০ বছর বয়সী মহররমের মতো শিশু শ্রমিক। এক মাস আগে কাজে এসেছে, থাকবে আরও পাঁচ মাস। সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত টানা শ্রম দিয়ে ছয় মাস শেষে পাবে ২৬ হাজার টাকা, মাসে চার হাজারের সামান্য বেশি। খুলনার কয়রা উপজেলা থেকে আরও ৩০-৩৫ জন শ্রমিকের সঙ্গে এসেছে সে। থাকতে-খেতে হয় সর্দারের ব্যবস্থা অনুযায়ী। ছবি তুলতে অনীহা জানায় মহররম।
একই ভাটায় ইট সাজানোর কাজ করছিল ১৬ বছর বয়সী বাদশা। ছয় মাসে তার চুক্তি ৫০ হাজার টাকা। পরিবারে অভাব, তাই স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও এসেছে ইটভাটায় কাজ করতে। বাদশা বলে, ‘স্কুলেই তো যেতে চাই। কিন্তু কীভাবে পড়বো, তাই কাজ করছি।’
শুধু একটি নয়, উপজেলাজুড়ে একাধিক ইটভাটায় দেখা যায় শিশু শ্রমের উপস্থিতি। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত মাটি-বালু বহন, ইট তৈরি ও সাজানোর মতো ভারি কাজে শিশুরা যুক্ত হলেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেই তেমন কোনো নজরদারি।
বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী ১৪ বছরের কমবয়সীদের কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করানো নিষিদ্ধ। তবে ভাটাগুলোতে এমন আইন বাস্তবায়নের কোনো চিহ্ন নেই। শিশু শ্রমিকদের প্রায় পূর্ণ বয়স্ক শ্রমিকের মতোই নিয়মিত কাজ করতে দেখা যায়।
ইটভাটায় কাজে ব্যস্ত এক কিশোর। স্ট্রিম ছবিধামরাই উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির তথ্যানুযায়ী, উপজেলায় রয়েছে প্রায় ১৮২টি ভাটা, যার মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেয়েছে প্রায় ১২০টি। প্রতিটি ভাটায় ২৫০-৩০০ শ্রমিক কাজ করেন। তবে কত শিশু শ্রম করছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই মালিক সংগঠনের কাছেও।
তবে মাটির ভাটাগুলোতে শিশু শ্রমের বাস্তবতা স্পষ্ট। সমিতির আহ্বায়ক মো. জালাল উদ্দীন বলেন, ‘শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগের সুযোগ নেই। আমার জানা মতে নেইও। অনেকে পরিবার নিয়ে আসেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে শিশুরা কাজ করতে পারে। তবে মালিক জানলে তারা শিশুকে কাজে দেবেন না।’
শিশু শ্রমে ঝুঁকি
মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ২০২৫ সালের গবেষণা, ‘হেলথ হ্যাজার্ড অব চাইল্ড লেবার ইন ব্রিক কিলন সেকটর’ এ বলা হয়, ইটভাটায় কর্মরত শিশুদের দৈনিক কাজের সময় ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা। ধুলো-ধোঁয়া, তীব্র গরম, কয়লার ধূলিকণা ও কাঁচামাল বহনের মতো লম্বা সময়ের ঝুঁকি গুরুতরভাবে তাদের শরীর ও মনকে প্রভাবিত করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এসব শিশুদের মধ্যে হাঁপানি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ত্বকের রোগ, হাড় ও পেশি ব্যথা, এমনকি টিউবারকিউলোসিসের লক্ষণও পাওয়া যায়। কম বয়সে ভারী কাজের কারণে অনেক শিশু পুষ্টিহীনতা, মেরুদণ্ড বক্রতা ও পেশির অবক্ষয়ে ভোগে। তাদের বেশির ভাগই স্কুল থেকে ঝরে পড়ে বা অনিয়মিত শিক্ষায় থাকে।
২০১৪ সালে আইএলও ও ইউনিসেফের যৌথ প্রতিবেদন ‘এ হেলথ অ্যাপ্রোচ টু চাইল্ড লেবার’ এ বলা হয়, বাংলাদেশে আনুমানিক ১ লাখ ১০ হাজার শিশু ইটভাটায় কাজ করে, যা শিশু শ্রমের অন্যতম বৃহৎ অনানুষ্ঠানিক খাত। প্রতিবেদন বলছে, দলবদ্ধভাবে ভাটায় কাজ করতে আসা শ্রমিক পরিবারের শিশুদের অনেকেই দীর্ঘ সময় উচ্চ তাপমাত্রা, ধুলো ও ধোঁয়াযুক্ত পরিবেশে শ্রম দিতে বাধ্য হয়, যা শারীরিক বিকাশ ব্যাহত করে এবং দীর্ঘমেয়াদে কর্মজীবন ও সামাজিক নিরাপত্তাকে দুর্বল করে।
বিশেষজ্ঞদের যা বলছেন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদা আখতার বলেন, ‘পরিবারের অভাব ও অসচেতনতা শিশুদের কাজে ঠেলে দিচ্ছে। পুরুষ শ্রমিককে যেখানে দিতে হয় ৬০০-৭০০ টাকা, নারীদের ৩০০-৪০০, সেখানে শিশুকে ১০০-১৫০ টাকা দিলেই একই কাজ করানো যায়। রোধ করতে হলে মালিকদের ভূমিকা এবং সরকারি পুনর্বাসনের উদ্যোগ জরুরি, না হলে আগামী প্রজন্ম কাঠামোগতভাবে পিছিয়ে পড়বে।’
ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডা. আহমেদুল হক তিতাস বলেন, ‘শিশু শ্রম নিষিদ্ধ, তবু ইটভাটায় কাজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ধোঁয়া ও দূষণে শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া থেকে ক্যান্সারের ঝুঁকি পর্যন্ত আছে। শীত এলেই এমন রোগী নিয়মিত পাওয়া যায়। সচেতনতা ও পরিবেশ উন্নয়ন দুটোই জরুরি।’
ঢাকা জেলা শিশু শ্রম মনিটরিং ও সমন্বয় কমিটির সভাপতি এবং জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘শিশু শ্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সাভারে ইটভাটাই আইনত চালানোর সুযোগ নেই। ধামরাইয়ে নতুন করে নবায়ন পাওয়া ভাটাগুলো চলছে, বাকিগুলো বন্ধ হবে। কোথায় শিশু শ্রম আছে, কতজন আছে; তা যাচাই করে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’