সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরে আসাকে ‘পুরো জাতির প্রত্যাশার প্রতিফলন’ উল্লেখ করে বিএনপিপন্থী জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলেছেন, আজকের দিনটি তাঁদের কাছে ঈদের মতো আনন্দের। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে এলেও আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হবে মূলত পরবর্তী অর্থাৎ চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে।
আজ বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ের পরপরই আদালত চত্বরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল ও ড. শরীফ ভূঁইয়া সাংবাদিকদের কাছে রায়ের আইনি ব্যাখ্যা ও নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
রায়ের পর সন্তোষ প্রকাশ করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রায়টি হলো প্রস্পেক্টিভ (ভবিষ্যৎ কার্যকারিতা সম্পন্ন)। আমরা আদালতে যে আইনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম, তা গ্রহণ করা হয়েছে। আদালত বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সংবিধানের ৫৮ (১) এবং ৫৮ (২) অনুচ্ছেদ আবার পুনর্বহাল হলো। এর অর্থ হলো তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আবার ফিরে এল।’
বিএনপি এই রায়ে খুশি কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই। আমরা মনে করি, এটা শুধু খুশি না, আজ ঈদের দিন মনে হচ্ছে আমাদের। কারণ, এই রায়ে শুধু বিএনপিই খুশি না, সারা জাতি খুশি।’
শুনানির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ আদালত আট থেকে দশ দিন এই মামলাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনেছেন। এমনকি নেপালের প্রধান বিচারপতিও এসে বক্তব্য শুনে গিয়েছেন। কাজেই আমরা মনে করি, এই জাজমেন্টটি (রায়) এই দেশের জন্য একটা মাইলফলক। আজ যে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে, তা শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার ফলেই সম্ভব হয়েছে।’
পরবর্তী নির্বাচন যেভাবে
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরলেও আসন্ন নির্বাচন কেন এর অধীনে হচ্ছে না, তা স্পষ্ট করেছেন বিএনপির আরেক আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল। তিনি বলেন, ‘আদালত বলেছেন, এর কার্যকারিতা প্রস্পেক্টিভলি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে ঘোষণা দিয়েছে এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এগোচ্ছে, তা বহাল থাকবে। আজকের রায়ের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আজ থেকেই সংবিধানে ফিরে এলেও আসন্ন নির্বাচনটি তার অধীনে হবে না। নির্বাচনটি হবে পরবর্তী সময় থেকে।’
রায়ের বিস্তারিত প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া রায়ের কঠোর সমালোচনা করেন। ওই রায়কে ‘বাজে ও ভুলে পরিপূর্ণ’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে দেওয়া ওই রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে গত ১৫ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল। ওই রায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও ধ্বংস করা হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজকের রায়ে আপিল বিভাগ স্পষ্টভাবে বলেছেন, ১৪ বছর আগের ওই রায় ত্রুটিপূর্ণ ছিল এবং তা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হলো। সুপ্রিম কোর্ট নিজের ভুল সংশোধন করার সুযোগ পেয়েছে এবং যথাযথভাবে তা করেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন।’
সংবিধানের ৫৮(গ) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়ে ড. শরীফ ভূঁইয়া বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হতে হবে। যেহেতু আমাদের সংসদ এক বছরের বেশি সময় আগে ভেঙে দেওয়া হয়েছে, তাই এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সুযোগ নেই। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন করবে, এরপর সংসদ গঠিত হবে। সেই সংসদের মেয়াদ যখন শেষ হবে, তখনই কেবল ত্রয়োদশ সংশোধনীর আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রশ্ন আসবে।’
জুলাই সনদের প্রস্তাবনার সঙ্গে আদালতের এই রায় সাংঘর্ষিক হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে শরীফ ভূঁইয়া বলেন, ‘আদালত শুধু ভুলভাবে বাতিল করা আইনটিকে পুনর্বহাল করেছেন। আইন প্রণয়ন বা পরিবর্তন সংসদের এখতিয়ার। সংসদ চাইলে জুলাই সনদের আলোকে ব্যবস্থাটিতে পরিবর্তন আনতে পারবে। আমরা সংস্কারের দুটি পথই (আদালত ও সংসদ) সচল রাখছি, যাতে সবচেয়ে ভালো জায়গায় পৌঁছানো যায়।’
প্রতিক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে তিনি মামলার অন্যতম আবেদনকারী প্রয়াত তোফায়েল আহমদকে স্মরণ করেন এবং দেশের স্বার্থে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করা আইনজীবীদের প্যানেলকে ধন্যবাদ জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই রায়ের মাধ্যমে দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম হবে।