leadT1ad

জাকসু নির্বাচনকালে শিক্ষকের প্রয়াণ

‘কিছু শিক্ষক থাকে না? যাকে মন খুলে সব বলা যায়…’ জান্নাতুল ফেরদৌস সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা

স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো কলাভবনের সামনে শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসের মরদেহ আনা হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিক্ষার্থীরা। স্ট্রিম ছবি

শুক্রবার দুপুর ১টা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো কলা ভবনের সামনে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীদের মুখে তখন শোকের ছাপ। তাঁদের শিক্ষক, তাঁদের প্রিয় জান্নাতুল ফেরদৌস আর নেই। তাঁর মরদেহ আনা হয়েছে এখানে। শিক্ষার্থীদের তখন চোখে অশ্রু আর গলা হয়ে এসেছে ভারী ।

‘শিক্ষার্থীবান্ধব কিছু শিক্ষক থাকে না? যাকে মন খুলে সব কিছু বলা যায়। আমি তো তাঁর প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলাম। তিনি ক্লাসে ছিলেন শিক্ষক, ক্লাসের বাইরে বোন, অভিভাবক। তাঁর মৃত্যু অপূরণীয়, এটা শুধু বলার জন্য বলা না। এটা মন থেকে আসা কথা,’ ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ঐশী সরকারের কণ্ঠ তখনো আবেগে ভারী।

আজ শুক্রবার সকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকালে অসুস্থ হয়ে মারা যান জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের একজন প্রভাষক এবং জাকসু ও প্রীতিলতা হল সংসদ নির্বাচনে পোলিং কর্মকর্তার দায়িত্বে।

সকাল সাড়ে ৮টার দিকে নির্বাচন কমিশন ভবনের তৃতীয় তলায় ওঠার পরই করিডোরে সহকর্মীদের সামনে হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়েন জান্নাতুল ফেরদৌস। দ্রুত তাঁকে স্ট্রেচারে করে নিচে নামিয়ে আনা হয়। প্রায় ১০ মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সে করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু শেষ রক্ষা করা যায়নি। হাসপাতালে পৌঁছানোর পরপরই চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শাওন হোসেন জানান, ‘সকাল ৯টায় জান্নাতুল ফেরদৌসকে হাসপাতালে আনা হয় এবং সকাল ৯টা ৪ মিনিটে ইমার্জেন্সি বিভাগে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।’

জান্নাতুল ফেরদৗস। ছবি: সংগৃহীত
জান্নাতুল ফেরদৗস। ছবি: সংগৃহীত

চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে, অচেতন হওয়ার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছিল এই শিক্ষকের।

জান্নাতুল ফেরদৌস যে শুধু একজন শিক্ষক ছিলেন না, তাঁর চেয়েও বেশি কিছু ছিলেন, তা শিক্ষার্থীদের কথায় স্পষ্ট। চারুকলা বিভাগের ৪৯ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী অর্ণব আদিত্য বলেন, ‘আমার পরীক্ষার একদম শেষ সময়ে আমি ঠিকমতো কোনো কিছুতে অংশ নিচ্ছিলাম না। তিনি বিষয়টা খেয়াল করে আমাকে ডাকলেন। আমার কথা শুনলেন। উৎসাহ দিলেন, নানাভাবে বোঝালেন, এরপর যা করা দরকার—গাইড করে করে আমাকে দিয়ে করালেন। শুধু আমি না, অভিভাবকের মতো সব শিক্ষার্থীর খেয়াল রাখতেন তিনি। তাঁর এইভাবে চলে যাওয়া আমরা মানতে পারছি না। এটা হয় না আসলে।’

শিক্ষার্থীরা জানান, জান্নাতুল ফেরদৌস ছিলেন চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী কল্যাণ উপদেষ্টা। তিনি মন দিয়ে শিক্ষার্থীদের সব সমস্যার কথা শুনতেন এবং সমাধানের চেষ্টা করতেন। কারও আর্থিক টানাপোড়েন চললে, তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।

চারুকলা বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের (বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী উজ্জ্বল হোসেন রাজা, যিনি পড়াশোনা শেষে একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করছেন, তিনিও এসেছিলেন পুরোনো কলা ভবনের সামনে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচে ছিলাম, উনি প্রথম ব্যাচের। সম্পর্কটা ছিলো ভাইবোনের মতো। উনি বিভাগের শিক্ষক হবার পর থেকে বিভিন্ন সময় আমাকে ফোন করে শিক্ষার্থীদের টিউশন ম্যানেজ করে দিতে বলতেন। অন্তত ২০টা টিউশন আমি ম্যানেজ করে দিয়েছি।’

শুধু কী শিক্ষার্থী—শিক্ষকেরাও তাঁর এ অকালপ্রয়াণ মেনে নিতে পারছেন না। তাঁর মৃত্যুর খবর শোনার পর নির্বাচনী দায়িত্বরত অনেক শিক্ষকই কান্নায় ভেঙে পড়েন।

এ সময় নির্বাচন কমিশনার রেজওয়ানা করিম সবাইকে জান্নাতুল ফেরদৌসের জন্য দোয়া করতে অনুরোধ করেন।

‘ও তো আমার মেয়ের মতো ছিল। ওর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল আমার’, বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদ। জান্নাতুল ফেরদৌসের এভাবে চলে যাওয়া মানতে পারছেন না তিনিও। পারিবারিক কারণে জান্নাতুলের কিছুটা হতাশার জায়গা ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘হতাশা নিয়ে ও এইভাবে চলে যাবে, এটা মানতে পারছি না।’

একজন শিক্ষক, একজন অভিভাবক, একজন বন্ধু—জান্নাতুল ফেরদৌস নামের এই মানুষটির হঠাৎ চলে যাওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার মনে এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করেছে। তাঁর স্মৃতি শিক্ষার্থীদের মনে অম্লান হয়ে থাকবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত